জুলাই সনদ নিয়ে বিপরীতধর্মী অবস্থান

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ০৪
আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ০৮
ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

চব্বিশের জুলাই। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। এক প্রবল প্রতাপশালী দানবীয় সরকার, যা যেকোনো মূল্যে এবং অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে হলেও ক্ষমতায় টিকে থাকার সব আয়োজন করে রেখেছিল এবং যার পাশে বিশাল ও বিপুল ক্ষমতাধর প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিমালয়ের মতো ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল—তা যে শাহাদতের তামান্নায় উজ্জীবিত নিরস্ত্র জনতার প্রতিরোধের মুখে এভাবে নতি স্বীকারে বাধ্য হতে পারে, তা ছিল এই শতাব্দীর এক অপার বিস্ময়। ঠিক কোন জিনিসটি সেই দানবীয় ফ্যাসিস্ট সরকারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিল? সারা দেশে বিপুল সংখ্যায় ছাত্র-জনতার মাঠে নেমে আসা, নাকি সেনাবাহিনীর মধ্য ও নিম্ন সারির অফিসার এবং জওয়ানদের নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি? এটা নিয়ে বোদ্ধা মহলের অনেক বিশ্লেষণ এসেছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরো বিশ্লেষণ আসবে। তবে অনেকেই মনে করেন, আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে জনতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর একাত্মতা ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও আসল প্রভাবক ছিল এক ঝাঁক অকুতোভয় তরুণের মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকার দৃপ্ত শপথ, যা খুনি সরকারের ঘাতক বাহিনীকে হতবিহ্বল করে দিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা একটি জনপ্রিয়, অথচ নেহাত নির্বিষ আন্দোলন কীভাবে এত অল্প সময়ে দাবানলের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল এবং সব শ্রেণির মানুষকে এতে যুক্ত করে ফেলল, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হবে। তবে এটা সকলেই স্বীকার করবেন, পাটাতন পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। বাকি ছিল শুধু হুইসেল বাজানো। দীর্ঘ ১৫ বছরের সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়ন জনতাকে এতটাই ত্যক্ত-বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তারা কেবল সঠিক জায়গা থেকে একটা ডাক আসার অপেক্ষায় ছিল। তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়—কোটাবিরোধী আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে উন্নীত করার পেছনে আসলেই কি কোনো মেটিকুলাস ডিজাইন বা নিখুঁত পরিকল্পনা কাজ করেছিল? ঘটনাপ্রবাহকে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে তেমনটি মনে হতেই পারে। বিশেষ করে পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের সংগঠকদের একজন যেমনটি বলেছেন, ৯ দফা দাবিনামা তারা এমনভাবে প্রণয়ন করেছিলেন, যাতে অবশেষে তা এক দফায় গিয়ে উন্নীত হয়।

সাফল্য মানুষের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণবিস্ফোরণের মুখে জালিমশাহির পতনের পর দেশের মানুষের মনে তীব্রভাবে এই আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয় যে, দেশটাকে নতুন করে গড়তে হবে। সর্বত্র ইনসাফ কায়েম করতে হবে। সবকিছু এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যেন ফের কোনো সরকার ক্ষমতায় বসার পর ফ্যাসিস্টে পরিণত হতে না পারে। সেইসঙ্গে এমন একটি আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কোনো একটি হঠকারী সরকার ক্ষমতায় এসে অভ্যুত্থানের নেতাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারে, কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত কার্যক্রমকে বেআইনি ঘোষণার উদ্যোগ নিতে না পারে।

প্রফেসর ইউনূসের মতো একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ায় মানুষের প্রত্যাশা আরো বহু গুণ বেড়ে গিয়েছিল। বিষয়টি কঠিন হলেও এটা আজ যে পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, হয়তোবা অতটা কঠিন হয়ে উঠত না। একটি প্রবাদ আছে, লোহা গরম থাকতেই আঘাত করতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত, অভিজ্ঞতা কিংবা সুপরামর্শের অভাবে শুরুতেই দ্রুতগতিতে জন-প্রত্যাশার ভিত্তিতে একটি ঘোষণাপত্র বা সনদ তৈরির পথে না গিয়ে ইন্টারিম সরকার লম্বা পথে হাঁটল। অভ্যুত্থানের নেতারাও শুরুতেই একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হলেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের সংবিধান ও রাষ্ট্রপ্রধানকে বহাল রেখে কাকের পেখমে ময়ূরপুচ্ছ লাগানোর মতো করে যে সরকার তারা দাঁড় করালেন, সেটা পদে পদে হোঁচট খেতে শুরু করল। উপদেষ্টা হিসেবে যাদের নেওয়া হলো, দেখা গেল, তাদের বেশির ভাগেরই এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। এমনকি তাদের অনেকেই আদৌ এই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করল। ফলাফল যা দাঁড়াল, তা হলো, দেশের পতিত জালিমশাহির সময়কার গুম-খুন বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অযাচিত/অতিরিক্ত বল প্রয়োগের মতো ঘটনাগুলো থেমে গেলেও মানুষ যতটা আশা করেছিল, সেরকম পরিবর্তন দেখতে ব্যর্থ হলো।

দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, সংবিধান ও আইন-কানুনে সংস্কার আনার জন্য সরকার বেশ কিছু কমিশন করল বটে, তাদের দেওয়া সুপারিশগুলো সমন্বয় করে একটা অভিন্ন সনদ তৈরি করা কঠিন বলে প্রমাণিত হলো। অভিযোগ রয়েছে, একটি বড় দল সংস্কার প্রশ্নে আগাগোড়া নিস্পৃহ ভূমিকা পালন করেছে। সে যা-ই হোক, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে অবশেষে যে দলিলটি দাঁড় করানো হলো, সেটার আইনি ভিত্তি প্রদান এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও সময়কাল নিয়ে একধরনের মতদ্বৈধ ও অচলাবস্থা তৈরি হলো। অনেক আলাপ-আলোচনার পর একটি সাংবিধানিক আদেশ জারি ও গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ অনুমোদনের বিষয়ে ঐকমত্য হলেও গণভোটের সময়কাল এবং পরবর্তী সংসদের এই সনদ বাস্তবায়নে কতটুকু ভূমিকা থাকবে, তা নিয়ে মতদ্বৈধ থেকেই গেল।

July-Certificate

একদিকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি চাচ্ছিল গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গেই হোক। উপরন্তু, তারা এরকম একটা ধারণা দিয়ে যাচ্ছিল যে, গণভোট হলেও এই সনদ অনুমোদন করবে পরবর্তী সংসদ। অন্যদিকে দেশের আরেকটি বড় দল জামায়াত এবং গণ-অভ্যুত্থানের নেতাদের নিয়ে গড়া দল এনসিপির দাবি ছিল, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে এই সনদের অনুমোদন করতে হবে এবং এই সনদের ভিত্তিতেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। পরবর্তী জাতীয় সংসদের ভূমিকা হবে কেবল এই সনদের আলোকে সংবিধানের পরিমার্জন করা। এ দুটো দলই হুমকি দিয়ে রাখে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করা না হলে তারা এতে স্বাক্ষর করবে না। দেখা গেল, সংশ্লিষ্ট কমিশন বিষয়টি মীমাংসা না করেই গত ১৭ অক্টোবর সনদ স্বাক্ষরের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যাতে যোগদানে এনসিপি অস্বীকৃতি জানায়, কিন্তু জামায়াত শেষ পর্যন্ত—যেকোনো বিবেচনাতেই হোক—ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।

জামায়াত জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির প্রশ্নে যে কঠোর অবস্থান নেয়, তাতে এনসিপি তো বটেই, দেশের রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের অনেকের ধারণা ছিল, বিষয়টির নিষ্পত্তি না হলে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জামায়াত যোগদান করবে না। কিন্তু তাদের অনেকেই জামায়াতের এই শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছেন। জামায়াতের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এনসিপি যতটা না কমিশন বা সরকারের প্রতি, তার চেয়েও বেশি জামায়াতের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছে।

স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে জামায়াত ও এনসিপির ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে সারা দেশে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে জামায়াতের দিক থেকে পরে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাতে এটাই প্রতীয়মান হয়, সরকারের পক্ষ থেকে সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করা হবে—এমন আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তারা সনদে স্বাক্ষর করতে রাজি হয়েছে।

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান প্রশ্নে এনসিপি ও জামায়াতের কঠোর অবস্থান সনদ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানকেই অনিশ্চিত করে তুলেছিল। এক্ষেত্রে এনসিপির নেওয়া অবস্থানকে অনেকেই প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছেন। কারণ, আইনি ভিত্তি ছাড়া এই সনদ একটি অর্থহীন দলিলে পরিণত হবে, যা মেনে চলার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এর মানে দাঁড়াবে, এই সনদের আলোকে সংবিধানের পরিমার্জনা পরবর্তী সংসদের অনুকম্পার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তাতে একদিকে এই অভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে যেসব সংস্কার হওয়ার কথা, তা মুখ থুবড়ে পড়বে; অন্যদিকে কেউ চাইলে পরবর্তী সময়ে অভ্যুত্থানের নায়কদের এবং ইন্টারিম সরকারের সদস্যদের বেআইনি কার্যকলাপের দায়ে বিচারের মুখোমুখি করতে পারবে। এনসিপির সনদে স্বাক্ষরে অস্বীকৃতির ফলে সরকারের ওপর এ বিষয়টি সুরাহা করার ব্যাপারে চাপ অব্যাহত থাকবে।

এবার দেখা যাক, জামায়াত স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগদান না করলে এর কী প্রভাব পড়তে পারত। জামায়াত অংশগ্রহণ না করলে সরকার ও অন্য প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি—এই উভয়ের সঙ্গে জামায়াতের বড় আকারের দূরত্ব তৈরি হতো। এমনিতেই বিএনপির সঙ্গে এ মুহূর্তে জামায়াতের একটি নরম-গরম সম্পর্ক চলছে। সেটা আরো বৃদ্ধি পেয়ে একটা মারমুখী আকার ধারণ করত। অন্যদিকে জামায়াত এই অনুষ্ঠান বয়কট করলে প্রফেসর ইউনূসের সরকারের ক্রেডিবিলিটি ভীষণ রকমের প্রশ্নের মুখোমুখি হতো। এর ফলে দেশে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারত, যা চূড়ান্ত বিচারে দেশের স্বার্থের অনুকূলে নাও যেতে পারে।

জামায়াতের অনুষ্ঠানে যোগদানের ফলে ইন্টারিমের পক্ষে যে আপাত বিপর্যয় সামলে ওঠা সম্ভব হয়েছে, সেটা ফের ফুঁসে উঠতে পারে, যদি না ইন্টারিম অনিষ্পন্ন বিষয়টি দ্রুত সুরাহা করে। ইন্টারিমকে মাথায় রাখতে হবে, সংস্কার প্রশ্নে এদেশের মানুষ কোনো আপস করবে না। শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জুলাইযোদ্ধা ও জুলাই অভ্যুত্থানের নায়কদের এদেশের মানুষ অনন্তকাল জাতীয় বীর হিসেবে গণ্য করবে এবং তাদের কোনো রকম অসম্মান কিংবা বিপন্নতাকে মানুষ সহজে গ্রহণ করবে না। সনদের আইনি স্বীকৃতির বিষয়টি নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হলে এনসিপির পাশাপাশি জামায়াতও ফের মাঠে নামবে। এই দাবিতে দেশের মানুষ তাদের পাশে থাকবে। এতে করে দেশময় যে দাবানল জ্বলে উঠবে, তাতে নির্বাচন তো অনিশ্চিত হয়ে পড়বেই, ইন্টারিমেরও বিদায়ঘণ্টা বেজে যাবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে দেশের। দেশ হাঁটা শুরু করতে পারে এক অনিশ্চিত গন্তব্যপানে। তবে এই ভাটি বাংলার মানুষ আজন্ম সংগ্রামী—তারা তাদের ন্যায্য হিস্যা ঠিকই বুঝে নেবে, এ বিশ্বাস রাখা যায়।

লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত