বাংলাদেশের টিকে থাকার শর্ত

মেহেদী হাসান
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৫, ১১: ৩৮

বাংলাদেশের তিনদিকে ভারতের সীমান্ত। ভারত চায় না বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং শক্তিশালী দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। কারণ শক্তিশালী বাংলাদেশ ভারতের অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ভারতের যেমন সাহায্য রয়েছে, তেমনি এর পেছনে ছিল ষড়যন্ত্র।

ভারত তার স্বার্থে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এ দেশের মানুষের প্রতি দয়া বা করুণা নয়, বরং ভারত তার ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করতে ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তান বানানোর জন্য ভারত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করেনি।

বিজ্ঞাপন

ভারত যেসব কারণে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করতে চেয়েছিল, তা আজও পুরোপুরি দূর হয়নি। এটি দূর করা সম্ভব শুধু বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর বা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার মাধ্যমে। সেটি করতে পুরোপুরি সক্ষম না হলেও নয়াদিল্লির ন্যূনতম চাওয়া হলো বাংলাদেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং নতজানু করে রাখা। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ভারত সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভারত এ ক্ষেত্রে কখনো আংশিক এবং কখনো পুরোপুরো সফল হয়েছে ।

বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমার। এ দেশটিও বাংলাদেশের প্রতি চরম বৈরী এক প্রতিবেশী। দীর্ঘকাল ধরে জাতিগত সংঘাত ও গৃহযুদ্ধকবলিত দেশটিতে রয়েছে চীনের ব্যাপক প্রভাব। মাঝেমধ্যে ভারতও কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় দেশটির ওপর।

মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো-বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে এবং বশে আনার জন্য বৃহৎ বিভিন্ন শক্তি মিয়ানমারকে ব্যবহার করতে পারে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ভবিষ্যতে মিয়ানমার পরিণত হতে পারে বৃহৎ পরাশক্তির প্রক্সি শক্তিতে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে বিরাজ করছে।

এ ধরনের প্রতিকূল প্রতিবেশী পরিবেষ্টিত ও ভৌগোলিক অবস্থানে অবস্থিত বাংলাদেশের মতো একটি দেশের সত্যিকারের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা নির্ভর করে কতগুলো শর্ত জোরালোভাবে কার্যকর থাকার ওপর। এই শর্তগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি হলো চৌকস নেতৃত্ব, যোগ্য নেতৃত্ব বিকাশের ব্যবস্থা এবং ঐক্যবদ্ধ সচেতন জনগণ। এ ছাড়া কার্যকর গণতন্ত্র, প্রযুক্তিনির্ভর শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, সক্ষম প্রতিটি নাগরিকের সামরিক প্রশিক্ষণ এবং জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের মালিকানাবোধ সৃষ্টি করা অন্যতম শর্ত।

এমন একটি রাষ্ট্রকাঠামো ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যাতে প্রতিটি নাগরিক তার দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে টের পান, আসলেই তিনি এ দেশের একজন মালিক। প্রতিটি মানুষকে বুঝতে পারতে হবে এ দেশ তার । তিনি অত্যাচারী কোনো শাসক দ্বারা শোষিত, নিপীড়িত নন। রাষ্ট্রযন্ত্র আর সরকার তার অধিকার হরণ আর নিরাপত্তা কেড়ে নেওয়ার কোনো হাতিয়ার নয়, বরং প্রকৃত অর্থেই রাষ্ট্র ও সরকার জনগণের সেবক ও রক্ষক।

একই সঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শত্রু এবং নিরাপত্তা সংকট সম্পর্কে জনসাধারণকে সর্বদা সচেতন রাখা, ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে প্রত্যেককে দেশের স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দেওয়ার বিষয়ে ভাবতে শেখানোর ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের টিকে থাকার শর্তগুলো আরো বিস্তারিতভাবে চিহ্নিত করে তা মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

শত্রুকে মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ, সার্বভৌম, মর্যাদাবান রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ও সচেতন করার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কৌশল নির্ধারণ করা অপরিহার্য। এ-বিষয়ক বয়ান রচনা ও প্রচার, বাংলাদেশের শত্রু-মিত্র, সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে তা জনগণকে ক্রমাগতভাবে অবহিত করতে হবে খোলাখুলিভাবে। জনগণের মধ্যে সদা কার্যকর রাখার ব্যবস্থা করতে হবে উদ্যম, প্রেরণা আর ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবেশ।

স্বাধীনতার পর থেকে এই দায়িত্ব পালনের কথা ছিল প্রতিটি সরকারের এবং রাজনীতিবিদদের। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এ দায়িত পালনের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার জাতিকে বিভক্ত করেছে। ৫৩ বছরে এ দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

স্বাধীনতার পর তিনিই দেশকে ভারতের গোলামির জিঞ্জির এবং শেখ মুজিবুর রহমানের দুঃশাসনে সৃষ্টি দুর্ভিক্ষ আর বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে অতিদ্রুত বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্রুত তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষকে তিনি আবার জাগিয়ে তুললেন নতুন উদ্যমে, নতুন প্রেরণায়।

স্বাধীনতার পর মোহভঙ্গ আর বিধ্বস্ত জাতির মধ্যে তিনি নতুন প্রাণের সঞ্চার করলেন। গত ৫৩ বছরের শাসনামলে জিয়াউর রহমানই একমাত্র নেতা, যিনি সীমিত সময়ের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই একজন রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠেছিলেন এবং সম্পূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের।

তার হাত ধরেই বাংলাদেশ তখন টিকে গিয়েছিল একটি সত্যিকার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। বাংলাদেশের টিকে থাকার ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হলো ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব আর এ ক্ষেত্রে এ দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে একমাত্র উদাহরণ হলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

বাংলাদেশের যে দল ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ধারা তাতে দীর্ঘকাল ধরে নেতৃত্ব তৈরি এবং বিকাশের পথ রুদ্ধ। এখানে একটি দলে কোনো নেতা যতই যোগ্য হোক না কেন, ক্ষমতায় গেলে বড়জোর তিনি একজন মন্ত্রী হতে পারবেন, প্রধানমন্ত্রী নন। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান দল দুটির মধ্যে নেতৃত্ব বিকাশের পথ রুদ্ধ থাকা বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ। কারণ উপযুক্ত নেতা ছাড়া কোনো দেশ, কোনো জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, এমনকি টিকে থাকতেও পারে না।

২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে যে নজিরবিহীন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা হয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসন এবং ভারতীয় সর্বগ্রাসী আধিপত্যের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হিসেবে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে এ ধরনের ঐক্য আর ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেরণা তৈরির ব্যবস্থা চালু করা উচিত ছিল সরকারের পক্ষ থেকে।

প্রতিটি সরকার যদি এ দায়িত্ব পালন করত, তাহলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সাড়ে ১৫ বছর টানা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং টিকিয়ে রাখতে পারতেন না। দেশের মানুষকেও বারবার ক্ষমতা থেকে স্বৈরশাসকদের টেনে নামাতে রাজপথে জীবন দিতে হতো না।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তনের পর দুই পর্বে ২০ বছরের বেশি দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ এই শাসনামলে আওয়ামী লীগের মূল কাজ ছিল কীভাবে বিরোধীদের দমন করে ক্ষমতাকে আজীবনের জন্য কুক্ষিগত করা যায়, তার ষড়যন্ত্র করা। এ ক্ষেত্রে তারা অবলম্বন করে নিষ্ঠুর উপায়ে বিরোধী দমনের পথ এবং দেশের স্বার্থ ভারতের পায়ে বিকিয়ে দেওয়ার নীতি।

ক্ষমতায় থেকে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বরং সদা চেষ্টা করেছে বিভক্ত সৃষ্টিতে । রাষ্ট্রীয়পর্যায় থেকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভক্তি আর হানাহানির বয়ান। আর এভাবে প্রতিবারই আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার যে শর্ত, তা চূড়ান্তভাবে নস্যাৎ হয়েছে। ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। ধ্বংস হয়েছে দেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আর নিরাপত্তাব্যবস্থা, যা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে একটি দেশকে।

অন্যদিকে ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় ছিল দুই মেয়াদে ১০ বছর। দেশ পরিচালনায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শের ধারা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় বহাল ছিল এ সময়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির দুই মেয়াদের এই শাসনামলে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল বিএনপিকে শান্তিতে দেশ পরিচালনা করতে না দেওয়া, দেশকে অস্থিতিশীল করা। প্রতি মেয়াদে বছরজুড়ে লাগাতার হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে ব্যস্ত রেখেছে তাদের মোকাবিলার জন্য।

ফলে বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশের টিকে থাকার শর্ত যতটা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তা সফল হয়নি। আর এ বিষয়ে তাদের আলাদা কোনো নীতি, কৌশল, দূরবর্তী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দৃশ্যমান ছিল না। সুদূরপ্রসারী কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা ছাড়া তারা গড়ে দেশ পরিচালনা করেছেন । যে কারণে শেষ পর্যন্ত জাতির ঘাড়ে টানা সাড়ে ১৫ বছর চেপে বসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা।

অসৎ রাজনীতিবিদ, অসৎ অযোগ্য প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার অধীনে কোনো দেশ কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। এ সমস্যা দূর করার জন্য প্রয়োজন একটি ভিশনারি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা । দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নীতিনৈতিকতা শিক্ষা, মনুষ্যত্বের বিকাশের মাধ্যমে চরিত্রবান আদর্শ মানুষ তৈরি করা। আর এটা সম্ভব মানুষের মধ্যে পরকাল সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে। একই সঙ্গে মানুষকে সঠিক ইতিহাস জানানো এবং বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ করে গড়ে তোলা উচিত শিক্ষার আরেকটি লক্ষ্য।

এ ধরনের মানুষ যখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন, তখন তাদের হাতেই দেশ হতে পারে নিরাপদ। বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন জাতি গঠন এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা। আর এটি সম্ভব উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একটি সচেতন, দক্ষ, আদর্শিক আর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জাতি তৈরির মাধ্যমে।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত