বিভাজন নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

ড. মো. ফরিদ তালুকদার
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১: ৪৮
ড. মো. ফরিদ তালুকদার

গুম, খুন, অর্থ পাচার‌, ভোটাধিকার হরণ ছিল পতিত ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থার স্তম্ভ বা খুঁটি, যা নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে কিছুটা হলেও সমালোচনা জারি আছে। এমনকি আইন-আদালতের মাধ্যমে এই অপশাসনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিচারের মুখোমুখি করার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট ক্ষত কিছুটা হলেও উপশম করা সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এই অপশাসনের পাশাপাশি পতিত ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা আমাদের এমন এক অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক এবং অ্যাকাডেমিক আলোচনা কম। এমনকি আইন-আদালতের মাধ্যমে যার সমাধানও প্রায় অসম্ভব। আর সেই অপশাসন হলো জাতীয় বিভাজন বা বিভেদ।

জাতীয় বিভাজন কখনো কখনো এমন পর্যায়ে চলে যায়, রাষ্ট্র সেই বিভাজন দূর করতে পারে না। যদি কখনো পারেও, সময় লাগে বহু বছর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি বিভাজন, পশ্চিমে সাদা কালো বর্ণ বিভাজন, এমনকি পাশের দেশ ভারতে শ্রেণিবিভাজন, ধর্মীয় বিভাজন রয়েছে। অপরদিকে শিয়া-সুন্নির বিভাজন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রই বদলে দিয়েছে (উৎস : কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনস, এপ্রিল ২৭, ২০২৩)।

এটা সত্য, মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তির জন্য ভূরাজনীতি অনেকাংশে দায়ী। বিভিন্ন শক্তি যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ইনফ্লুয়েনশিয়াল হতে পেরেছে, তার মূলে রয়েছে শিয়া-সুন্নি বিভাজন।

সাদা-কালোর বিভাজন পশ্চিমের সোশ্যাল সিস্টেম কি ভেঙে দিয়েছে? পিউ রিসার্চের মতে, অর্ধেকেরও বেশি (৫৩ শতাংশ) কালোরা মনে করে, সামাজিক দ্বন্দ্বের মূল কারণ বর্ণবিভাজন (সাদা-কালোর বিভাজন) (উৎস : পিউ রিসার্চ সেন্টার, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০০৯)।

এই বিভাজনের প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পশ্চিমে নানা সংগঠন এবং ক্যাম্পেইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার অন্যতম। কিন্তু এরপরও বর্ণবিভাজন দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এমনকি ধর্মীয় এবং শ্রেণিবিভাজন ভারতের অখণ্ডতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, এভাবে চলতে থাকলে ভারত ভেঙে যাতে পারে (উৎস : দ্য হিন্দু, জুন ২২, ২০২৩)। এই বিভাজনের কারণে ভারতের শিখ সম্প্রদায় নতুন রাষ্ট্র খালিস্তান গঠনের আন্দোলন করছে অনেক বছর ধরে (বিবিসি, ডিসেম্বর ১, ২০২৩)।

যেহেতু বাংলাদেশে জাতিগত, ধর্মীয় এবং বর্ণের সাংঘর্ষিক বিভাজন ছিল না এবং নেই, তাই ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর পতিত ফ্যাসিস্ট শাসক নিজের এবং ভারতের যৌথ স্ট্র্যাটিজিতে এ দেশে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং নাগরিক পরিচয়কেন্দ্রিক বিভাজন তৈরি করেছে। আর এই বিভাজন পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশকে দুর্বল করে বাংলাদেশের ওপর ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিভাজন এমনভাবে তৈরি করেছে যে, শুধু একটি দল এবং একটি পরিবারের আনুগত্য করা ছাড়া কোনো নাগরিকেরই কার্যত রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে প্রবেশাধিকার ছিল না। আওয়ামী বলয়ের বাইরে অন্যদের ভোটাধিকার ছিল একপ্রকার নিষিদ্ধ। এমনকি এই বলয়ের বাইরের কারও পক্ষেই গবেষণার মাধ্যমে, নাটক-সিনেমার মাধ্যমে, শিল্পচর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠনে ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না বললেই চলে।

অন্যদিকে, শিয়া-সুন্নি বিভেদ না থাকলেও, পতিত সরকার নিজস্ব অনুসারীদের দিয়ে ভুঁইফোড় এবং ইসলামি আদর্শ থেকে বিচ্যুত সংগঠনের মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে সাংঘর্ষিক নানা ফ্যাঁকড়া ও মতাদর্শ তৈরি করেছে। এমনকি এই ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো দিয়ে অন্যান্য সহি আকিদার ইসলামি সংগঠনকে নানাভাবে অত্যাচার করেছে, নির্যাতন করেছে অবিরত।

বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এই ভূখণ্ডে বহু বছর ধরে শান্তিতে বসবাস করে আসছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা ভোটব্যাংক হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়কে ব্যবহার করার স্বার্থে এবং সংখ্যালঘু ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে ভারত এবং পশ্চিমের অনুকম্পা পাওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং অসহিষ্ণু সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছে।

নাগরিককেন্দ্রিক বিভাজন ছিল আরও ভয়াবহ। এই বিভাজনের একটি দিক বলি : কোনো ব্যক্তি যদি ভারতের স্বার্থের ওপরে বাংলাদেশের স্বার্থকে স্থান দিত অথবা বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করত, সেই ব্যক্তিকে পাকিস্তানি আখ্যা দিয়ে দলীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্যাতন করত ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার সব মেশিনারি। এমনকি বঞ্চিত করা হতো রাষ্ট্রের সুযোগ এবং বেঁচে থাকার অধিকার থেকে। আমরা জানি, ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আমাদের আবরারকে কী নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছে।

এই বিভাজন রাষ্ট্রের ওপরের স্তরে অথবা শুধু শহরকেন্দ্রিকই ছিল না, বরং বিস্তৃত ছিল গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। যেই গ্রাম ছিল সব শ্রেণির মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাসের জায়গা, সেই গ্রাম হয়ে ওঠে অস্থির, অশান্ত এবং মানসম্মান নিয়ে বসবাসের অনুপযোগী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশের মানুষের সামষ্টিক অ্যাসপিরেশনকে দুর্বল করার জন্য পতিত ফ্যাসিস্ট শাসন এবং ভারত যৌথভাবে যে বিভাজন তৈরি করেছে এবং এই বিভাজনের ওপর ভর দিয়ে কতশত ছাত্র-ছাত্রীকে তাদের উচ্চশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, তার বিরুদ্ধে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফ্যাসিবাদের অপশাসনের পক্ষে বয়ান তৈরি করেছে এবং তৈরি করা বয়ান প্রচার করেছে, ফেরি করেছে।

ইয়েল ইউনিভার্সিটির ফিলোসফির প্রফেসর জেসন স্ট্যানলি ‘ফ্যাসসিসম অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি’ প্রবন্ধে বলেন, হায়ার এডুকেশন হিস্টোরিক্যালয় এ বুলওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট অথরিটারিয়ানিজম মানে উচ্চশিক্ষা ঐতিহাসিকভাবে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে একটি বাধা (জিএম সেন্টার, অক্টোবর ৩, ২০১৮)। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। তাই, ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থার উৎখাতের পর এই বিভাজন দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায় এবং ভূমিকা দুটিই অপরিসীম।

মানুষ প্রত্যাশা করে যে এই বিভাজন দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয় : ১. যুগোপযোগী মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করবে। ২. ক্লাস লেকচার, বই, আর্টিকেল, উপন্যাসসহ নানা লেখনীর মাধ্যমে পতিত ফ্যাসিস্ট শাসনের অপশাসন মানুষের কাছে তুলে ধরবে, সচেতন করবে। ৩. বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবে। কনফারেন্স, সিম্পোজিয়াম, সেমিনার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার আয়োজনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসকে মুখরিত করবে। ৪. ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন, বিভিন্ন অনুষদে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন এবং ক্লাব কার্যক্রমের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। ৫. শিক্ষকদের সাদা দল এবং নীল দল বিভাজন এবং গোলামির আঁতুড়ঘর। শুধু তা-ই নয়, এই কনসেপ্ট বিশ্রী এবং আধুনিক শিক্ষাঙ্গন ধারণার সঙ্গে বেমানান ও সেকেলে। শিক্ষকরা অবশ্যই রাজনীতি করবেন, তবে তা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। তাই বাংলাদেশ ২ দশমিক শূন্যতে গোলামির এই আঁতুড়ঘর বন্ধ হবে বলে মানুষ আশা করে। ৬. যেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক এবং প্রশাসক নিয়োগের নামে দলীয় ক্যাডার এবং ভোটার নিয়োগ দেওয়া হয়, সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে এমন নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রণয়ন করা হবে, যেই প্রক্রিয়ায় যোগ্য, মেধাবী এবং প্রকৃতপক্ষেই যারা শিক্ষা পেশায় আসতে চান, তারা নিয়োগ পাবেন। ৭. হলগুলোয় প্রচলিত গণরুম তথা টর্চার সেলপ্রথা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হবে। কারণ এই টর্চার সেল ছাত্রছাত্রীদের মানসিকভাবে অসুস্থ করে, প্রতিহিংসাপরায়ণ করে। তাই তাদের সহজে বিভাজনের ফাঁদে ফেলা যায়। ৮. শিক্ষকদের পদোন্নতি ও অন্যান্য বিষয় নির্ধারণে তাদের শিক্ষাদানের মান এবং গবেষণার অবদানকে মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কারণ যেসব শিক্ষক ভালো পড়ান না এবং ভালো গবেষণা করেন না, তারাই সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় বিভাজনকে স্বাগত জানায় এবং এই বিভাজনের মাধ্যমে টিকে থাকে।

সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয় যদি শিক্ষা এবং গবেষণা ওরিয়েন্টেড হয়, ক্যাম্পাস যদি সব ছাত্রছাত্রীর জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, নিরাপত্তা দিতে পারে, শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা যদি দলীয় গোলামিমুক্ত হয়, কম্পিটেন্ট হয়, তাহলে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠী বিভাজন তৈরির মাধ্যমে সমগ্র জাতির ওপর ভিনদেশি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না।

লেখক : অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অব ম্যানেজমেন্ট ম্যাকনিস স্টেট ইউনিভার্সিটি, লুইসিয়ানা ইউএসএ

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত