
তারেক হাসান

দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তি হয়ে ওঠার পথে ভারত দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন ও মস্কোর সঙ্গে দ্বৈত কূটনীতির একটি নকশা অনুসরণ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা দুই স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েই ভারত তার বহুমুখী কূটনৈতিক অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর শুল্কনীতি, বিশেষত ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ সম্পর্কের এই ভারসাম্যকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘এশিয়া পিভট’ কৌশল, যা ওবামা প্রশাসন ২০১১ সালে রিব্যালান্স টু এশিয়া হিসেবে ঘোষণা করেছিল, যা ভারতের জন্য ছিল একধরনের কৌশলগত আশীর্বাদ। সেই নীতির অন্তর্গত ‘কোয়াড’ জোট (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান) চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় একটি নিরাপত্তা বলয়ের তীর হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ট্রাম্পের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে চীনের ওপর আপাতদৃষ্টিতে নরম ভঙ্গি এবং ভারতের ওপর কঠোর বাণিজ্যিক চাপ একসঙ্গে দৃশ্যমানের বাইনারি পুরো আঞ্চলিক কূটনৈতিক সমীকরণকে পুনর্বিবেচনার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ইতিহাসে যেখানে দেখা যায়, ২০০০ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উভয় দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট ভারতকে চীনের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী ছিল। এ কারণেই জর্জ ডব্লিউ বুশ থেকে শুরু করে বারাক ওবামা পর্যন্ত নিউ দিল্লির সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্বকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। এমনকি জো বাইডেনের সময়ও ভারতের ওপর নির্ভর করে রাশিয়া-চীন ঘনিষ্ঠতাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা ছিল স্পষ্ট। কিন্তু ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে সেই ধারাবাহিকতা ভেঙে গেছে।
এই পরিস্থিতিকে আমরা মার্কিন কূটনীতির মৌলিক রূপান্তরের প্রতিফলন হিসেবেও চিন্তা করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনকেন্দ্রিক দীর্ঘমেয়াদি কৌশল থেকে সরে এসে স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। ভারত ইতোমধ্যেই রাশিয়া-ভারত-চীন প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা ওয়াশিংটনের কাছে একধরনের কূটনৈতিক সতর্কবার্তা।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উত্থান
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ইতিহাস মূলত স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক কাঠামোর ভেতরেই নতুন মাত্রা পেয়েছে। স্বাধীনতার পর ভারত দীর্ঘ সময় জোটনিরপেক্ষ নীতির অংশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান সংজ্ঞায়িত করেছিল, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ছিল দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ভারত ছিল দ্বিধাগ্রস্ত একটি শক্তি, যে কি না একদিকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতিনিধি, আবার অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্লকের সঙ্গে মিত্র। এ কারণেই ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ওয়াশিংটন বরং পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত অংশীদার হিসেবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চিত্র পাল্টে যায়। ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর ভারত বিশ্ববাজারে প্রবেশ করে এবং প্রযুক্তি ও সেবা খাতে দ্রুত একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভারতের বিপুল বাজার ও দক্ষ জনশক্তিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এই অর্থনৈতিক মাত্রার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করতে থাকে, এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারতের উত্থান চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সক্ষম।
২০০৫ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সময় স্বাক্ষরিত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি ছিল এই সম্পর্কের প্রথম বড় মাইলফলক। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সে সময় ভারতের প্রতি কৌশলগত ‘আলট্রুইজম’ প্রদর্শন করেছিল, যেখানে বৈশ্বিক পরমাণু শৃঙ্খলার কড়াকড়ি শিথিল করে নয়াদিল্লিকে একটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয় যে ভারতকে তারা দীর্ঘমেয়াদি অংশীদার হিসেবে দেখতে চায়।
ওবামা প্রশাসনের সময় এই সম্পর্ক আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এ সময় ‘পিভট টু এশিয়া’ কৌশলের অন্তর্গত নিরাপত্তা সহযোগিতা ছিল দৃশ্যমান। যেমন : মালাবার নৌ-ব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা চুক্তি, সন্ত্রাসবাদ দমন সহযোগিতাসহ ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো দৃঢ়তর হয়। তবে এই উষ্ণ সম্পর্কের পেছনে একটি বৃহত্তর কৌশলগত হিসাবও ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভারসাম্য করার জন্য বিকল্প শক্তি খুঁজছিল। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মিত্ররা নিরাপত্তা ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য হলেও, তাদের ভূরাজনৈতিক পরিসর সীমিত। ভারত ছিল একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যার রয়েছে বিপুল জনসংখ্যা, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং ভৌগোলিকভাবে ভারত মহাসাগর থেকে হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত কৌশলগত উপস্থিতি। তাই ওয়াশিংটনের কাছে ভারতকে ‘স্ট্র্যাটেজিক পিভট’ হিসেবে কল্পনা করা স্বাভাবিক ছিল। তবে ভারতও সমানভাবে এই সম্পর্ক থেকে লাভবান হতে চেয়েছে। ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক পরীক্ষার পর ভারত যে আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মুখে পড়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্রের সান্নিধ্য ছিল অপরিহার্য। একই সঙ্গে, প্রযুক্তি স্থানান্তর, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়, সাইবার ও মহাকাশ খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ভারতের কৌশলগত সক্ষমতা বাড়ায়।
এই ঐতিহাসিক যাত্রাপথ থেকে একটি সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কখনোই নিছক কূটনৈতিক সৌজন্যতার ফল নয়, বরং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক ক্যালকুলেশনের অংশ। বর্তমান সময়ের অস্থিরতা ও টানাপোড়েন বুঝতে হলে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে অবহেলা করা যাবে না। কারণ এই অতীতই প্রমাণ করে, উষ্ণতা ও শীতলতার উত্থান-পতনের মধ্যেও দুই দেশের মধ্যে একটি কৌশলগত ‘ইনভিজিবল হেল্পিং হ্যান্ড’ কাজ করেছে চীনকে কেন্দ্র করে।
ট্রাম্পের আমলে সম্পর্কের নতুন ধাক্কা
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উত্থানকে যদি এক দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়, তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামল সেখানে এক অপ্রত্যাশিত ও অস্থিতিশীল বাঁক এনে দিয়েছে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন—‘Howdy Modi’ (হিউস্টন, ২০১৯) এবং ‘Namaste Trump’ (আহমেদাবাদ, ২০২০) সমাবেশে দুই নেতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন ‘প্রকৃত বন্ধুত্বের’র প্রদর্শনী। কিন্তু রাজনৈতিক আলোকচিত্র আর বাস্তব নীতির ফারাক শিগগির স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ। এ শুল্ক আরোপকে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ‘বিশেষ অংশীদার’ হিসেবে যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তা হঠাৎ করে ছিন্ন হলো। দ্বিতীয়ত, এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ভারতের রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির কারণে, যা একদিকে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে অপরিহার্য, অন্যদিকে পূর্ববর্তী বাইডেন প্রশাসন নিজেই উৎসাহিত করেছিল বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ফলে নয়াদিল্লির কাছে এটি দ্বৈত মানদণ্ডের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায় : একই কর্মকাণ্ডের জন্য চীন শিথিলতা পাচ্ছে অথচ ভারত শাস্তি ভোগ করছে।
এখানেই ট্রাম্পের নীতির ট্রানজ্যাকশনাল (লেনদেনভিত্তিক) চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওবামা ও বুশ প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সমীকরণের ছায়াপথে অবস্থান করেছিল, যেখানে মূল্যবোধ, নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ভারসাম্য সব একসঙ্গে বিবেচনায় আনা হতো। কিন্তু ট্রাম্পের কাছে পররাষ্ট্রনীতি হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের ব্যবসায়িক চুক্তি, যেখানে তৎক্ষণাৎ লাভ-ক্ষতি ছাড়া অন্য কোনো বিষয় খুব বেশি গুরুত্ব পায় না। ফলত, ভারতের বহুমুখী কূটনীতির (মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট) কৌশলগত চুক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই অস্থির মানসিকতা অনেকটা সাংঘর্ষিক টার্ম হিসেবে পরিচিতি পায়।
ভারতের ভেতরে এর রাজনৈতিক অভিঘাতও কম নয়। মোদি সরকার সবসময় যুক্তরাষ্ট্রকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে তুলে ধরেছে, বিশেষ করে চীনকে মোকাবিলার প্রেক্ষাপটে। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ এবং প্রকাশ্য চাপ সৃষ্টি সেই আস্থাকে চূর্ণ করেছে। এটি দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে গত কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় ফাটল। ভারতের কূটনীতিকরা প্রথমে ট্রাম্পকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও, শেষ পর্যন্ত নয়াদিল্লিকে প্রকাশ্যে ওয়াশিংটনকে ভণ্ডামির অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়েছে।
ট্রাম্পের নীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পাকিস্তান ফ্যাক্টর। ভারত যখন রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনেছিল, তখন মার্কিন কংগ্রেসের অনেকেই ভারতের জন্য নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছিল। কারণ ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব স্পষ্ট ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের আমলে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানো এবং দ্বিপক্ষীয় উষ্ণতার সংকেত নয়াদিল্লির কাছে ছিল আস্থার বড় ধাক্কা। ভারতের কৌশলবিদদের দীর্ঘদিনের সন্দেহ যে ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে কখনোই সম্পূর্ণ ছাড়তে পারবে না, ট্রাম্প সেই আশঙ্কাকে নতুন জীবন দিলেন। চীন প্রসঙ্গও এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন হলো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং কোয়াড জোটের মাধ্যমে ভারতকে সামনের সারিতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতার জন্য একদিকে চাপ কমাতে থাকেন, অন্যদিকে ভারতের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক চাপ আরোপ করেন। এ বৈপরীত্য স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিল, ওয়াশিংটনের কৌশলগত অগ্রাধিকার চীনকে ঘিরে হলেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখন আর অপরিহার্য নয়, বরং আলোচনার টেবিলে দর-কষাকষির অংশ।
এই পর্বে ভারতের জন্য শিক্ষা হলো ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব বা আবেগনির্ভর কূটনীতি টেকসই নয়। মোদি-ট্রাম্পের উষ্ণ প্রদর্শনী রাজনৈতিকভাবে নজর কাড়লেও, তার কোনো বাস্তব কূটনৈতিক সুরক্ষা দিল না। বরং এই অভিজ্ঞতা নয়াদিল্লিকে মনে করিয়ে দিল, বহুমুখী কূটনীতি (মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট) শুধু বিকল্প নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার একমাত্র পথ। যদি ওয়াশিংটন অস্থির ও লেনদেননির্ভর হয়ে ওঠে, তবে মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে কৌশলগত সমীকরণ গড়ে তোলাই ভারতের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
এশিয়ার কৌশলগত বাস্তবতা
আজকের বাস্তবতায় এশিয়া হচ্ছে বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি, ভারত মহাসাগরে চীনা বন্দর ও নৌঘাঁটির নেটওয়ার্ক, কোয়াড বনাম ব্রিকসের পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক বার্তা ইত্যাদি সবকিছুই প্রমাণ করে যে এশিয়া ভবিষ্যতের বিশ্ব রাজনীতির প্রধান মঞ্চ। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কীভাবে বহুমুখী কূটনীতি বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। ভারত একদিকে কোয়াডে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার হতে চায়, আবার অন্যদিকে ব্রিকস ও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে রাশিয়া-চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে চায়। কিন্তু ট্রাম্পের বর্তমান বাণিজ্যিক আঘাত ভারতের জন্য স্পষ্ট সংকেত। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ‘স্ট্র্যাটেজিক আলট্রুইজম’ দেখাবে না, বরং তাৎক্ষণিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে। এর ফলে নয়াদিল্লির সামনে দাঁড়াচ্ছে একটি নতুন প্রশ্ন, এশিয়ার ভবিষ্যৎ শক্তি ভারসাম্যে ভারত কতটা স্বাধীনভাবে খেলতে পারবে আর কতটা বাধ্য থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের বা চীনের প্রভাবে চলতে।
চীন ফ্যাক্টরই এখন ভারতের কূটনৈতিক দোটানার কেন্দ্রবিন্দু : যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করলে অনিশ্চয়তা, চীনের দিকে ঝুঁকলেই নিরাপত্তা সংকট। আর এই টানাপোড়েনের ভেতরেই গড়ে উঠতে যাচ্ছে এশিয়ার আগামী দিনের কৌশলগত বাস্তবতা।
লেখক : গবেষক

দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তি হয়ে ওঠার পথে ভারত দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন ও মস্কোর সঙ্গে দ্বৈত কূটনীতির একটি নকশা অনুসরণ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা দুই স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েই ভারত তার বহুমুখী কূটনৈতিক অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর শুল্কনীতি, বিশেষত ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ সম্পর্কের এই ভারসাম্যকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘এশিয়া পিভট’ কৌশল, যা ওবামা প্রশাসন ২০১১ সালে রিব্যালান্স টু এশিয়া হিসেবে ঘোষণা করেছিল, যা ভারতের জন্য ছিল একধরনের কৌশলগত আশীর্বাদ। সেই নীতির অন্তর্গত ‘কোয়াড’ জোট (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান) চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় একটি নিরাপত্তা বলয়ের তীর হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ট্রাম্পের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে চীনের ওপর আপাতদৃষ্টিতে নরম ভঙ্গি এবং ভারতের ওপর কঠোর বাণিজ্যিক চাপ একসঙ্গে দৃশ্যমানের বাইনারি পুরো আঞ্চলিক কূটনৈতিক সমীকরণকে পুনর্বিবেচনার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ইতিহাসে যেখানে দেখা যায়, ২০০০ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উভয় দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট ভারতকে চীনের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী ছিল। এ কারণেই জর্জ ডব্লিউ বুশ থেকে শুরু করে বারাক ওবামা পর্যন্ত নিউ দিল্লির সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্বকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। এমনকি জো বাইডেনের সময়ও ভারতের ওপর নির্ভর করে রাশিয়া-চীন ঘনিষ্ঠতাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা ছিল স্পষ্ট। কিন্তু ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে সেই ধারাবাহিকতা ভেঙে গেছে।
এই পরিস্থিতিকে আমরা মার্কিন কূটনীতির মৌলিক রূপান্তরের প্রতিফলন হিসেবেও চিন্তা করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনকেন্দ্রিক দীর্ঘমেয়াদি কৌশল থেকে সরে এসে স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। ভারত ইতোমধ্যেই রাশিয়া-ভারত-চীন প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা ওয়াশিংটনের কাছে একধরনের কূটনৈতিক সতর্কবার্তা।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উত্থান
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ইতিহাস মূলত স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক কাঠামোর ভেতরেই নতুন মাত্রা পেয়েছে। স্বাধীনতার পর ভারত দীর্ঘ সময় জোটনিরপেক্ষ নীতির অংশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান সংজ্ঞায়িত করেছিল, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ছিল দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ভারত ছিল দ্বিধাগ্রস্ত একটি শক্তি, যে কি না একদিকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতিনিধি, আবার অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্লকের সঙ্গে মিত্র। এ কারণেই ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ওয়াশিংটন বরং পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত অংশীদার হিসেবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চিত্র পাল্টে যায়। ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর ভারত বিশ্ববাজারে প্রবেশ করে এবং প্রযুক্তি ও সেবা খাতে দ্রুত একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভারতের বিপুল বাজার ও দক্ষ জনশক্তিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এই অর্থনৈতিক মাত্রার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করতে থাকে, এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারতের উত্থান চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সক্ষম।
২০০৫ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সময় স্বাক্ষরিত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি ছিল এই সম্পর্কের প্রথম বড় মাইলফলক। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সে সময় ভারতের প্রতি কৌশলগত ‘আলট্রুইজম’ প্রদর্শন করেছিল, যেখানে বৈশ্বিক পরমাণু শৃঙ্খলার কড়াকড়ি শিথিল করে নয়াদিল্লিকে একটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয় যে ভারতকে তারা দীর্ঘমেয়াদি অংশীদার হিসেবে দেখতে চায়।
ওবামা প্রশাসনের সময় এই সম্পর্ক আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এ সময় ‘পিভট টু এশিয়া’ কৌশলের অন্তর্গত নিরাপত্তা সহযোগিতা ছিল দৃশ্যমান। যেমন : মালাবার নৌ-ব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা চুক্তি, সন্ত্রাসবাদ দমন সহযোগিতাসহ ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো দৃঢ়তর হয়। তবে এই উষ্ণ সম্পর্কের পেছনে একটি বৃহত্তর কৌশলগত হিসাবও ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভারসাম্য করার জন্য বিকল্প শক্তি খুঁজছিল। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মিত্ররা নিরাপত্তা ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য হলেও, তাদের ভূরাজনৈতিক পরিসর সীমিত। ভারত ছিল একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যার রয়েছে বিপুল জনসংখ্যা, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং ভৌগোলিকভাবে ভারত মহাসাগর থেকে হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত কৌশলগত উপস্থিতি। তাই ওয়াশিংটনের কাছে ভারতকে ‘স্ট্র্যাটেজিক পিভট’ হিসেবে কল্পনা করা স্বাভাবিক ছিল। তবে ভারতও সমানভাবে এই সম্পর্ক থেকে লাভবান হতে চেয়েছে। ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক পরীক্ষার পর ভারত যে আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মুখে পড়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্রের সান্নিধ্য ছিল অপরিহার্য। একই সঙ্গে, প্রযুক্তি স্থানান্তর, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়, সাইবার ও মহাকাশ খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ভারতের কৌশলগত সক্ষমতা বাড়ায়।
এই ঐতিহাসিক যাত্রাপথ থেকে একটি সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কখনোই নিছক কূটনৈতিক সৌজন্যতার ফল নয়, বরং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক ক্যালকুলেশনের অংশ। বর্তমান সময়ের অস্থিরতা ও টানাপোড়েন বুঝতে হলে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে অবহেলা করা যাবে না। কারণ এই অতীতই প্রমাণ করে, উষ্ণতা ও শীতলতার উত্থান-পতনের মধ্যেও দুই দেশের মধ্যে একটি কৌশলগত ‘ইনভিজিবল হেল্পিং হ্যান্ড’ কাজ করেছে চীনকে কেন্দ্র করে।
ট্রাম্পের আমলে সম্পর্কের নতুন ধাক্কা
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উত্থানকে যদি এক দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়, তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামল সেখানে এক অপ্রত্যাশিত ও অস্থিতিশীল বাঁক এনে দিয়েছে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন—‘Howdy Modi’ (হিউস্টন, ২০১৯) এবং ‘Namaste Trump’ (আহমেদাবাদ, ২০২০) সমাবেশে দুই নেতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন ‘প্রকৃত বন্ধুত্বের’র প্রদর্শনী। কিন্তু রাজনৈতিক আলোকচিত্র আর বাস্তব নীতির ফারাক শিগগির স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ। এ শুল্ক আরোপকে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ‘বিশেষ অংশীদার’ হিসেবে যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তা হঠাৎ করে ছিন্ন হলো। দ্বিতীয়ত, এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ভারতের রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির কারণে, যা একদিকে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে অপরিহার্য, অন্যদিকে পূর্ববর্তী বাইডেন প্রশাসন নিজেই উৎসাহিত করেছিল বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ফলে নয়াদিল্লির কাছে এটি দ্বৈত মানদণ্ডের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায় : একই কর্মকাণ্ডের জন্য চীন শিথিলতা পাচ্ছে অথচ ভারত শাস্তি ভোগ করছে।
এখানেই ট্রাম্পের নীতির ট্রানজ্যাকশনাল (লেনদেনভিত্তিক) চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওবামা ও বুশ প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সমীকরণের ছায়াপথে অবস্থান করেছিল, যেখানে মূল্যবোধ, নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ভারসাম্য সব একসঙ্গে বিবেচনায় আনা হতো। কিন্তু ট্রাম্পের কাছে পররাষ্ট্রনীতি হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের ব্যবসায়িক চুক্তি, যেখানে তৎক্ষণাৎ লাভ-ক্ষতি ছাড়া অন্য কোনো বিষয় খুব বেশি গুরুত্ব পায় না। ফলত, ভারতের বহুমুখী কূটনীতির (মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট) কৌশলগত চুক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই অস্থির মানসিকতা অনেকটা সাংঘর্ষিক টার্ম হিসেবে পরিচিতি পায়।
ভারতের ভেতরে এর রাজনৈতিক অভিঘাতও কম নয়। মোদি সরকার সবসময় যুক্তরাষ্ট্রকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে তুলে ধরেছে, বিশেষ করে চীনকে মোকাবিলার প্রেক্ষাপটে। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ এবং প্রকাশ্য চাপ সৃষ্টি সেই আস্থাকে চূর্ণ করেছে। এটি দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে গত কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় ফাটল। ভারতের কূটনীতিকরা প্রথমে ট্রাম্পকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও, শেষ পর্যন্ত নয়াদিল্লিকে প্রকাশ্যে ওয়াশিংটনকে ভণ্ডামির অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়েছে।
ট্রাম্পের নীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পাকিস্তান ফ্যাক্টর। ভারত যখন রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনেছিল, তখন মার্কিন কংগ্রেসের অনেকেই ভারতের জন্য নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছিল। কারণ ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব স্পষ্ট ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের আমলে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানো এবং দ্বিপক্ষীয় উষ্ণতার সংকেত নয়াদিল্লির কাছে ছিল আস্থার বড় ধাক্কা। ভারতের কৌশলবিদদের দীর্ঘদিনের সন্দেহ যে ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে কখনোই সম্পূর্ণ ছাড়তে পারবে না, ট্রাম্প সেই আশঙ্কাকে নতুন জীবন দিলেন। চীন প্রসঙ্গও এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন হলো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং কোয়াড জোটের মাধ্যমে ভারতকে সামনের সারিতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতার জন্য একদিকে চাপ কমাতে থাকেন, অন্যদিকে ভারতের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক চাপ আরোপ করেন। এ বৈপরীত্য স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিল, ওয়াশিংটনের কৌশলগত অগ্রাধিকার চীনকে ঘিরে হলেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখন আর অপরিহার্য নয়, বরং আলোচনার টেবিলে দর-কষাকষির অংশ।
এই পর্বে ভারতের জন্য শিক্ষা হলো ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব বা আবেগনির্ভর কূটনীতি টেকসই নয়। মোদি-ট্রাম্পের উষ্ণ প্রদর্শনী রাজনৈতিকভাবে নজর কাড়লেও, তার কোনো বাস্তব কূটনৈতিক সুরক্ষা দিল না। বরং এই অভিজ্ঞতা নয়াদিল্লিকে মনে করিয়ে দিল, বহুমুখী কূটনীতি (মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট) শুধু বিকল্প নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার একমাত্র পথ। যদি ওয়াশিংটন অস্থির ও লেনদেননির্ভর হয়ে ওঠে, তবে মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে কৌশলগত সমীকরণ গড়ে তোলাই ভারতের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
এশিয়ার কৌশলগত বাস্তবতা
আজকের বাস্তবতায় এশিয়া হচ্ছে বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি, ভারত মহাসাগরে চীনা বন্দর ও নৌঘাঁটির নেটওয়ার্ক, কোয়াড বনাম ব্রিকসের পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক বার্তা ইত্যাদি সবকিছুই প্রমাণ করে যে এশিয়া ভবিষ্যতের বিশ্ব রাজনীতির প্রধান মঞ্চ। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কীভাবে বহুমুখী কূটনীতি বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। ভারত একদিকে কোয়াডে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার হতে চায়, আবার অন্যদিকে ব্রিকস ও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে রাশিয়া-চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে চায়। কিন্তু ট্রাম্পের বর্তমান বাণিজ্যিক আঘাত ভারতের জন্য স্পষ্ট সংকেত। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ‘স্ট্র্যাটেজিক আলট্রুইজম’ দেখাবে না, বরং তাৎক্ষণিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে। এর ফলে নয়াদিল্লির সামনে দাঁড়াচ্ছে একটি নতুন প্রশ্ন, এশিয়ার ভবিষ্যৎ শক্তি ভারসাম্যে ভারত কতটা স্বাধীনভাবে খেলতে পারবে আর কতটা বাধ্য থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের বা চীনের প্রভাবে চলতে।
চীন ফ্যাক্টরই এখন ভারতের কূটনৈতিক দোটানার কেন্দ্রবিন্দু : যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করলে অনিশ্চয়তা, চীনের দিকে ঝুঁকলেই নিরাপত্তা সংকট। আর এই টানাপোড়েনের ভেতরেই গড়ে উঠতে যাচ্ছে এশিয়ার আগামী দিনের কৌশলগত বাস্তবতা।
লেখক : গবেষক

বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। দেশকে দ্রুতই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যাতে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বায়োমাস, বর্জ্য থেকে জ্বালানি, জৈবজ্বালানি, ভূ-তাপীয় শক্তি, জোয়ার-ভাটা শক্তি...
১২ ঘণ্টা আগে
রাজশাহীর যে শহর একসময় পদ্মা, বারনই, নবগঙ্গা, বারহী, বড়াল, শিবনদী আর অসংখ্য খাল-বিলের জলধারায় জীবন্ত ছিল, আজ সেখানে কেবল শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ আর বিষাক্ত বর্জ্যের স্তুপ। নদী ছিল এই শহরের প্রাণ, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের মূল উৎস।
১৩ ঘণ্টা আগে
সাধারণত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা জানেন সময় কত বেশি মূল্যবান। একটি প্রবাদ আছেÑ‘সময় হলো সোনার মতো দামি’। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করেন। আর ইসলামে সময় স্বর্ণ কিংবা বিশ্বের যেকোনো মূল্যবান বস্তুর চেয়ে বেশি দামি। সময়ের মূল্য কী, ইসলাম শুধু তা-ই শেখায় না। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ইসলাম মানবজাতিকে বিশেষভাবে শেখ
২০ ঘণ্টা আগে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংশ্লিষ্টতার পক্ষে ঢোল জোরেশোরেই বাজছে ওয়াশিংটনে। নীতিনির্ধারণী মহলে কেউ কেউ ফিসফিস করে আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে চিৎকার করে বলছেন গাজায় সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য।
২০ ঘণ্টা আগে