আপনার বর্ষীয়ান দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানিকে নিশ্চয় স্বর্ণালি সাদাকালো কোনো সিনেমা দেখে এখনো চোখের পানি ফেলতে দেখেন? নব্বই দশকের ছেলেমেয়েরা নিশ্চিত করেই গান বলতে বোঝে ‘কুমার শানু আর অলকা ইয়াগনিক’। বাংলাদেশের বিনোদন মানেই বলিউড হয়ে যাওয়ার সময়টা মনে করলে তখন সংগীতশিল্পী বলতে বোঝাত স্রেফ শ্রেয়া ঘোষাল, সুনিধি চৌহান, অরিজিৎ সিং, আতিফ আসলাম এবং কমবেশি জনপ্রিয় নানা শিল্পীকে। ওদিকে আজীবন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প বলা মানুষগুলোকেও দেখা গিয়েছে রবীন্দ্রসংগীতের তালে তালে ঢুলছেন আর তাল দিচ্ছেন। এরপর হঠাৎ করে পাল্টে যায় সব। বিপ্লবী জেন-জি জেনারেশনের বিনোদনেও ঘটে যায় নানা বিপ্লব। তারাও যে কুমার শানু-অলকা ইয়াগনিকের গান শুনে না, এমন নয়- তবে সেখানে আছে নানা রূপান্তর ও বৈপরীত্য।
অনেক রবীন্দ্রপ্রেমী হয়তো ক্ষেপে যেতে পারেন এই ভেবে যে, এই ‘উচ্চিঙ্গে জেনারেশন’ তাদের প্রিয় কবিকে সংক্ষেপে বলে র. ঠা.। চিরচেনা সুর ফেলে দিয়ে তারা ‘তাদের র. ঠা.’কে নতুন করে আবিষ্কার করেছে ‘বিশ্বকবি’ রোদ্দুর রায়ের অচেনা এক সুরে। যে সুর শুনে সাধারণ শ্রোতাদেরই সরাসরি গিয়ে ব্রহ্মতালুতে আঘাত লাগে, রাবিন্দ্রিক মৌলবাদীরা হয়তো কোমায় চলে যেতে পারেন।
কিন্তু এই মামলা-হামলা আর বিদ্রূপ কী থামাতে পেরেছে জেন-জিকে? সহজ উত্তর—‘না’। এ জন্যই তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের আবেদন ফিকে হয়ে গেছে; কিন্তু রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ এখনো জীবন্ত, নজরুল-সুকান্তের দ্রোহ আজও দুর্মর। আর এ জন্যই রবিঠাকুরের গীতবিতানকে একপাশে রেখে তারা ‘তাদের র. ঠা.’কে খুঁজে ফিরছে বিশ্বকবি রোদ্দুর রায়ের গানের ছন্দে কিংবা কবিতার ছত্রে।
এর থেকে সবাই স্বীকার করবেন, বর্তমান সময়ে বিনোদনশিল্পে নিঃসন্দেহে একটি বিপ্লব ঘটে গেছে। বিশেষ করে গণমাধ্যমের প্রকরণ থেকে বিনোদনের মাধ্যমের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের। রাজনৈতিক দ্রোহ, বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের উন্মাদনায় ভরপুর জেন-জিকেই মনে করা হচ্ছে এর নায়ক। আর তাদের বাইরে কেউ হওয়ারও কথা নয়। কারণ আমরা জানি, ‘জেন Z’ তথা জেন-জি ১৯৯০-এর মাঝামাঝি থেকে ২০১০-এর প্রথম দিক পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করেছে।
প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্মটি বিনোদন উপভোগ ও তৈরি করার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। আগের প্রজন্ম বিনোদনে যুক্ত হতো শুধু অবসর যাপন কিংবা উপভোগের প্রয়োজনে। ওদিকে ডিজিটাল যুগে বড় হওয়া এই প্রজন্মটি শুধু বিনোদনের উপভোগী নয়। তাদের অনেকে এখন কনটেন্ট তৈরির মাধ্যমে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিকও হয়েছেন। জেন-জির এই রূপান্তর ও পরিবর্তন বিনোদন শিল্পের সব দিকেই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তারা, আজকের দিনে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তারা নিজেরাই একটি নতুন বিনোদন সংস্কৃতি তৈরি করছে, যা আগামীকালের বিনোদনশিল্পের মূলধারা হতে পারে।
ডিজিটাল যুগের সন্তান হিসেবে জেন-জি হলো এমন একটি প্রজন্ম, যারা স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের দুনিয়ায় বেড়ে উঠেছে। তারা সে সময় জন্মেছে, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম এবং অনলাইন কনটেন্টের প্রভাব বিস্তার সবে শুরু হয়েছে কিংবা প্রাধান্য শুরু হয়েছিল। তারপর তাদের জীবনে প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ এতটাই গভীর যে, তাদের জন্য ডিজিটাল মাধ্যম এবং কনটেন্ট তৈরির কৌশলগুলো এক ধরনের প্রাকৃতিক দক্ষতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের কাছে এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ব্যবহার একটি সহজাত ব্যাপার। তাদের মধ্যে সামাজিক মিডিয়া অ্যালগরিদম, ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার এবং কনটেন্ট তৈরির দক্ষতা এতই প্রগাঢ় যে, তারা খুব সহজেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পুরো বিশ্বে নিজেদের পৌঁছে দিতে পারে।
আগের প্রজন্মকে তার প্রতিভা দেখাতে টিভি কিংবা পত্রিকার সাহায্য নিতে হতো। তখন কাউকে লেখক হতে গেলে যেমন, পত্রিকার অথর্ব সাহিত্য সম্পাদকদের তেল দিয়ে বেড়াতে হতো, তেমনি গায়ক হতে গেলে পা ধরতে হতো অখ্যাত কোনো গায়ক এবং টিভি প্রোগ্রামের প্রডিউসারকে। আর জেন-জি তাদের ভাষায় বলে দিচ্ছে ‘সাহিত্য সম্পাদক সিডিআই’ কিংবা ‘টিভি প্রোগ্রামের প্রডিউসার সিডিআই’। কারণ বর্তমানে ফেসবুক আর বিভিন্ন টিউব সাইট সেই অভাব পূরণ করছে। তাদের এই স্বাধীনতাকে আমরা ‘কনটেন্ট তৈরির গণতন্ত্র’ বললে ভুল হবে না। তবে, জেন-জির বিনোদনশিল্পে বিপ্লব ঘটানোর মূল কারণ একটি ব্যাপক পরিবর্তন। এখানে কনটেন্ট তৈরির গণতন্ত্রায়ণের ফলে যারা খাবার নিয়ে আসে, তারা আর বাইরে খায় না।
আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী প্রযুক্তি এবং ব্যবহারবান্ধব সফটওয়্যারের বিস্তৃতি জেন-জিকে আকৃষ্ট করেছে। আজকের দিনে এক সাধারণ তরুণও তার স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে প্রফেশনাল মানের কনটেন্ট তৈরি করতে সক্ষম। একসময় যেখানে কনটেন্ট তৈরি করতে বড় স্টুডিও এবং প্রচুর খরচের প্রয়োজন ছিল, এখন সেই কাজটি অনেকটাই ঘরোয়া পরিবেশে, এক ব্যক্তির হাতেই হতে পারে। এই সুযোগটি তুলে নিয়ে জেন-জি তার সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করার জন্য নিজেদের কণ্ঠ তুলে ধরছে এবং নিজেদের গল্প ও চিন্তাভাবনা বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দিচ্ছে।
ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম এবং অন্যান্য সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এখন জেন-জির কনটেন্ট তৈরির প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো এমন এক বিশেষ সুবিধা প্রদান করেছে, যেখানে সহজেই কনটেন্ট তৈরি করা যায় এবং বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিগোচর হতে পারে। এছাড়া এসব প্ল্যাটফর্মে দর্শক তৈরি করা এবং নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করা এখন সহজতর হয়েছে, যেটি আগের প্রজন্মের জন্য ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
ইনফ্লুয়েন্সার সংস্কৃতি ও উদ্যোক্তা মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠেছেন অনেকে। ইনফ্লুয়েন্সার সংস্কৃতি এখন জেন-জির মধ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের মাধ্যমে যে নতুন ধরনের সেলিব্রিটির উত্থান ঘটেছে, তাদের পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা আজকের দিনে অনস্বীকার্য। এরা শুধু কনটেন্ট তৈরির মাধ্যমে নিজেদের পরিচিতি লাভ করেনি, বরং এই তরুণরা আজ বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং বিজ্ঞাপন প্রচারে অংশ নিয়ে নিজের এক নতুন ধারা তৈরি করছে। এই নতুন প্রজন্মের ইনফ্লুয়েন্সাররা ব্যবসা, বিজ্ঞাপন এবং বিনোদনশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তাদের প্রভাব, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সততা ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য প্রচারে কাজে আসছে, যা আগের প্রজন্মের জন্য ছিল অচিন্তনীয়। অনেক জেন-জি কনটেন্ট ক্রিয়েটর শুধু ক্যামেরার সামনে থেমে নেই। তারা তাদের নিজস্ব প্রোডাকশন হাউস শুরু করছে, অ্যাপ ডেভেলপ করছে, কনটেন্ট স্টুডিও গড়ে তুলছে এবং এমনকি নতুন ধরনের ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করছে। এদের উদ্যোক্তা মনোভাব প্রচলিত বিনোদনশিল্পের কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং নতুন এক ডিজিটাল দুনিয়া তৈরি করছে। সেখানে মিডিয়া মাফিয়াদের আগের সেই একক দৌরাত্ম্য অনেকটাই ঠুনকো হয়ে পড়েছে।
জেন-জি শুধু কনটেন্ট তৈরি করছে না, তারা সেই কনটেন্টে বৈচিত্র্য ও প্রতিনিধিত্বের গুরুত্বকেও প্রাধান্য দিচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের জন্য কনটেন্টের মূল উপাদান হলো আস্থা, সঠিকতা এবং বাস্তবতা। তারা এমন কনটেন্টের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে চায়, যা তাদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরে। সেই কনটেন্টের মধ্যে জাতিগত বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্ব এবং সামাজিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা গল্প তাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু একটি ট্রেন্ড নয়, বরং জেন-জির মূল চাহিদা, যা বিনোদনশিল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ করছে।
জেন-জিদের হিসেবে সৃজনশীলতার জন্য বড় মঞ্চে পৌঁছানোর জন্য বিখ্যাত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন যে কেউই নিজের কনটেন্টকে ভাইরাল করতে পারে এবং তা মুহূর্তেই হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট তৈরি করা, যেকোনো সময় একটি বড় প্ল্যাটফর্মে পৌঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ‘ফর ইউ পেজ’ বা ‘এক্সপ্লোর পেজ’র মতো ফিচারগুলোর মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তারা তাদের নিজস্ব কনটেন্টকে একটি বৃহত্তর অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন। এটি শুধু কনটেন্ট ক্রিয়েটরের জন্য নয়, বিনোদনশিল্পের জন্যও লাভজনক। জনপ্রিয় টিকটকার, ইউটিউবার এবং ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সারদের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন, সিনেমা এবং টিভি শোতে অংশগ্রহণ করার, যা বিনোদন কোম্পানির জন্য একটি বিশাল লাভজনক পদক্ষেপ।
জেন-জি নিজেই আজকের বিনোদনশিল্পের রূপান্তরের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে। তারা প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা, বৈচিত্র্য এবং আত্মবিশ্বাসের মিশেলে এক ‘নতুন ও বৈপ্লবিক বিনোদন সংস্কৃতি’ তৈরি করছে। বিনোদন শুধু উপভোগের বিষয় নয় তাদের কাছে। তাদের তৈরি এসব কনটেন্ট বিশ্বব্যাপী পৌঁছেও যাচ্ছে সবার কাছে। এটি শুধু একটি ট্রেন্ড নয়, বরং একটি বিপ্লব, যা বিনোদনশিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এই প্রজন্মের সৃজনশীলতা, উদ্যোগ এবং বৈচিত্র্যকে তাই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ তারা শুধু শিল্প নয়, পুরো সমাজকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। তাই সম্প্রতি বিনোদনের ক্ষেত্রে যে বিপ্লব ঘটে গেছে, সেটিকে হিসাবের বাইরে রাখলে কারো পক্ষে জেন-জি সংস্কৃতি বোঝা কঠিন হবে। যারা এর বাইরে থাকছেন, সমাজের আকস্মিক বাঁকবদল সম্পর্কেও তারা রয়ে গিয়েছেন এক ধরনের অজ্ঞাতবাসে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (ইতিহাস), ওপেন স্কুল, বাংলাদেশে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


বামপন্থা ও স্বৈরাচার
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব?