খানের আখ্যান

দল ও রাজনীতি বদলে দাও

মারুফ কামাল খান
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ৪০

ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম পতনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লিখতে গেলেই আমি ঘুরেফিরে বারবার এই ‘প্রেডিকশন’ করে চলেছি যে, আগামী সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে সরকার গঠন করবে। আমার এ ভাবীকথনের ভিত্তি হচ্ছে, দীর্ঘদিনের একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমার নিজের মূল্যায়ন। আমি এ দেশকে চিনি, এ দেশের মানুষকে জানি এবং তাদের মনোভাব বুঝতে পারি।

বিজ্ঞাপন

কিছুদিন আগে আমি নরওয়ের প্রখ্যাত গবেষক আরাইল অ্যাঙ্গেলসন রুডের একটি সাক্ষাৎকারের বক্তব্য খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। ইউনিভার্সিটি অব অসলোর সাউথ এশিয়া স্টাডির অধ্যাপক তিনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ডাইনামিকস নিয়ে তার একাধিক গবেষণা আছে। সেই রুড সাহেবের বক্তব্যের একটু লম্বা কোটেশন দিই। তিনি বলেছেন : ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্র দুর্বল। প্রশাসনিক যন্ত্র হিসেবেও রাষ্ট্র দুর্বল। দেশের বড় অংশে কার্যত রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। গ্রামীণ পর্যায়ে আপনি এমন কাউকে ভোট দেন, যিনি প্রয়োজনে আপনাকে রক্ষা করবেন। এমন কাউকে যিনি শক্তিশালী, যার সংযোগ আছে, যিনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। আপনার যদি পুলিশ, প্রতিবেশী বা প্রশাসনের সঙ্গে সমস্যা হয়, আপনি স্থানীয় নেতার কাছে যাবেন। সেই নেতা যেতে পারেন একজন মধ্যপর্যায়ের নেতার কাছে। সেই নেতা আবার যেতে পারেন এমপির কাছে। তারপর আপনি আপনার সমস্যা সমাধান করতে পারেন। এটা একধরনের বেসরকারিকরণ। একটা বেসরকারি সম্পর্ক। এ ধরনের অবস্থা থেকে তৈরি হয় নেটওয়ার্ক সোসাইটি। রাষ্ট্রের দুর্বলতা মানে নেতা ছাড়া আপনার আর কোনো উপায় নেই। আপনি আপনার প্রশাসনের কাছে যেতে পারবেন না। নেতাদের কাছে না গেলে আপনার কঠিন সমস্যা সমাধানের আশা করতে পারবেন না। তাই লক্ষণীয় রকম পরিবর্তন না ঘটলে বাংলাদেশের মানুষ যে শক্তিশালী, তাকেই ভোট দেবে।’

মি. রুড তথাকথিত এক-এগারোর পরে, ২০০৭ সালে, তার নিজের এক গবেষণার বরাত দিয়ে বলেন, ‘আমরা নরসিংদীর স্থানীয় জনগণকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম। ধরুন দুজন প্রার্থী আছে। একজন সৎ এবং দুর্নীতি করেন না। আগে তিনি রাজনীতি করেননি। অন্যজন দুর্নীতিগ্রস্ত কিন্তু বহু বছর ধরে রাজনীতিতে আছেন। আপনি কোনজনকে ভোট দেবেন? তারা জানিয়েছিলেন, যিনি দুর্নীতি করেন, কিন্তু অভিজ্ঞ, তাকেই ভোট দেবেন। কারণ, কোনো সমস্যা হলে তিনি তাদের সাহায্য করতে পারবেন। অনভিজ্ঞ ব্যক্তি তা করতে পারবেন না।’

রুড সাহেবের এই গবেষণালব্ধ তথ্য ও বক্তব্যও আমাকে খুব সহজেই এই উপসংহারে পৌঁছাতে সাহায্য করে যে, আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশে পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির বিজয় মোটামুটি অবধারিত। বিএনপির জনপ্রিয়তা ছাড়াও এর পেছনে আরো কারণ আছে। এই দুর্বল রাষ্ট্রে যে নেটওয়ার্ক সোসাইটি তৈরি হয়ে আছে এবং শক্তিশালী প্রার্থীর যে প্রচলিত ধারণা রয়েছে, তাতে পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপিই নিয়তি। কেননা খুব সহসা এই ব্যবস্থার লক্ষণীয় পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই নেই। এই ব্যবস্থা বিএনপির জিতে আসার জন্য সবচেয়ে অনুকূল। কাজেই এ ব্যবস্থার আওতায় তারা অনতিবিলম্বে নির্বাচন ত্বরান্বিত করে বিজয় নিশ্চিত করতে চায়।

এই ব্যবস্থা কি খুব একটা আদর্শ পরিস্থিতির ইঙ্গিত বহন করে? নিশ্চয়ই না। তবে এটাই বাস্তবতা এবং এ পরিস্থিতির আশু উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হবে না। আমি এখন আরেকটি উদ্ধৃতি দেব। সেটা কোনো গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা ট্রেডিশনাল রাজনীতিবিদের উক্তি নয়। বাংলাদেশের শহীদ রাষ্ট্রনেতা জিয়াউর রহমানের উক্তি এটি। তার কোটেশন বিএনপিবিষয়ক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, তিনিই এ দলটির প্রতিষ্ঠাতা। জিয়াউর রহমানের উক্তিটি হচ্ছে : ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।’ তাহলে দেশের স্বার্থ ও কল্যাণকে ব্যক্তি এবং দলের চেয়ে বড় করে দেখতে হবে বিএনপিকে। দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হলে বর্তমানের দুর্বল রাষ্ট্রকে সবল করতে হবে। নেটওয়ার্ক সোসাইটির পরিবর্তন করতে হবে। একটি আধুনিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রবর্তন করতে হবে। মানে রাষ্ট্রে সংস্কার করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংস্কার সফল ও টেকসই করতে হলে বিএনপির রাজনৈতিক এবং দলীয় সংস্কার করতে হবে। এই সংস্কার করতে হবে দলের স্বার্থে। দলকে আরো উন্নত, আধুনিক ও গণমুখী করার লক্ষ্যে পরিচালিত এই সংস্কার অনেক কায়েমি স্বার্থবাদী ব্যক্তির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে দলীয় স্বার্থকে সমুন্নত করবে। আর এই দলীয় স্বার্থ মূলত দেশ ও জাতির স্বার্থ এবং কল্যাণই নিশ্চিত করবে।

বিএনপি সম্পর্কে বড় অভিযোগগুলোর একটি হচ্ছে দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নেই। দলের নেতৃত্ব আরোপিত এবং ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিএনপিতে গণতন্ত্রের অনুশীলন থাকলে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান যিনিই শীর্ষ নেতৃত্বে থাকুন না কেন, তার কোনো অসুবিধা বা সমস্যা নেই। সমস্যা কায়েমি স্বার্থবাদী কিছু নেতা-নেত্রীর। দলে গণতন্ত্র এলে তাদের জন্য পলিটিকস উইল বি ডিফিকাল্ট। এত সহজে চিরস্থায়ীভাবে নেতা সেজে বসে থাকা সম্ভব হবে না। তাদের নিয়মিত এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ অন্তে যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। এই কঠিন পরীক্ষা এড়াতে এরাই চক্র-চক্রান্তের মাধ্যমে দলের গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। এরাই দলে বিভিন্ন কোটারি ও উপদল সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী ও দলকে দুর্বল করে রাখেন। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নিয়মিত কাউন্সিল ও নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন এবং একেবারে প্রান্তিক থেকে শীর্ষপর্যায় পর্যন্ত নেতাকে নির্বাচিত হতে হতে উঠে আসার প্রক্রিয়াই দলকে প্রাণবন্ত, যোগ্য ও উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু তা হতে দেওয়া হয় না। এতে দলের কর্মীরা উপেক্ষিত হন। নেতারা কর্মীনির্ভর হন না, মূলত কর্মীদেরই নেতানির্ভর হয়ে থাকতে হয়। দলের নেতৃত্ব নির্বাচন ছাড়াও নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও কর্মীদের তৃণমূলপর্যায়ের মতামতও কোনো গুরুত্ব পান না। অথচ তারাই থাকেন সাধারণ মানুষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে। তৃণমূলের মতামতকে উপেক্ষা করার প্রবণতা দলের মধ্যে নেতাদের মোসাহেব ও চামচা একটি গণবিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীকে শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। সব ক্ষেত্রে এরাই প্রভাব বিস্তারক ও নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এভাবেই দল গণবিচ্ছিন্ন একটি নেটওয়ার্ক সোসাইটিতে পরিণত হয়। শুধু ওপর থেকে পুরস্কার ও তিরস্কারের মাধ্যমে এ অবস্থার শুদ্ধিকরণ সম্ভব নয়।

বিএনপির মতো একটি বিশাল এবং সর্বত্রবিস্তৃত রাজনৈতিক দলে নিয়মিত জরিপ ও জনমত যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সব সিদ্ধান্ত ও নীতিনির্ধারণ ধারণার ওপর নির্ভর করে নেওয়া হয়। এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় সর্বাধিক। দেশের কোন এলাকায় দল দুর্বল ও সবল তার কোনো প্রামাণ্য ও নিখুঁত চিত্র বিএনপির হাতে নেই। বিএনপির সদস্যদের মধ্যে কোন এলাকা, কোন বয়স, কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা, কোন ইনকাম গ্রুপ, কোন লিঙ্গের ও কোন পেশার লোক বেশি বা কম, তারও কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ বিএনপিতে সদস্যদের তালিকা সঠিকভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণেরই কোনো ব্যবস্থা নেই। নিয়মিত এ তালিকার নবায়ন, আপডেট ও যাচাই কিছুই সঠিকভাবে করা হয় না। কোটারি নেতারাই সেটা করতে দেন না। এমনকি নেতাদের আজ্ঞাবহ না হলে তাদের সদস্যভুক্তির ফরম পর্যন্ত নিতে দেওয়া হয় না। সদস্যতালিকা সঠিক না হওয়ায় কোনো স্তরেই কাউন্সিলর ও ডেলিগেট নির্বাচন যথাযথ হয় না। অথচ একটিমাত্র পদক্ষেপেই সেটা করা সম্ভব। এতে দলকে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করেও গড়ে তোলা যায়।

দলের সদস্য ফরমে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের ছক থাকা দরকার। দলের সদস্যদের সবাইকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য মেম্বার নম্বরসহ মেম্বার কার্ড দেওয়া যায়। মেম্বার কার্ড ও সদস্য ফরমে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরও যুক্ত করা যেতে পারে। দলের একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেস বা ডাটাব্যাংক থাকবে। এর সঙ্গে প্রতিটি উপজেলার পার্টি সার্ভার যুক্ত থাকবে। উপজেলায় ফিলআপ করা সদস্য ফরমগুলো সংরক্ষিত থাকবে। একই সঙ্গে তা কম্পিউটার সার্ভারে এন্ট্রি করার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ডাটাবেসে চলে আসবে। এতে দলের সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ ও নিখুঁত চিত্র ও প্রয়োজনীয় তথ্য দলের হাতে থাকবে। প্রতিটি এলাকার প্রতিটি সদস্যের পূর্ণ বিবরণ গবেষণা ও জরিপের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হয়ে উঠবে। এই ডাটা সার্বক্ষণিক মনিটর ও আপডেটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সদস্যের মৃত্যু ও পদ খারিজ বা দলত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তার নাম অ্যাকটিভ লিস্ট থেকে সরাতে হবে। শুধু রিসার্চ পারপাস নয়, এই তথ্য সর্বস্তরে সঠিক কাউন্সিলর ও ডেলিগেট বাছাইয়ের জন্যও সহায়ক হবে। এটি একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপের কথা বললাম, যার মাধ্যমে এক ধাক্কায় দলকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেওয়া সম্ভব।

আজ আরেকটি পদক্ষেপের কথা বলেই এ লেখা শেষ করব। সেটা হচ্ছে, বিষয়ভিত্তিক গবেষণা সেল ও উপকমিটি গঠন। বিএনপিতে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক অনেক সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক আছেন। এই পদগুলোর সবই আলংকারিক এবং কেউই তার নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করেন না। অথচ প্রতিটি সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকের আওতায় একটি করে বিষয়ভিত্তিক উপকমিটি এবং গবেষণা সেল গঠন করে বিএনপি তার তথ্যভান্ডার বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে। ধরা যাক, কৃষিবিষয়ক উপকমিটি ও রিসার্চ সেলের কথা। তাদের হাতে কৃষি খাতের হালনাগাদ সব তথ্য থাকতে হবে। তারা কৃষিক্ষেত্রের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত এবং তার সমাধান নিয়ে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত সংগ্রহ করবে। প্রয়োজনীয় আলোচনা সভা ও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন করবে। দলকে কৃষিবিষয়ক নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও পরামর্শের জোগান দেবে। মেঠো বক্তৃতার চেয়ে এসব কাজ দলের অনেক বেশি উপকারে আসবে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে বিএনপিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অপ্রতিরোধ্য করে তোলা সম্ভব।

জিয়াউর রহমান পলিটিকসকে ডিফিকাল্ট করতে চেয়েছিলেন। বিএনপিও নিজের দলের নেতাকর্মী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর জন্য এভাবেই সস্তা পলিটিকসকে ডিফিকাল্ট করে তুলতে পারে। এভাবেই দলকে বাণিজ্যকরণ এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিনির্ভরতা থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। এভাবেই বিএনপি ব্যক্তির চাইতে দলকে বড় করে তুলতে পারে এবং এভাবেই দলের মাধ্যমে দেশ-জাতির কল্যাণ ও স্বার্থকে নিশ্চিত করতে পারে। আগামীতে দল ও রাষ্ট্রপরিচালনা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতের সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দলকে মেধাচর্চিত, তারুণ্যখচিত, জ্ঞান-প্রযুক্তি-গবেষণা-তথ্যনির্ভর করতে হবে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়তে হবে এবং সেই বন্দোবস্তে নেতৃত্ব দেওয়ার সামর্থ্য ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। না হলে অনিবার্য যে মন্দ পরিস্থিতি বরণ করতে হবে, তার বিবরণ আজ আর নাই বা দিলাম।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

ই-মেইল : mrfshl@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত