আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

খৃস্টের সম্মান

ড. আহমদ আনিসুর রহমান

খৃস্টের সম্মান

হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান

তুমি মোরে দানিয়াছ খৃষ্টের সম্মন ।।

বিজ্ঞাপন

খৃষ্ট সারা বিশ্বের। কোন একটি মাত্র ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায় বা দেশের শুধু ন’ন।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপরোক্ত চরণদ্বয়ে খৃষ্টের প্রতি যে গভীর প্রেম-ভক্তি সিক্ত সম্মামানের প্রকাশ, তা’তেই তা’ দিবালোক সম প্রকাশ।

বাংলা জাতির অনার্য বিশ্বদৃষ্টি

মূলতঃ ও প্রধানতঃ সেমিটিক, তথা শ্যাম-বংশীয় – শ্যামল – অনার্য বাংলা জাতির বিশ্ব জনীনতামুখী বিশ্বদৃষ্টি (“Weltenschaun”, বা World-view”)-সঞ্জাত সংস্কৃতিতে তা’ আরো ।

বিকৃত হয়ে পড়া আর্য জাতায়ভিমান-জাত বর্ণ প্রথার জাত-পাত আর বর্ণ-বিদ্বেষী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের সঙ্কীর্ণতার উর্ধে উঠে এই অনার্য বাংলা জাতি নিজেকে দেখে ব্যাপকতর বিশ্বের এক সগর্ব বিশ্বময় জ্ঞাতি করা সমান সদস্য সেরা জাতিদের অন্যতম হিসেবে। তারই এক কবির ভাষায়,

ধন ধাণ্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা

তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা,

আর , আবারও সেই বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,

আমরা সেই সে জাতি –

সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা,

বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।

সমগ্র মানব কূলের সঙ্গে এই জ্ঞাতি-বন্ধন বোধ থেকেই বাংলাদেশের হাজারো বছরের বিবর্তনে আজ বিশালতর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রধানতঃ ই মুসলিম রূপে বিকশিত বাংলা জাতি সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের বেথলেমের খৃষ্টের সম্মানকে সেভাবেই একান্ত আপন করে সগর্বে তাতে তৃপ্ত, যে ভাবে ঐ একই মধ্যপ্রাচ্যের মদীনার মহানবী মোহাম্মদের সপ্রেম আনুগত্য- অনুসরণে সে বলে,

বাংলাদেশের কুটীর হতে

দূর আরবের স্বপন দেখি…

আমার নূর নবী হজরত …।।

তাদের অনুসৃত কোরানেই বলা হয়, “তারা বলে … আমরা তাঁদের কোন একজনের সংগেও পার্থক্য করিনা”, অর্থাৎ ভক্তি ভরে আপন করে নিতে, আর তাদের অনুসৃত হাদীসে জানান হয়, তাদের নবী মোহাম্মদ য়ীস’র সঙ্গে তাঁর নিজের নেকট্যের কথা জানাতে নিজের হাতের তর্জনী আর মধ্যমাকে একসাথ করে দেখিয়ে বলেছেন, তিনি আর খৃষ্ট ওরকম, অর্থাৎ অবিচ্ছেদ্য নৈকট্যে। হজরত মোহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের এটাও বলে যান যে জগতে অন্য সব ধর্ম-রূপ অনুসারীদের ভেতর খৃষ্টের অনুসারীরাই হবে ভালবাসায় সবচেয়ে নিকট, কোরানে বলা হয়েছে, যেদিন য়ীস’র জন্ম, সে দিন “সালাম “ – অর্থাৎ শান্তি, অভিবাদন।

খৃষ্টের জন্ম দিনের শান্তি বা অভিবাদন উদযাপনেই মূলতঃ খৃষ্টানুসরণে আগ্রহী গণের “খৃষ্টমাস”, যাকে তাঁরা “বড়দিন” বলেন আজকাল বাংলায়। ইংরেজী শাসনের প্রভাবে তা “ইংরেজী” পঞ্জিকা মতে, ইংরেজী রীতি অনুযায়ী করেন ২৫ শে ডিসেম্বর। যদিও আসলে জন্মের সে তারিখ খৃষ্টের জন্মস্থান, বেথলেহেমে প্রচলিত সেখান কার প্রাচীন পঞ্জিকা-মতে ঠিক সে তারিখে ছিল – কিন্তু কখনো কখনো বাস্তব অবস্থাগত সুবিধার জন্য কোন কোন ঐতিহাসিক ঘটণার স্মরণিকা পালিত হয় সুবিধাজনক অন্য কোন এক দিনে। যেমনটি বিলেতের রাণী ২য় এলিজাবেথের জন্মদিনের বেলায় হয়, সাম্প্রতিক কালেও। খৃষ্টমাসের ক্ষেত্রেও সে রকমই হয় ইংরেজদের বিলাত সহ পশ্চিম য়ুরোপে – আর তার প্রভাবে বাংলার খৃষ্টানদের বেলায়।

আজো পূর্ব য়ুরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকা সহ প্রাচ্যের বহু খৃষ্টান সমাজেই খৃষ্টমাস পালিত হয় অন্য তারিখ, উদাহরণ স্বরূপ, ১০ ই জানুয়ারীতে।

খৃষ্ট ও তাঁর অনুসারীদের সম্পর্কে হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর নিজের অনুসারী, তথা “মুসলমান”-দের শেখানো, ওপরে বর্ণিত কোরান-হাদীসের কথাগুলো সত্বেও এঁরা খৃষ্টধর্মের আজকের প্রচলিত রূপকে গ্রহণ করেন না, তা’তে ধর্মান্তরিত করবার বিবিধ প্রচেষ্টা সম্পর্কে সচেতন থেকে তার বিরুদ্ধাচারণকে নিজেদের ধর্মমতে বাধ্যতামূলক মনে করেন – আর খৃষ্টধর্মের আজকের ঐ প্রচলিত রূপ অনুযায়ী খৃষ্টের জন্মদিনের শান্তি ও সালাম, বা অভিবাদনের উদযাপনো করেন না। যদিও হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর শিক্ষানুযায়ীই সর্ব ধরম-রূপে সহিষ্ণুতার নীতি পালনে খৃষ্টধর্মের আজকের প্রচলিত রূপের অনুসারীদের সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ্মুক্ত শান্তিপূর্ণভাবে,তাঁদের মত সে সব পালনে বাধাও দেন না, এমন বাধাদানকে পাপ মনে করেন।

কেনই বা বাংলাদেশের বিশালাংশের নিজেদের ধরমেরই শিক্ষানুযায়ী এক দিকে খৃষ্টের প্রতি অগাধ ভক্তি-সম্মান ও ভালবাসা ও ভালবাসায় তাঁর অনুসারীদের নিজেদের নিকটতম জ্ঞান করা – আর অন্য দিকে আজকের প্রচলিত খৃষ্টধর্ম-রূপে ধর্মান্তরের সূক্ষ্মতম যে কোন চেষ্টারও বিরুদ্ধে সচেতন থেকে তার বিরোধীতার স্বধর্মীয় বাধ্য বাধকতা বোধ – তা’ বুঝবার জন্য দরকার, বিষয়টির মূলে যাওয়ার।

এই মূল স্বয়ং য়ীস খৃষ্টের জন্ম – এবং, তার পটভূমি ও ততপরবর্তী ঘটণা প্রবাহের নানা বিবর্তন্মূল্ক চড়াই উতরাইতেই।

য়ীসু খৃষ্ট

খৃষ্ট তাঁর নাম নয়, তাঁর খোদার দেয়া পদানুযায়ী সম্মানসূচক পদবী, “মসীহ” বা “মসীয়হ”-এর গ্রীক অনুবাদ “ক্রিস্ট” বা “কৃস্ট”-এর কিঞ্চিত পরবর্তিত রূপ “খৃষ্টস”-এর সংক্ষেপিত উচ্চারণ-জাত শব্দ । “ক্রিস্ট”-ই আবার ইংরেজীতে “ক্রাইস্ট” হয়েছে, আর “মসীয়হ” কিছুটা অপভ্রংশায়নে হয়েছে, “মেসাইয়হ”। ঐ “ক্রিস্ট” থেকে ইংরেজীতে হয়, “ক্রিস্ট”-“মাস”, অর্থাত খৃষ্টের “মাস”, “ভোজ”-এর উতসব। খৃষ্টের জন্মদিনের “সালাম” , অর্থাৎ “শান্তি” বা “অভিবাদন”-এর উতসব।

জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল “য়ীস” – যা য়ূরোপীয় বর্ণমালায় “Y “ হরফটি যোগ হবার পূর্বে হরফটির উচ্চারণ “J “ দিয়ে লিখবার রীতির কারণে, “Jesu” -রূপে লেখা হ’ত, যদিও আরো অনেক প্রে পশ্চিম ইয়ুরোপীয়দের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে, তখনো উচ্চারিত হ’ত “ Jesu“-রূপেই। সম্মান বা গুরুত্ব দেখাবার জন্য একটি শব্দের শেষে “সেমিটিক” ভাষাসমূহে যেভাবে “ম” যোগ করা হয় – সে ভাবেই গ্রীকে, যোগ করা হয় “s” – সে জন্য, “Jesu“-এর শেষে “s” যোগ করে “Jesus”, তথা “যীসস” বা “যীসুস”-রূপে লেখা ও উচ্চারণ করা হয় – কালে তা’ সংক্ষিপ্ত হয়ে হ’য়,”যীসু”, ও “যীশু”। “ইয়ীস” আর “যীসুস” “য়ীস”, কখনো কখনো লিখবার বা উচ্চারণের সুবিধার জন্য “ইয়ীস”, “ইয়ীসা”, বা “ইয়ীশা” বলা বা লিখা হয় – তা সংক্ষেপিত হয়ে হয় “ঈসা” বা “ঈশা”-ও, যেমন “হজরত ঈসা” ও “ঈশা খাঁ”-এর ক্ষেত্রে।

তাঁর সাম-বংশীয় অনার্য “সেমেটিক”-দের আদি ও প্রধান ধারাতে জন্মটা খুশীর বিষয় হলেও, নিয়ে খোদার শোকর আদায় করে যখন তখনই, মনে এলে, সুযোগ তপেলেই তার উদযাপনের রীতি থাকলেও - জন্মদিনের হিসেব কেতাব রাখা, বা তার ভিত্তিতে পালনের রেওয়াজ কোনদিনি ছিল না। সত্যি বলতে এখনও নেই। লিংগ পূজা থেকে নিয়ে জন্ম-সংক্রান্ত নানারূপ আচার অনুষ্ঠানে যৌনতা, যৌনাংগ ও প্রজনন দেব দেবী-পূজার প্রাধান্যের কারণে আর্য ধর্মরূপ সংস্কৃতিতে জন্মের দিন ক্ষন লগ্ন সবই এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে যে জন্মের দিন ক্ষণ লগ্ন ধরে তার উদযাপ্ন-মূলক পূজা-পাট সমন্বিত আচার অর্চণার জন্য জন্ম দিনের নির্দিষ্ট তারিখ জেনে তার উদযাপনের রেওয়াজ গড়ে ওঠে গ্রীক ও রোমান এলাকা সহ বিভিন্ন আর্য অধ্যুষিত অঞ্চলে। সাম বংশীয় “সেমেটিক” ইয়ীস’র মূল দেশ ও সমাজে, বা তাঁর খৃষ্টীয় ধর্ম-রূপে আর সকলের মতই তাঁরো জন্ম দিন পালিত হয় নি কখনো তাঁর জন্মের প্রায় ৩০০ পরেও। সে জন্য য়ীস খৃষ্টের জন্মের ঠিক তারিখ জানা যায় না – তাঁর জন্মের কয়েক শতাব্দী পরই শুধু প্রধানতঃ য়ুরোপীয় গ্রীক ও রোমক উচ্চবর্ণ আর্য শাসক শ্রেণী প্রধানতঃ, মূলতঃ রাজনৈতিক কারণে সেমেটিক খৃষ্ট ধর্ম আংশিকভাবে গ্রহণ করে তার আর্যায়ন শুরু করলে, “খৃষ্টমাস” বলে য়ীস খৃষ্টেরর জন্ম দিবস উদযাপণের রেওয়াজ চালু হয়। তাঁর জন্মের এই তিন শ্তাব্দী ধরে তাঁর সমাজ বা অনুসারীদের কেউই তার জন্মের ঠিক তারিখটার কথা মনে না করায় তা’ করোই জানা থাকে নি বিধায়, এই খৃষ্টমাস উদযাপণের জন্য তাঁর জন্মের সেই সঠিক তারিখ বলে কিছু একটা বলবার দরকার অনুভব করে খৃষ্ট ধর্মে আংশিক দীক্ষিত গ্রীক রোমক ইয়ুরোপীয় আর্যেরা।

তার সন্ধান শুরু করলে আন্দাজ করা হয়, য়ীস খৃষ্টের জন্ম হয় এমন এক তারিখে যা খৃষ্টের জন্মের বহু শতাব্দী পর “খৃষ্টাব্দ” বলে পরিচিত হয়ে পড়া মূলতঃ রোমক পঞ্জিকা মতে, হয়ে থাকবে “খৃষ্টপূর্ব” ৬ থেকে ৪ সণের কোন এক সণে – সেই বহু শতাব্দী পরে “খৃষ্টাব্দ” পঞ্জিকা বলে প্রচলিত করা দিন-তারিখ গণনা রীতির ভাষায়, যা আসলে তাঁর জন্মের সময় দুনিয়াতে ছিলই না!

জন্মদিন

য়ীস খৃষ্টের জন্মের ঠিক তারিখ আর মাস পাওয়া না গেলেও, তা ছিল বছরের সেই সময়ের আশপাশে, যখন দিন আর রাত সমান দৈর্ঘ্যের হয় তা’ জানা যায়। তা ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর ছাড়াও ২০ থেকে ২২ মার্চ, বা ২০ থেকে ২২ জুনেও হয়ে থাকে। এর ভেতর ডিসেম্বরের তারিখটা হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না, এই জন্য যে, য়ীস’র জন্মের সময় রাখালদের মাঠে ভেড়া চরাবার কথা বর্ণণার কথা আছে। শীতের প্রখরতায় ভেড়া চরানো সম্ভব হত না – বরং, তা হয়ে থাকবে অক্টোবরের শেষের দিক বা নভেম্বর, অথবা জানুয়ারীর পূর্বে ফেব্রুয়ারী বা তার পরে কিন্তু বছরের শুরুর দিকে – মার্চ বা এপ্রিলের দিকে।

প্রায় নিশ্চিতই শীতকালের চরম শীতের সময় বাদ দিয়ে অন্য কোন সময়। শীত কালের শুরু বা তার একটু আগের, বা শীত কালের শেষের দিকে বা তার একটু পরে কোন এক সময়। য়ীস’র জন্মের সময় খেজুর পাকার সময় ছিল –তাঁর মা’ মহীয়সী মরিয়মকে নবজাতকের জন্মের সময় খেজুর গাছ ঝাঁকিয়ে পাকা খেজুর পড়লে তা খেতে বলা হয়েছিল – তা’ হলে তা খেজুর পাকার মরশুম অক্টোবরেই হবার কথা। তাঁর জন্মের সময় আকাশে একটি অত্যুজ্জ্বল নতুন তারকা দেখা যায়, ধারণা করা হয় তা’ ছিল একটি নতুন ধূমকেতু, আর জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক হিসেব নিকেশে জানা যায় তা সম্ভবতঃ ছিল এপ্রিল মাসে কোন এক সময়। এত সব বিচারে্র কোনটায়ই ইয়ীস’র শুভ জন্মটা ডিসেম্বরে হবার কথা নয় – ২৫ ডিসেম্বরে ত নয়ই।

সাম-বংশীয়দের এক শাখা, “আলে য়াকূব”-এ জন্ম হয়েছিল য়ীস খৃষ্টের, তাদের কাছ থেকে তাঁর জন্মের মাস বা তারিখ পাওয়া গেলেও, তাদের নিকট জ্ঞাতি, আরব, “আলে ইসমাইল”-দের স্মৃতি-নির্ভর ইতিহাস থেকে তার একটি অনুমেয় দিন তারিখ পাওয়া যায়, খুব সম্ভব তাদের চান্দ্র বর্ষের হিসেবে, ১০ ই মহররমে – যে তারিখটায় য়ীস খৃষ্টের জন্ম ছাড়াও ইতিহাসের আরো অনেকগুলো তাতপর্য ঘটণাও ঘটেছিল।

আরো পরে সূর্যপূজারী আর্যদের প্রচলিত সৌর সণ মোতাবেক গণনার পূর্বে - অনার্য “সেমিটিক”-দের চান্দ্র সণ মোতাবেক গণনায় খৃষ্টের জন্মদিন ধরা হ’ত চান্দ্র বর্ষের প্রথম মাসের দশম দিনে। রাজনৈতিক হিসেব নিকেশে চতুর্থ “খৃষ্টীয়” শতকে রোমক আর্য সম্রাট কন্সতান্তিন আংশিকভাবে মূলতঃ “সেমেটিক” অনার্য “খৃষ্ট ধর্ম “ গ্রহণ করলে তার ইতি মধ্যেই ঘটমান আর্যায়ন সরকারী ভাবে বেগবান হলে, চান্দ্রের পরিবর্তে সৌর সণ গণনামতে খৃষ্টের জন্মদিন উদযাপন শুরু হয়। ফলে, তা এখন চান্দ্র প্রথম মাসের ১০ তারিখের পরিবর্তে সৌর প্রথম মাসের ১০ তারিখে তা উদযাপন শুরু হয়। সে সময় আর্য রোমকদের সৌর বর্ষ গণনায় বছরে মাস ধরা হত ১০ টি, প্রথম মাস ছিল মার্চ। তাই, খৃষ্টের উদযাপন শুরু হয় ১০ মার্চ বা তার একটু পরে কোন এক তারিখে।

রোমক সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক হিসেব কেতাবে তাদের সৌর সণে আরো দু’টো মাস যোগ করা হয় – জানুয়ারী আর ফেব্রুয়ারী, জানুয়ারীকে করা হয় বছরের প্রথম মাস। ফলে, খৃষ্টের জন্মদিনের উতসব, “খৃষ্ট-মাস” উদযাপণ শুরু হয়, ১০ জানুয়ারীতে। আজও, খৃষ্টের জন্মস্থান ও খৃষ্টধর্মের আদিভূমির নিকটতর গ্রীস সহ পূর্ব য়ুরোপ, বেথলেহেম আর যেরূসালেম, মিশর আর ইথিওপিয়া সহ অনেক খৃষ্টান সমাজেই খৃষ্টমাস এই ১০ ই জানুয়ারী বা তার কাছাকাছি কোন এক তারিখেই উদযাপিত হয়।

এক সময় গ্রীক প্রভাবিত খৃষ্টানদের মাধ্যমে শাসক রোমকগণ ও আর্যায়িত খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করলে খাঁটি, নিখাদ একেশ্বরবাদী মূল খৃষ্টধর্ম আর বহু দেব-দেবীর উপাসণা-ভিত্তিক আর্য ধর্মের ভেতর শংকরায়ন-ভিত্তিক যে “সমঝোতা”-তে গ্রীক, আর বিশেষ করে রোমক সম্রাট ও তাঁদের উপাসক রোমক জনসাধারণ খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল, তার স্বার্থে ৭ থেকে ১০ জানুয়ারীর খৃষ্টমাস উদযাপণ আর গ্রীক-রোমকদের ২১ থেকে ২৩ ডিসেম্বর উদযাপিত ভোগ ও মদের দেব “বাকুস”-এর পূজা উদযাপন, আর ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২রা জানুয়ারী পর্যন্ত “জানুস”-নামক নববর্ষের দেবের পূজার উতসব - তিনটাকে খরচ ও শ্রম সাশ্রয়ের জন্য কাছাকাছি আনবার দরকার অনুভঊত হয়। তার জন্য, ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২রা জানুয়ারী পর্যন্ত খৃষ্টমাস-নববর্ষের ভোগ, মদ, ইত্যাদিসহ “খৃষ্টমাস” উতসবের রেওয়াজ চালু হয়।

নাজারতের য়ীসু

৪র্থ “খৃষ্টীয়” শতকে অনার্য সেমেটিক খৃষ্টধর্মের য়ুরোপীয় আর্যদের রাজনৈতিক ক্ষমতার আর্যায়ন সরাসরি সরকারী ক্ষমতাবলে ত্বারান্বিত ও প্রকটতর করবারও শতাব্দী দু’য়েরও পূর্বে সাম-বংশীয়দের দেশে রোমক সাম্রাজ্যের কর-আদায়কারী অত্যাচারী আর্যায়িত সাম-বংশীয় অনার্য কর্মচারী, জনৈক স’ল হঠাত সেমেটিক অনার্য খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষার দাবী করে “প’ল” নাম নিয়ে সে ধর্মের প্রচারক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে আসলে ধর্মের আর্যায়ন শুরু করেছিলেন। সে প্রক্রিয়ায় য়ুরোপীয় আর্য সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে অনার্য “সেমেটিক” মূল খৃষ্ট ধর্মের এমন পরিবর্তন সাধন করা হয় , যাতে মধ্যপ্রাচ্যিক অনার্য “সেমেটিক” ধর্মের নিখাদ একেশ্বরবাদী বিমূর্ত উপাস্য-উপাসণামূলক মৌলিক চরিত্রটি পর্যন্ত প্রতিস্থাপিত হয়ে পড়ে, “খৃষ্ট ধর্মের” নামের আবরণের ভেতরই, য়ুরোপীয় আর্য পৌত্তলিক, বহু ঈশ্বরবাদী নানা বিশ্বাস ও আর্চণা-অনুষ্ঠান রীতি দ্বারা। এই প্রক্রিয়ায় “খৃষ্টধর্ম” অসংখ্য ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর ভেতর প্রাচীনতম, আদি, nikhad খৃষ্টধর্মটি মূলতঃ “নাসারা” (“Nazarene” ) খৃষ্ট ধর্ম – সংক্ষেপে “নাসারা” – নামে পরিচিত হয়, “নাসারঃ” বা “নাসারত” (“Nazareth”) নামক যে শহরের নিবাসী ছিলেন “নাসারতের য়ীস” (“Jesus of Nazareth”), আর তাঁর ঘনিষ্ঠতম, প্রধানতম শিষ্য ও উত্তরসূরী, পরে “সেন্ট পিটার” (“St. Peter”) বলে পরিচিত হওয়া “নাসারতের সামীউন” বা “নাসারী সামীউন” (“Simon” or “Peter” of “Nazareth”)। য়ীস খৃষ্টের স্বর্গোরোহরণের পর তাঁর ধর্মের প্রচার ও শিক্ষার দায়ীত্ব বর্তায় সেন্ট পিটার বা সামীউন নাসারীর ওপর, আর খৃষ্টধর্মের নানা ক্রমে পরিবর্তনশীল ধারার আবির্ভাব হতে শুরু করলে, খৃষ্ট, তথা নাসারতের বা নাসারীর য়ীসুর নিখাদ, খাঁটি খৃষ্টধর্মের ধারা ধরে রেখে প্রচার ও শিক্ষার দায়ীত্ব নেয়া নাসারী “পিটার” বা “সামীউন”-এর শেখানো ধারাটিই “নাসারী” বা “নাসারা” খৃষ্টধর্ম – তার অনুসারীদের “নাসারী” বা “নাসারা” বলে পরিচিত হয়। “নাসারী”-এর বহুবচনই “নাসারা”।

য়ুরোপীয় আর্য রোমক সাম্রাজ্য ও তার উরররসূরী বিবিধ রাজ ক্ষমতার সক্রিয় প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও পরোক্ষ সাংস্কৃতিক প্রভাব ব্যাপক ও মৌলিকভাবেই মূলতঃ অনার্য “সেমিটিক” নিখাদ একেশ্বরবাদী বিমূর্ত উপাস্য -উপাসণার মূল, আদি ও খাঁটি খৃষ্টধর্মকে ত্রিত্ববাদী মূর্ত য়ীশুর উপাসণা ভিত্তিক বিভিন্ন ধারায় বিবর্তিত করে ফেলবার পর, নিখাদ খৃষ্টধর্মের প্রকাশ হিসে শুধু “নাসারা”- নামক খৃষ্টধর্ম ধারাটিই বাকী থেকে এত দুর্বল হয়ে পড়ে যে অবশেষে প্রায় বিলুপ্তই হয়ে যায়।

খৃষ্টের ধর্মের পুনরাভিব্যক্তি

এমতাবস্থায় খৃষ্টেরই এলাকার অদূরে একটু দক্ষিণ-পূর্বে মক্কা-মদীনায়, তাঁরই সাম-বংশীয় নিকটতম জ্ঞাতিগণের অন্য ধারা, কোরায়শ আরবদের ভেতর আবির্ভূত হ’ন হজরত মোহাম্মদ (দঃ) – খৃষ্টেরই ধর্মের আদি ও নিখাদ একেশ্বরবাদী বিমূর্ত উপাস্য-উপাসণা মূলক ধর্ম ধারারই পুনরাভিব্যক্তি-মূলক “ইসলাম” ধর্মের বাণী নিয়ে। তাঁর ও তাঁর উত্তরসূরী-অনুসারীদের কর্ম, নীতি, শিক্ষা ও দীক্ষার প্রভাব ও ফলশ্রুতিতে, মূলতঃ ও প্রধানতঃ “সেমিটিক” আর্য বাংলা জাতি-সহ জনসংখ্যা-বিচারে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া দুনিয়ার বিশাল সংখ্যক “সেমিটিক” জনসংখ্যার প্রায় সকলেই নিখাদ একেশ্বরবাদী বিমূর্ত উপাস্য-উপাসক আদি “সেমিটিক” ধর্মের এই পুনরাভিব্যিক্তিমূলক বিস্তৃততর, নতুন ও সর্বশেষ প্রধান উপস্থাপনায় দীক্ষিত হয়, যেমনটি হয় বেশ কিছু বিপুল সংখ্যক হাম-বংশীয় ও ইয়াফেস-বংশীয় আর্যরাও।

অন্য দিকে, পশ্চিম য়ুরোপের “শ্যামায়িত” আর্যগণ তাদের বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদের সুবাদে বাংলাদেশ-সহ প্রাচ্যে এসে পৌঁছালে, তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা আর্যায়িত “সেমেটিক” “খৃষ্টধর্ম”-এ অত্যল্পকিছু স্থানীয়কে দীক্ষিত করে। এঁরা “নাসারা” খৃষ্টান না হলেও, খৃষ্টান – খৃষ্টের প্রতি ভক্তি রাখেন, তাঁর উপাসণাও করেন। তাঁদেরই সঙ্গে একই দেশবাসী, বাংলা জাতির বিশালতর অংশও, খৃষ্টেরই নিখাদ একেশ্বরবাদী বিমূর্ত উপাস্য-উপাসণামূলক আদি অনার্য “সেমিটিক” ধর্মের পুনরাভিব্যাক্তি ও বিস্তার রূপ বলে বিশ্বাস করা “ইসলাম”-এর অনুসারীরাও খৃষ্টের উপাসণা - বা ইয়ুরোপীয়দের আংশিক শ্যামায়িত আর্যদের মত ২৫ ডিসেম্বরকে তাঁর জন্মদিন মনে করে তার উদযাপণ - থেকে বিরত থাকলেও , খৃষ্টের প্রতি ভক্তি ও ভালবাসায়, তাঁর উপাসণার পরিবর্তে তাঁরই নিখাদ একেশ্বরবাদী “সেমিটিক” ধর্ম বিশ্বাসের প্রবক্তা হজরত মোহাম্মদের অনুসরণে, তাঁদের উভয়ের দরিদ্র-প্রেমে দারিদ্র্য -মন্ডিত জীবণধারার অনুসরণে সম্মানপূর্বক গর্বিত গর্বিত হন।

লেখকঃ প্রফেসর ড. আহমদ আনিসুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্ত্রাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্যান্য বিবিধ বিষয়ের সঙ্গে তুলনামূলক ধর্ম ও মতাদর্শে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, ও শিক্ষকতা করেন। কিয়তকাল সিডনী থেকে প্রকাশিত তুলণামূলক ধর্ম বিষয়ক গবেষণা সাময়িকী Religious Traditions-এর উত্তর আমেরিকা আঞ্চলিক সম্পাদকের, ও ইতালীয় ক্যাথলিক সেন্ট বারনান্ডিন অর্ডার পরিচালিত Centre for Migration Studies-এর প্রতষ্ঠাকালীন গবেষণাধ্যক্ষ-রূপে ক্যাথলিক অভিভাসীদের সাংস্কৃতিক চেতণা বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার তত্বাবধানে নিযুক্ত রূপে দায়ীত্ব পালন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের এম.আই.টি. থেকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে, মধ্যপ্রাচ্যে খৃষ্ট মুসলিম ধর্মের বিভিন্ন শাখা প্রশাখার সম্পর্ক ও সহাবস্থান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে পি.এইচ.ডি., এবং অন্যান্য একাডিক স্নাতকোত্ত্র ছাড়াও, অষ্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের College of Theology থেকেও একটি স্নাতকোত্ত্র ডিগ্রী অর্জন করেন।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন