অগ্নিকাণ্ড : নিরাপত্তাহীন নগরজীবন

নুসরাত জাহান স্মরনীকা
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১১: ৩৩
আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ১০
আগুন। প্রতীকী ছবি

আগুন একদিকে জীবনের আলোকশিখা, অন্যদিকে মৃত্যুর ছায়া। যে আগুন রান্নাঘরে আমাদের আহার জোগায়, সেই আগুনই অসচেতনতার সুযোগ পেলে মুহূর্তেই ধ্বংসের রূপ ধারণ করে। আগুন নিভে গেলে ছাই পড়ে থাকে, কিন্তু সেই ছাইয়ের ভেতর হারিয়ে যায় কত স্বপ্ন, কত শ্রম, কত জীবন তার হিসাব থাকে না কারো কাছে। অসচেতনতার কারণে লেগে যাওয়া আগুন যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। নতুন একটা দিন, নতুন একটা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। নগরজীবন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে প্রতিনিয়ত।

বিজ্ঞাপন

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যেন নিত্যদিনের ব্যাপার। গত ৬ অক্টোবর সকালে রাজধানীর সদরঘাট পাইকারি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সকাল ৮টার দিকে হঠাৎ আগুন লাগে মার্কেটে। দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আগুন, মুহূর্তের মধ্যে জ্বলতে শুরু করে দোকানগুলোর পণ্যসামগ্রী। ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বহু দোকান ও পণ্য। ব্যবসায়ীরা চোখের সামনে তাদের বছরের পর বছর পরিশ্রমের ফল ধ্বংস হতে দেখেছে অসহায়ের মতো।

এদিকে, দুপুরের কিছু আগে আশুলিয়ার জামগড়ায় একটি পোশাক কারখানায় আগুন লাগে। শ্রমিকরা তখন কাজ করছিলেন, ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তে। দ্রুত সবাই ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও কয়েকজন ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্থানীয়রা ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও কারখানার একটি বড় অংশ সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন লাগার এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে আমাদের আশপাশে, তবু নেই কোনো সচেতনতামূলক পদক্ষেপ।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ২৫ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। বাণিজ্যিক ভবন, কারখানা, বাজার ও আবাসিক এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যায়, প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না, বৈদ্যুতিক তারের অযত্নে থাকা বা অবৈধ সংযোগ ছিল অন্যতম কারণ আর বিল্ডিংয়ে পর্যাপ্ত জরুরি নির্গমন পথ ছিল না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নিটল টেক্স, তাজরীন ফ্যাশন, চুরিচরিত রানা প্লাজা কিংবা চট্টগ্রামের বস্তি এলাকায় আগুনের ঘটনাগুলো বারবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, নিরাপত্তার প্রতি আমাদের অবহেলা কতটা মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনে।

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটে চলা ঘটনার পেছনে রয়েছে কিছু কারণ। মূল কারণগুলো খতিয়ে দেখলে কিছু অন্যতম কারণ দেখা যায়। অবহেলা ও অনিয়মের ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভবন নির্মাণে নিয়ম না মানা, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র স্থাপন না করা, বিদ্যুৎ সংযোগে অব্যবস্থাপনা সবই সাধারণ চিত্র। বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। পুরোনো তার, অতিরিক্ত লোডে সংযোগ ও নিম্নমানের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আগুন লাগার অন্যতম উৎস। যান্ত্রিক ত্রুটির পাশাপাশি মানবিক ত্রুটিও অগ্নিকাণ্ডের পেছনে দায়ী। সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, গ্যাসের চুলা বন্ধ না রাখা, কিংবা অল্প সময়ের অসতর্কতা থেকেও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে। অপর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। বেশির ভাগ বাজার ও কারখানায় ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই আর থাকলেও তা কার্যকর নয়। আইনের দুর্বল প্রয়োগ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে। বিল্ডিং কোড না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও তা বাস্তবে প্রয়োগ হয় খুব কম।

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে শুধু ঘটনার পর কান্না নয়, ঘটনার আগে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। নিয়মিত তদারকি করতে হবে। বিশেষ করে প্রতিটি বাজার, গুদাম ও কারখানায় মাসিক ফায়ার সেফটি পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে। সবার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিক ও দোকান মালিকদের প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপণ প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা আগুন লাগলে প্রাথমিক প্রতিরোধে সক্ষম হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিরসনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। স্মার্ট ফায়ার অ্যালার্ম ও অটোমেটিক স্প্রিংকলার সিস্টেম স্থাপন করতে হবে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক এলাকায়। বিল্ডিং কোডের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। অনিয়মে নির্মিত ভবন বা কারখানার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। গণমাধ্যম, স্কুল ও কমিউনিটি পর্যায়ে অগ্নিসচেতনতা কার্যক্রম চালু করতে হবে।

আগুনের লেলিহান শিখা শুধু দোকানপাট বা ভবন নয়, পুড়িয়ে দেয় মানুষের বিশ্বাসকেও। প্রতিবার আগুন লাগে, কয়েক দিন হইচই হয়, তারপর আবার নিস্তব্ধতা নেমে আসে। নতুন করে নির্মিত হয় বাজার, নতুন করে খোলে কারখানা কিন্তু পুরোনো ভুলগুলো ঠিক হয় না। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা যখন শিল্পায়ন ও নগরায়ণের পথে এগিয়ে যাচ্ছি, তখন অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু দায়িত্ব নয়, এটি নাগরিক অধিকারের অংশ। প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিশ্রুতি হওয়া উচিত।

আগুনকে ভয় না করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কারণ, আগুনের ভয়াল থাবা শুধু ভবন ভস্মীভূত করে না, ভেতরের মানুষগুলোকেও শূন্য করে দেয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত