ভূরাজনীতির দাবা খেলায় বাংলাদেশ আজ শুধু কোনো ক্ষুদ্র ঘুঁটি নয়, বরং এক শক্তিশালী খেলোয়াড়। বাংলাদেশ আজ তার কৌশলগত অবস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জনশক্তিসহ বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে। বিশেষ করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশকে দিয়েছে এক অনন্য সুযোগ, যা কাজে লাগিয়ে দেশটি তার সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। এটি এখন আর কোনো দুর্বল প্রতিবেশী নয়, বরং একটি উদীয়মান শক্তি, যার সামনে অপার সম্ভাবনা এবং কিছু সুদূরপ্রসারী চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ভূগোলই যেখানে শক্তি
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের মূল কারণ এর অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান। একদিকে বিশাল বঙ্গোপসাগর, যা বিশ্ববাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ জলপথ; অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য, যা ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত। এই রাজ্যগুলো ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এবং তাদের সংযোগস্থল হলো বাংলাদেশসংলগ্ন সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেন নেক’। এই করিডোরের যেকোনো বিঘ্ন ঘটলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। ভারত ভালো করেই জানে, এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক অপরিহার্য।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক মন্তব্য ‘আমরাই সাগরের অভিভাবক’ একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে। এই বক্তব্য শুধু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের দাবিই প্রতিষ্ঠা করে না, বরং এটি ভারতের ‘সাগর’-নীতির বিপরীতে বাংলাদেশের নিজস্ব কৌশলগত অবস্থানকে জোরালোভাবে তুলে ধরে। এই মন্তব্যে এটি স্পষ্ট হয়, ভারত বা অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশের ভূখণ্ড ও সমুদ্রপথকে নিঃশর্তভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। বরং যেকোনো সহযোগিতা হবে পারস্পরিক সম্মান এবং সার্বভৌমত্বের নীতির ভিত্তিতে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের জন্য একটি কঠিন বাস্তবতা, কারণ এতে তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় ছন্দপতন ঘটে।
অর্থনীতির উত্থান ও কৌশলগত অবস্থান
বাংলাদেশ এখন আর তথাকথিত তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘এশিয়ান টাইগার’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আইএমএফ এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে চলেছে। এই অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং ১৮ কোটির বিশাল জনসংখ্যা, যার অধিকাংশই তরুণ, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ সব পরাশক্তিই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাজার এবং কৌশলগত অবস্থানের সুবিধা নিতে আগ্রহী।
ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড হিসেবে কাজ করছে। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বিআরআইয়ের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী আর যুক্তরাষ্ট্র তার এশিয়া-প্যাসিফিক কৌশল দিয়ে চীনের প্রভাবকে মোকাবিলা করতে চাইছে। এই দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশ যদি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি বজায় রাখতে পারে, তবে উভয় পক্ষ থেকেই অর্থনৈতিক ও সামরিক সুবিধা আদায় করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে বিচক্ষণতার সঙ্গে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে দেশের সব পক্ষকে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে এক হতে হবে। এটিই বৈদেশিক চাপ মোকাবিলা এবং শক্তিশালী অবস্থান তৈরির মূল ভিত্তি। কোনো নির্দিষ্ট পরাশক্তির দিকে ঝুঁকে না পড়ে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি, কারণ প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ জড়িত। বৈদেশিক ঋণ ও নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে হবে। দুর্নীতি দমন এবং উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে একটি টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য। দেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে এবং কোনো পরাশক্তির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ কমিয়ে দেবে।
বাংলাদেশের ভূখণ্ড ও সমুদ্রপথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘ইকুইটিফুল’ বা সমতাপূর্ণ নীতি গ্রহণ করতে হবে। ট্রানজিট বা করিডোর সুবিধার বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তি যেন সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
বঙ্গোপসাগরের খনিজসম্পদ ও বাণিজ্যিক পথের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মাতারবাড়ীর মতো গভীর সমুদ্রবন্দরগুলো শুধু বিদেশি শক্তির সুবিধার জন্য নয়, বরং দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক হাব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিশাল তরুণ জনসংখ্যাকে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। তারাই ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেবে। এই পথে চলতে পারলে বাংলাদেশ শুধু আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার শিকার হবে না, বরং নিজের কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে একটি স্বনির্ভর ও মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
লেখক : শিক্ষক, কক্সবাজার

