দরবেশিনী মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী
রাষ্ট্রনায়ক দুখিনী বিধবা ।
মজলুম সন্তানহারা তারুণ্যে
জনতার আশা, হৃদ প্রভা।।
সংগ্রামী জীবন নিষ্কলুষ, নীতি
ঢাকঢোলহীন, দেশপ্রীতি :
নিশ্চুপে শহীদ, দেবীতুল্য ত্রাতা
ঠিকানা যার দেশ, দেশমাতা ।।
বিদায়, বিদায়!
না বিদায় নহে-
আয় কোলে আয়,
দেশমৃত্তিকা কহে।।
আমি কখনোই বেগম খালেদা জিয়াকে দেখিনি। তার স্বামী, পূর্বসূরি ও প্রেরণা, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে দেখি, ঘটনাচক্রে মাত্র একবার পথ চলতে গিয়ে ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সদ্য সিপাহি-জনতা কর্তৃক মুক্ত করা জেনারেল জিয়া একটি ট্রাকে দাঁড়িয়ে হাতে মাইক নিয়ে জোরে জোরে অফিসার হত্যায় মাতা উচ্ছৃঙ্খল সিপাহিদের, নিজের পরিচয় দিয়ে বলছিলেন ব্যারাকে ফিরে যেতে। সিপাহিরাও তার কথা শুনে সুবোধ বালকের মতো তাই করেছিলেন। এটা ছিল ফার্মগেটে, এয়ারপোর্ট রোড আর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের মিলনস্থলে, আজকে যেখানে ওভারব্রিজ, সেখানে। আমি তখন হলি ক্রস কলেজের গলি হয়ে তেজকুনীপাড়ায় আমার শিক্ষক প্রফেসর মুহম্মদ আব্দুল আযীযের বাসা থেকে বেরিয়ে আসছিলাম-আর সেই সময় বাংলা বলতে না পারা একজন কৃষ্ণবর্ণ সৈনিককে আটক করেছিল বলে লোকে বলছিল আর ভিড় জমেছিল বলে রাস্তার পাশে থেমেছিলাম-সে জন্য তাকে ওই একই সময় ওভাবে দেখেছিলাম। না হলে ওখানে কিছু দেখতে যাইনি-তাকে দেখতে তো নয়ই। আশৈশবই আমি কোনো শাসক বা রাজনৈতিক নেতাদের দেখতে যাওয়ায় অনাগ্রহ রাখতাম। এ ছিল আমার আজীবনের দলীয় রাজনীতির ধারে-কাছে পর্যন্ত যাওয়ার বিষয়ে একান্ত অনাগ্রহেরই কারণে।
এরই সঙ্গে, আকৈশোরে আমার সমাজ-রাজনৈতিক সচেতনতাসহ সাংবাদিকতার ও প্রবন্ধকারের ভূমিকায়, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে সরকারের গঠনমূলক কিন্তু প্রখর ও তীব্র সমালোচনার অভ্যাসের জন্য ইতোমধ্যেই জনমনে সমীহসহ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলাম। এই সমালোচনা করতাম সরকারের আমার কাছে ভুল মনে হওয়া নীতির-তা সরকার যে দলেরই হোক, তারদিকে খেয়াল না করেই। আবার সাধারণত পর্দার আড়ালে থেকে, সাধারণত প্রফেসর আযীয স্যারের নির্দেশে, তারই মাধ্যমে সরকারকে নীতিনির্ধারণমূলক আমার নিজের গবেষণা ও চিন্তাপ্রসূত পরামর্শ-সংবলিত ধারণাও দিতাম-তাও সে সরকার যে দলেরই হোক না কেন। এই অভ্যাসের বশবর্তী হয়েই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অজ্ঞাতেই, তার নীতির ভিত্তিরূপ কিছু ধারণা ও সহায়তা দিয়ে থাকলেও-যেমনটি করেছিলাম তার পূর্বসূরি ওয়ার-পরবর্তী, উত্তরসূরি সরকারগুলোর বেলাও-তার ইন্তেকালের সময়, তারই সরকারের কিছু নীতির তীব্র সমালোচনামূলক একটি প্রবন্ধ লিখছিলাম সাপ্তাহিক বিচিত্রার জন্য। সেকালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় জনমত গঠনকারী পত্রিকাই শুধু ছিল না-ছিল দেশের নীতিনির্ধারণেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী-আমি সে সময় তাতে প্রায় প্রায় সংখ্যায় বিপুল জনপ্রিয় নীতিনির্দেশনামূলক প্রবন্ধ বা কলাম লিখতাম।
সুদূর সিডনির নিউ টাউনে পাঁচ বা ছয়তলার চিলেকোঠায় বসে জিয়াউর রহমানের সরকারের কোনো কোনো নীতির তীব্র গঠনমূলক সমালোচনা-সংবলিত বেশ দীর্ঘ প্রবন্ধটি প্রায় শেষ করেই এনেছিলাম-এমন সময় খবর এলো প্রেসিডেন্ট শহীদ হয়েছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রবন্ধটি লেখা বন্ধ করে দিই-এমনকি যে বাক্যটি লিখছিলাম, তাও পূর্ণ করিনি। সঙ্গে সঙ্গে কলম রেখে দিই । ঘটনার বিস্তারিত কোনো খবর তখনো আসেনি। কিন্তু তিনি নিহত হয়েছেন-এটাই আমার তার সরকারের সমালোচনামূলক কলাম লেখা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমার সমালোচনা তো যার নীতির সমালোচনা করছি, তার সমালোচিত নীতি ঠিক করে নেওয়ার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই করি। তার ইন্তেকালের পর তো তার পক্ষে আর তা করা সম্ভব নয়-তখন এ সমালোচনা, আত্মপক্ষ সমর্থন বা সমালোচিত নীতি সংশোধনে অক্ষম প্রয়াতের কুৎসা ছাড়া আর কিছুই হবে না। এই একই ধরনের বিচারেই তার আগের সরকার প্রধানের নিহত হওয়ার সময়ও মোটামুটি এ রকম আচরণই করেছিলাম-তার ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তার সরকারের তীব্র সমালোচনায় দুঃসাহসী লেখনী চালিয়ে গেলেও, তার নিহত হওয়ার সংবাদ পেয়েই তার বাসার জন্য ছুটে গিয়েছিলাম, যদিও সৈন্যদের বাধার জন্য কাছে গিয়েও বাসায় পৌঁছাতে পারিনি।
আজ কয়েক দশক পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকালের সময়ও একইভাবে তার বহু দূর, বিদেশে বসে সে খবর পাওয়ার সময় কিছু একটা লিখছিলাম। সংবাদটি পেতেই থমকে গেলাম-লেখাটি বন্ধ করে দিলাম, তার জন্য দোয়া করলাম। আর লিখতে পারলাম না। কিন্তু এবার সে ইন্তেকালের খবর পাওয়ার সময় প্রয়াতের কোনো সমালোচনা লিখছিলাম না। তার পূর্ববর্তী সরকারগুলোর মতোই তার সরকারেরও কোনো কোনো নীতির পেছনে তার অজ্ঞাতেই, সাধারণত প্রফেসর আযীযের মাধ্যমেই পরামর্শমূলক ধারণা দিয়েছিলাম; কিন্তু এবার তার ইন্তেকালের সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমি তার সরকারের কোনো নীতির সমালোচনা করিনি। তা লক্ষ করে নিজেই আশ্চর্যান্বিত হলাম। কেন এমন?
বসে ভাবছি। বুঝতে পারছি, আমার সর্বদাই গঠনমূলক সমালোচনায় নিবিষ্ট থাকার অভ্যাস সত্ত্বেও এই অনন্য এক রাষ্ট্রনায়কের দীর্ঘকালীন তিন আলাদা আলাদা দফার সরকার আর তার বাইরের সরকারবিরোধী ভূমিকার সময় তার কোথাও কখনো সমালোচনা করার মতো কিছুই লক্ষ করিনি। একমাত্র ২০০০ সালে বা তার পরপর কোনো একটি তুলনামূলক ছোট বিষয়ে মনে হচ্ছিল, তিনি হয়তো একটি ভুল করতে যাচ্ছেন। এ নিয়ে একটি লেখা লিখে সে সময়কার দেশের সম্ভবত সবচেয়ে বড় দৈনিকে পাঠাতে উদ্যত হলেও যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এককালে অধ্যাপনা করি, তারই এক অধ্যাপক খুব কাছের বন্ধু পরামর্শ দেন, এটি আপাতত ছাপাবেন না আর অচিরেই তা ছাপানোর দরকার থাকল না পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে। দীর্ঘ কয়েক দশকের তার নেতৃত্ব, আমার মতো এমন গভীর পর্যায়ের বিশ্লেষণভিত্তিক দল-মত নির্বিশেষে সব সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের গঠনমূলক সমালোচনায় অভ্যস্ত রাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ সমালোচনার মতো তেমন বড় কোনো ভুলই দেখতে পেলাম না? তা কেমন করে হয়? অসাধারণ!
এখানেই অনেকটা হঠাৎই আজ তার ইন্তেকালের পর সচেতনভাবে উপলব্ধি করলাম খালেদা জিয়ার অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা।
তিনি রাজনীতিক ছিলেন না, ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক। নিজের, আপনজনের, স্বগোত্রীয়দের, নিজস্ব দলের, এমনকি নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বা মতামতের ঊর্ধ্বে থেকে রাষ্ট্রের সব সদস্যের প্রকৃত সুস্বার্থকে সমুন্নত রেখে গভীর অন্তর্দৃষ্টি, আদিগন্ত দূরদৃষ্টি নিয়ে স্বীয় সক্ষমতার সবটুকুই সর্বোচ্চ সম্ভব দক্ষতাসহ উৎসর্গ করাতেই একজন রাষ্ট্রনায়ক সাধারণ রাজনীতিক থেকে আলাদা।
রাষ্ট্রনায়কোচিত এই ভূমিকায় খালেদা জিয়া তার জীবন আর সবকিছুই উৎসর্গ করেছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, যার ফলে তার প্রয়াণের পরও তিনি রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে রইলেন।
আমি কোনো দিন তাকে দেখিনি, তার দলের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা রাখিনি-যেমন রাখিনি কোনো দলের সঙ্গেই-তার প্রশংসায় এর আগে কখনো একটি বাক্যও লিখিনি, আজকে তার প্রয়াণের পর তার থেকে আমার কোনোভাবেই উপকৃত হওয়ার আশা বা উপায় নেই-সেই আমার মতো একজন সম্পূর্ণভাবে নৈর্ব্যক্তিক, আবেগমুক্ত বিশ্লেষণে অভ্যস্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও উপরোক্ত বলতে বাধ্য হলাম তার সারা জীবনের কর্মপর্যালোচনার ভিত্তিতে।
এক অনন্যা রাষ্ট্রনায়ক, জনগণমনের মমতাময়ী অভিভাবিক, তিনি ছিলেন একজন সেই,
‘নিঃশেষে প্রাণ,
যে করিল দানঃ
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞান-বিশেষজ্ঞ, ঢাকা ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা এবং গবেষণা, সাংবাদিকতা ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

