Ad T1

মানবিক করিডোর নিয়ে কেন এত হইচই

এলাহী নাওয়াজ খান
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫, ১০: ০৯

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি ‘মানবিক করিডোর’ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়ে বেশ হইচই শুরু হয়েছে। কোনো কোনো মহল এই উদ্যোগকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা হিসেবে দেখছে, যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সফিকুল আলম বলেছেন, ‘মানবিক করিডোরের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সর্বশেষ যেটা জানা গেছে তা হচ্ছে, মানবিক করিডোর নয়, মানবিক চ্যানেল নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে কথা হয়েছে।’

মূলত এটা হচ্ছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে জাতিসংঘের উদ্যোগে এমন একটা অস্থায়ী অসামরিক নিরাপদ রুট তৈরি করা, যে রুট দিয়ে মানবিক সাহায্যসামগ্রী সংকটজর্জর অঞ্চলে পৌঁছাবে এবং শরণার্থীরা নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরিত হবে। সাধারণত যুদ্ধরত পক্ষগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে এ ধরনের করিডোর সৃষ্টি করা হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।

তবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যা-বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমানের মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর কিংবা চ্যানেল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ খুবই আগ্রহী। কারণ বাংলাদেশ খুব দ্রুততর সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে চায়। গত ২৯ এপ্রিল মঙ্গলবার ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘রাখাইনে জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সহায়তার উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ তাতে কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহী। আমরা বিশ্বাস করি জাতিসংঘের সহায়তার মাধ্যমে রাখাইনে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা শরণার্থীদের ফেরার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। তবে মানবিক সহায়তা রুটের বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে, যা নিয়ে নানা পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন।’ এই বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বাংলাদেশ বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় রেখেছে।

যাহোক, জাতিসংঘের উদ্যোগে এ ধরনের মানবিক করিডোর সৃষ্টির ঘটনা নতুন কিছু নয়। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর বসনিয়া যুদ্ধের সময় ১৯৯৩ সালে প্রথম জাতিসংঘের উদ্যোগে বসনিয়া ও হারজেগোভিনার মধ্যে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর গজনি, সিরিয়া, গাঁজা, লিবিয়া, রুশ-জর্জিয়া, ইউক্রেনের মারিওপল প্রভৃতি অঞ্চলে যুদ্ধের সময় জাতিসংঘ এ ধরনের মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করেছিল। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে জাতিসংঘ তা-ই করতে চাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সামান্যতম আশঙ্কা নেই। আর মিয়ানমার তো অতীতে বহুবার বাংলাদেশ সঙ্গে যুদ্ধ করতে চেয়েছে, কিন্তু সুকৌশলে বাংলাদেশ তা এড়িয়ে গেছে।

অনেকের হয়তো জানা আছে, বেশ কিছুদিন আগে মিয়ানমার সরকার তার দেশের ভেতরে সৃষ্ট তীব্র খাদ্যসংকট মোকাবিলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশ সফরে এসে এ ধরনের একটা নিরাপদ করিডোর বা চ্যানেল সৃষ্টির কথা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে গেছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে বলে মনে হয়। এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা খুবই জরুরি। প্রথমত, পূর্ব দিকে মিয়ানমার অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। কারণ বাংলাদেশ হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ স্থাপনকারী একটি দেশ; বলা যায়, আগামী দিনের লাইফলাইন।

দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে এ রকম একটি নিরাপদ করিডোর সৃষ্টি করতে না পারলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে আরো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হতে পারে। কারণ মিয়ানমারের মধ্যে যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা ভয়াবহ আকার ধারণ করলে ক্ষুধার্ত মানুষের স্রোত বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হবে। তাই আগেভাগে ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

তৃতীয়ত, অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টিকারী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে এ ধরনের একটি অসামরিক অঞ্চল গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, যে অঞ্চলটি ‘নো ফ্লাই জোন’ হিসেবে বিবেচিত হবে। জাতিসংঘের উদ্যোগে এ ধরনের একটা মানবিক চ্যানেল সৃষ্টি করতে না পারলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অসম্ভব হয়ে পড়বে, কারণ কোনো সমঝোতা ছাড়া এ ধরনের যেকোনো প্রত্যাবাসনকে আরাকান আর্মি বাধা প্রদান করবে। এ ছাড়া সেখানে ঐকমত্যের সরকার বলে একটি পক্ষ আছে। তাদের সঙ্গেও সমঝোতা প্রয়োজন।

এখানে উল্লেখ করতে হয়, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় পৌনে ৩০০ কিলোমিটারের যে সীমান্ত রয়েছে, তার সবটাই এখন আরাকান আর্মির দখলে। সুতরাং আরাকান আর্মির সঙ্গে একটা সমঝোতা করে মানবিক করিডোর সৃষ্টি করতে না পারলে রোহিঙ্গাদের আর কখনো তাদের বসতবাটিতে পাঠানো যাবে না।

অন্যদিকে বাংলাদেশের অখণ্ডতা বজায় রাখা এবং ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে একটি গোপন বোঝাপড়া খুবই জরুরি, যদিও বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর ও জটিল। কারণ ‘নন-স্টেট’ সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে স্বাধীন-সার্বভৌম কোনো রাষ্ট্র প্রকাশ্যে সম্পর্ক রাখতে পারে না। অন্যদিকে আরাকান আর্মির সব সদস্যই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আবার তাদের সঙ্গে রয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের দ্বন্দ্ব। বেশ কয়েকবার এই দ্বন্দ্ব সংঘাতেও রূপ নিয়েছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে আরাকান আর্মির সদস্যসংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। তাদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। সুতরাং বাংলাদেশকে খুব ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে। আবার এটাও সত্য, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরাকান আর্মিই সবচেয়ে বড় বাধা। কদিন আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সেটাই বলেছেন।

অতীতে জাতিসংঘ যেসব অঞ্চলে করিডোর সৃষ্টি করেছিল, তার সবকটিই ছিল যুদ্ধকবলিত অঞ্চল। আর যুদ্ধে লিপ্ত পক্ষগুলো এ ধরনের অসামরিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে নিরাপদ করিডোর প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। জাতিসংঘের উদ্যোগে যুদ্ধকবলিত যেসব অঞ্চলে এ ধরনের মানবিক করিডোর সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেসব অঞ্চলে যুদ্ধ আরো ছড়িয়ে পড়েছিল কিংবা তীব্র হয়েছিল বলে কোনো নজির নেই; তবে সমঝোতা ভেঙে পড়ার নজির আছে অনেক।

সবশেষে এটা বলা যায়, বাংলাদেশে জাতিসংঘের দুটি কাজ করা খুব জরুরি হয়ে গেছে। তার একটি হচ্ছে, গণহত্যার বিচার হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, একটি নিরাপদ মানবিক করিডোর বা চ্যানেল সৃষ্টি করে খুব শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করা। কারণ বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী বাসিন্দা করা সম্ভব নয়—যেমন আমাদের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের স্থায়ী বসতি করতে দিল অন্য পক্ষ বাংলাদেশকে ডাম্পিং গ্রাউন্ড ভাববে।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, অতীতে বেশ কিছু সুযোগ আমরা হাতছাড়া করেছি। যেমন প্রথমেই আমাদের উচিত ছিল রোহিঙ্গাদের মানুষের ভেতরে আশ্রয় না দিয়ে মিয়ানমারের মধ্যে একটি বাফার জোন তৈরি করে সেখানে আশ্রয় প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, আরাকান আর্মি যখন বলেছিল, তাদের সাহায্য করলে তারা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করবে। একসময় তারা মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাংলাদেশের সাহায্য চেয়েছিল। ’৭১ সালে ভারত যেমন আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল এবং পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা দান করেছিল, ঠিক সেভাবে আমরা আরাকান আর্মিকে সাহায্য করতে পারতাম। কিন্তু ভারতের চাপে তা সম্ভব হয়নি বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

অতঃপর আমাদের সামনে এখন যে সুযোগটি এসেছে, তা হচ্ছে জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি মানবিক করিডোর অথবা চ্যানেল সৃষ্টি করে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করে ফেলা। ওই অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অন্যতম একটি শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশকে আবির্ভূত হতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত