ভেনেজুয়েলায় মার্কিন হামলা কি আসন্ন?

ব্রায়ান অসগুড
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১১: ৩৮

লাতিন আমেরিকার ‘মাদক সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চলমান সামরিক অভিযান ক্যারিবীয় অঞ্চলকে একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত করেছে। মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ওয়াশিংটন গত আগস্ট মাস থেকে এই অঞ্চলজুড়ে যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান এবং হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। একই সঙ্গে পুয়ের্টো রিকোতে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আবার চালু করার পাশাপাশি সেখানে সামরিক মহড়াও সম্পন্ন করেছে ইতোমধ্যে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্লেষকরা ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে গত কয়েক দশকের মধ্যে লাতিন আমেরিকায় বৃহত্তম মার্কিন সামরিক উপস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তারা মাদকবিরোধী অভিযানকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিবীয় সাগরে বিমানবাহী রণতরী, পারমাণবিক সাবমেরিন, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও ১০ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েনকে মশা মারতে কামান দাগার মতো শক্তি প্রদর্শন বলে মন্তব্য করছেন।

ক্যারিবীয় সাগরে আগে থেকেই আটটি যুদ্ধজাহাজ, একটি পারমাণবিক সাবমেরিন, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও প্রায় ছয় হাজার মোতায়েন করেছে ওয়াশিংটন। এগুলো মাদকপাচার দমনের অংশ বলে দাবি করেছে তারা। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড, এর সঙ্গে থাকা পাঁচটি ডেস্ট্রয়ার এবং অতিরিক্ত সাড়ে ৪ হাজার সেনা।

তবে লাতিন আমেরিকায় বিশেষ করে ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিবৃদ্ধির মূল লক্ষ্য আসলে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকার উৎখাত করে পশ্চিমাপন্থি বিরোধী দলকে ক্ষমতায় আনা। এই লক্ষ্য হাসিলেই মাদুরোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মাদকপাচারের অভিযোগ এনেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ওয়াশিংটন গত ৭ আগস্ট মাদুরোকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান মাদকপাচারকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। তাকে গ্রেপ্তারে সহায়ক তথ্য দেওয়ার জন্য প্রথমে আড়াই কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে ট্রাম্প প্রশাসন। সম্প্রতি তা বাড়িয়ে ৫ কোটি ডলার করা হয়।

দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের রোষাণলের শিকার ভেনেজুয়েলা। সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের সময় থেকেই দেশটির সরকার উৎখাতের চেষ্টা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন তাদের টার্গেট বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। তার সরকারকে উৎখাতের টার্গেট নিয়েই এই অঞ্চলে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও তারা দাবি করছে, ভেনেজুয়েলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদকপাচার বন্ধ করাই তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু শুধু মাদকপাচার বন্ধের জন্য এই অঞ্চলে এত বিপুল সামরিক শক্তি মোতায়েন করার দাবিটি কোনোভাবেই ধোপে টিকছে না।

লাতিন আমেরিকায় মার্কিন বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি সম্পর্কে পেন্টাগনের মুখপাত্র শন পার্নেল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি অব্যাহত রাখা এবং পশ্চিম গোলার্ধে আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী অবৈধ ব্যক্তি এবং কার্যকলাপ শনাক্ত, পর্যবেক্ষণ এবং ব্যাহত করার জন্য মার্কিন সক্ষমতাকে জোরদার করবে।

ট্রাম্প বলেছেন, তিনি সিআইএকে ভেনেজুয়েলায় অভিযান চালানোর অনুমোদন দিয়েছেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় দেশটিতে স্থল অভিযানও চালানো হতে পারে। এই পদক্ষেপের অজুহাত হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, প্রেসিডেন্ট মাদুরোর সরকার মাদক ও অভিবাসনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে ‘আক্রমণ’ করার জন্য অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করছে।

মাদকপাচার চক্রের সঙ্গে মাদুরো প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত দাবি করে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল প্যাম বন্ডি বলেছেন, ভেনেজুয়ালভিত্তিক অপরাধচক্র ত্রেন দে আরাহুয়া এবং মেক্সিকোর প্রভাবশালী অপরাধচক্র সিনলোয়া কার্টেলের সঙ্গে মাদুরোর সংশ্লিষ্টতা আছে। ত্রেন দে আরাহুয়াকে এরই মধ্যে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।

১৫ অক্টোবর হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, দুটো কারণে সিআইএকে ভেনেজুয়েলায় গোপন অভিযান পরিচালনার অনুমতি দিয়েছেন তিনি। প্রথম কারণ, ভেনেজুয়েলা সরকার তাদের কারাগারের সব অপরাধীকে যুক্তরাষ্ট্রে এনে ছেড়ে দিয়েছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার হচ্ছে। তবে এই দুটো দাবির একটির সপক্ষেও কোনো প্রমাণ দেখাননি ট্রাম্প।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয়, মাদকপাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত লক্ষ্যের চেয়ে সামরিক শক্তির মাত্রা অনেক বেশি। এটি এমন একসময়ে করা হচ্ছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমানভাবে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে।

কিন্তু মাদকপাচারে সংশ্লিষ্টতার মার্কিন অভিযোগ বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছেন মাদুরো। ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউভান গিল যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযোগকে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা আখ্যায়িত করেছেন।

বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী মাদক কারবারে ভেনেজুয়েলার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা মূল্যায়নেও মাদুরো সরকার অপরাধী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন দাবির পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারপরও সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকান অঞ্চলের সাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোয় ক্রমবর্ধমানভাবে হামলা করে আসছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০টি নৌযানে হামলা করা হয়েছে। এসব হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৪৩ জন নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব হামলা মার্কিন এবং আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য।

ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সামরিক তৎপরতা এই অঞ্চলে গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় হুমকি সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৮৯ সালে পানামায় মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে তার সামরিক শক্তি ও তৎপরতা অনেকগুণ বাড়িয়েছে।

মাদুরোর সরকার বলেছে, ভেনেজুয়েলায় সরকার উৎখাতের লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের এ ধরনের যেকোনো চেষ্টার কঠোর জবাব দেবেন তারা।

কিন্তু সম্ভাব্য মার্কিন সামরিক আগ্রাসন প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ভেনেজুয়েলা সরকার। প্রেসিডেন্ট মাদুরো দেশটির বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে বড় ধরনের সামরিক মহড়ার নির্দেশ দেন সেপ্টেম্বর মাসে।

এছাড়া দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে, মাদুরো একই সঙ্গে ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে শান্তির বার্তাও পাঠিয়েছেন। বৃহস্পতিবার ট্রাম্পের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘দয়া করে কোনো পাগলাটে যুদ্ধ শুরু করবেন না। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই।’ কিন্তু ট্রাম্পের পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতির অভিযোগ অস্বীকার করলেও এখনো পর্যন্ত মাদুরোর শান্তির আহ্বানের স্পষ্ট কোনো জবাব দেননি।

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত