আমেরিকার ‘সফট পাওয়ার’কে ধ্বংস করছেন ট্রাম্প?

সিওনগিয়ান লি
প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৫২
ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা) বা যুক্তরাষ্ট্রকে আবার মহান করার স্লোগান তার নির্বাচনি প্রচারণায় একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল। রিপাবলিকান পার্টির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দেশটির শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণির লোকজনকেও ট্রাম্পের এই রাজনৈতিক স্লোগান যথেষ্ট উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার পর তার নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সাধারণ মার্কিনিদের পাশাপাশি নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যেও তার ‘মাগা’ স্লোগানের আবেদন কমতে থাকে। কমছে তার সমর্থনও। যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোয় এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

ট্রাম্পের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটাচ্ছে । বিশেষ করে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে ট্রাম্পের অস্বাভাবিক শুল্ক আরোপ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। এতে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সফট পাওয়ার’-এর প্রভাব কমছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বে ‘গ্রেট’ করার পরিবর্তে বরং বন্ধুহীন করার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়াচ্ছে যে, আগামী দিনে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সফট পাওয়ার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না, সে প্রশ্নও সামনে আসছে।

বিজ্ঞাপন

সফট পাওয়ার বলতে সামরিক বলপ্রয়োগ বা অর্থনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভর না করে অন্যদের প্রভাবিত করতে একটি জাতির ক্ষমতাকে বোঝায়। যেখানে বল প্রয়োগ এবং অর্থ প্রদানের মতো প্রণোদনার মাধ্যমে কারো আচরণ পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়, সফট পাওয়ার সেখানে অন্যদের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সফট পাওয়ারের গুরুত্ব এখানেই। যুক্তরাষ্ট্র তার এই ক্ষমতা বা শক্তিকে ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর প্রভাববিস্তারের কাজটি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু ট্রাম্পের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সফট পাওয়ারকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সফট পাওয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে আসছে। শীতল যুদ্ধের সময় আমেরিকার জনপ্রিয় সংস্কৃতির আবেদন ছিল বিশ্বব্যাপী এবং এটা দেশটির প্রভাব বাড়ানো এবং নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালানোর শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ বিশ্বে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা ওয়াশিংটনের প্রভাবকে বিশ্বব্যাপী আরো বেশি বৈধতা দেয়।

বর্তমানে হলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোর বিশ্বব্যাপী চাহিদা আছে, আমেরিকার সংগীত বিভিন্ন দেশে প্রতিধ্বনিত হয় এবং মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করে। কিন্তু এসবের পরেও যুক্তরাষ্ট্রের সফট পাওয়ারের একসময়কার প্রশ্নাতীত আধিপত্যে এখন ক্ষয়ের লক্ষণ স্পষ্ট। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি যে অনুকূল মনোভাব ছিল, তা এখন কমছে। সাম্প্রতিক সূচকগুলো মার্কিন সফট পাওয়ারের পতনের প্রতিচ্ছবিই প্রকাশ করে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সফট পাওয়ারকে সমর্থন দিয়েছিল, সেগুলো এখন দুর্বল হতে শুরু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক আবেদন এবং আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করেছে। একইভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকারের প্রচার এবং বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচিও যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করেছিল।

এই উপাদানগুলো মার্কিন নেতৃত্বের ভিত্তি তৈরি করে বিশ্বমঞ্চে দেশটির প্রভাবকে বৈধতা দিয়েছে। তবে মার্কিন সফট পাওয়ার কখনো স্থির ছিল না। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় দেশটির সফট পাওয়ারের প্রভাব ওঠানামা করেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মার্কিন পদক্ষেপগুলোকে যখন একতরফা বা অবৈধ বলে মনে করতে থাকে, কার্যত তখন থেকেই দেশটির সফট পাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যাপক নিন্দা ও সমালোচনার মুখে ফেলে এবং এই যুদ্ধ দেশটির নৈতিক কর্তৃত্বকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছিল। এরপর ২০০৩ সালে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়াই ইরাকে আগ্রাসন বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সম্প্রতি প্যারিস চুক্তির মতো বহুপক্ষীয় চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করার পর ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা অনেকটাই কমে গেছে।

বর্তমান সময়টি যুক্তরাষ্ট্রের সামনে ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রনীতিতে ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার মাত্রা সব সীমা ছাড়িয়েছে। তিনি মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বা ইউএসএইড ভেঙে দেওয়ার আগে ৯০ দিনের জন্য বিদেশি সাহায্য স্থগিত করেছিলেন। তার এই পদক্ষেপে বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন সহায়তার প্রতি মার্কিন প্রতিশ্রুতির প্রতীকী কর্মসূচিগুলো বন্ধ হয়ে যায়।

ভয়েস অব আমেরিকাসহ মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত মিডিয়াগুলো বিদেশে ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। কিন্তু ট্রাম্প এগুলোর বাজেট কমিয়ে দেন, যা এসব প্ল্যাটফর্মকে দুর্বল করেছে। এছাড়া তিনি মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বী উভয় ধরনের দেশ থেকে পণ্য আমদানির ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেন, যা বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার সম্পর্কে গুরুতর টানাপোড়েন তৈরি করেছে।

অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে তিনি হার্ভার্ডের মতো অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ফেডারেল তহবিল স্থগিত করে উচ্চশিক্ষায় বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত বিদেশিদের নির্বিচারে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে এসব পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং দেশটির সফট পাওয়ার টিকিয়ে রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাবকে ক্ষয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে।

ট্রাম্পের এসব নীতি অস্থায়ী হতে পারে এবং ভবিষ্যতে তিনি তার সরকারের নীতি সমন্বয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু বিপদের কথা হচ্ছে, সাময়িকভাবে নেওয়া এসব পদক্ষেপই বিশ্বে মার্কিন প্রভাব বজায় রাখে, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

ভুল নীতির পরিবর্তন বা পুনর্গঠন অনেকটা সহজে করা গেলেও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেগুলোকে দ্রুত পুনর্গঠন বা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের জন্য বছরের পর বছর চেষ্টা করার পাশাপাশি বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু তারপরেও আন্তর্জাতিক আস্থা পুনরুদ্ধার করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

সফট পাওয়ার সাধারণত বিশ্বাসযোগ্যতা, ধারাবাহিকতা এবং তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক চক্রের বাইরে স্থায়ী মূল্যবোধ ধারণকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে। মানবিক সহায়তা প্রদানকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী খ্যাতির কেন্দ্রে রয়েছে দেশটির মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা ইউএসএআইডি। কিন্তু ট্রাম্প এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ করে যুক্তরাষ্ট্রের সফট পাওয়ারের শক্তি অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন।

যেসব সমাজে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত, সেগুলোতে ভয়েস অব আমেরিকা এবং এ ধরনের সংবাদমাধ্যমগুলো দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক আদর্শকে প্রচার-প্রসার করে আসছে। হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাডেমিক উৎকর্ষের প্রতীক এবং ভবিষ্যতের বিশ্বনেতাদের জন্য চুম্বক হিসেবে কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবমূল্যায়ন করা কেবল বিদেশে মার্কিন প্রভাবকেই খর্ব করে না, বরং দেশটির বিশ্ব নেতৃত্বের বৈধতাকেও দুর্বল করে দেয়।

সব দিক মিলিয়েই বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রে সফট পাওয়ার বর্তমানে হুমকির মুখে। ভ্রান্ত নীতি ও একতরফা পদক্ষেপ সত্ত্বেও অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের সফট পাওয়ার টিকে ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের হুমকি কাঠামোগত, যা মার্কিন সফট পাওয়ারকে টিকিয়ে রাখে, এমন সব প্রতিষ্ঠানকেই ফাঁকা করে দিচ্ছে।

স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রভাবকে বিসর্জন দেওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। যদি যুক্তরাষ্ট্র তাদের সফট পাওয়ারকে টিকিয়ে রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করতে থাকে, তাহলে মহাকাশে দেশটির আধিপত্যের অবসানের ঝুঁকি তৈরি হবে। যদি বিশ্বে মার্কিন সফট পাওয়ারের পতন ঘটেই যায়, তাহলে তা পুনরুদ্ধার করা কেবল অনেক ব্যয়বহুলই হবে না, অসম্ভবও হয়ে পড়বে।

এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত