Ad T1

সংগীতকে ভালোবেসে জীবন কাটিয়ে দেন আহাদ ভাই

কামরুননেসা হাসান
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ২৪
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ২৭

ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে শাহবাগে অবস্থিত ঢাকা রেডিওতে সকালে কিশোর-কিশোরীদের জন্য সংগীত শিক্ষার আসর প্রচারিত হতো। ‘এখন শুরু হচ্ছে সংগীত শিক্ষার আসর, গান শেখাবেন সংগীত পরিচালক আব্দুল আহাদ’- এমন ঘোষণার পর ওস্তাদ ইয়াসিন খান ও বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী লায়লা আর্জুমান্দ বানুর দ্বৈতকণ্ঠে সা-রে-গা-মা’র উচ্চাঙ্গ সূচনা সুর বাজানো হতো।

রেডিও স্টেশনে পাঁচ নম্বর স্টুডিওতে একটি বড় পিয়ানো ছিল। আব্দুল আহাদের কণ্ঠে ঘোষণা হতো- ‘আমার সামনে এবং ঘরে বসে রেডিওতে যারা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছো, সবাইকে স্বাগত জানিয়ে আজকের অনুষ্ঠান শুরু করছি।’ তার সামনে বসে সে সময়ের তরুণ কাদেরি কিবরিয়া, শাহীন সামাদ, লীনু বিল্লাহসহ আরো অনেকে গান শিখতেন। দরাজ ও দরদি কণ্ঠে সে অনুষ্ঠানে গান শেখাতেন। পরবর্তীতে সবাই প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়েছেন।

কলকাতা শান্তিনিকেতন থেকে সংগীতে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ঢাকা ফিরে আসেন আহাদ ভাই। ভালো রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন। উঁচুমাপের একজন সুরকার আব্দুল আহাদ ভাইকে ঢাকা বেতারে নিজস্ব শিল্পীর তালিকায় সংগীত পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সে সময়ে প্রখ্যাত ও বিশিষ্ট শিল্পীদের দিয়ে অসংখ্য জনপ্রিয় গান তৈরি করেছেন তিনি। শুধু আধুনিক বাংলা গান নয়, দেশাত্মবোধক গানেও মুন্সিয়ানায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন আব্দুল আহাদ।

ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা- ‘কেন যে আমার কৃষ্ণচূড়ার বনে’, ‘আমি সাগরের নীল নয়নে মেখেছি ভ্রমরের পাখনা যতদূর যাক না’- প্রখ্যাত শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে অসাধারণ জনপ্রিয়তা পায়। হেনা স্যারের লেখা রুনা লায়লার গাওয়া ‘অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে’, ড. মুহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা সৈয়দ আব্দুল হাদীর গাওয়া ‘কিছু বলো কিছু বলো’, ‘এই নির্জন প্রহরের কণাগুলো’, ‘হৃদয় মাধুরী দিয়ে ভরে তোল’। আরেক কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া শহিদুল ইসলামের লেখা ‘সেই চিঠি আজও লেখা হয়নি’, ‘আমি এই তো আমি সেই তো, দিতে নেই তো কিছু বাকি’। সুরকার আব্দুল আহাদ এ রকম অসংখ্য মানসম্পন্ন জনপ্রিয় আধুনিক বাংলা গান আমাদের সংগীতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে গেছেন। ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন’ ড. মুহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা সমবেত কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গানটি আজও সেরা।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের একসময় জনপ্রিয় আধুনিক গানের অনুষ্ঠান ‘সুরবিতান’-এ সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে অনেক অবদান রেখেছেন এই মহান সংগীতস্রষ্টা। দুজন শিল্পী চারটি গান পরিবেশন করতেন। বিখ্যাত গীতিকারের কাছ থেকে গান সংগ্রহ করে শিল্পীদের রিহার্সাল করে বিটিভিতে অনেক রাত পর্যন্ত অডিও ধারণ করে পরদিন রেকর্ডিংয়ে উপস্থিত থাকতেন।

‘আহাদ ভাই, আপনি আজকে কষ্ট করে না এলেও পারতেন।’

‘শোন মেনকা (এই নামে আমাকে ডাকতেন), ভিডিও করার সময় অডিওটা যেন ঠিক থাকে, সে জন্য আসা।’ আমি অবাক হতাম নিজের সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞে কতটা মমতা থাকলে এত সচেতন হতেন আহাদ ভাই।

একদিন বিটিভিতে এসে বললেন, ‘কাজী নজরুল ইসলামের গান নিয়ে একটা গীতি নৃত্যনাট্য আছে। তুমি এটা প্রযোজনা করলে খুব ভালো হবে। পড়ে মুগ্ধ হলাম। বেশ কয়েকটি নাচ ছিল। প্রয়াত বিশিষ্ট নৃত্যপরিচালক ও শিল্পী জীনাত বরকত উল্লাহ এবং অন্য আরো অনেকে মিলে মহড়া শুরু করলেন। এবার শুটিংয়ের স্থান নির্বাচন ঠিক করা। আহাদ ভাই আমাকে বাইরে শুটিং করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তিনি গাজীপুরে ন্যাশনাল পার্ক ঠিক করে দিলেন। নির্ধারিত দিনে শুটিং টিম নিয়ে আহাদ ভাইসহ গন্তব্যে পৌঁছাই। উল্লেখ্য, তখন বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন তার ছোট ভাই। নৃত্যনাট্যে ধারাবর্ণনায় কণ্ঠ ছিল কবিপুত্র কাজী সব্যসাচীর। অসাধারণ! আর তখন এতে অভিনয় করলেন জনপ্রিয় অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ। সব মিলিয়ে অনবদ্য এক পরিবেশনা। তার ভাইয়ের অতিথি আপ্যায়নে আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে যাই। সেদিনের অনুষ্ঠানে আহাদ ভাইয়ের সহযোগিতা স্মৃতির মণিকোঠায় আজও অমলিন।

সাংস্কৃতিক দলের নেতা হিসেবে অনেক দেশে আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন তিনি। চীন ভ্রমণ করে ‘গণচীনে ২৪ দিন’ গ্রন্থ রচনা করেন। আরো বেশ কিছু লেখা বই আছে তার।

অনেক স্নেহ করতেন আমাকে। সেসব দিনের কথা মনে হলে আজও আবেগাপ্লুত হই।

সর্বদা পরিপাটি, স্মার্ট, ধীরস্থির ছিলেন আব্দুল আহাদ। প্রচুর ধূমপান করতেন। তিনি একাধারে ছিলেন সুরকার, প্রশিক্ষক, পরিচালক ও গায়ক।

সারা জীবন সংগীতকে ভালোবেসে বিভোর ছিলেন। তাইতো সঙ্গীবিহীন জীবনে চিরকুমার রয়ে গেছেন। সংগীতে অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার দেওয়া হয় তাকে। এই অমর সুরস্রষ্টা ১৯৯৪ সালের ১৫ মে পরলোক গমন করেন।

প্রশ্ন জাগে- এ প্রজন্ম এত বড় মাপের একজন মহান পণ্ডিত সম্পর্কে কতটুকু জানে। আমরা তা জানানোর চেষ্টা করিনি। এ ব্যর্থতা আমাদের সবার। তার নামে কোনো পদক প্রদানের ব্যবস্থা করলে হয়তো আগামী প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে- এই কামনা করি।

প্রয়াত আহাদ ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন- আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।

লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত