এক নদী সুরের অভিমান : শাহনাজ রহমতউল্লাহকে স্মরণ

কামরুননেসা হাসান
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ৩৯

ঘর থেকে দেশজোড়া গানের যাত্রা

ছোটবেলার ঘরোয়া পরিমণ্ডলে গান ছিল অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। মা গাইতেন আপন খেয়ালে, গলার ধ্বনি আর সুরের ঢেউ যেন ঘরটিকে স্নিগ্ধ করে তুলত। সেই সুরেরা নিঃশব্দে শৈশবকে জড়িয়ে ধরেছিল। সেখান থেকেই গানকে ভালোবাসার শুরু আর সেই ভালোবাসা পরিণত হলো সারাজীবনের এক নির্বিচার সাধনায়। সংগীত ভুবনে জ্বলজ্বলে এক নক্ষত্র শাহনাজ রহমতউল্লাহ।

বিজ্ঞাপন

বড় ভাই একজন শ্রেষ্ঠ সুরকার আনোয়ার পারভেজ আর এক ভাই চলচ্চিত্র জগতের সুদর্শন স্মার্ট নায়ক জাফর ইকবাল।

তখন হয়তো আমার বয়স ১৫ কিংবা ১৬। কিশোরী বয়সে প্রথম শাহনাজ রহমতউল্লাহর গান শুনি রেডিওতে। মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। কী অপার্থিব কণ্ঠস্বর! যেন এক মোহনীয় জাদুর পরশ—শুদ্ধ, স্বচ্ছ আর গভীরতায় পূর্ণ। তার গায়কি আমাদের প্রজন্মের শ্রবণ জগতে এক নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল।

স্মরণীয় সেই সুরেরা

আজও মনে পড়ে তার কণ্ঠে মিশে থাকা সেই সুরের রেশ :

আমি তো আমার গল্প বলেছি, তুমি কেন কাঁদলে—জেবুন্নেসা জামালের কথায়, আজাদ রহমানের সুরে।

সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে তোমার কপালে ছোঁয়াব বলে—করিম শাহাবুদ্দিনের সুরে, একই কবির লেখা।

তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখে, এ কি তৃষ্ণা, এ কি ক্লান্তি—খান আতাউর রহমানের সুরে ও কথায়।

গানের প্রতিটি চরণে তার কণ্ঠ এমনভাবে মিশে থাকত, যেন প্রতিটি শব্দ শ্বাস ফেলে—প্রতিটি সুর হৃদয়ের অন্তস্তলে প্রবেশ করে।

বেতার-টেলিভিশন থেকে চলচ্চিত্র : সর্বত্র আলো

শাহনাজ রহমতউল্লাহ শুধু একজন রেডিও শিল্পী ছিলেন না। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, মঞ্চ—সর্বত্রই তার স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত অথচ পরিশীলিত উপস্থিতি ছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘সুরবিতান’ অনুষ্ঠানে তার গাওয়া ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’ গানটি আজও শ্রোতার হৃদয়ে অমলিন।

আর দেশপ্রেমের ভাষ্য হলো—‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’—এই গান আজও শিরায়-শিরায় রক্তস্রোতের মতো বয়ে চলে। মনিরুজ্জামান মনিরের কথায়, আলাউদ্দিন আলীর সুরে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।

গজলে অনন্য, মেহেদী হাসানের শিষ্যা

গজল পরিবেশনায় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়িকা ছিলেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। তার গুরু ছিলেন কিংবদন্তি গজল সম্রাট মেহেদী হাসান। তাদের গুরুশিষ্য সম্পর্ক ছিল শুধু আনুষ্ঠানিক নয়, আত্মিকও। বহু মঞ্চে তারা একসঙ্গে পারফর্ম করেছেন এবং শ্রোতাদের অভিভূত করে ঔতুলেছেন।

সংগীত সাধনার মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়া

তবে জীবনের শেষ অধ্যায়ে এই শিল্পী পড়েছিলেন গভীর অভিমানে। কোনো রাজনৈতিক মতের কারণে নয়, বরং অপ্রকাশ্য এক বিভাজনের বলি হয়েছিলেন তিনি। কোনো রকম আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, তার গান যেন আড়ালে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।

তিনি কোনোদিনই রাজনীতিবিদ ছিলেন না। সংগীত ছিল তার জীবন, তার সাধনা।

একবার, ২০০২ সালের এক সন্ধ্যায় তাকে ফোন করে বলি, ‘আপনার কিছু জনপ্রিয় গান আবার বিটিভিতে ধারণ করতে চাই।’ শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছিলেন। আমরা গান নির্বাচন করলাম, শুটিংয়ের পরিকল্পনা করলাম—দশটি গান আমরা ধারণ করেছিলাম।

কিন্তু এরপর দীর্ঘ দশ-বারো বছর তাকে আর কোনো মিডিয়ায় দেখা যায়নি। তিনি যেন সাগরজল-ভরা অভিমানে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। এক সন্ধ্যায় মোবাইলে তারই গাওয়া গান শুনে তাকে ফোন করি—খুব খুশি হয়েছিলেন।

একান্ত বেদনা

একটা সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি আর গান করব না।’ সে বাক্যটি শুনে হৃদয়টা ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু তখন তার যন্ত্রণার পাশে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাইনি।

আর একদিন, ফোনে বললেন, মাহতারেমা (মাঝে মাঝে আমাকে এই সম্বোধন করতেন) একদিন আসব আপনার বাসায়। অনেক কথা আছে।

আমি অপেক্ষা করলাম, কিন্তু তিনি এলেন না।

পরের সপ্তাহেই খবর এলো—শাহনাজ রহমতউল্লাহ নেই। গানের পাখি উড়ে গেছে গা ফেরার দেশে।

সে কী কথা ছিল, যা তিনি বলতে চেয়েছিলেন? কী ব্যথা জমে ছিল বুকের গভীরে? ভাবলে আজও মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।

আজও ভাবি, কেমন জাতি আমরা—একজন শাহনাজ রহমতউল্লাহকে বুঝে উঠতে পারিনি, তাকে যথোচিত সম্মান দিতে পারিনি। শুধু রাজনৈতিক ছায়ায় বিভক্ত এই সমাজের হাতে আমরা হারিয়ে ফেলেছি এক অনন্য কণ্ঠ।

সেই সুর এখনো ভেসে আসে

আজও যখন সেই গান শুনি—‘একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ অথবা ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’—মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়াভরা মুখ, গভীর চাহনি মিষ্টি হাসি আর সেই করুণ স্বর, যা আর কখনো ফিরে আসবে না।

দ্বিতীয় কোনো শাহনাজ রহমতউল্লাহ আর হবে না।

যিনি গানের মধ্য দিয়ে জাতির আত্মাকে ছুঁয়ে গেছেন আর একদিন নিঃশব্দে, অভিমানে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

আমরা শুধু প্রার্থনা করতে পারি—ঐ সুরলোকে, যেখানে কোনো বিভাজন নেই, কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই,

শাহনাজ রহমতউল্লাহ যেন চিরকাল গেয়ে চলেন—এক মোহনীয়, শুদ্ধ, অপরূপ সুরে।

লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক

বাংলাদেশ টেলিভিশন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত