এম আবদুল্লাহ
বহুল আলোচিত ও কাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ সই হলো। অনিশ্চয়তা ছিল, পক্ষগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা ও দোলাচল ছিল, শেষ মুহূর্তেও স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ভন্ডুল হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তবু ২৪টি রাজনৈতিক দল এবং জোট রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের যুগান্তকারী এক অঙ্গীকারনামায় সই করে নিপীড়ক ও লুটেরা রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। সরকারের হয়ে সই করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের দল এনসিপি অনুষ্ঠানে যায়নি, স্বাক্ষরও করেনি। গণফোরাম অনুষ্ঠানে গিয়েও সনদে সই করেনি। বামপন্থি কয়েকটি দলও বিরত থেকেছে। তারপরও বলা যায়, হাজারো মানুষের রক্তেভেজা নতুন বাংলাদেশে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে এই সনদ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ও মাইলফলক। যদিও নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভঙ্গুরতা কাটাতে কতটা ভূমিকা রাখবে, তা আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সে পর্যালোচনায় পরে যাচ্ছি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ স্বাক্ষরের ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে যেভাবে উৎসবমুখর বা আনন্দঘন করতে চেয়েছিলেন, তেমনটা হয়নি। সহিংসতার কারণে সাধারণ মানুষের বিপুল উপস্থিতির প্রত্যাশাও শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। অনুষ্ঠান শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ‘জুলাইযোদ্ধা’ পরিচয় দিয়ে একদল লোক অনুষ্ঠানস্থলে অবস্থান নেয়। দাবি আদায়ের নামে গেট টপকে ভেতরে ঢুকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা করে তাদের সরিয়ে দেয়। এ সময় সংসদ ভবন এলাকার আশপাশে পুলিশ ও কথিত ‘জুলাইযোদ্ধাদের’ মধ্যে সংঘর্ষ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে। অনুষ্ঠান করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি হয়। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী উপদেষ্টাদের কেউ কেউ অনুষ্ঠান স্থগিতের পক্ষে মত দেন। তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নেন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বৃষ্টিবিঘ্নিত হয়ে বিলম্বিত হয়। অনুষ্ঠানটি ভন্ডুল হলে আগামী নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয়ে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে ভুল বার্তা যেতে পারত। তা হয়নি, এটা অবশ্যই স্বস্তির।
জুলাইযোদ্ধা দাবি করে যারা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনটি ভন্ডুল করতে চেয়েছে, তাদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা পুলিশের ওপর শক্তিশালী ককটেল নিক্ষেপ করেছে, পুলিশের গাড়ি ও যাত্রীবাহী বাস ভাঙচুর করেছে। নিরাপত্তাচৌকি ও দর্শনার্থীদের প্যান্ডেলে আগুন দিয়েছে। এমনকি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ঝুলে থাকা বিএনপির ব্যানারও তাদের আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি। একজনকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে গণভবন ভাঙচুরকারীদের ডাকতে শোনা গেছে। জুলাইযোদ্ধার টি-শার্ট পরা একজন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেছেন। গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে বলেছেন, তিনি সিলেট এমসি কলেজে এসএসসিতে পড়ছেন। দাবি পূরণ হওয়ার পরও কেন তাণ্ডব চালাচ্ছেÑএমন প্রশ্নেও বিক্ষোভকারীরা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। তবে পুলিশি অ্যাকশনে জুলাইযোদ্ধা পরিচয় দেওয়া একজনের কৃত্রিম হাত খুলে রাস্তায় পড়ে থাকার ফুটেজ ও ছবি ভাইরাল হওয়ার পর অনেকে সরকার এবং পুলিশকে দুষেছেন। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা দরকারÑগুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান পণ্ড করতে বেপরোয়া বিক্ষোভকারীদের কে সংঘটিত করেছে। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগকারীদের আসল পরিচয়ও জানা দরকার। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে ৫৪ বছর যা খুশি তাই করার লাইসেন্স ছিল। এখন সেই লাইসেন্স ‘জুলাইযোদ্ধাদের’ হাতে স্থানান্তর হওয়া কাম্য হতে পারে না। কারণ দুটি ক্ষেত্রেই আসলের চেয়ে নকলের দাপট দৃশ্যমান। গাছ থেকে পড়ে মৃত ব্যক্তিও যখন ‘জুলাই শহীদ’ হিসেবে সুবিধার জন্য তালিকাভুক্ত হয়, সনদ পায়, তখন সন্দেহ প্রবল হওয়াই স্বাভাবিক। মাসিক ভাতা পাওয়া বা কোনো সনদে স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষায় জুলাইতে জীবন ও রক্ত দেয়নি কোনো ছাত্র-জনতা।
এটা মানতে হবে যে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ যেনতেন একটি চুক্তি নয়, এটি ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে সমঝোতা ও সহাবস্থানের একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গণ্য হবে। কিছু দুর্বলতা ও মতভিন্নতা সত্ত্বেও সনদে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের রূপরেখা রয়েছে। জনগণের মধ্যে প্রত্যাশার জন্ম হয়েছে যে, এ সনদের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা অচিরেই দূর হবে এবং দেশ এক নতুন স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রার পথে পা বাড়াবে।
জুলাই সনদের মাধ্যমে ‘নতুন বাংলাদেশের সূচনা’ বা ‘নতুন করে দেশ গড়া’র যে প্রত্যাশা প্রধান উপদেষ্টা ব্যক্ত করেছেন, তা কতটা সম্ভব হবে, সেদিকে নজর থাকবে সবার। সনদের সম্ভাব্য কার্যকারিতা কতটুকু তা-ও পর্যবেক্ষণে থাকবে। যারা সই করেননি, তাদের অবস্থানইবা কতটা যৌক্তিক, সেটি বিশ্লেষণ চলবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই পর্বে আলোচনা করে জুলাই সনদ তৈরি করেছে। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে তারা। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫২টি।
জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছে ২৪ রাজনৈতিক দল ও জোট। আশার দিক হলোÑআগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দুটি দল সরকার গঠন ও প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, সেই দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী সনদে স্বাক্ষর করেছে। রাষ্ট্রকাঠামোর ব্যাপক সংস্কারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। এই অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত হলে ছাত্র-জনতা চব্বিশের জুলাইয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে যে কালবিলম্ব করবে না, তা নিশ্চয়ই তারা অনুধাবন করেন। প্রধান দল দুটির সমমনারাও সনদে সই করে বাস্তবায়নে সহযাত্রী হওয়ার অঙ্গীকার করেছে। যদিও অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া অন্য দলের ভূমিকা হবে অনেকটাই গৌণ।
স্বাক্ষরিত সাত দফা অঙ্গীকারনামায় সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চয়তা, পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্তি, সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন না তোলা, গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান, আহতদের চিকিৎসা, সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারে প্রয়োজনীয় আইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার দ্রুততম সময়ে সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এসব অঙ্গীকারের মূল্য কী? অতীতেও রাজনীতিকরা অঙ্গীকার করে তার খেলাপ করেছেন। কাগুজে সনদ রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে আদৌ ভূমিকা রাখবে কি নাÑসে সংশয় ব্যক্ত করেছেন কেউ কেউ। আদতে রাজনীতিকদের ওপর আস্থাহীনতার কারণেই এমন প্রশ্ন উঠছে। জুলাই সনদে ৮৪ দফা সংস্কারের বিষয়ে কিছু ভিন্নমতসহ ঐকমত্য হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান-সংশ্লিষ্ট ৪৭ দফা সংস্কার চূড়ান্ত হয়েছে। বাকি ৩৭ দফা বাস্তবায়ন হবে কোনো কালক্ষেপণ ছাড়াই। বাস্তবে অধ্যাদেশ বা বিধির মাধ্যমে কার্যকরযোগ্য ৩৭ দফার অনেকগুলো ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়ে গেছে কিংবা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
জুলাই সনদে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পুনরুত্থান রোধে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদলই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ। সনদে এক ব্যক্তির ১০ বছরের অধিক সময় প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। সংবিধানকে খেয়ালখুশিমতো পরিবর্তন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে প্রবণতা দেখা গেছে, তা রোধে সনদে মতৈক্য আছে। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ ও ক্ষমতা-সংক্রান্ত ৪৮ অনুচ্ছেদ, প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ এবং ক্ষমতা-সংক্রান্ত ৫৬ অনুচ্ছেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-সংক্রান্ত ৫৮(খ) এবং সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত ১৪২ অনুচ্ছেদ সংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একা পরিবর্তন করতে পারবে না। গণভোট লাগবে।
পছন্দের লোককে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করে ক্ষমতার পথ মসৃণ করার প্রবণতা রোধেও ব্যবস্থা রয়েছে সনদে। ঐকমত্য হয়েছেÑপ্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার, তৃতীয় বৃহত্তম দল মিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবে। রাতের কিংবা আমি-ডামির নির্বাচনের জন্য রকিব, নুরুল হুদা বা আউয়াল মার্কা নির্বাচন কমিশন গঠনের পথও বন্ধ করা হয়েছে জুলাই সনদে। ঐকমত্য হয়েছে, ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতি মিলে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ইসি গঠন নয়, পুলিশ কমিশনসহ নানা নিয়োগে বিরোধী দলের ভূমিকা থাকবে। যদিও বিএনপি দুদক, পিএসসি, সিএজি, ন্যায়পাল নিয়োগে বিরোধী দলকে নিয়ে কমিটি গঠনে আপত্তি দিয়ে রেখেছে। কিন্তু যেগুলোতে একমত হয়েছে, তা হলো বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার হবেন। বিরোধী দলকে কথা বলতে না দেওয়া, পয়েন্ট অব অর্ডার ওঠাতে না দেওয়ার মতো পরিস্থিতি আর দেখা যাবে না। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি হলো সরকারের জন্য আতঙ্ক। জুলাই সনদে ঐকমত্য হয়েছেÑএই কমিটির সভাপতি হবেন বিরোধী দল থেকে। লাগামহীন লুটপাট বন্ধে এ কমিটির বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকবে।
বিচার বিভাগকে করায়ত্ত করে ইশারা-ইঙ্গিতের আদেশ-নিষেধে ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার প্রবণতা দেখা গেছে। এটি রোধে ভবিষ্যতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক হবেন প্রধান বিচারপতি। পরীক্ষার মাধ্যমে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ দেবেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিটি। নিম্ন আদালতে পদোন্নতি বদলি মন্ত্রণালয়ের হাত থেকে চলে যাবে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয়ে। সেখানেও যাতে দুর্নীতির বিস্তার না ঘটে, সে জন্য বিচারক, বিচারপতিদের তিন বছর অন্তর অন্তর প্রকাশ্যে সম্পদের হিসাব দিতে হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়িত হলে জনপ্রতিনিধিদেরও প্রতিবছর সম্পদের হিসাব দিতে হবে। নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামার ভিত্তিতে রাজস্ব বোর্ড এবং দুদক দিয়ে সম্পদের হিসাব যাচাই হবে। খুনি, অপরাধীকে ক্ষমা করার রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র ক্ষমতা রহিত হবে। নিহতের পরিবারের সম্মতি ছাড়া আর কোনো খুনি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাবে না।
এমপিদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। প্রধানমন্ত্রীর একক পছন্দে পুতুল রাষ্ট্রপতি বানানোর সুযোগ রহিত হবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা, রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনে আওতায় আনাসহ আরো কিছু সংস্কার সনদে আছে কোনো ধরনের ভিন্নমত ছাড়াই। সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে দুদককে পূর্বানুমতির জালে আটকে থাকতে হবে না। দুদক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হবে। সনদ কার্যকর হলে সরকার আর কখনো ইন্টারনেট বন্ধ করতে পারবে না। অর্থপাচারের প্রকৃত সুবিধাভোগীর বিচারের মতো বিষয়গুলো অবশ্যই সনদের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অনেকগুলো রাজনৈতিক দলকে আলোচনা ও স্বাক্ষরের বাইরে রেখে জুলাই সনদ কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে প্রশ্নও তুলতে দেখা যাচ্ছে। যারা এই বিতর্ক করছেন, তারা বিবেচনায় নিচ্ছেন না যে, চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যেসব রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় তারা থাকবেনÑএটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেটাই হয়ে থাকে। পরাজিত কাউকে কোনো প্রক্রিয়ায় রাখা হয় না। ইসিতে নিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দল বিগত সরকারের সহযোগী ও সমর্থক থাকায় তাদের জুলাই সনদে যুক্ত করা হয়নি।
বিএনপির নোট অব ডিসেন্টকে জুলাই সনদের সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হিসেবে দেখতে চাইছেন অনেকে। যদিও জামায়াতও বেশ কয়েকটি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে রেখেছে। দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন না বলা আছে সনদে। বিএনপি এর বিপক্ষে। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের নেতার সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত হলেও কমিটি ব্যর্থ হলে তাদের সঙ্গে বিচার বিভাগের দুজন প্রতিনিধি যুক্ত হবেন, যারা গোপন ব্যালটে র্যাংকড চয়েজ (ক্রমভিত্তিক) পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নির্বাচন করার বিষয়ে বিএনপির আপত্তি। সনদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে (পিআর) উচ্চকক্ষ গঠনের কথা বলা হলেও বিএনপি চায় আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল এবং আস্থা ভোট ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোটদানের ক্ষমতা দেওয়ার কথা রয়েছে সনদে। বিএনপি এ দুটির সঙ্গে সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় নিরাপত্তা (যুদ্ধ পরিস্থিতি) যুক্ত করার পক্ষে। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের কথা রয়েছে সনদে। জ্যেষ্ঠতম দুই বিচারপতি থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের কথা বলছে বিএনপি। ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার বিপক্ষে বিএনপি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন বিষয়টি বিবেচনা করে শুধু পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বহাল রেখেছে শেষ পর্যন্ত। বাম দলগুলো সনদে স্বাক্ষর করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
এনসিপির জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করা রাজনৈতিক কৌশল। তবে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারত। অঙ্গীকারনামা সই করলে তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা বা এখতিয়ার এনসিপির হাতে যে যাবে না, তা নিশ্চিত। ভবিষ্যৎ সরকার বা প্রধান বিরোধী দলই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এখতিয়ার রাখবে। না করার দায়ও তাদের ওপরই বর্তাবে। এই প্রেক্ষাপটে এনসিপি স্বাক্ষর না করে বরং ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পেরেছে। সরকারের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের যে অভিযোগ তোলা হয়, তা যে নিছক প্রচারণা সম্ভবত সেই বার্তাটিও দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও তাদের স্বাক্ষর করার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। ধারণা করি, তারা আর স্বাক্ষর করবে না। বরং বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তির দাবি জোরদার করে প্রতিবাদী চরিত্রে থাকবে। এনসিপি সম্ভবত নিজের অবস্থানের পক্ষে সঙ্গী হিসেবে জামায়াতকে চেয়েছিল। হতাশ হয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো এনসিপি নেতাকে। জামায়াত এনসিপির অবস্থানে থাকলে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টার যে অপবাদ তাদের বিরুদ্ধে আছে, তা আরো পোক্ত হতো। সে কারণে সম্ভবত দলটি দোলাচল কাটিয়ে অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিতি ও সনদ সই করতে ভুল করেনি। আগামী দিনগুলোয় জুলাই জাতীয় সনদ ইস্যুতে পারস্পরিক মতভিন্নতা নিরসন করে অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো সৎ, নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক হবে বলে প্রত্যাশা রাখি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক
বহুল আলোচিত ও কাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ সই হলো। অনিশ্চয়তা ছিল, পক্ষগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা ও দোলাচল ছিল, শেষ মুহূর্তেও স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ভন্ডুল হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তবু ২৪টি রাজনৈতিক দল এবং জোট রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের যুগান্তকারী এক অঙ্গীকারনামায় সই করে নিপীড়ক ও লুটেরা রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। সরকারের হয়ে সই করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের দল এনসিপি অনুষ্ঠানে যায়নি, স্বাক্ষরও করেনি। গণফোরাম অনুষ্ঠানে গিয়েও সনদে সই করেনি। বামপন্থি কয়েকটি দলও বিরত থেকেছে। তারপরও বলা যায়, হাজারো মানুষের রক্তেভেজা নতুন বাংলাদেশে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে এই সনদ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ও মাইলফলক। যদিও নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভঙ্গুরতা কাটাতে কতটা ভূমিকা রাখবে, তা আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সে পর্যালোচনায় পরে যাচ্ছি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ স্বাক্ষরের ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে যেভাবে উৎসবমুখর বা আনন্দঘন করতে চেয়েছিলেন, তেমনটা হয়নি। সহিংসতার কারণে সাধারণ মানুষের বিপুল উপস্থিতির প্রত্যাশাও শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। অনুষ্ঠান শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ‘জুলাইযোদ্ধা’ পরিচয় দিয়ে একদল লোক অনুষ্ঠানস্থলে অবস্থান নেয়। দাবি আদায়ের নামে গেট টপকে ভেতরে ঢুকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা করে তাদের সরিয়ে দেয়। এ সময় সংসদ ভবন এলাকার আশপাশে পুলিশ ও কথিত ‘জুলাইযোদ্ধাদের’ মধ্যে সংঘর্ষ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে। অনুষ্ঠান করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি হয়। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী উপদেষ্টাদের কেউ কেউ অনুষ্ঠান স্থগিতের পক্ষে মত দেন। তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নেন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বৃষ্টিবিঘ্নিত হয়ে বিলম্বিত হয়। অনুষ্ঠানটি ভন্ডুল হলে আগামী নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয়ে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে ভুল বার্তা যেতে পারত। তা হয়নি, এটা অবশ্যই স্বস্তির।
জুলাইযোদ্ধা দাবি করে যারা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনটি ভন্ডুল করতে চেয়েছে, তাদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা পুলিশের ওপর শক্তিশালী ককটেল নিক্ষেপ করেছে, পুলিশের গাড়ি ও যাত্রীবাহী বাস ভাঙচুর করেছে। নিরাপত্তাচৌকি ও দর্শনার্থীদের প্যান্ডেলে আগুন দিয়েছে। এমনকি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ঝুলে থাকা বিএনপির ব্যানারও তাদের আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি। একজনকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে গণভবন ভাঙচুরকারীদের ডাকতে শোনা গেছে। জুলাইযোদ্ধার টি-শার্ট পরা একজন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেছেন। গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে বলেছেন, তিনি সিলেট এমসি কলেজে এসএসসিতে পড়ছেন। দাবি পূরণ হওয়ার পরও কেন তাণ্ডব চালাচ্ছেÑএমন প্রশ্নেও বিক্ষোভকারীরা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। তবে পুলিশি অ্যাকশনে জুলাইযোদ্ধা পরিচয় দেওয়া একজনের কৃত্রিম হাত খুলে রাস্তায় পড়ে থাকার ফুটেজ ও ছবি ভাইরাল হওয়ার পর অনেকে সরকার এবং পুলিশকে দুষেছেন। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা দরকারÑগুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান পণ্ড করতে বেপরোয়া বিক্ষোভকারীদের কে সংঘটিত করেছে। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগকারীদের আসল পরিচয়ও জানা দরকার। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে ৫৪ বছর যা খুশি তাই করার লাইসেন্স ছিল। এখন সেই লাইসেন্স ‘জুলাইযোদ্ধাদের’ হাতে স্থানান্তর হওয়া কাম্য হতে পারে না। কারণ দুটি ক্ষেত্রেই আসলের চেয়ে নকলের দাপট দৃশ্যমান। গাছ থেকে পড়ে মৃত ব্যক্তিও যখন ‘জুলাই শহীদ’ হিসেবে সুবিধার জন্য তালিকাভুক্ত হয়, সনদ পায়, তখন সন্দেহ প্রবল হওয়াই স্বাভাবিক। মাসিক ভাতা পাওয়া বা কোনো সনদে স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষায় জুলাইতে জীবন ও রক্ত দেয়নি কোনো ছাত্র-জনতা।
এটা মানতে হবে যে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ যেনতেন একটি চুক্তি নয়, এটি ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে সমঝোতা ও সহাবস্থানের একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গণ্য হবে। কিছু দুর্বলতা ও মতভিন্নতা সত্ত্বেও সনদে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের রূপরেখা রয়েছে। জনগণের মধ্যে প্রত্যাশার জন্ম হয়েছে যে, এ সনদের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা অচিরেই দূর হবে এবং দেশ এক নতুন স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রার পথে পা বাড়াবে।
জুলাই সনদের মাধ্যমে ‘নতুন বাংলাদেশের সূচনা’ বা ‘নতুন করে দেশ গড়া’র যে প্রত্যাশা প্রধান উপদেষ্টা ব্যক্ত করেছেন, তা কতটা সম্ভব হবে, সেদিকে নজর থাকবে সবার। সনদের সম্ভাব্য কার্যকারিতা কতটুকু তা-ও পর্যবেক্ষণে থাকবে। যারা সই করেননি, তাদের অবস্থানইবা কতটা যৌক্তিক, সেটি বিশ্লেষণ চলবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই পর্বে আলোচনা করে জুলাই সনদ তৈরি করেছে। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে তারা। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫২টি।
জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছে ২৪ রাজনৈতিক দল ও জোট। আশার দিক হলোÑআগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দুটি দল সরকার গঠন ও প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, সেই দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী সনদে স্বাক্ষর করেছে। রাষ্ট্রকাঠামোর ব্যাপক সংস্কারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। এই অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত হলে ছাত্র-জনতা চব্বিশের জুলাইয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে যে কালবিলম্ব করবে না, তা নিশ্চয়ই তারা অনুধাবন করেন। প্রধান দল দুটির সমমনারাও সনদে সই করে বাস্তবায়নে সহযাত্রী হওয়ার অঙ্গীকার করেছে। যদিও অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া অন্য দলের ভূমিকা হবে অনেকটাই গৌণ।
স্বাক্ষরিত সাত দফা অঙ্গীকারনামায় সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চয়তা, পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্তি, সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন না তোলা, গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান, আহতদের চিকিৎসা, সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারে প্রয়োজনীয় আইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার দ্রুততম সময়ে সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এসব অঙ্গীকারের মূল্য কী? অতীতেও রাজনীতিকরা অঙ্গীকার করে তার খেলাপ করেছেন। কাগুজে সনদ রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে আদৌ ভূমিকা রাখবে কি নাÑসে সংশয় ব্যক্ত করেছেন কেউ কেউ। আদতে রাজনীতিকদের ওপর আস্থাহীনতার কারণেই এমন প্রশ্ন উঠছে। জুলাই সনদে ৮৪ দফা সংস্কারের বিষয়ে কিছু ভিন্নমতসহ ঐকমত্য হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান-সংশ্লিষ্ট ৪৭ দফা সংস্কার চূড়ান্ত হয়েছে। বাকি ৩৭ দফা বাস্তবায়ন হবে কোনো কালক্ষেপণ ছাড়াই। বাস্তবে অধ্যাদেশ বা বিধির মাধ্যমে কার্যকরযোগ্য ৩৭ দফার অনেকগুলো ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়ে গেছে কিংবা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
জুলাই সনদে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পুনরুত্থান রোধে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদলই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ। সনদে এক ব্যক্তির ১০ বছরের অধিক সময় প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। সংবিধানকে খেয়ালখুশিমতো পরিবর্তন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে প্রবণতা দেখা গেছে, তা রোধে সনদে মতৈক্য আছে। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ ও ক্ষমতা-সংক্রান্ত ৪৮ অনুচ্ছেদ, প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ এবং ক্ষমতা-সংক্রান্ত ৫৬ অনুচ্ছেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-সংক্রান্ত ৫৮(খ) এবং সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত ১৪২ অনুচ্ছেদ সংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একা পরিবর্তন করতে পারবে না। গণভোট লাগবে।
পছন্দের লোককে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করে ক্ষমতার পথ মসৃণ করার প্রবণতা রোধেও ব্যবস্থা রয়েছে সনদে। ঐকমত্য হয়েছেÑপ্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার, তৃতীয় বৃহত্তম দল মিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবে। রাতের কিংবা আমি-ডামির নির্বাচনের জন্য রকিব, নুরুল হুদা বা আউয়াল মার্কা নির্বাচন কমিশন গঠনের পথও বন্ধ করা হয়েছে জুলাই সনদে। ঐকমত্য হয়েছে, ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতি মিলে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ইসি গঠন নয়, পুলিশ কমিশনসহ নানা নিয়োগে বিরোধী দলের ভূমিকা থাকবে। যদিও বিএনপি দুদক, পিএসসি, সিএজি, ন্যায়পাল নিয়োগে বিরোধী দলকে নিয়ে কমিটি গঠনে আপত্তি দিয়ে রেখেছে। কিন্তু যেগুলোতে একমত হয়েছে, তা হলো বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার হবেন। বিরোধী দলকে কথা বলতে না দেওয়া, পয়েন্ট অব অর্ডার ওঠাতে না দেওয়ার মতো পরিস্থিতি আর দেখা যাবে না। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি হলো সরকারের জন্য আতঙ্ক। জুলাই সনদে ঐকমত্য হয়েছেÑএই কমিটির সভাপতি হবেন বিরোধী দল থেকে। লাগামহীন লুটপাট বন্ধে এ কমিটির বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকবে।
বিচার বিভাগকে করায়ত্ত করে ইশারা-ইঙ্গিতের আদেশ-নিষেধে ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার প্রবণতা দেখা গেছে। এটি রোধে ভবিষ্যতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক হবেন প্রধান বিচারপতি। পরীক্ষার মাধ্যমে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ দেবেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিটি। নিম্ন আদালতে পদোন্নতি বদলি মন্ত্রণালয়ের হাত থেকে চলে যাবে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয়ে। সেখানেও যাতে দুর্নীতির বিস্তার না ঘটে, সে জন্য বিচারক, বিচারপতিদের তিন বছর অন্তর অন্তর প্রকাশ্যে সম্পদের হিসাব দিতে হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়িত হলে জনপ্রতিনিধিদেরও প্রতিবছর সম্পদের হিসাব দিতে হবে। নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামার ভিত্তিতে রাজস্ব বোর্ড এবং দুদক দিয়ে সম্পদের হিসাব যাচাই হবে। খুনি, অপরাধীকে ক্ষমা করার রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র ক্ষমতা রহিত হবে। নিহতের পরিবারের সম্মতি ছাড়া আর কোনো খুনি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাবে না।
এমপিদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। প্রধানমন্ত্রীর একক পছন্দে পুতুল রাষ্ট্রপতি বানানোর সুযোগ রহিত হবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা, রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনে আওতায় আনাসহ আরো কিছু সংস্কার সনদে আছে কোনো ধরনের ভিন্নমত ছাড়াই। সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে দুদককে পূর্বানুমতির জালে আটকে থাকতে হবে না। দুদক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হবে। সনদ কার্যকর হলে সরকার আর কখনো ইন্টারনেট বন্ধ করতে পারবে না। অর্থপাচারের প্রকৃত সুবিধাভোগীর বিচারের মতো বিষয়গুলো অবশ্যই সনদের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অনেকগুলো রাজনৈতিক দলকে আলোচনা ও স্বাক্ষরের বাইরে রেখে জুলাই সনদ কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে প্রশ্নও তুলতে দেখা যাচ্ছে। যারা এই বিতর্ক করছেন, তারা বিবেচনায় নিচ্ছেন না যে, চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যেসব রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় তারা থাকবেনÑএটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেটাই হয়ে থাকে। পরাজিত কাউকে কোনো প্রক্রিয়ায় রাখা হয় না। ইসিতে নিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দল বিগত সরকারের সহযোগী ও সমর্থক থাকায় তাদের জুলাই সনদে যুক্ত করা হয়নি।
বিএনপির নোট অব ডিসেন্টকে জুলাই সনদের সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হিসেবে দেখতে চাইছেন অনেকে। যদিও জামায়াতও বেশ কয়েকটি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে রেখেছে। দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন না বলা আছে সনদে। বিএনপি এর বিপক্ষে। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের নেতার সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত হলেও কমিটি ব্যর্থ হলে তাদের সঙ্গে বিচার বিভাগের দুজন প্রতিনিধি যুক্ত হবেন, যারা গোপন ব্যালটে র্যাংকড চয়েজ (ক্রমভিত্তিক) পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নির্বাচন করার বিষয়ে বিএনপির আপত্তি। সনদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে (পিআর) উচ্চকক্ষ গঠনের কথা বলা হলেও বিএনপি চায় আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল এবং আস্থা ভোট ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোটদানের ক্ষমতা দেওয়ার কথা রয়েছে সনদে। বিএনপি এ দুটির সঙ্গে সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় নিরাপত্তা (যুদ্ধ পরিস্থিতি) যুক্ত করার পক্ষে। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের কথা রয়েছে সনদে। জ্যেষ্ঠতম দুই বিচারপতি থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের কথা বলছে বিএনপি। ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার বিপক্ষে বিএনপি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন বিষয়টি বিবেচনা করে শুধু পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বহাল রেখেছে শেষ পর্যন্ত। বাম দলগুলো সনদে স্বাক্ষর করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
এনসিপির জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করা রাজনৈতিক কৌশল। তবে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারত। অঙ্গীকারনামা সই করলে তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা বা এখতিয়ার এনসিপির হাতে যে যাবে না, তা নিশ্চিত। ভবিষ্যৎ সরকার বা প্রধান বিরোধী দলই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এখতিয়ার রাখবে। না করার দায়ও তাদের ওপরই বর্তাবে। এই প্রেক্ষাপটে এনসিপি স্বাক্ষর না করে বরং ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পেরেছে। সরকারের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের যে অভিযোগ তোলা হয়, তা যে নিছক প্রচারণা সম্ভবত সেই বার্তাটিও দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও তাদের স্বাক্ষর করার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। ধারণা করি, তারা আর স্বাক্ষর করবে না। বরং বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তির দাবি জোরদার করে প্রতিবাদী চরিত্রে থাকবে। এনসিপি সম্ভবত নিজের অবস্থানের পক্ষে সঙ্গী হিসেবে জামায়াতকে চেয়েছিল। হতাশ হয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো এনসিপি নেতাকে। জামায়াত এনসিপির অবস্থানে থাকলে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টার যে অপবাদ তাদের বিরুদ্ধে আছে, তা আরো পোক্ত হতো। সে কারণে সম্ভবত দলটি দোলাচল কাটিয়ে অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিতি ও সনদ সই করতে ভুল করেনি। আগামী দিনগুলোয় জুলাই জাতীয় সনদ ইস্যুতে পারস্পরিক মতভিন্নতা নিরসন করে অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো সৎ, নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক হবে বলে প্রত্যাশা রাখি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক
গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১৯ ঘণ্টা আগেযখন অনুন্নত দেশের যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী ব্যক্তিরা উন্নত দেশে স্থানান্তরিত হন, তখন এ ঘটনাকে ‘মেধা পাচার’ বা ‘ব্রেইন ড্রেন’ বলা হয়। নানা কারণে দেশ ত্যাগ করার বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের ক্ষেত্রে। অথচ জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের ‘বিশ্ব জনসংখ্যার অবস্থা প্রতিবেদন-২০২৫’-এ বাংলাদেশকে বর্তমান
১৯ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের অনেক গুণ থাকলেও, যে গুণটির বড্ড অভাব, তা হলো আত্মপর্যালোচনার অভ্যাস। কিন্তু এর জন্য পুরোপুরি তাদের দায়ী করা চলে না। কারণ, তাদের কর্মকাণ্ডের যারা দর্শক-শ্রোতা তথা (সু)ফলভোগী, অর্থাৎ আমাদের মতো আমজনতা, আমরা তাদের কাজকে সেটা ভুল হোক, ভালো হোক হাততালি দিয়ে আর প্রশংসায় ভ
১৯ ঘণ্টা আগেভারতও এই নিয়মের বাইরে নয়। তাই আমি আবার সেই প্রশ্নে ফিরে যাই : আমরা কি মুসলিম, নাকি মুজরিম (অপরাধী)? কেন আমাদের প্রতিদিন আসামির মতো বাঁচতে হবে, যখন খুনিরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়? কেন আমাদের শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা মিডিয়া থেকে গায়েব করে ফেলা হয়, অথচ রাষ্ট্র স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ উদযাপন করে?
১৯ ঘণ্টা আগে