
সৈয়দ আবদাল আহমদ

কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তান এখন মুখোমুখি। দুই দেশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। সীমান্তে দুই দেশের সামরিক বাহিনী গোলাগুলি করছে। উভয় দেশের নেতারা বাকযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পাশাপাশি সর্বাত্মক যুদ্ধেরও হুমকি দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র বৈসারণ উপত্যকায় গত ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনা। সেই হামলায় নিহতদের সবাই ছিলেন পর্যটক। ভারত দাবি করেছে এরা সবাই ভারতের নাগরিক। ঘটনার জন্য ভারত দায়ী করেছে পাকিস্তানকে। কিন্তু পাকিস্তান ভারতের দেওয়া বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এ ঘটনার সঙ্গে তারা জড়িত নয়। ভারতের কাছে কোনো প্রমাণ থাকলে তা উপস্থাপনেরও আহ্বান জানায় পাকিস্তান। সর্বশেষ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছেন।
ভারত-পাকিস্তান নতুন করে উত্তেজনার প্রেক্ষিতে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সামগ্রিক বিষয় বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে এ মুহূর্তে ভারত যুদ্ধে জড়ালে তা দেশটির জন্য সুফল বয়ে আনবে না। কারণ ভারতের রাজ্যে রাজ্যে নানামুখী বিরোধ রয়েছে। কয়েকটি রাজ্যে স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে। চীন, বাংলাদেশ, নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ বাঁধলে ভারতকে চীন, বাংলাদেশ ও নেপাল সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে হবে। রাজ্যে রাজ্যে যাতে স্বাধীনতার আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে সে জন্য সৈন্য নিয়োজিত রাখতে হবে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য, মেঘালয়, খালিস্তান উল্লেখযোগ্য। কোনো কারণে চীনের সঙ্গে নতুন করে বিরোধ সৃষ্টি হয়ে গেলে সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ পাকিস্তান ও চীন দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করা ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না। দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের জন্য ভারতের সামরিক বাহিনীকে সম্পদ দেওয়ার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য দেশটির নেই। এক্ষেত্রে যুদ্ধ বাধলে ভারতকে তার কোনো কোনো রাজ্য হারাতেও হতে পারে।
পেহেলগামে হামলার পর নিরাপত্তা পরিস্থিতি সরেজমিন খতিয়ে দেখতে গত ২৫ এপ্রিল কাশ্মীর যান ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি হামলার স্থলও তিনি পরিদর্শন করেন। ভারতের পক্ষে কাশ্মীরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যথেষ্ট গাফিলতি থাকার প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। ভারত এটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকারও করেছে। ভারতের মিডিয়ার খবরে বলা হয়, এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্র্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামের স্বল্প পরিচিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তবে টিআরএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা এ ধরনের কোনো বক্তব্য মিডিয়ায় দেয়নি। এটি ভারতীয় মিডিয়ার সৃষ্টি। হামলার পরপরই ভারত পাকিস্তানের নাগরিকদের ভিসা বাতিল ও সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতসহ ৫টি পদক্ষেপ নেয়। জবাবে পরদিন পাকিস্তান ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা বাতিল, সিমলা চুক্তি স্থগিত, পাকিস্তানের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমান উড্ডয়ন বন্ধসহ বেশ কয়েকটি পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। এই পদক্ষেপে অব্যাহত উত্তেজনার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এই গোলাগুলি এখনো চলছে। স্কাই নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ সব সময়ই উদ্বেগের। যদি পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়, তাহলে এই সংঘাত একটি করুণ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, হামলার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধে’ রূপ নিতে পারে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের জন্য দুই দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা জানালেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ঘটনাকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তিনি শুধু বলেছেন, দুই দেশই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ভাষায় ভারত-পাকিস্তান নিজেরাই সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানিচুক্তি (আইডব্লিউটি) একতরফাভাবে স্থগিত করায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারত। এই চুক্তি করার সময় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু বিশ্বব্যাংককে এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি ভারত। ১৯৬০ সাল থেকে কার্যকর থাকা এই চুক্তি স্থগিত করায় পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এই চুক্তিটিতে সিন্ধু অববাহিকায় ছয়টি নদীর পানিবন্টনের বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, চেনাব, ঝিলম ও মূল সিন্ধু পানি সরবরাহ। এই চুক্তি অনুযায়ী পানি সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে। সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের সঙ্গে যুক্ত একজন পানি বিজ্ঞানী বলেছেন, যদি ভারত সিন্ধু নদের পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তবে তাকে পুরোপুরি আইডব্লিউটি চুক্তি উপেক্ষা করতে হবে। চুক্তির বর্তমান শর্তে তা সম্ভব নয়।
দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের ৬টি যৌথ নদীর পানি ন্যায্যতার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এর আগে দুটি যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু সিন্ধু চুক্তি বাতিল হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধু অববাহিকার রাভি (ইরাবতী), বিয়াস (বিপাশা) ও সুতলেজ (শতদ্রু) নদীর পানি ভারতের জন্য বরাদ্দ আর সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব নদীর ৮০ শতাংশ পানি পায় পাকিস্তান।
এদিকে পাকিস্তানের আকাশে ভারতের বিমান বন্ধ করে দেওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ভারত। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ ভারতীয় ফ্লাইট পাকিস্তানের আকাশসীমা অতিক্রম করে। ফ্লাইটগুলো ঘুরে অন্য রুটে যাওয়ায় খরচ বেড়ে গেছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সক্ষমতা
প্রচলিত যুদ্ধে জনবল গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। ভারত ও পাকিস্তানের জন্যও তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশাল জনসংখ্যা ও স্থলবাহিনীর ওপর উভয় দেশেরই নির্ভরতা রয়েছে।
ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি (বিশ্বে দ্বিতীয়)। সক্রিয় জনশক্তি ৬৬ কোটি ২০ লাখ। সক্রিয় সেনা ১৪ লাখ ৬০ হাজার (বিশ্বে দ্বিতীয়)। রিজার্ভ সেনা ১১ লাখ ৬০ হাজার (বিশ্বে সপ্তম)। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লাখ ৩০ হাজার (বিশ্বে দ্বিতীয়)। মোট সামরিক (সক্রিয় ও রিজার্ভ সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনী) জনবল ৫১ লাখ।
অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৫ কোটি ২০ লাখ (বিশ্বে পঞ্চম)। সক্রিয় জনবল ১০ কোটি ৮০ লাখ। সক্রিয় সেনা ৬ লাখ ৫৪ হাজার (বিশ্বে সপ্তম)। রিজার্ভ সেনা ৬ লাখ ৫০ হাজার। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য জিএফপিতে স্পষ্টভাবে পরিমাপ করা হয়নি, তবে উল্লেখযোগ্য (রেঞ্জার্স ও ফ্রন্টিয়ার কোরসহ)। মোট সামরিক শক্তি ১৭ লাখ (সক্রিয়, রিজার্ভ ও আধা সামরিক বাহিনী)।
ভারতের সামরিক অস্ত্রের মধ্যে ট্যাংক ৪৬১৪টি, সাঁজোয়া যান ১৫১২৪৮টি, কামান ৯৭১৯টি, যুদ্ধ বিমান ৬শ’ ৬টি, আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এসইউ-৩০ এমকেআই, রাফায়েল, তেজস, হেলিকপ্টার এপাচি ও চিনুক।
অন্যদিকে পাকিস্তানের ট্যাংক ৩৭৪২টি, সাঁজোয়া যান ৫০ হাজার, কামান ৪ হাজার ৪৭২টি, যুদ্ধবিমান ৩৮৭টি, আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন, জেএফ-১৭ থান্ডার, মিরেজ-থ্রি-৫। পারমাণবিক অস্ত্রে এগিয়ে পাকিস্তান। সার্বিক সক্ষমতায় ভারত। তবে সব সীমান্ত সুরক্ষা করে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে গেলে শক্তি-সামর্থ্য ভারতের খুব একটা বেশি হবে না।
পেহেলগামে হামলা মোদির সৃষ্ট!
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সূত্রগুলো ও বিশেষজ্ঞরা পেহেলগাম হামলার বিশ্লেষণ করে বলছেন, হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এ হামলা এবং পর্যটকদের নিশানা করা রহস্যজনক ও উদ্দেশ্যমূলক। সন্দেহের তীর নরেন্দ্র মোদির দিকে। কারণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মোদির ইমেজ এখন তলানিতে রয়েছে। বিশেষ করে কানাডায় খালিস্তান মুভমেন্টের একজন নেতাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর মাধ্যমে হত্যা করার ঘটনা ফাঁস হয়ে গেছে। তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে খালিস্তান মুভমেন্টের একজন নেতাকে হত্যা করানোর জন্য ভারতীয় ‘র’ যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যক্তিকে ভাড়া করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী তাকে ধরে ফেলেছে। এ দুটি ঘটনায় মোদি কোণঠাসা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আবার তিনি জঙ্গি কার্ড খেলছেন। পশ্চিমা বিশ্বকে ধারণা দিচ্ছেন ইসলামি জঙ্গিরা আবার জড়ো হচ্ছে। পেহেলগামের হামলা এ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তবে মনে হচ্ছে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধে যাবেন না মোদি। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কিংবা ছোট-খাটো জায়গায় যুদ্ধ করে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবেন তিনি।
কাশ্মীর নিয়ে কেন যুদ্ধ, কেন বিরোধ
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দু’বার যুদ্ধ হয়েছে। একবার ১৯৪৭-৪৮ সালে এবং আরেকবার ১৯৬৫ সালে। তেমনি ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে ১৯৬২ সালে। এ যুদ্ধে ভারত চীনের কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধে ভারতের ৪ হাজার ৯০০ সেনা নিহত হয়েছিল এবং ৩ হাজার ৯৬৮ জন ভারতীয় সেনাকে আটক করেছিল চীন। তবে কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে চীনের চেয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাই বেশি হয়েছে। ছোট-খাটো ও মাঝারি ধরনের সংঘর্ষ-সহিংসতা হয়েছে অন্তত আট-দশবার। গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এ ধরনের উত্তেজনা লেগে আছে।
১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়। ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’ নামে ব্রিটিশ-ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীর তার ইচ্ছা অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তানÑ যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেই যোগ দিতে পারবে। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু রাজা ছিলেন হরি সিং। মূলত তিনিই বিরোধের মূল কারণ। এই হিন্দু রাজা বলেছিলেন, হয় কাশ্মীর স্বাধীন থাকবে, নইলে ভারতের সঙ্গে যোগ দেবে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন কাশ্মীর পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে মহারাজা হরি সিং সিদ্ধান্ত নেন কাশ্মীর ভারতে যোগ দেবে। তিনি ভারতের সঙ্গে চুক্তিও স্বাক্ষর করেন এবং ভারতের সামরিক সহায়তাও পান। এ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধ চলে প্রায় দু’বছর। ভারত ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। ফলে ১৯৪৮ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ৪৭ নম্বর প্রস্তাব পাস করে। এই প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়।
এ অবস্থায় কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি। তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। কাশ্মীরের ভারতের অংশ হচ্ছে কাশ্মীর উপত্যকা, জম্মু ও লাদাখ। অন্যদিকে পাকিস্তানের অংশটি হচ্ছে আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বালতিস্তান।
১৯৬২ সালে কাশ্মীর অঞ্চলে চীনের সীমানা নিয়ে চীন-ভারত বিরোধের জেরে যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে ভারতকে চীন পরাজিত করে। পরের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের হাতে ছেড়ে দেয়। ফলে কাশ্মীর অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীনÑ এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের ফলে চীন কাশ্মীরের আকসাই চীন অংশটিতে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।
কাশ্মীর নিয়ে দ্বিতীয় পাক-ভারত যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে। এরপর আরেকটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধে ভারত জড়িত হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির মধ্য দিয়ে কাশ্মীরে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) চূড়ান্ত রূপ পায়। ১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে। ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বাহিনী আরেকটি তিক্ত লড়াইয়ে জড়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে। সেটা কারগিল যুদ্ধ নামে পরিচিত। কারগিল সংকটের আগেই দুই দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়। কারগিল যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তান দু’দেশেরই বহু সেনা নিহত হয়। তবে যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনার সংখ্যাই বেশি ছিল। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালেও দু’দেশের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। এর মধ্যে পুলওয়ামায় আক্রমণে ৪০ জনের বেশি ভারতীয় আধা সামরিক পুলিশ নিহত হয়।
ভারতশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি মুসলিম। এটাই হচ্ছে ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাশ্মীরের এ অংশের নাগরিকদের বেশিরভাগই চায় না যে এলাকাটি ভারতের শাসনে থাকুক। তারা চায় হয় কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি। কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ এবং রক্তাক্ত সংঘাতের এটাই কারণ যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের চাহিদা প্রাধান্য দিলে এমন হতো না। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি সরকার সেদিকে না গিয়ে মুসলমান পরিচয়কেই আঘাত করছে। পেহেলগাম হামলার পর কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাশ্মীরিদের হেনস্তা ও মারধর করা হচ্ছে। বিশেষ করে কাশ্মীরের মুসলিম ছাত্রছাত্রীরাই বেশি মারধরের শিকার হচ্ছে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক
দৈনিক আমার দেশ

কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তান এখন মুখোমুখি। দুই দেশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। সীমান্তে দুই দেশের সামরিক বাহিনী গোলাগুলি করছে। উভয় দেশের নেতারা বাকযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পাশাপাশি সর্বাত্মক যুদ্ধেরও হুমকি দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র বৈসারণ উপত্যকায় গত ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনা। সেই হামলায় নিহতদের সবাই ছিলেন পর্যটক। ভারত দাবি করেছে এরা সবাই ভারতের নাগরিক। ঘটনার জন্য ভারত দায়ী করেছে পাকিস্তানকে। কিন্তু পাকিস্তান ভারতের দেওয়া বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এ ঘটনার সঙ্গে তারা জড়িত নয়। ভারতের কাছে কোনো প্রমাণ থাকলে তা উপস্থাপনেরও আহ্বান জানায় পাকিস্তান। সর্বশেষ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছেন।
ভারত-পাকিস্তান নতুন করে উত্তেজনার প্রেক্ষিতে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সামগ্রিক বিষয় বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে এ মুহূর্তে ভারত যুদ্ধে জড়ালে তা দেশটির জন্য সুফল বয়ে আনবে না। কারণ ভারতের রাজ্যে রাজ্যে নানামুখী বিরোধ রয়েছে। কয়েকটি রাজ্যে স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে। চীন, বাংলাদেশ, নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ বাঁধলে ভারতকে চীন, বাংলাদেশ ও নেপাল সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে হবে। রাজ্যে রাজ্যে যাতে স্বাধীনতার আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে সে জন্য সৈন্য নিয়োজিত রাখতে হবে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য, মেঘালয়, খালিস্তান উল্লেখযোগ্য। কোনো কারণে চীনের সঙ্গে নতুন করে বিরোধ সৃষ্টি হয়ে গেলে সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ পাকিস্তান ও চীন দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করা ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না। দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের জন্য ভারতের সামরিক বাহিনীকে সম্পদ দেওয়ার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য দেশটির নেই। এক্ষেত্রে যুদ্ধ বাধলে ভারতকে তার কোনো কোনো রাজ্য হারাতেও হতে পারে।
পেহেলগামে হামলার পর নিরাপত্তা পরিস্থিতি সরেজমিন খতিয়ে দেখতে গত ২৫ এপ্রিল কাশ্মীর যান ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি হামলার স্থলও তিনি পরিদর্শন করেন। ভারতের পক্ষে কাশ্মীরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যথেষ্ট গাফিলতি থাকার প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। ভারত এটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকারও করেছে। ভারতের মিডিয়ার খবরে বলা হয়, এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্র্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামের স্বল্প পরিচিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তবে টিআরএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা এ ধরনের কোনো বক্তব্য মিডিয়ায় দেয়নি। এটি ভারতীয় মিডিয়ার সৃষ্টি। হামলার পরপরই ভারত পাকিস্তানের নাগরিকদের ভিসা বাতিল ও সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতসহ ৫টি পদক্ষেপ নেয়। জবাবে পরদিন পাকিস্তান ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা বাতিল, সিমলা চুক্তি স্থগিত, পাকিস্তানের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমান উড্ডয়ন বন্ধসহ বেশ কয়েকটি পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। এই পদক্ষেপে অব্যাহত উত্তেজনার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এই গোলাগুলি এখনো চলছে। স্কাই নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ সব সময়ই উদ্বেগের। যদি পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়, তাহলে এই সংঘাত একটি করুণ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, হামলার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধে’ রূপ নিতে পারে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের জন্য দুই দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা জানালেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ঘটনাকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তিনি শুধু বলেছেন, দুই দেশই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ভাষায় ভারত-পাকিস্তান নিজেরাই সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানিচুক্তি (আইডব্লিউটি) একতরফাভাবে স্থগিত করায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারত। এই চুক্তি করার সময় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু বিশ্বব্যাংককে এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি ভারত। ১৯৬০ সাল থেকে কার্যকর থাকা এই চুক্তি স্থগিত করায় পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এই চুক্তিটিতে সিন্ধু অববাহিকায় ছয়টি নদীর পানিবন্টনের বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, চেনাব, ঝিলম ও মূল সিন্ধু পানি সরবরাহ। এই চুক্তি অনুযায়ী পানি সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে। সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের সঙ্গে যুক্ত একজন পানি বিজ্ঞানী বলেছেন, যদি ভারত সিন্ধু নদের পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তবে তাকে পুরোপুরি আইডব্লিউটি চুক্তি উপেক্ষা করতে হবে। চুক্তির বর্তমান শর্তে তা সম্ভব নয়।
দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের ৬টি যৌথ নদীর পানি ন্যায্যতার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এর আগে দুটি যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু সিন্ধু চুক্তি বাতিল হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধু অববাহিকার রাভি (ইরাবতী), বিয়াস (বিপাশা) ও সুতলেজ (শতদ্রু) নদীর পানি ভারতের জন্য বরাদ্দ আর সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব নদীর ৮০ শতাংশ পানি পায় পাকিস্তান।
এদিকে পাকিস্তানের আকাশে ভারতের বিমান বন্ধ করে দেওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ভারত। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ ভারতীয় ফ্লাইট পাকিস্তানের আকাশসীমা অতিক্রম করে। ফ্লাইটগুলো ঘুরে অন্য রুটে যাওয়ায় খরচ বেড়ে গেছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সক্ষমতা
প্রচলিত যুদ্ধে জনবল গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। ভারত ও পাকিস্তানের জন্যও তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশাল জনসংখ্যা ও স্থলবাহিনীর ওপর উভয় দেশেরই নির্ভরতা রয়েছে।
ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি (বিশ্বে দ্বিতীয়)। সক্রিয় জনশক্তি ৬৬ কোটি ২০ লাখ। সক্রিয় সেনা ১৪ লাখ ৬০ হাজার (বিশ্বে দ্বিতীয়)। রিজার্ভ সেনা ১১ লাখ ৬০ হাজার (বিশ্বে সপ্তম)। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লাখ ৩০ হাজার (বিশ্বে দ্বিতীয়)। মোট সামরিক (সক্রিয় ও রিজার্ভ সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনী) জনবল ৫১ লাখ।
অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৫ কোটি ২০ লাখ (বিশ্বে পঞ্চম)। সক্রিয় জনবল ১০ কোটি ৮০ লাখ। সক্রিয় সেনা ৬ লাখ ৫৪ হাজার (বিশ্বে সপ্তম)। রিজার্ভ সেনা ৬ লাখ ৫০ হাজার। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য জিএফপিতে স্পষ্টভাবে পরিমাপ করা হয়নি, তবে উল্লেখযোগ্য (রেঞ্জার্স ও ফ্রন্টিয়ার কোরসহ)। মোট সামরিক শক্তি ১৭ লাখ (সক্রিয়, রিজার্ভ ও আধা সামরিক বাহিনী)।
ভারতের সামরিক অস্ত্রের মধ্যে ট্যাংক ৪৬১৪টি, সাঁজোয়া যান ১৫১২৪৮টি, কামান ৯৭১৯টি, যুদ্ধ বিমান ৬শ’ ৬টি, আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এসইউ-৩০ এমকেআই, রাফায়েল, তেজস, হেলিকপ্টার এপাচি ও চিনুক।
অন্যদিকে পাকিস্তানের ট্যাংক ৩৭৪২টি, সাঁজোয়া যান ৫০ হাজার, কামান ৪ হাজার ৪৭২টি, যুদ্ধবিমান ৩৮৭টি, আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন, জেএফ-১৭ থান্ডার, মিরেজ-থ্রি-৫। পারমাণবিক অস্ত্রে এগিয়ে পাকিস্তান। সার্বিক সক্ষমতায় ভারত। তবে সব সীমান্ত সুরক্ষা করে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে গেলে শক্তি-সামর্থ্য ভারতের খুব একটা বেশি হবে না।
পেহেলগামে হামলা মোদির সৃষ্ট!
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সূত্রগুলো ও বিশেষজ্ঞরা পেহেলগাম হামলার বিশ্লেষণ করে বলছেন, হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এ হামলা এবং পর্যটকদের নিশানা করা রহস্যজনক ও উদ্দেশ্যমূলক। সন্দেহের তীর নরেন্দ্র মোদির দিকে। কারণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মোদির ইমেজ এখন তলানিতে রয়েছে। বিশেষ করে কানাডায় খালিস্তান মুভমেন্টের একজন নেতাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর মাধ্যমে হত্যা করার ঘটনা ফাঁস হয়ে গেছে। তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে খালিস্তান মুভমেন্টের একজন নেতাকে হত্যা করানোর জন্য ভারতীয় ‘র’ যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যক্তিকে ভাড়া করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী তাকে ধরে ফেলেছে। এ দুটি ঘটনায় মোদি কোণঠাসা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আবার তিনি জঙ্গি কার্ড খেলছেন। পশ্চিমা বিশ্বকে ধারণা দিচ্ছেন ইসলামি জঙ্গিরা আবার জড়ো হচ্ছে। পেহেলগামের হামলা এ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তবে মনে হচ্ছে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধে যাবেন না মোদি। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কিংবা ছোট-খাটো জায়গায় যুদ্ধ করে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবেন তিনি।
কাশ্মীর নিয়ে কেন যুদ্ধ, কেন বিরোধ
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দু’বার যুদ্ধ হয়েছে। একবার ১৯৪৭-৪৮ সালে এবং আরেকবার ১৯৬৫ সালে। তেমনি ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে ১৯৬২ সালে। এ যুদ্ধে ভারত চীনের কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধে ভারতের ৪ হাজার ৯০০ সেনা নিহত হয়েছিল এবং ৩ হাজার ৯৬৮ জন ভারতীয় সেনাকে আটক করেছিল চীন। তবে কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে চীনের চেয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাই বেশি হয়েছে। ছোট-খাটো ও মাঝারি ধরনের সংঘর্ষ-সহিংসতা হয়েছে অন্তত আট-দশবার। গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এ ধরনের উত্তেজনা লেগে আছে।
১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়। ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’ নামে ব্রিটিশ-ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীর তার ইচ্ছা অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তানÑ যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেই যোগ দিতে পারবে। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু রাজা ছিলেন হরি সিং। মূলত তিনিই বিরোধের মূল কারণ। এই হিন্দু রাজা বলেছিলেন, হয় কাশ্মীর স্বাধীন থাকবে, নইলে ভারতের সঙ্গে যোগ দেবে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন কাশ্মীর পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে মহারাজা হরি সিং সিদ্ধান্ত নেন কাশ্মীর ভারতে যোগ দেবে। তিনি ভারতের সঙ্গে চুক্তিও স্বাক্ষর করেন এবং ভারতের সামরিক সহায়তাও পান। এ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধ চলে প্রায় দু’বছর। ভারত ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। ফলে ১৯৪৮ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ৪৭ নম্বর প্রস্তাব পাস করে। এই প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়।
এ অবস্থায় কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি। তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। কাশ্মীরের ভারতের অংশ হচ্ছে কাশ্মীর উপত্যকা, জম্মু ও লাদাখ। অন্যদিকে পাকিস্তানের অংশটি হচ্ছে আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বালতিস্তান।
১৯৬২ সালে কাশ্মীর অঞ্চলে চীনের সীমানা নিয়ে চীন-ভারত বিরোধের জেরে যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে ভারতকে চীন পরাজিত করে। পরের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের হাতে ছেড়ে দেয়। ফলে কাশ্মীর অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীনÑ এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের ফলে চীন কাশ্মীরের আকসাই চীন অংশটিতে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।
কাশ্মীর নিয়ে দ্বিতীয় পাক-ভারত যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে। এরপর আরেকটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধে ভারত জড়িত হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির মধ্য দিয়ে কাশ্মীরে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) চূড়ান্ত রূপ পায়। ১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে। ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বাহিনী আরেকটি তিক্ত লড়াইয়ে জড়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে। সেটা কারগিল যুদ্ধ নামে পরিচিত। কারগিল সংকটের আগেই দুই দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়। কারগিল যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তান দু’দেশেরই বহু সেনা নিহত হয়। তবে যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনার সংখ্যাই বেশি ছিল। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালেও দু’দেশের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। এর মধ্যে পুলওয়ামায় আক্রমণে ৪০ জনের বেশি ভারতীয় আধা সামরিক পুলিশ নিহত হয়।
ভারতশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি মুসলিম। এটাই হচ্ছে ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাশ্মীরের এ অংশের নাগরিকদের বেশিরভাগই চায় না যে এলাকাটি ভারতের শাসনে থাকুক। তারা চায় হয় কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি। কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ এবং রক্তাক্ত সংঘাতের এটাই কারণ যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের চাহিদা প্রাধান্য দিলে এমন হতো না। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি সরকার সেদিকে না গিয়ে মুসলমান পরিচয়কেই আঘাত করছে। পেহেলগাম হামলার পর কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাশ্মীরিদের হেনস্তা ও মারধর করা হচ্ছে। বিশেষ করে কাশ্মীরের মুসলিম ছাত্রছাত্রীরাই বেশি মারধরের শিকার হচ্ছে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক
দৈনিক আমার দেশ

সাধারণত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা জানেন সময় কত বেশি মূল্যবান। একটি প্রবাদ আছেÑ‘সময় হলো সোনার মতো দামি’। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করেন। আর ইসলামে সময় স্বর্ণ কিংবা বিশ্বের যেকোনো মূল্যবান বস্তুর চেয়ে বেশি দামি। সময়ের মূল্য কী, ইসলাম শুধু তা-ই শেখায় না। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ইসলাম মানবজাতিকে বিশেষভাবে শেখ
২ ঘণ্টা আগে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংশ্লিষ্টতার পক্ষে ঢোল জোরেশোরেই বাজছে ওয়াশিংটনে। নীতিনির্ধারণী মহলে কেউ কেউ ফিসফিস করে আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে চিৎকার করে বলছেন গাজায় সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য।
২ ঘণ্টা আগে
আস্থা সংকটে উদ্যোক্তারা, গতি নেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেÑএই বাস্তবতা এখন দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও যখন দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন কারখানা স্থাপন, ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা প্রযুক্তি খাতে বড় উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন অর্থনীতির মধ্যে প্রাণচাঞ্চ
৩ ঘণ্টা আগে
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার যে প্রবণতা ১৯৭২-৭৩-এ শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতা এখন পর্যন্ত চলছে। সে সময় থেকেই এদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের শুরুটা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনৈতিক দলাদলির প্রেক্ষিতে, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়
৩ ঘণ্টা আগে