
এলাহী নেওয়াজ খান

অতি-রাজনীতির শাসন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক সমস্যা ও সংকট নিয়ে আলোচনাকে দূরে সরিয়ে রাখে। বলা যায়, রাজনৈতিক ভাবনা আমাদের বোধশক্তিকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। ভাবখানা এমন যে, রাজনীতির বাইরে বুঝি আর কোনো সমস্যা নেই, কিংবা থাকতে পারে না। সম্ভবত আমাদের চারপাশের পাহাড়সমান সমস্যাগুলো সমাধান করার অক্ষমতা থেকে এই এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তাই আজ আমার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে ঢাকা মহানগরীর অন্তহীন সংকট নিয়ে কিছু কথা।
পাকিস্তান আমল থেকে বাসে ও রিকশায় চলাচল করার অভিজ্ঞতা থেকে আজ এ কথা বলতে পারি, চলাফেরার ক্ষেত্রে আমাদের এই প্রিয় নগরী প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। একদিকে ফুটপাতে হকারদের রাজত্ব এবং অন্যদিকে রাজপথে অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, বেবিট্যাক্সি, কাভার্ডভ্যান, যাত্রীবাহী বাসসহ নানা যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল প্রতি মুহূর্তেই জীবনের ঝুঁকি তৈরি করে। তীব্র গতিতে ছুটে আসা অটোরিকশার দাপটে রাস্তা পারাপার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে নারী ও শিশুদের রাস্তা পারাপার। যাত্রী নিয়ে দ্রুতগতিতে চলতে চলতে যানবাহনের উল্টে পড়ার দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে। প্রতিদিনই ঘটছে এ ধরনের দুর্ঘটনা। এতে ভেঙে পড়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাও। তাই জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনটার মতোই বলা যায়, অদ্ভুত এক বিপর্যয় নেমে এসেছে ঢাকায়। এতটা বিশৃঙ্খল নগরী হয়তো আর কোনো দেশে নেই। দক্ষিণ এশিয়ার নগরীগুলোর মধ্যে সম্ভবত ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৫৪ বছরে কোনো সরকারই ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ঠিক করতে পারেনি। বরং দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে একদিকে যেমন ঢুকছে গ্রাম থেকে আসা জনতার স্রোত, অন্যদিকে প্রতিদিন অলিগলি ও প্রধান প্রধান সড়কে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে অটোরিকশার চলাচল। এগুলো আগে অলিগলিতে চলত; কিন্তু গত এক বছরে বিশেষ করে গত কয়েক মাসে ঢাকার প্রায় সব সড়কে তাদের দাপটের সীমা ছাড়িয়েছে। যেভাবে প্রতিদিন অটোরিকশার সংখ্যা বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে ঢাকার রাজপথ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়বে।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আমরা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের উদ্যোগে বিভিন্ন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে বাতাসের ক্ষতিকর দূষণ কমাতে ব্যাটারিচালিত ছোট যানবাহনের পক্ষে ওকালতি করেছিলাম। ১৯৯০ সালের দিকে পরিবেশবিষয়ক একটি সেমিনারে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে গিয়ে এ রকম ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দেখে আমরা আরো উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। তখন আমাদের কথা কে কতটুকু শুনেছিল জানি না, তবে পরবর্তী সময়ে তথা বিগত এক দশকে বণিকের মুনাফার লোভের কারণে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, টেম্পো ও ভ্যান ঢাকার রাস্তাঘাটে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সবকিছুরই ধারণ ও বহন করার একটা সীমা থাকে। যেমন এই রাজধানী নগরী কত জনসংখ্যা এবং এর সড়কগুলো কত যানবাহন ধারণ করতে পারবে, তার একটা সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করলে বিপর্যয় নেমে আসাই স্বাভাবিক, যেটা ঢাকায় এখন আমরা দেখছি।
বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, একটি আধুনিক ম্যাগাসিটিতে যেখানে রাস্তা দরকার ২৫ শতাংশ, সেখানে ঢাকায় রাস্তার পরিমাণ মাত্র আট থেকে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি মহানগর বা মেগাসিটির জনঘনত্বের মানদণ্ড ধরা হয় প্রতি একরে ১২০ জন। কিন্তু ঢাকার ৬৩ শতাংশ এলাকায় প্রতি একরে জনঘনত্ব ৩০০ জনের বেশি। এমনকি ৪০ শতাংশ এলাকায় এই সংখ্যা ৪০০ জনের বেশি। এছাড়া লালবাগ, বংশাল, গেন্ডারিয়া ও সবুজবাগ এলাকায় জনঘনত্ব প্রতি একরে ৭০০ থেকে ৮০০ জন, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। আধুনিক নগরীর প্রতি একরে যেখানে ৭০ থেকে ৮০ জন বাস করার কথা, সেখানে ঢাকায় বাস করে ৭০০ জন। এ অবস্থা থেকে বোঝা যায়, ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে আট শতাংশ সড়কে যে পরিমাণ যানবাহন চলার কথা, তার থেকে কয়েকশ গুণ বেশি চলাচল করে। ফলে আমরা কতটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এর সঙ্গে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো যুক্ত হয়েছে অটোরিকশা, যার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আগে ঢাকা মহানগরীতে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের লাইসেন্স ছাড়া কোনো রিকশা চলতে পারত না। কিন্তু অটোরিকশার ব্যাপারে লাইসেন্সের কোনো বালাই নেই। ফলে এগুলোর সংখ্যা অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে। গত কয়েক মাসে ঢাকায় জনসংখ্যা ও অটোরিকশা বাড়ছে সমান তালে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, হঠাৎ করে কোথা থেকে এত অটোরিকশা ঢাকায় আসছে? খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, কোনো লাইসেন্স যেহেতু লাগে না, তাই কারখানাগুলোয় যেমন উৎপাদন বেড়েছে, তেমনি অধিক আয়ের জন্য ঢাকার আশেপাশের অঞ্চল থেকেও বন্যার স্রোতের মতো অটোরিকশা ঢাকায় আসছে। এছাড়া আরেকটি বড় খবর হচ্ছে, সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীতে অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ হওয়ায় সেগুলোও চলে আসছে ঢাকায়।
এ অবস্থায় বর্তমানে প্যাডেলওয়ালা রিকশা প্রায় উধাও হয়ে গেছে। ওই রিকশা-চালকরা অটোরিকশার চাপে এবং অধিক আয়ের লোভে অটোরিকশা-চালকে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। তা হচ্ছে, কৃষিমজুরদের অটোরিকশা শ্রমিকে পরিণত হওয়া। এ ব্যাপারে আমি বেশ কয়েকজন অটোরিকশা-চালককে জিজ্ঞেস করেছি, ‘আপনি এর আগে কী করতেন?’ অধিকাংশ চালকই জবাব দিয়েছেন, তারা কৃষিশ্রমিক ছিলেন। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের কৃষিভিত্তিক সমাজের ব্যাপক একটা পরিবর্তন ঘটেছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই কৃষি উৎপাদনের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এতে গ্রামে এখন কৃষিশ্রমিকের অভাব প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে। কৃষিশ্রমিকের অভাবে জমির আবাদও অনেক কমে গেছে, যার ফলে শাকসবজি ও তরিতরকারির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে বারবার।
বর্তমানে হাজার হাজার কৃষিমজুর মাইগ্রেট করছে ছোট-বড় সব শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় আগমনের স্রোত সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় এখন অটোরিকশার সংখ্যা এতটাই বেশি যে, তা নিয়ন্ত্রণের করার বাইরে চলে গেছে। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকার যদি প্রধান প্রধান সড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়, কিংবা এর সংখ্যা সীমিত করে বলে, লাইসেন্স ছাড়া কোনো অটোরিকশা ঢাকার রাস্তায় চলতে পারবে না, তখন তারা রাস্তায় নেমে ঢাকা নগর অচল করে দেবে। বিগত দিনে কয়েকবার তারা এটা করেছে।
তাই সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এটা বোঝা যাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। একইভাবে আবাসন বৃদ্ধির সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে বহুতলাবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এ কারণেই যেখানে একটি মহল্লায় পাঁচ হাজার লোক বাস করত, সেখানে এখন বাস করে হয়তো এক লাখ লোক। কালোটাকা আবাসনে ব্যয় করার সুযোগ থাকায় এ রকম একটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক মেগাসিটিতে যেখানে-সেখানে বহুতলবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট করার সুযোগ নেই।
এ রকম একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গেলে অবশ্যই ব্যাপক ভিত্তিতে নীতিমালা থাকা দরকার। কৃষি খাতকে রক্ষা করতে হলে উপার্জনের জন্য আসা মানুষগুলোকে থামাতে হবে। কোথায় কত তলা ভবন হবে, সে ব্যাপারে কঠিন আইন করা জরুরি। যানবাহন চলাচলে প্রণয়ন করতে হবে কঠিন নীতিমালা। বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক নগরীতে সব নম্বরের গাড়ি এক দিনে চলাচল করে না। একেক নম্বরের গাড়ি একেক দিন চলে। অর্থাৎ আজকে যে নম্বরে গাড়ি চলছে, আগামীকাল সে গাড়ি চলবে না। নগরীতে চলাচলকারী বাসগুলোর জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন। কারণ অনেক ক্ষেত্রে বাসচালকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে থাকে।
সবশেষে অটোরিকশার দৌরাত্ম্য কমানোর লক্ষ্যে এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অটোরিকশার সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত সীমার মধ্যে আনা যাবে। এক্ষেত্রে শুধু এই নগরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই জরুরি নয়, পরিবেশ রক্ষার জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অটোরিকশার নষ্ট ব্যাটারিগুলোর যত্রতত্র ডাম্পিং নগরীর পরিবেশকে আরো বিপজ্জনক করে তুলবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

অতি-রাজনীতির শাসন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক সমস্যা ও সংকট নিয়ে আলোচনাকে দূরে সরিয়ে রাখে। বলা যায়, রাজনৈতিক ভাবনা আমাদের বোধশক্তিকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। ভাবখানা এমন যে, রাজনীতির বাইরে বুঝি আর কোনো সমস্যা নেই, কিংবা থাকতে পারে না। সম্ভবত আমাদের চারপাশের পাহাড়সমান সমস্যাগুলো সমাধান করার অক্ষমতা থেকে এই এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তাই আজ আমার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে ঢাকা মহানগরীর অন্তহীন সংকট নিয়ে কিছু কথা।
পাকিস্তান আমল থেকে বাসে ও রিকশায় চলাচল করার অভিজ্ঞতা থেকে আজ এ কথা বলতে পারি, চলাফেরার ক্ষেত্রে আমাদের এই প্রিয় নগরী প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। একদিকে ফুটপাতে হকারদের রাজত্ব এবং অন্যদিকে রাজপথে অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, বেবিট্যাক্সি, কাভার্ডভ্যান, যাত্রীবাহী বাসসহ নানা যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল প্রতি মুহূর্তেই জীবনের ঝুঁকি তৈরি করে। তীব্র গতিতে ছুটে আসা অটোরিকশার দাপটে রাস্তা পারাপার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে নারী ও শিশুদের রাস্তা পারাপার। যাত্রী নিয়ে দ্রুতগতিতে চলতে চলতে যানবাহনের উল্টে পড়ার দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে। প্রতিদিনই ঘটছে এ ধরনের দুর্ঘটনা। এতে ভেঙে পড়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাও। তাই জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনটার মতোই বলা যায়, অদ্ভুত এক বিপর্যয় নেমে এসেছে ঢাকায়। এতটা বিশৃঙ্খল নগরী হয়তো আর কোনো দেশে নেই। দক্ষিণ এশিয়ার নগরীগুলোর মধ্যে সম্ভবত ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৫৪ বছরে কোনো সরকারই ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ঠিক করতে পারেনি। বরং দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে একদিকে যেমন ঢুকছে গ্রাম থেকে আসা জনতার স্রোত, অন্যদিকে প্রতিদিন অলিগলি ও প্রধান প্রধান সড়কে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে অটোরিকশার চলাচল। এগুলো আগে অলিগলিতে চলত; কিন্তু গত এক বছরে বিশেষ করে গত কয়েক মাসে ঢাকার প্রায় সব সড়কে তাদের দাপটের সীমা ছাড়িয়েছে। যেভাবে প্রতিদিন অটোরিকশার সংখ্যা বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে ঢাকার রাজপথ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়বে।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আমরা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের উদ্যোগে বিভিন্ন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে বাতাসের ক্ষতিকর দূষণ কমাতে ব্যাটারিচালিত ছোট যানবাহনের পক্ষে ওকালতি করেছিলাম। ১৯৯০ সালের দিকে পরিবেশবিষয়ক একটি সেমিনারে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে গিয়ে এ রকম ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দেখে আমরা আরো উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। তখন আমাদের কথা কে কতটুকু শুনেছিল জানি না, তবে পরবর্তী সময়ে তথা বিগত এক দশকে বণিকের মুনাফার লোভের কারণে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, টেম্পো ও ভ্যান ঢাকার রাস্তাঘাটে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সবকিছুরই ধারণ ও বহন করার একটা সীমা থাকে। যেমন এই রাজধানী নগরী কত জনসংখ্যা এবং এর সড়কগুলো কত যানবাহন ধারণ করতে পারবে, তার একটা সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করলে বিপর্যয় নেমে আসাই স্বাভাবিক, যেটা ঢাকায় এখন আমরা দেখছি।
বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, একটি আধুনিক ম্যাগাসিটিতে যেখানে রাস্তা দরকার ২৫ শতাংশ, সেখানে ঢাকায় রাস্তার পরিমাণ মাত্র আট থেকে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি মহানগর বা মেগাসিটির জনঘনত্বের মানদণ্ড ধরা হয় প্রতি একরে ১২০ জন। কিন্তু ঢাকার ৬৩ শতাংশ এলাকায় প্রতি একরে জনঘনত্ব ৩০০ জনের বেশি। এমনকি ৪০ শতাংশ এলাকায় এই সংখ্যা ৪০০ জনের বেশি। এছাড়া লালবাগ, বংশাল, গেন্ডারিয়া ও সবুজবাগ এলাকায় জনঘনত্ব প্রতি একরে ৭০০ থেকে ৮০০ জন, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। আধুনিক নগরীর প্রতি একরে যেখানে ৭০ থেকে ৮০ জন বাস করার কথা, সেখানে ঢাকায় বাস করে ৭০০ জন। এ অবস্থা থেকে বোঝা যায়, ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে আট শতাংশ সড়কে যে পরিমাণ যানবাহন চলার কথা, তার থেকে কয়েকশ গুণ বেশি চলাচল করে। ফলে আমরা কতটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এর সঙ্গে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো যুক্ত হয়েছে অটোরিকশা, যার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আগে ঢাকা মহানগরীতে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের লাইসেন্স ছাড়া কোনো রিকশা চলতে পারত না। কিন্তু অটোরিকশার ব্যাপারে লাইসেন্সের কোনো বালাই নেই। ফলে এগুলোর সংখ্যা অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে। গত কয়েক মাসে ঢাকায় জনসংখ্যা ও অটোরিকশা বাড়ছে সমান তালে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, হঠাৎ করে কোথা থেকে এত অটোরিকশা ঢাকায় আসছে? খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, কোনো লাইসেন্স যেহেতু লাগে না, তাই কারখানাগুলোয় যেমন উৎপাদন বেড়েছে, তেমনি অধিক আয়ের জন্য ঢাকার আশেপাশের অঞ্চল থেকেও বন্যার স্রোতের মতো অটোরিকশা ঢাকায় আসছে। এছাড়া আরেকটি বড় খবর হচ্ছে, সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীতে অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ হওয়ায় সেগুলোও চলে আসছে ঢাকায়।
এ অবস্থায় বর্তমানে প্যাডেলওয়ালা রিকশা প্রায় উধাও হয়ে গেছে। ওই রিকশা-চালকরা অটোরিকশার চাপে এবং অধিক আয়ের লোভে অটোরিকশা-চালকে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। তা হচ্ছে, কৃষিমজুরদের অটোরিকশা শ্রমিকে পরিণত হওয়া। এ ব্যাপারে আমি বেশ কয়েকজন অটোরিকশা-চালককে জিজ্ঞেস করেছি, ‘আপনি এর আগে কী করতেন?’ অধিকাংশ চালকই জবাব দিয়েছেন, তারা কৃষিশ্রমিক ছিলেন। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের কৃষিভিত্তিক সমাজের ব্যাপক একটা পরিবর্তন ঘটেছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই কৃষি উৎপাদনের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এতে গ্রামে এখন কৃষিশ্রমিকের অভাব প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে। কৃষিশ্রমিকের অভাবে জমির আবাদও অনেক কমে গেছে, যার ফলে শাকসবজি ও তরিতরকারির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে বারবার।
বর্তমানে হাজার হাজার কৃষিমজুর মাইগ্রেট করছে ছোট-বড় সব শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় আগমনের স্রোত সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় এখন অটোরিকশার সংখ্যা এতটাই বেশি যে, তা নিয়ন্ত্রণের করার বাইরে চলে গেছে। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকার যদি প্রধান প্রধান সড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়, কিংবা এর সংখ্যা সীমিত করে বলে, লাইসেন্স ছাড়া কোনো অটোরিকশা ঢাকার রাস্তায় চলতে পারবে না, তখন তারা রাস্তায় নেমে ঢাকা নগর অচল করে দেবে। বিগত দিনে কয়েকবার তারা এটা করেছে।
তাই সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এটা বোঝা যাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। একইভাবে আবাসন বৃদ্ধির সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে বহুতলাবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এ কারণেই যেখানে একটি মহল্লায় পাঁচ হাজার লোক বাস করত, সেখানে এখন বাস করে হয়তো এক লাখ লোক। কালোটাকা আবাসনে ব্যয় করার সুযোগ থাকায় এ রকম একটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক মেগাসিটিতে যেখানে-সেখানে বহুতলবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট করার সুযোগ নেই।
এ রকম একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গেলে অবশ্যই ব্যাপক ভিত্তিতে নীতিমালা থাকা দরকার। কৃষি খাতকে রক্ষা করতে হলে উপার্জনের জন্য আসা মানুষগুলোকে থামাতে হবে। কোথায় কত তলা ভবন হবে, সে ব্যাপারে কঠিন আইন করা জরুরি। যানবাহন চলাচলে প্রণয়ন করতে হবে কঠিন নীতিমালা। বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক নগরীতে সব নম্বরের গাড়ি এক দিনে চলাচল করে না। একেক নম্বরের গাড়ি একেক দিন চলে। অর্থাৎ আজকে যে নম্বরে গাড়ি চলছে, আগামীকাল সে গাড়ি চলবে না। নগরীতে চলাচলকারী বাসগুলোর জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন। কারণ অনেক ক্ষেত্রে বাসচালকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে থাকে।
সবশেষে অটোরিকশার দৌরাত্ম্য কমানোর লক্ষ্যে এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অটোরিকশার সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত সীমার মধ্যে আনা যাবে। এক্ষেত্রে শুধু এই নগরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই জরুরি নয়, পরিবেশ রক্ষার জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অটোরিকশার নষ্ট ব্যাটারিগুলোর যত্রতত্র ডাম্পিং নগরীর পরিবেশকে আরো বিপজ্জনক করে তুলবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। দেশকে দ্রুতই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যাতে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বায়োমাস, বর্জ্য থেকে জ্বালানি, জৈবজ্বালানি, ভূ-তাপীয় শক্তি, জোয়ার-ভাটা শক্তি...
১২ ঘণ্টা আগে
রাজশাহীর যে শহর একসময় পদ্মা, বারনই, নবগঙ্গা, বারহী, বড়াল, শিবনদী আর অসংখ্য খাল-বিলের জলধারায় জীবন্ত ছিল, আজ সেখানে কেবল শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ আর বিষাক্ত বর্জ্যের স্তুপ। নদী ছিল এই শহরের প্রাণ, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের মূল উৎস।
১৩ ঘণ্টা আগে
সাধারণত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা জানেন সময় কত বেশি মূল্যবান। একটি প্রবাদ আছেÑ‘সময় হলো সোনার মতো দামি’। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করেন। আর ইসলামে সময় স্বর্ণ কিংবা বিশ্বের যেকোনো মূল্যবান বস্তুর চেয়ে বেশি দামি। সময়ের মূল্য কী, ইসলাম শুধু তা-ই শেখায় না। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ইসলাম মানবজাতিকে বিশেষভাবে শেখ
২০ ঘণ্টা আগে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংশ্লিষ্টতার পক্ষে ঢোল জোরেশোরেই বাজছে ওয়াশিংটনে। নীতিনির্ধারণী মহলে কেউ কেউ ফিসফিস করে আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে চিৎকার করে বলছেন গাজায় সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য।
২০ ঘণ্টা আগে