আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

মার্ক কার্নি ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

আব্দুল্লাহ আল রাশেদ

মার্ক কার্নি ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সংসদীয় ধারার রাজনীতিতে সাধারণত দলই মুখ্য, ব্যক্তি সেখানে গৌণ। দীর্ঘদিন ধরে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে এটাই স্বীকৃত বাস্তবতা। তবে ইতিহাস বলে, কিছু সময় আসে যখন ব্যক্তি তার গুণ, দক্ষতা ও নৈতিক অবস্থানের মাধ্যমে দলীয় সীমানা অতিক্রম করে জনমানুষের আস্থা অর্জন করেন। তখন তিনি আর শুধু একটি দলের নেতা থাকেন না; হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক পরিবর্তন ও জাতীয় চেতনার প্রতীক। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডার রাজনীতিতে মার্ক কার্নির উত্থান সেই বাস্তবতারই একটি দৃষ্টান্ত—যার তাৎপর্য শুধু কানাডার জন্য নয়, বাংলাদেশের মতো দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ভাবনার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক।

মার্ক কার্নি কোনো পেশাদার রাজনীতিক নন। রাজনীতিতে আসার আগে তার পরিচয় ছিল একজন অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারক হিসেবে, যিনি সংকটকালে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ব্যাংক অব কানাডা এবং পরে একমাত্র বিদেশি হিসেবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নরের দায়িত্ব পালনকালে তিনি এমন এক ধরনের নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যেখানে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আস্থা, স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা তাকে প্রচলিত রাজনৈতিক বক্তৃতা ও তাৎক্ষণিক প্রতিশ্রুতিনির্ভর রাজনীতির বাইরে একটি ভিন্ন অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক সময়ে কানাডার ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপে ছিল। দীর্ঘদিনের শুভাকাঙ্ক্ষী ও প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে কানাডার ওপর অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপ করলে দেশটির রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র-থেকে-রাষ্ট্র সম্পর্কে এই ফাটল দুই দেশের জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা ও বিশ্বাসভঙ্গের অনুভূতি তৈরি করে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ তাদের সরকারপ্রধানের এই সিদ্ধান্তে মর্মাহত হন এবং কানাডার মানুষের প্রতি প্রকাশ্যে সহমর্মিতা জানান। এর পাশাপাশি জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, আবাসন সংকট, অভিবাসন ও জলবায়ু নীতির মতো ইস্যুতেও লিবারেল পার্টির ওপর জন-আস্থার চাপ ক্রমেই বাড়ছিল।

এই প্রেক্ষাপটে জাস্টিন ট্রুডোর রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো এবং মার্ক কার্নির নেতৃত্বে দলের হাল ধরা লিবারেল পার্টির জন্য শুধু মুখ বদলের ঘটনা ছিল না; বরং এটি ছিল বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্গঠনের একটি প্রয়াস। লক্ষণীয় যে, কার্নির প্রতি সমর্থন অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় সীমা অতিক্রম করেছে। সরকার গঠনের পর দুজন বিরোধীদলীয় সাংসদ ফ্লোর ক্রসিং করে লিবারেল শিবিরে যোগ দেন, যা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৫৫ শতাংশ মানুষ মার্ক কার্নিকে পছন্দ করছেন, যেখানে লিবারেল পার্টির প্রতি সমর্থন রয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশের। অর্থাৎ তিনি এককভাবে তার দলের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এই বাস্তবতা ইঙ্গিত দেয়—মানুষ তাকে রাজনৈতিক পরিচয়ের আগে ব্যক্তি হিসেবে দেখছে; তার দক্ষতা, সততা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার ভিত্তিতেই এই গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে।

এই জায়গা থেকেই নেতৃত্বের গুণগত প্রশ্নটি সামনে আসে। যখন কোনো দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সৎ, ন্যায়পরায়ণ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক হওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক এবং বিচক্ষণ হন, তখন তার প্রভাব শুধু উপরের স্তরে সীমাবদ্ধ থাকে না। নেতৃত্বের সেই মান ধীরে ধীরে দলীয় কাঠামোর ভেতরে প্রবাহিত হয়। নেতা ও কর্মী নির্বাচনের প্রক্রিয়া যখন যোগ্যতা, দক্ষতা এবং সততার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তখন দল নিজেই সৎ ও সক্ষম মানুষকে আকৃষ্ট করে। মানুষ জানে, সেখানে তাদের যোগ্যতার মূল্যায়ন হবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই দলীয় গণ্ডির ভেতরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা গড়ে ওঠে, যা একসময় রাষ্ট্রের সামগ্রিক রাজনৈতিক আচরণে প্রতিফলিত হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই প্রশ্নটি আরো জটিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা যাচ্ছে, অনেক ভোটার দলীয় পরিচয়ের বাইরে নেতৃত্বের ব্যক্তিগত চরিত্র, ভাষা ও আচরণের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন; কিন্তু সেই প্রত্যাশা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ খুব সীমিত। এখানে দল ও ব্যক্তির সম্পর্ক প্রায়ই এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে ব্যক্তি দলীয় কাঠামোর বাইরে স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে পারেন না, কিংবা দল ব্যক্তিকে শুধু নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। এর ফলে নেতৃত্বের গুণগত পরিবর্তনের বদলে রাজনীতিতে ক্ষমতার পুনরাবৃত্তি ঘটে।

দীর্ঘদিন দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা বা সততার চেয়ে আনুগত্যই অগ্রাধিকার পায়, যা নেতৃত্বের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। রাজনৈতিক বিরোধিতা নীতিগত অবস্থানের বদলে প্রায়ই ব্যক্তিগত শত্রুতায় রূপ নেয়। ভিন্নমত ও বিতর্কের প্রতি অসহিষ্ণুতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সংযত বিরোধিতাও অনেক সময় আক্রমণাত্মক ভাষায় প্রকাশ পায়। ফলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের প্রতি সহিষ্ণুতা, বিরোধিতার ভাষায় সংযম এবং ক্ষমতার ব্যবহারে দায়িত্ববোধ—এসব রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে পারেনি।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আসন্ন রাজনৈতিক সময়পর্ব বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভাব্য জোটনেতা ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আলোচনায় থাকা ব্যক্তিত্ব—তারেক রহমান, ডা. শফিকুর রহমান কিংবা নাহিদ ইসলামের মতো নেতারা নিজেদের নেতৃত্বের ধরন কীভাবে রূপান্তর করবেন এবং দলকে কী ধরনের ইতিবাচক দিকনির্দেশনা দেবেন, তার ওপরই দেশের নিকট ভবিষ্যতের সম্ভাবনা কিংবা শঙ্কা নির্ভর করছে। প্রশ্নটি ব্যক্তিকে ঘিরে নয়; বরং তাদের রাজনৈতিক আচরণ, সহনশীলতা ও দল পরিচালনার দর্শনকে ঘিরে।

এখানে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে ফ্লোটিং ভোটার ও শ্রমজীবী শ্রেণির ভূমিকা অবহেলা করার সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেতৃত্ব শুধু ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো বিষয় নয়। সচেতন অংশগ্রহণ, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং ক্ষমতার প্রশ্নে নৈতিক অবস্থান—এসবের মধ্য দিয়েই নেতৃত্বের ওপর সমাজের চাপ তৈরি হয় এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তনের বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হয়।

মার্ক কার্নির অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাজনীতি অবধারিতভাবে একই ধরনের থাকবে, এমন নয়। নেতৃত্ব যখন দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে নৈতিকতা, দক্ষতা ও দায়িত্ববোধকে প্রাধান্য দেয়, তখন দলকেও বদলাতে হয়। সেই বদল ধীরে হলেও তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হবে এই প্রশ্নের উত্তরে—এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ কি শুধু ক্ষমতার ধারাবাহিকতা দেখবে, নাকি নেতৃত্বের গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথে হাঁটবে?

লেখক : নির্বাচন ও রাজনৈতিক আচরণবিষয়ক গবেষক

মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউফাউন্ডল্যান্ড (এমইউএন), কানাডা

aarashed@mun.ca

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন