খানের আখ্যান

স্বাধীনতার হুইসেলব্লোয়ার

মারুফ কামাল খান
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৫, ১২: ২০

সপ্তাহে এক দিন কলাম লিখি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায়। অতি ঘটনাবহুল সময়ে হররোজ কত ঘটনা, রটনা, প্রসঙ্গ ও ইস্যু এসে যায়। তার কটা নিয়েই বা লেখা যায়! এর মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। সে ভাষণ পর্যালোচনার সময় সুযোগ হয়নি। তবে গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনার আক্রমণাত্মক, আত্মপ্রচারমূলক ও অসত্য তথ্যসংবলিত ভাষণ শুনে ক্লিষ্ট এবং পীড়িত দেশবাসীর বেশিরভাগই একজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষকের অতি শিষ্ট ভাষণে স্বস্তি বোধ করেন। ড. ইউনূস ইতোমধ্যে চীন দেশে বহুল আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ সফরে গেছেন। তার এ সফর সফল হোক। আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রভাবশালী সমরনায়ক সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এ সফরের গুরুত্ব অনেক এবং এর পরবর্তী ঘটনাক্রমের দিকে সতর্ক নজর রাখার প্রয়োজন আছে। এবারের পবিত্র রমজান ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ রমজানের ইবাদত-বন্দেগি যেন আমাদের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের উসিলা হয়, মহামহিম আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে সেই মোনাজাত করি। সামনে ঈদুল ফিতর। এ উপলক্ষে প্রতিটি উম্মতে মোহাম্মদি (সা.)-কে ঈদ মোবারাক।

২৬ মার্চ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিবস। আমরা এমন এক জাতি যে, এই স্বাধীনতার ইতিহাসকে আমরা অবিকল থাকতে দিইনি। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে সেই ইতিহাসও বিকৃত করেছে একটি রাজনৈতিক মহল। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, দীর্ঘকাল ধরে এ দেশে একতরফাভাবে প্রচারিত হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাসের আওয়ামী ভাষ্য। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বিএনপি চরম ইতিহাসবিমুখ। তাদের কোনো কার্যকর সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও তৎপরতা নেই। নেই শক্তিশালী ও উপযুক্ত প্রচার বিভাগ এবং মিডিয়া। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা, প্রকাশনা, এমনকি দলীয় লিটারেচারের ক্ষেত্রেও তারা অতি হতদরিদ্র। কাজেই সাধারণ জনগণ এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীরা পর্যন্ত পরের মুখে ঝোল খেতে বাধ্য হন। এসব কারণে ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার বাইরে যেখানেই আ.লীগ অবস্থান করুক, সমাজে তাদের একটা কালচারাল ডোমিনেশন থেকেই যায়। তাই আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস আওয়ামী ইতিহাসেরই একটা অংশ হয়ে আছে। অথচ প্রকৃত ইতিহাসে আওয়ামী লীগের রয়েছে ব্যর্থতার অনেক ক্ষতচিহ্ন। আর বিএনপির স্থপতি জিয়াউর রহমানের ভূমিকা অনেক বেশি উজ্জ্বল।

বিজ্ঞাপন

উনিশ শ একাত্তর সালের শুরুতে জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ‘সামান্য মেজর’। তবে এই সামান্য মেজরটিই একটি অসামান্য কাজ করেছিলেন। তখন যারা অসামান্য লোক ছিলেন, তারা একটা সামান্য কাজও করতে পারেননি। জিয়া ছাড়াও আরো কয়েকজন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানি মেজর তখন পাকবাহিনীর আক্রমণ রুখতে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তবে জিয়া শুধু বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের লড়াই-ই শুরু করেননি। তিনি ইতিহাসে পৃথক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন আরেকটি অসামান্য ভূমিকা পালনের মাধ্যমে।

তার ভূমিকাকে ক্ষুণ্ণ করতে বলা হয়, একজন মেজরের হুইসেলের মাধ্যমে স্বাধীনতা আসেনি। কথা সত্য। শুধু একজনের ভূমিকায় একটা দেশের ও জাতির স্বাধীনতা আসে না। এক দীর্ঘ সংগ্রামী প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং অবশেষে রক্তক্ষয়ী এক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অর্জন হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। কোটি কোটি মানুষের অপরিমেয় ত্যাগ এবং অগণিত মানুষের প্রাণদান ও অবদান রয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পেছনে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। কাউকে হেয়, তুচ্ছ ও খাটো করার সুযোগ নেই। জিয়ার ভূমিকাকেও হেয় করতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই বিকৃত ও খর্ব হয়ে যায়।

জিয়া আসলে ছিলেন আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের তূর্যবাদক বা হুইসেলব্লোয়ার। এই হুইসেল বাজানোকে অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করা হয়। স্বাধীনতার পর নিরাপদ সময়ে প্রচারণার ধূম্রজালে সেই অসামান্য ভূমিকাকে তাচ্ছিল্য করা খুব সস্তা কিন্তু সেই ঘোর অমানিশার অন্ধকারে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে জিয়া যা করেছিলেন, তা ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে।

১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে পাকিস্তানি সেনারা নিধনযজ্ঞ শুরু করলে চট্টগ্রামে কর্মরত ‘সামান্য মেজর’ জিয়া ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তানি শাসন কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। সামরিক কৌশলে প্রতিপক্ষকে বন্দি করেন। নিজের ইউনিটের অনুগত বাংলাভাষী সৈনিকদের উদ্দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়ে তাদের শপথ করান। প্রতিরোধ যুদ্ধ আরো অনেক জায়গায় হয়েছে কিন্তু জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা দেন। এরপর তিনি কালুরঘাট বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে তার স্বাধীনতার ঘোষণা ইথারে ছড়িয়ে দেন সবখানে। স্বাধীনতা যখন সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জনের বিষয়, তখন নিরস্ত্র কারো ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়। রণাঙ্গনের একজন সামান্য মেজরের ঘোষণাই তখন অসামান্য হয়ে ওঠে। চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে আক্রান্ত মানুষ একজন যোদ্ধার ঘোষণাতেই তখন ভরসা পায়। জিয়া জাতিকে সেই বরাভয়ই শুনিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি পাকিস্তানি শাসন কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে তার ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধে উন্নীত করেছিলেন।

জিয়া বেতারে একবার একটা ঘোষণা দিয়েই সটকে পড়েননি। তিনি কয়েক দিন ধরে বারবার ঘোষণা দিয়েছেন। একই ঘোষণা নয়। ছোট-বড় অনেকগুলো ঘোষণা। তার কণ্ঠে উচ্চারিত স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাটি ছিল সংক্ষিপ্ত। তিনি নিজেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধান সামরিক অধিনায়ক হিসেবে উল্লেখ করে সে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটা না করলে মুক্তিযুদ্ধ বৈধতা পেত না। কেননা এই ভূখণ্ডে তখন পাকিস্তান সরকারের বৈধ কর্তৃত্ব ছিল। সেই কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে একটি পাল্টা শাসন-কাঠামো দাঁড় না করালে স্বাধীনতাযুদ্ধ বৈধতা অর্জন করে না। জিয়া সে কাজটিই করেছিলেন। ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ বলে নিজের নামেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা তিনি মোচন করেছিলেন সেই দুঃসাহসী ও ঐতিহাসিক সঠিক ভূমিকার মাধ্যমে।

অতুলনীয় দেশপ্রেমের কোনো ঘাটতি এবং ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে কোনো সংকীর্ণতা জিয়ার মধ্যে ছিল না। কেননা চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ মেনে তিনি তার ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করেননি। কেননা, পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি শেখ মুজিব তখন ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা। তার নামে ঘোষণা হলে সেটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ থাকে না। তাই জিয়া তার দ্বিতীয় ঘোষণায় উল্লেখ করেন, ‘অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার শেখ মুজিবুর রহমান’, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠন করেছেন। ইংরেজিতে দেওয়া ঘোষণাগুলোয় জিয়া বারবার বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা ও স্বীকৃতি চেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও নীতিমালার কথাও ঘোষণা করেন। জিয়া ছাড়া তখন বাংলাদেশের কোনো ঘোষিত সরকার ছিল না এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের কোনো ঘোষিত অধিনায়কত্বও ছিল না।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তদানীন্তন বৃহত্তর সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বাংলাদেশের সামরিক অধিনায়কদের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিফৌজ গঠন, সেক্টর বিভাজন, অধিনায়কদের দায়িত্ব অর্পণ এবং এম এ জি ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক করা হয়। এর মাধ্যমে অস্থায়ী প্রধান সামরিক অধিনায়ক হিসেবে জিয়ার আপৎকালীন ভূমিকার অবসান ঘটে। তাকে প্রথমে সেক্টর কমান্ডার ও পরে ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিফৌজ গঠনকালেই বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারই আলোকে ১০ এপ্রিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মুজিবনগর সরকার নামে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে সেই সরকারের শপথগ্রহণ ও অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান রূপে জিয়ার সাময়িক দায়িত্বেরও অবসান ঘটে।

স্বাধীনতার হুইসেলব্লোয়ার হওয়ার দায়িত্ব সহজ নয়। কোনো গোপন চিরকুট দিয়ে বা এর-ওর মারফত সেটা করা যায় না। জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে সদর্পে সদম্ভে স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ করা, পাকিস্তানি শাসন কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নিজেকে পাল্টা শাসন ও সামরিক কর্তৃত্বের প্রধান ঘোষণা করা এক ঐতিহাসিক অসামান্য কাজ। এক সামান্য মেজর সেই অসামান্য কাজটি করেই ইতিহাসে অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছেন।

অনেক জাতির রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীনতাযুদ্ধ ও গেরিলাযুদ্ধে রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ কিছুটা আলাদা। এক হাজার মাইল দূরবর্তী দুটি ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্রের প্রকৃতিও আলাদা ছিল। প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ছাত্র-তরুণ ও সাংস্কৃতিক বলয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মান্যতা পেলে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু না হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হতেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার সেই বৈধ অধিকার লাভের চেষ্টাই করে যাচ্ছিলেন। এটাই ছিল ন্যায়সংগত।

তবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আলোচনার ছলে সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রাতের অন্ধকারে কাপুরুষোচিত মরণযজ্ঞ শুরু করে। এতে রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব বন্দিত্ববরণ করেন। অন্য নেতারা পালিয়ে যান। সে সময়ের কঠিন বাস্তবতা অনুধাবন করলেই বোঝা যায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কতটা ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

অন্ততপক্ষে দুই যুগ ধরে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন ও প্রচারণা মোটামুটি সবাই জানে। একটা মানুষ অনেক আগে নিহত হয়েছেন কিন্তু তার সম্পর্কে একটি ইতিবাচক বাক্যও তারা উচ্চারণ করেননি। শ্রদ্ধা জানানো দূরের কথা, এমন কোনো কুৎসা নেই, যা তারা রটনা করতে বাদ রেখেছেন। তার শাসনামলের সমালোচনা শুধু নয়, স্বাধীনতা ঘোষণার কথাটাও স্বীকার করেননি। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বীরউত্তম খেতাব অর্জনকারী একজন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান। যুদ্ধ চলাকালেই গঠিত ব্রিগেড আকৃতির জেড ফোর্স-এর অধিনায়ক হিসেবে উন্নীত হন তিনি। অথচ সেই জিয়াউর রহমান আসলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি না আওয়ামী লীগের নাবালক নেতাকর্মীরা পর্যন্ত বিলিয়ে বেড়িয়েছেন সেই সন্দেহের সার্টিফিকেট।

‘জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানি চর, মন থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেননি, স্বাধীনতার চেতনার তিনি বারোটা বাজিয়েছেন, সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাসের জন্য যাওয়ার পথে পাবলিক জিয়াকে ধরে এনে তাকে দিয়ে রেডিওতে স্বাধীনতার কথা বলিয়ে নেয়’Ñ এসব আওয়ামী বয়ান শুনতে শুনতে আমাদের কান পচে গেছে। অথচ জিয়া যখন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেননি, ক্ষমতায় আসেননি, দল করেননি, তখন আওয়ামী লীগ কি এসব কথা বলেছে?

যে আওয়ামী লীগ কখনো পারতপক্ষে অন্য কারো কৃতিত্ব স্বীকার করে না, সেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম বেতার ভাষণে বলেছিলেন : ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমানবাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাইবোনরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্টালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবলমুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলাকে মুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই জিয়াউর রহমানের বীরত্ব, সাফল্য ও কৃতিত্বের ব্যাপারে যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে মুক্তকণ্ঠে উচ্চারিত এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অমোচনীয় রেকর্ড। সেই একই ভাষণে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। তিনি বলেন : ‘এই প্রাথমিক বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।’

কালুরঘাটের বেতার তরঙ্গ মারফত জিয়াউর রহমানের স্বকণ্ঠে দেওয়া ঘোষণাকে সে সময়েই প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলছেন : ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর’। এর অর্থ খুব পরিষ্কার। এ ঘোষণার আগে আর কোনো কণ্ঠ থেকেই উচ্চারিত হয়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা, এটাই প্রথম। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে সারা দুনিয়ার সামনে দেওয়া বেতার ভাষণে তিনি কি নিশ্চিত না হয়ে এই কথা এত স্পষ্ট করে বলেছিলেন? শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিবাহিনীর সাময়িক প্রধান হিসেবে উল্লেখ করে সরকার গঠনের যে ঘোষণা দেন, তাজউদ্দীন সে ঘোষণাও তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে অনুমোদন করেন। তার সে অনুমোদন স্পষ্ট হয় : ‘এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়’ এই বাক্যটির মাধ্যমে। আর এতেই স্বাধীনতার ঘোষণাকাল থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ধারাবাহিকতা পায়।

মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দলীয় স্বীকৃতির আরেকটি রেকর্ড ইতিহাসে রয়ে গেছে। তখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। অপ্রতিরোধ্য মর্যাদায় ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত শেখ মুজিবুর রহমান তার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসে সদ্যস্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শাসনভার হাতে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সরকারের নেতা তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে অর্থমন্ত্রী হয়ে এককোনায় সরতে হয়েছে। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও শেখ সাহেব মুক্তিযুদ্ধে নিজের অনুপস্থিতির কারণে যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর ছিলেন। ওনার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ব্যক্তি তাজউদ্দীনকে এবং আরো অনেক কিছুকেই তিনি খুব সহজ করে নিতে পারতেন না। তাকে খুশি রাখতে তখন ওইসব প্রসঙ্গে সবাইকেই খুব মেপে কথা বলতে হয়।

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালের ৭-৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয় শেখ সাহেবের সভাপতিত্বে। সেই কাউন্সিলে সবার সম্মতিতে পাস হওয়া সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে আছে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কয়েকটি কথা। তাতে বলা হয়েছে : ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শক্রমে চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামেরত মেজর জিয়াউর রহমান বেতার মারফত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন এবং বাংলাদেশে গণহত্যা রোধ করতে সারা পৃথিবীর সাহায্য কামনা করেন।’

স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতা ঘোষণার মোটামুটি একক কৃতিত্ব দেওয়া হলেও স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ বিষয়টাকে একটু মডিফাই করে। এটাকে একেবারে মিথ্যাও বলা যাবে না। নিজের নামে স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা কয়েকবার দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের অনুরোধে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা হিসেবে শেখ সাহেবের নাম তাতে যুক্ত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। কেননা জাতির ঘোর সংকটকালে তার নিজের কৃতিত্ব নেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, তার লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। শেখ সাহেব তখন এ অঞ্চলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা। ঘোষণাটি তার পক্ষ থেকে দেওয়া হলে এর গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়ে। এই যুক্তি ও পরামর্শ শোনার পর তিনি সেটা করতে মোটেও দ্বিধা বা বিলম্ব করেননি।

যাই হোক, শেখ সাহেব নিজে এবং তাজউদ্দীনসহ প্রবাসী সরকারের সব নেতার সম্মতিতে পাস হওয়া রিপোর্টে মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের এটাই একমাত্র অফিশিয়াল পজিশন এবং এটা ইতিহাসের রেকর্ড। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ওয়্যারলেস, টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার বা এর-ওর মারফত বার্তা পাঠানোর যেসব গল্প চালু করেছে, সেগুলোর কোনোটি কিংবা অন্য কোনোভাবে অন্য কারো স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো ভাষ্য আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের ওই রিপোর্টে নেই। ওই ঘোষণায় জিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা রোধে সারা পৃথিবীর সাহায্য চেয়েছেন বলেও স্বীকার করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের স্বকণ্ঠে প্রচারিত ঘোষণাটিকেই আওয়ামী লীগ তাদের ভাষায় ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা’ বলে উল্লেখ করে এবং রিপোর্টের পরবর্তী বাক্যেই বলা হয় : ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানতে পেরে বাংলার মানুষ এক দুর্জয় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলল। সারা বাংলাদেশে সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক কর্মীরা অপূর্ব দক্ষতা, অপরিসীম সাহসিকতা ও অতুলনীয় ত্যাগের মনোভাব নিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে অগ্রসর হন।’ আওয়ামী লীগের সেই ঐতিহাসিক দলিলই বুঝিয়ে দিচ্ছে, আগে কিংবা পরে নয়, অন্য কোনো ভাবেও নয়, জিয়ার কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণা। মুজিবের নামাঙ্কিত জিয়ার সেই ঘোষণাই স্বাধীনতার তূর্যধ্বনি। এই ডাকের ফলেই স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত