মুহাম্মদ তালহা
২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই, নরওয়ে সময় সকাল ১০টা। মেঘে ঢাকা বার্গেনের দিগন্তজোড়া পাহাড়ে পাহাড়ে সেদিন সূর্য ঝকমক করছে। উত্তরীয় গ্রীষ্ম তখন শেষের দিকে। ট্যুরস নরওয়ের সঙ্গে গাইড হিসেবে আমাদের সেকেন্ড জবের জন্য এয়ারপোর্টে ওয়েট করছি দেশি ভাই-ব্রাদাররা একসঙ্গে। সঙ্গে বেশ কয়েকজন ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি ও নরওয়েজিয়ান। আমরা অধিকাংশই ইউনিভার্সিটি অব বারগেনে মাস্টার্স বা এমফিল করতে যাওয়া শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি নরওয়ের উচ্চমূল্যের জীবন নির্বাহ করতে সবার পার্টটাইম জব তখন সামারের ছুটির কারণে ফুলটাইম হয়ে গেছে। দেশের রক্তক্ষয়ী বাস্তবতা আর অনাগত অভ্যুত্থানের খোঁজখবর এবং এই মুহূর্তে ছাত্রনেতাদের করণীয় নিয়ে সিটিজেন ইনিশিয়েটিভের গ্রুপে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। আর নানা স্টেকহোল্ডারের কাছে আমাদের নীতিগুলো পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকায় জবের পরে পাওয়া সময়ে আর ঘুম হয়নি জুলাইয়ের অধিকাংশ রাতেই।
ঘুম না হওয়া ঢুলুঢুলু চোখে ক্ষণে ক্ষণেই ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে আলাপ করছি আর রিফ্রেশ করছি। ফজরের পর থেকে ৯-১০টা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী বা উত্তরার কোনো দিকেরই খোঁজ পাচ্ছিলাম না। মধ্যরাতের দিকে তৎকালীন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং রাজবন্দিদের মুক্তির পোস্ট মূলত সিআই গ্রুপে দুটো আলোচনার জন্ম দেয়। আমি ছাড়া একরকম সবাই-ই! তরুণ চিন্তক মোহাম্মাদ ইশরাক, মেটার সালমান শামিল ভাই, ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক জুনায়েদ আল মামুন ভাই ও ইউকের তারেক ভাইরা এটাকে শঙ্কার হিসেবেই দেখেছিলেন, তথা তাড়াহুড়োর মতো করে, যা বুমেরাং হতে পারে। আর ইশরাকের শঙ্কা ছিল আন্দোলনটা ছাত্রশক্তির নেতাদের ব্যক্তিগত অর্জনের দিকে যায় কি না! স্পেশালি বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম সিনড্রোমের শঙ্কা প্রকাশ করে, যদিও সবাই-ই ভাবছিলেন, হয়তো ছাত্রনেতারা ছায়া সরকার ঘোষণা করবেন, যাতে হয়তো আসিফ-মাহফুজরা নেতৃত্ব দেবেন। পরে তাদের ক্যাপচার করে নিলে মিডল ক্লাস বা জনমানুষ আন্দোলন করবে কি না, সেই প্রশ্নই জারি ছিল বাকি সবার শঙ্কায়।
তখন বর্তমান জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা ও তৎকালীন ছাত্রনেতা আকরাম সবাইকে আশ্বস্ত করেন, ছাত্ররা ক্ষমতা নিতে চান না, তারা ন্যায়বিচার চাইছেন এবং এর ভিত্তিতে যারা ক্ষমতায় যাওয়ার, তারাই যাক। আমি তখন বলেছিলাম, আসিফ মাহমুদরা যদি এমন করতে চান, তাহলে এটি তাকে ভিপি নুরের মতো আস্থাহীন নেতৃত্বে পরিণত করবে। এছাড়া ক্ষমতা পরিবর্তন হলে ক্ষমতায় গিয়ে যদি যথাযথ কাজ করে, তাহলে তারা দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক দল করে রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, সেই সম্ভাবনার কথাও বলি আমি, যে বাস্তবতা আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি। তবে ইশরাক অন্য একটা শঙ্কাও প্রকাশ করেন যে, ছাত্ররা ’৭১-এর মতো ’২৪-এর চেতনাপূজা করতে চান সম্ভবত। তবে এসবের বাইরে গিয়ে আমার মতোই ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির ড. সিব্বির ভাই পোস্টটাকে ইতিবাচকভাবে দেখেন পোস্ট-হাসিনা সময়ে বিপ্লব যাতে বেহাত না হয়, তা চিন্তা করে। তবে ইশরাকের সাবধানবাণী ছিল ক্ষমতার প্রতি লালায়িত হাসিনার টিকে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে । সেক্ষেত্রে আমি বলেছিলাম—‘ইনশাআল্লাহ! টিকবে না। খোদা এবার শেখ হাসিনাকে ধ্বংস করবেন ইনশাআল্লাহ,’ যা কিনা ১০ ঘণ্টার মধ্যেই আল্লাহ সত্য করেছিলেন।
এরপর আকরামের চাপাচাপিতে সবাই মিলে পরামর্শ করে সিআইর পক্ষ থেকে রাষ্ট্র বিনির্মাণ প্রস্তাবনা লিখলাম। আমি সেটাকে ফেসবুকে দেওয়ার পাশাপাশি উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সঙ্গে হওয়া আলাপমতো তাকেও পাঠালাম। এর মাঝে হুট করে শহীদুল ইসলাম তারেক ভাই বললেন, ‘আমি যদি হাসিনা হতাম, এই আগস্ট মাসে বাপের রক্তাক্ত স্মৃতির কথা মনে করে কোনোভাবেই ক্ষমতা ছাড়তাম না।’ তখন আমি বললাম, ‘এসব এবার ধোপে টিকবে না, যদি ছাত্ররা বড় কোনো ভুল না করে।’ এরপর ড. সিব্বির ভাই জানতে চাইলেন, ‘যদি হাসিনার পতন না হয় এবং গণহত্যা কন্টিনিউ করা হয়, তাহলে ছাত্রদের কী করা উচিত?’ তারেক ভাই বললেন, অর্থনৈতিক অক্সিজেন বন্ধ করা ও ক্যাজুয়ালিটি কমানোর চেষ্টা করা। জুনায়েদ আল মামুন ভাই বললেন, ‘অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখা, অর্থনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা ও ঢাকা ত্যাগ না করা।’ ইশরাক বলল, ‘লো ইনটেনসিটি মুভমেন্ট চালু রাখা।’ আমি তখনো আবার বললাম, ‘এসব হবে না, ভাই। এবারে একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে।’
এসবের মাঝেও শহীদ মিনারে একত্র হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থতার ভিডিও দেখলাম। এছাড়া কোনো ভিডিও বা খবর আসছিল না। তখন দেশের সময় ১০টা পার হয়ে গেছে। বারবার মনে শঙ্কা জাগছে, ‘তবে কি তীরে এসেও তরী ডুবল? নানাজন নানা জায়গা থেকে তথ্য আনছে, কিন্তু কোথাও কোনো আশার আলো নেই।’ দেশের সময় ১১টার পর হঠাৎ করেই শুনলাম যাত্রাবাড়ী থেকে একদল রওনা দিয়েছে। অন্যদিকে রামপুরা দিয়েও আসছে একদল। নেট বন্ধ থাকায় তেমন ভিডিও না পাওয়ায় তা যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাহলে কি এবারও ২০১৪-১৫ সালের মতো এত জীবনের ত্যাগ আর কোরবানি বৃথা যাবে? এর মাঝে শুনি তখনো ঢাবি এরিয়া পুলিশ ও আর্মির দখলে, আর জাবি থেকে বিশাল মিছিল আসছে। ১২টার পরে শুনতে পেলাম, উত্তরা দিয়ে বিশাল মিছিল আসছে। যদিও ভিডিও পাইনি, তারপরও বিন্দু বিন্দু আশা তখন জাগতে শুরু করেছে। ঠিক ১টার সময় বুয়েটিয়ান পেজ থেকে থেকে দেখলাম সেই মহামুহূর্ত! বেলা ২টায় মিলিটারি চিফ ভাষণ দেবেন। তার মানে চিড়িয়া হাওয়া।
তখন নরওয়ে টাইম প্রায় সকাল ১০টা, হালকা শীতে রোদ বেশ উপাদেয় লাগছে। আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে এমন এক ব্যক্তি যে কি না দেশে ছাত্রলীগ করেছে, কিন্তু তার পরিবার বিএনপিপন্থি এবং সেও হাসিনার পতন চায়, জানি না এখন তার অবস্থানের পরিবর্তন হয়ে ‘আগেই ভালো ছিলাম’ দলে চলে গিয়েছে কি না। তখন তাকে বললাম, ‘শিওর থাকেন—Hasina is gone. কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন খুবই কমই ঘটেছে যে, সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় থাকা ছাড়া সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তারপরও শঙ্কা কাটছিল না। তবে একটু পরেই হাসিনার দুর্নীতিবাজ পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দেওয়া ভাষণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে হাসিনার পদত্যাগের ব্যাপারে মোটামুটি শিওর হয়ে গিয়েছিলাম। সেই ভাষণেই মূলত গত এক বছর ধরে দেশকে অস্থিতিশীল করে রাখা নানা গ্রুপের কার্যক্রমের একটি পূর্বাভাস ছিল এবং আমার পরিচিতজনদের মাঝে এই আশঙ্কা শেয়ারও করে থাকি। সিআইয়ের গ্রুপে চলছিল তখন নানারকম বিশ্লেষণ। সবাই হাসিনাকে আটক দেখানো তথা ফ্রি পাস না দেওয়ার দাবি দাওয়া পেশ করার জন্য লেখালেখি শুরু করছিল। কিন্তু খানিক বাদেই হাসিনার গণভবন থেকে হেলিকপ্টারে পালিয়ে যাওয়ার যে ভিডিও দৃষ্টিগোচর হলো, যা তখন শিওর না থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যে শিওর হলাম।
এরপরে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ও নিশ্চিত খবর, সঙ্গে সঙ্গে আব্বুকে ফোন করলাম। ২০০৮ সালের পর থেকে প্রতিটি দিনের যে স্বপ্ন আমাদের পরিবারের, সেই স্বপ্ন পূরণের দিন বলে কথা। কত লাখ মানুষের সঙ্গে রাজপথের নিপীড়ন, গুলি, জেল, মৃত্যু আর পালিয়ে বেড়ানোর দিন শেষ হলো। আম্মুর সঙ্গে আবার ভাবও নিলাম এই বলে যে, ১৬ তারিখের পর থেকে বলে আসছি, হাসিনার চলে যাওয়ার সময় এসেছে। ঈদ মোবারক বিনিময় করলাম এয়ারপোর্টে থাকা ভাই-ব্রাদারদের সঙ্গে। ইউআইবির এমফিল স্টুডেন্ট মুনিমসহ সবাই দেখলাম বাসায় কথা বলছে আনন্দে। ইউআইবির আরেক জুনিয়র সামীকে দেখলাম ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি চলে আসতে। ওর আর আমার গল্পটা অন্যদের থেকে একটু ভিন্ন। ও কিছুটা বাম চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হলেও পারসোনালি সেই ২০১৫-১৬ সাল থেকে সরকারবিরোধিতা করে এলাকার পুলিশের নজরে পড়েছে। আর আমি তো জন্ম থেকেই বিরোধী দল। ২০১১, ’১২, ’১৩, ’১৪ সালের নয়াপল্টন আর সোহরাওয়ার্দীর রাজপথ-ময়দান পেরিয়ে, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া খেয়ে অভ্যস্ত। ’২৩ সালে নরওয়ে থেকে দেশে গিয়েও বরগুনার বাসা থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল বেনামি মামলার কবলে পড়ে। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে মাহমুদ ফোন করে কেঁদে ফেলছে। আমার বউ এর মাঝে রা—হতে পারে নরওয়েই আশ্রয় দিল হাসিনাকে এবং এয়ারপোর্ট থেকে হাসিনা বের হয়ে এলো, তখন আমরা কী করব হাসিনাকে? জুতা মারব, নাকি মিছিল করব? একটু পরেই দেখলাম এক গাইড এয়ারপোর্টের অ্যারাইভালে বিএসএল লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। সামিকে বললাম, ‘দেখো ছাত্রলীগরা পালিয়ে আসবে, সেজন্য এই লোক রিসিভ করতে দাঁড়িয়ে আছে।’ সঙ্গে থাকা কলিগ ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি ও নরওয়েজিয়ানদের হাসিনা ও লীগের সব কীর্তি নিয়ে বোঝাতে বোঝাতে তখন ওদের কান ঝালাপালা। এর মাঝে আবেগে আপ্লুত হেফাজতের সমর্থক নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সিয়াম ভাই ফোন করে বলেন, ‘বিরিয়ানি রান্না করব সবার জন্য, ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে আসবেন।’ ঘুমঘুম চোখে টলমল টলমল করতে করতে আমি আর মুনিম প্রায় ২০ জনের আয়োজনের বাজার করে ফিরলাম। ফেরার পথে সিরিয়ান, পাকিস্তানি, নরওয়েজিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের পরিচিতজনরা বাংলাদেশের মুক্তির জন্য অভিনন্দন জানাল। এরপর সিয়াম ভাইর কল্যাণের ডর্মেটরিতে ডান, বাম, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে হোয়াইট নরওয়েজিয়ান বন্ধুসহ সবাই মিলে আনন্দভোজ, বাংলাদেশ ২.০-এর স্বপ্নে নানা আলাপ ও ছবি তোলা শেষে স্মৃতিময় ৫ আগস্টের সমাপ্তি।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কো-ফাউন্ডার, সিটিজেন ইনিশিয়েটিভ
এক্স প্রেসিডেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, ইউনিভার্সিটি অব বার্গেন, নরওয়ে
Mjh.talha@gmail.com
২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই, নরওয়ে সময় সকাল ১০টা। মেঘে ঢাকা বার্গেনের দিগন্তজোড়া পাহাড়ে পাহাড়ে সেদিন সূর্য ঝকমক করছে। উত্তরীয় গ্রীষ্ম তখন শেষের দিকে। ট্যুরস নরওয়ের সঙ্গে গাইড হিসেবে আমাদের সেকেন্ড জবের জন্য এয়ারপোর্টে ওয়েট করছি দেশি ভাই-ব্রাদাররা একসঙ্গে। সঙ্গে বেশ কয়েকজন ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি ও নরওয়েজিয়ান। আমরা অধিকাংশই ইউনিভার্সিটি অব বারগেনে মাস্টার্স বা এমফিল করতে যাওয়া শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি নরওয়ের উচ্চমূল্যের জীবন নির্বাহ করতে সবার পার্টটাইম জব তখন সামারের ছুটির কারণে ফুলটাইম হয়ে গেছে। দেশের রক্তক্ষয়ী বাস্তবতা আর অনাগত অভ্যুত্থানের খোঁজখবর এবং এই মুহূর্তে ছাত্রনেতাদের করণীয় নিয়ে সিটিজেন ইনিশিয়েটিভের গ্রুপে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। আর নানা স্টেকহোল্ডারের কাছে আমাদের নীতিগুলো পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকায় জবের পরে পাওয়া সময়ে আর ঘুম হয়নি জুলাইয়ের অধিকাংশ রাতেই।
ঘুম না হওয়া ঢুলুঢুলু চোখে ক্ষণে ক্ষণেই ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে আলাপ করছি আর রিফ্রেশ করছি। ফজরের পর থেকে ৯-১০টা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী বা উত্তরার কোনো দিকেরই খোঁজ পাচ্ছিলাম না। মধ্যরাতের দিকে তৎকালীন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং রাজবন্দিদের মুক্তির পোস্ট মূলত সিআই গ্রুপে দুটো আলোচনার জন্ম দেয়। আমি ছাড়া একরকম সবাই-ই! তরুণ চিন্তক মোহাম্মাদ ইশরাক, মেটার সালমান শামিল ভাই, ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক জুনায়েদ আল মামুন ভাই ও ইউকের তারেক ভাইরা এটাকে শঙ্কার হিসেবেই দেখেছিলেন, তথা তাড়াহুড়োর মতো করে, যা বুমেরাং হতে পারে। আর ইশরাকের শঙ্কা ছিল আন্দোলনটা ছাত্রশক্তির নেতাদের ব্যক্তিগত অর্জনের দিকে যায় কি না! স্পেশালি বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম সিনড্রোমের শঙ্কা প্রকাশ করে, যদিও সবাই-ই ভাবছিলেন, হয়তো ছাত্রনেতারা ছায়া সরকার ঘোষণা করবেন, যাতে হয়তো আসিফ-মাহফুজরা নেতৃত্ব দেবেন। পরে তাদের ক্যাপচার করে নিলে মিডল ক্লাস বা জনমানুষ আন্দোলন করবে কি না, সেই প্রশ্নই জারি ছিল বাকি সবার শঙ্কায়।
তখন বর্তমান জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা ও তৎকালীন ছাত্রনেতা আকরাম সবাইকে আশ্বস্ত করেন, ছাত্ররা ক্ষমতা নিতে চান না, তারা ন্যায়বিচার চাইছেন এবং এর ভিত্তিতে যারা ক্ষমতায় যাওয়ার, তারাই যাক। আমি তখন বলেছিলাম, আসিফ মাহমুদরা যদি এমন করতে চান, তাহলে এটি তাকে ভিপি নুরের মতো আস্থাহীন নেতৃত্বে পরিণত করবে। এছাড়া ক্ষমতা পরিবর্তন হলে ক্ষমতায় গিয়ে যদি যথাযথ কাজ করে, তাহলে তারা দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক দল করে রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, সেই সম্ভাবনার কথাও বলি আমি, যে বাস্তবতা আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি। তবে ইশরাক অন্য একটা শঙ্কাও প্রকাশ করেন যে, ছাত্ররা ’৭১-এর মতো ’২৪-এর চেতনাপূজা করতে চান সম্ভবত। তবে এসবের বাইরে গিয়ে আমার মতোই ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির ড. সিব্বির ভাই পোস্টটাকে ইতিবাচকভাবে দেখেন পোস্ট-হাসিনা সময়ে বিপ্লব যাতে বেহাত না হয়, তা চিন্তা করে। তবে ইশরাকের সাবধানবাণী ছিল ক্ষমতার প্রতি লালায়িত হাসিনার টিকে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে । সেক্ষেত্রে আমি বলেছিলাম—‘ইনশাআল্লাহ! টিকবে না। খোদা এবার শেখ হাসিনাকে ধ্বংস করবেন ইনশাআল্লাহ,’ যা কিনা ১০ ঘণ্টার মধ্যেই আল্লাহ সত্য করেছিলেন।
এরপর আকরামের চাপাচাপিতে সবাই মিলে পরামর্শ করে সিআইর পক্ষ থেকে রাষ্ট্র বিনির্মাণ প্রস্তাবনা লিখলাম। আমি সেটাকে ফেসবুকে দেওয়ার পাশাপাশি উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সঙ্গে হওয়া আলাপমতো তাকেও পাঠালাম। এর মাঝে হুট করে শহীদুল ইসলাম তারেক ভাই বললেন, ‘আমি যদি হাসিনা হতাম, এই আগস্ট মাসে বাপের রক্তাক্ত স্মৃতির কথা মনে করে কোনোভাবেই ক্ষমতা ছাড়তাম না।’ তখন আমি বললাম, ‘এসব এবার ধোপে টিকবে না, যদি ছাত্ররা বড় কোনো ভুল না করে।’ এরপর ড. সিব্বির ভাই জানতে চাইলেন, ‘যদি হাসিনার পতন না হয় এবং গণহত্যা কন্টিনিউ করা হয়, তাহলে ছাত্রদের কী করা উচিত?’ তারেক ভাই বললেন, অর্থনৈতিক অক্সিজেন বন্ধ করা ও ক্যাজুয়ালিটি কমানোর চেষ্টা করা। জুনায়েদ আল মামুন ভাই বললেন, ‘অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখা, অর্থনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা ও ঢাকা ত্যাগ না করা।’ ইশরাক বলল, ‘লো ইনটেনসিটি মুভমেন্ট চালু রাখা।’ আমি তখনো আবার বললাম, ‘এসব হবে না, ভাই। এবারে একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে।’
এসবের মাঝেও শহীদ মিনারে একত্র হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থতার ভিডিও দেখলাম। এছাড়া কোনো ভিডিও বা খবর আসছিল না। তখন দেশের সময় ১০টা পার হয়ে গেছে। বারবার মনে শঙ্কা জাগছে, ‘তবে কি তীরে এসেও তরী ডুবল? নানাজন নানা জায়গা থেকে তথ্য আনছে, কিন্তু কোথাও কোনো আশার আলো নেই।’ দেশের সময় ১১টার পর হঠাৎ করেই শুনলাম যাত্রাবাড়ী থেকে একদল রওনা দিয়েছে। অন্যদিকে রামপুরা দিয়েও আসছে একদল। নেট বন্ধ থাকায় তেমন ভিডিও না পাওয়ায় তা যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাহলে কি এবারও ২০১৪-১৫ সালের মতো এত জীবনের ত্যাগ আর কোরবানি বৃথা যাবে? এর মাঝে শুনি তখনো ঢাবি এরিয়া পুলিশ ও আর্মির দখলে, আর জাবি থেকে বিশাল মিছিল আসছে। ১২টার পরে শুনতে পেলাম, উত্তরা দিয়ে বিশাল মিছিল আসছে। যদিও ভিডিও পাইনি, তারপরও বিন্দু বিন্দু আশা তখন জাগতে শুরু করেছে। ঠিক ১টার সময় বুয়েটিয়ান পেজ থেকে থেকে দেখলাম সেই মহামুহূর্ত! বেলা ২টায় মিলিটারি চিফ ভাষণ দেবেন। তার মানে চিড়িয়া হাওয়া।
তখন নরওয়ে টাইম প্রায় সকাল ১০টা, হালকা শীতে রোদ বেশ উপাদেয় লাগছে। আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে এমন এক ব্যক্তি যে কি না দেশে ছাত্রলীগ করেছে, কিন্তু তার পরিবার বিএনপিপন্থি এবং সেও হাসিনার পতন চায়, জানি না এখন তার অবস্থানের পরিবর্তন হয়ে ‘আগেই ভালো ছিলাম’ দলে চলে গিয়েছে কি না। তখন তাকে বললাম, ‘শিওর থাকেন—Hasina is gone. কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন খুবই কমই ঘটেছে যে, সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় থাকা ছাড়া সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তারপরও শঙ্কা কাটছিল না। তবে একটু পরেই হাসিনার দুর্নীতিবাজ পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দেওয়া ভাষণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে হাসিনার পদত্যাগের ব্যাপারে মোটামুটি শিওর হয়ে গিয়েছিলাম। সেই ভাষণেই মূলত গত এক বছর ধরে দেশকে অস্থিতিশীল করে রাখা নানা গ্রুপের কার্যক্রমের একটি পূর্বাভাস ছিল এবং আমার পরিচিতজনদের মাঝে এই আশঙ্কা শেয়ারও করে থাকি। সিআইয়ের গ্রুপে চলছিল তখন নানারকম বিশ্লেষণ। সবাই হাসিনাকে আটক দেখানো তথা ফ্রি পাস না দেওয়ার দাবি দাওয়া পেশ করার জন্য লেখালেখি শুরু করছিল। কিন্তু খানিক বাদেই হাসিনার গণভবন থেকে হেলিকপ্টারে পালিয়ে যাওয়ার যে ভিডিও দৃষ্টিগোচর হলো, যা তখন শিওর না থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যে শিওর হলাম।
এরপরে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ও নিশ্চিত খবর, সঙ্গে সঙ্গে আব্বুকে ফোন করলাম। ২০০৮ সালের পর থেকে প্রতিটি দিনের যে স্বপ্ন আমাদের পরিবারের, সেই স্বপ্ন পূরণের দিন বলে কথা। কত লাখ মানুষের সঙ্গে রাজপথের নিপীড়ন, গুলি, জেল, মৃত্যু আর পালিয়ে বেড়ানোর দিন শেষ হলো। আম্মুর সঙ্গে আবার ভাবও নিলাম এই বলে যে, ১৬ তারিখের পর থেকে বলে আসছি, হাসিনার চলে যাওয়ার সময় এসেছে। ঈদ মোবারক বিনিময় করলাম এয়ারপোর্টে থাকা ভাই-ব্রাদারদের সঙ্গে। ইউআইবির এমফিল স্টুডেন্ট মুনিমসহ সবাই দেখলাম বাসায় কথা বলছে আনন্দে। ইউআইবির আরেক জুনিয়র সামীকে দেখলাম ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি চলে আসতে। ওর আর আমার গল্পটা অন্যদের থেকে একটু ভিন্ন। ও কিছুটা বাম চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হলেও পারসোনালি সেই ২০১৫-১৬ সাল থেকে সরকারবিরোধিতা করে এলাকার পুলিশের নজরে পড়েছে। আর আমি তো জন্ম থেকেই বিরোধী দল। ২০১১, ’১২, ’১৩, ’১৪ সালের নয়াপল্টন আর সোহরাওয়ার্দীর রাজপথ-ময়দান পেরিয়ে, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া খেয়ে অভ্যস্ত। ’২৩ সালে নরওয়ে থেকে দেশে গিয়েও বরগুনার বাসা থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল বেনামি মামলার কবলে পড়ে। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে মাহমুদ ফোন করে কেঁদে ফেলছে। আমার বউ এর মাঝে রা—হতে পারে নরওয়েই আশ্রয় দিল হাসিনাকে এবং এয়ারপোর্ট থেকে হাসিনা বের হয়ে এলো, তখন আমরা কী করব হাসিনাকে? জুতা মারব, নাকি মিছিল করব? একটু পরেই দেখলাম এক গাইড এয়ারপোর্টের অ্যারাইভালে বিএসএল লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। সামিকে বললাম, ‘দেখো ছাত্রলীগরা পালিয়ে আসবে, সেজন্য এই লোক রিসিভ করতে দাঁড়িয়ে আছে।’ সঙ্গে থাকা কলিগ ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি ও নরওয়েজিয়ানদের হাসিনা ও লীগের সব কীর্তি নিয়ে বোঝাতে বোঝাতে তখন ওদের কান ঝালাপালা। এর মাঝে আবেগে আপ্লুত হেফাজতের সমর্থক নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সিয়াম ভাই ফোন করে বলেন, ‘বিরিয়ানি রান্না করব সবার জন্য, ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে আসবেন।’ ঘুমঘুম চোখে টলমল টলমল করতে করতে আমি আর মুনিম প্রায় ২০ জনের আয়োজনের বাজার করে ফিরলাম। ফেরার পথে সিরিয়ান, পাকিস্তানি, নরওয়েজিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের পরিচিতজনরা বাংলাদেশের মুক্তির জন্য অভিনন্দন জানাল। এরপর সিয়াম ভাইর কল্যাণের ডর্মেটরিতে ডান, বাম, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে হোয়াইট নরওয়েজিয়ান বন্ধুসহ সবাই মিলে আনন্দভোজ, বাংলাদেশ ২.০-এর স্বপ্নে নানা আলাপ ও ছবি তোলা শেষে স্মৃতিময় ৫ আগস্টের সমাপ্তি।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কো-ফাউন্ডার, সিটিজেন ইনিশিয়েটিভ
এক্স প্রেসিডেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, ইউনিভার্সিটি অব বার্গেন, নরওয়ে
Mjh.talha@gmail.com
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে