ড. মো. খলিলুর রহমান
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণা ছিল১৯৭০ সালেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে জয়ী হবে বলে জনজোয়ার তৈরি হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভাবত যে চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই হবে। কারণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর ভুট্টোরা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তাদের শোষণ-নিপীড়ন-রীতি-নীতেতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মন বিষিয়ে ওঠে। এর মধ্যে জুলফিকার ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে কূটকৌশল শুরু করে। বলেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তাদের ক্ষমতায় বসানো হবে না। তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের শত্রু। সে সময় প্রলয়ংকরী বন্যায় বাংলাদেশ ভেসে যায় কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো উল্লেখযোগ্য নেতা বাংলাদেশে আসেননি। লে. জেনারেল আযম খান তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মঙ্গল কামনা করতেন এবং সেভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার জনগণের মতপার্থক্য চরম প্রকট হয়ে ওঠে।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শুধু পূর্ব পাকিস্তানের পাট, চা, চামড়া ও অন্যান্য রপ্তানিযোগ্য পণ্যের রপ্তানি আয় নেওয়ার জন্যই যেন পূর্ব পাকিস্তানকে সৃষ্টি করেছে। অথচ পাকিস্তান তৈরির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা। বন্যার করাল গ্রাস অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা না আসায় মওলানা ভাসানী অলাইকুম আসসালাম বলে তাদের বিদায় জানালেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু ইয়াহিয়া গায়ের জোরে ১ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন বাতিল করেন। গর্জে ওঠে জনগণ, নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। জনরোষে ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে, শেখ মুজিব অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। আমরা তখন তরুণ টগবগে যুবক, সারা দিন মিটিং-মিছিলে কাটিয়েছি। নিজেদের বাসা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সেন্ট্রাল রোডের এক চাচার বাসায় একটি খালি ফ্ল্যাটে থাকি। যাতে করে সব খবর নখদর্পণে থাকে। খুবই আবেগতাড়িত ছিলাম সে সময়।
১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত খবর ছিল ‘ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের সার্থক আলোচনা হচ্ছে’। অথচ শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নেশায় ইয়াহিয়া ভুট্টোদের কূটকৌশল মাথায় আনেননি বা ভাবেননি। প্রধানমন্ত্রিত্বের যে আশা দেশবাসীর ছিল, তা তারা এবার পাবেই। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা আর্মি ক্র্যাকডাউনের অর্ডার দিয়েই ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে অগোচরে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। কিন্তু ২৫ মার্চ রাত ১০টায় খবর ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী সমস্ত ঢাকা শহরে ধরপাকড় করবে এবং মানুষ হত্যা করবে। সে রাতে আমরা সেন্ট্রাল রোডে সব যা কিছু আছে তা দিয়ে ব্যারিকেট দিলাম আর অনেকে যার যার মতো তাদের ক্ষুদ্র শক্তি পাকিস্তানি আর্মির শক্তিশালী সৈন্যদের মোকাবিলায় রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেট দেয়, প্রতিরোধ-সংগ্রাম শুরু করতে হলো। কিন্তু রাত ১১টায় সেকি গুড়ুম গুড়ুম গোলাগুলি, মর্টারের শেলের আওয়াজ, ট্যাংকের গাড়ির আওয়াজ। অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত, আধুনিক কামান, গোলা, ট্যাংকের মুখে দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা, বিডিআর, পুলিশ আর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে।
২৫ মার্চের রাতের ধ্বংসযজ্ঞে সবাই বাসায় আবদ্ধ, ২৬ মার্চ কারফিউ থাকায় তাই কেউ রেডিও ধরতে পারিনি। তবে ২৬ তারিখ বাসার চিলেকোঠায় উঠে দেখলাম আর্মিরা গাড়িতে করে এদিক-সেদিক তাকিয়ে টহল দিচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি বসে পড়েছি বলে রক্ষা পেলাম, তা না হলে আমাকে দেখলে তারা নির্ঘাত গেটের ভেতরে ঢুকে পড়ে ধরে নিয়ে যেত। ২৬ মার্চ সারা দিন বাইরে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে আওয়াজ ও চিৎকার শোনা যাচ্ছিল বাইরে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। আর পূর্বদিক থেকেও গোলাগুলির আওয়াজ, ট্যাংক ও গাড়ির আওয়াজ আর গোলাগুলির শব্দ। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে সবাই আত্মীয়স্বজনের খোঁজে আর বাড়ি যেতে রাস্তায় বের হলেন।
শিক্ষার্থীদের খোঁজে ব্যস্ত সবাই। ঢাকা যেন এক বিভীশিকাময় নগরী। চারদিকে হায় হায় রব, সবাই যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেন্ট্রাল রোডের ওয়ালঘেঁষা কত যে নারী-পুরুষের লাশ, ভদ্র ড্রেস পরা, গুলি, বেয়নেটের আঘাতে মৃত্যু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলসহ প্রায় হলেই গুলিতে মারা গেছে ছাত্র-শিক্ষকরা। আগুনে ঠাটারীবাজার জ্বলছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অনেক পুলিশ অফিসার আক্রান্ত, মারা গেছেন অনেকে, গায়ে-পায়ে ড্রেস পর্যন্ত নেই। কমলাপুর রেলস্টেশনের শুকনো গর্তে দেখলাম অনেক ভদ্রলোকের লাশ। পাঞ্জাবি-জামা পরা ক্রেতাদুরস্ত লোক ছিলেন সবাই। আমারদিকে টহলরত আর্মি তাকালে আমি তাড়াতাড়ি কেটে পড়ে বাঁচি।
রাজারবাগ রেললাইনের ওপর আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তিনি আমার খোঁজে বের হয়েছেন, আমাকে পেয়ে আশ্বস্ত হলেন। শেষে মগবাজারের বাসায় আত্মীয়দের নিয়ে আমরা হেঁটে মেরাইদে গিয়ে ২৭ তারিখ ৫২ জন আত্মীয়স্বজন নিয়ে আমাদের দুধওয়ালার বাড়িতে আশ্রয় নিই।
মন ছিল খুব খারাপ, দিকভ্রান্ত, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশায় যারা এই হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে বুঝে উঠতে পারেনি, আমার কচিমনে রাগ হয়েছিল। দুধওয়ালা আমাদের যথেষ্ট আদর-আপ্যায়ন করেছেন এ জন্য যে, সেই লোক আমাদের পূর্বপরিচিত দুধওয়ালা, আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। তবু আমার মন ছিল খুব খারাপ। কারণ এখন কী হবে, দেশের কী হবে, দেশ কোন পথে যাবে, কে নেতৃত্ব দেবে, কে আশা-ভরসা দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি চিন্তায় মান খারাপ।
রেডিও হাতে গরুর খড়ের পালায় হেলান দিয়ে রেডিওর নব ঘোরাতেই দেখি এক সুন্দর সুস্পষ্ট মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা! ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে, দেশবাসীকে সহযোগিতা ও ধৈর্য ধরার আহ্বান করছি। আমি তো খুশিতে আটখানা। দৌড়ে গিয়ে ভাইকে বললাম, ভাই আর চিন্তা নেই, এক মেজর জিয়া স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়ে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে ও তাদের সহযোগিতার আশ্বাস চেয়েছে। ইথারে ইথারে ভেসে যে আওয়াজ তৎকালীন সাত কোটি মানুষের কানে সুধাসম স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণা শুনিয়েছিল এ দেশের রাজনীতিবিদদের, সাধারণ মানুষকে, ছাত্র-জনতা, কামার-কুমার, শিক্ষক, তাঁতি ও জেলে সবাইকে, সেই মুক্তিযুদ্ধের ফলে দেশের সবাই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে, বাংলাদেশ সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠ আজও কানে বাজে।
আমি মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি, সেই জিয়াকে মানুষ ভুলে কীভাবে!! কালক্রমে নিজের পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভুলে মানুষের চিন্তায় জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের প্রেসিডেন্ট জিয়া হয়েছিলেন। দেশের ভাবমূর্তি বিদেশে সমুন্নত করেছিলেন, দেশবরেণ্য নেতা হয়েছিলেন, শিক্ষায় মানুষের উন্নতি করেছেন তাকে আমরা ভুলি কী করে। জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণায় শুধু আমি নই, পুরো দেশের জনগণ সবার মুখেই উল্লাস ও হাসি ফুটে ওঠে। যাক, আমাদের জন্য একজন অন্তত স্বাধীনতাযুদ্ধে নেমেছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেনÑ তিনি একজন মেজর জিয়াউর রহমান, সময়কাল মার্চ, ১৯৭১। তখন প্রতিদিন রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে হাতের আঙুল ব্যথা করে ফেলেছি। সেই প্রিয় ঘোষণা, প্রিয় স্বাধীনতার ঘোষকের কণ্ঠের জন্য, সেই গলার স্বর এখনো আমার কানে বাজে।
লেখক : সাবেক প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, প্রাণরসায়ন এবং অণুপ্রান বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠাতা, নিউরোসায়েন্স রিসার্চ সেন্টার অব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণা ছিল১৯৭০ সালেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে জয়ী হবে বলে জনজোয়ার তৈরি হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভাবত যে চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই হবে। কারণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর ভুট্টোরা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তাদের শোষণ-নিপীড়ন-রীতি-নীতেতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মন বিষিয়ে ওঠে। এর মধ্যে জুলফিকার ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে কূটকৌশল শুরু করে। বলেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তাদের ক্ষমতায় বসানো হবে না। তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের শত্রু। সে সময় প্রলয়ংকরী বন্যায় বাংলাদেশ ভেসে যায় কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো উল্লেখযোগ্য নেতা বাংলাদেশে আসেননি। লে. জেনারেল আযম খান তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মঙ্গল কামনা করতেন এবং সেভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার জনগণের মতপার্থক্য চরম প্রকট হয়ে ওঠে।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শুধু পূর্ব পাকিস্তানের পাট, চা, চামড়া ও অন্যান্য রপ্তানিযোগ্য পণ্যের রপ্তানি আয় নেওয়ার জন্যই যেন পূর্ব পাকিস্তানকে সৃষ্টি করেছে। অথচ পাকিস্তান তৈরির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা। বন্যার করাল গ্রাস অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা না আসায় মওলানা ভাসানী অলাইকুম আসসালাম বলে তাদের বিদায় জানালেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু ইয়াহিয়া গায়ের জোরে ১ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন বাতিল করেন। গর্জে ওঠে জনগণ, নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। জনরোষে ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে, শেখ মুজিব অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। আমরা তখন তরুণ টগবগে যুবক, সারা দিন মিটিং-মিছিলে কাটিয়েছি। নিজেদের বাসা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সেন্ট্রাল রোডের এক চাচার বাসায় একটি খালি ফ্ল্যাটে থাকি। যাতে করে সব খবর নখদর্পণে থাকে। খুবই আবেগতাড়িত ছিলাম সে সময়।
১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত খবর ছিল ‘ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের সার্থক আলোচনা হচ্ছে’। অথচ শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নেশায় ইয়াহিয়া ভুট্টোদের কূটকৌশল মাথায় আনেননি বা ভাবেননি। প্রধানমন্ত্রিত্বের যে আশা দেশবাসীর ছিল, তা তারা এবার পাবেই। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা আর্মি ক্র্যাকডাউনের অর্ডার দিয়েই ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে অগোচরে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। কিন্তু ২৫ মার্চ রাত ১০টায় খবর ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী সমস্ত ঢাকা শহরে ধরপাকড় করবে এবং মানুষ হত্যা করবে। সে রাতে আমরা সেন্ট্রাল রোডে সব যা কিছু আছে তা দিয়ে ব্যারিকেট দিলাম আর অনেকে যার যার মতো তাদের ক্ষুদ্র শক্তি পাকিস্তানি আর্মির শক্তিশালী সৈন্যদের মোকাবিলায় রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেট দেয়, প্রতিরোধ-সংগ্রাম শুরু করতে হলো। কিন্তু রাত ১১টায় সেকি গুড়ুম গুড়ুম গোলাগুলি, মর্টারের শেলের আওয়াজ, ট্যাংকের গাড়ির আওয়াজ। অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত, আধুনিক কামান, গোলা, ট্যাংকের মুখে দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা, বিডিআর, পুলিশ আর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে।
২৫ মার্চের রাতের ধ্বংসযজ্ঞে সবাই বাসায় আবদ্ধ, ২৬ মার্চ কারফিউ থাকায় তাই কেউ রেডিও ধরতে পারিনি। তবে ২৬ তারিখ বাসার চিলেকোঠায় উঠে দেখলাম আর্মিরা গাড়িতে করে এদিক-সেদিক তাকিয়ে টহল দিচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি বসে পড়েছি বলে রক্ষা পেলাম, তা না হলে আমাকে দেখলে তারা নির্ঘাত গেটের ভেতরে ঢুকে পড়ে ধরে নিয়ে যেত। ২৬ মার্চ সারা দিন বাইরে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে আওয়াজ ও চিৎকার শোনা যাচ্ছিল বাইরে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। আর পূর্বদিক থেকেও গোলাগুলির আওয়াজ, ট্যাংক ও গাড়ির আওয়াজ আর গোলাগুলির শব্দ। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে সবাই আত্মীয়স্বজনের খোঁজে আর বাড়ি যেতে রাস্তায় বের হলেন।
শিক্ষার্থীদের খোঁজে ব্যস্ত সবাই। ঢাকা যেন এক বিভীশিকাময় নগরী। চারদিকে হায় হায় রব, সবাই যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেন্ট্রাল রোডের ওয়ালঘেঁষা কত যে নারী-পুরুষের লাশ, ভদ্র ড্রেস পরা, গুলি, বেয়নেটের আঘাতে মৃত্যু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলসহ প্রায় হলেই গুলিতে মারা গেছে ছাত্র-শিক্ষকরা। আগুনে ঠাটারীবাজার জ্বলছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অনেক পুলিশ অফিসার আক্রান্ত, মারা গেছেন অনেকে, গায়ে-পায়ে ড্রেস পর্যন্ত নেই। কমলাপুর রেলস্টেশনের শুকনো গর্তে দেখলাম অনেক ভদ্রলোকের লাশ। পাঞ্জাবি-জামা পরা ক্রেতাদুরস্ত লোক ছিলেন সবাই। আমারদিকে টহলরত আর্মি তাকালে আমি তাড়াতাড়ি কেটে পড়ে বাঁচি।
রাজারবাগ রেললাইনের ওপর আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তিনি আমার খোঁজে বের হয়েছেন, আমাকে পেয়ে আশ্বস্ত হলেন। শেষে মগবাজারের বাসায় আত্মীয়দের নিয়ে আমরা হেঁটে মেরাইদে গিয়ে ২৭ তারিখ ৫২ জন আত্মীয়স্বজন নিয়ে আমাদের দুধওয়ালার বাড়িতে আশ্রয় নিই।
মন ছিল খুব খারাপ, দিকভ্রান্ত, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশায় যারা এই হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে বুঝে উঠতে পারেনি, আমার কচিমনে রাগ হয়েছিল। দুধওয়ালা আমাদের যথেষ্ট আদর-আপ্যায়ন করেছেন এ জন্য যে, সেই লোক আমাদের পূর্বপরিচিত দুধওয়ালা, আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। তবু আমার মন ছিল খুব খারাপ। কারণ এখন কী হবে, দেশের কী হবে, দেশ কোন পথে যাবে, কে নেতৃত্ব দেবে, কে আশা-ভরসা দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি চিন্তায় মান খারাপ।
রেডিও হাতে গরুর খড়ের পালায় হেলান দিয়ে রেডিওর নব ঘোরাতেই দেখি এক সুন্দর সুস্পষ্ট মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা! ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে, দেশবাসীকে সহযোগিতা ও ধৈর্য ধরার আহ্বান করছি। আমি তো খুশিতে আটখানা। দৌড়ে গিয়ে ভাইকে বললাম, ভাই আর চিন্তা নেই, এক মেজর জিয়া স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়ে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে ও তাদের সহযোগিতার আশ্বাস চেয়েছে। ইথারে ইথারে ভেসে যে আওয়াজ তৎকালীন সাত কোটি মানুষের কানে সুধাসম স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণা শুনিয়েছিল এ দেশের রাজনীতিবিদদের, সাধারণ মানুষকে, ছাত্র-জনতা, কামার-কুমার, শিক্ষক, তাঁতি ও জেলে সবাইকে, সেই মুক্তিযুদ্ধের ফলে দেশের সবাই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে, বাংলাদেশ সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠ আজও কানে বাজে।
আমি মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি, সেই জিয়াকে মানুষ ভুলে কীভাবে!! কালক্রমে নিজের পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভুলে মানুষের চিন্তায় জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের প্রেসিডেন্ট জিয়া হয়েছিলেন। দেশের ভাবমূর্তি বিদেশে সমুন্নত করেছিলেন, দেশবরেণ্য নেতা হয়েছিলেন, শিক্ষায় মানুষের উন্নতি করেছেন তাকে আমরা ভুলি কী করে। জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণায় শুধু আমি নই, পুরো দেশের জনগণ সবার মুখেই উল্লাস ও হাসি ফুটে ওঠে। যাক, আমাদের জন্য একজন অন্তত স্বাধীনতাযুদ্ধে নেমেছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেনÑ তিনি একজন মেজর জিয়াউর রহমান, সময়কাল মার্চ, ১৯৭১। তখন প্রতিদিন রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে হাতের আঙুল ব্যথা করে ফেলেছি। সেই প্রিয় ঘোষণা, প্রিয় স্বাধীনতার ঘোষকের কণ্ঠের জন্য, সেই গলার স্বর এখনো আমার কানে বাজে।
লেখক : সাবেক প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, প্রাণরসায়ন এবং অণুপ্রান বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠাতা, নিউরোসায়েন্স রিসার্চ সেন্টার অব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে