কামরুননেসা হাসান
একজন মানুষ এত বহুমাত্রিক প্রতিভা নিয়ে জন্ম নিতে পারেন, তা হুমায়ুন ফরীদির জীবন না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। তাকে কোনো বিশেষণে বাঁধা যায় না; তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেতা, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা এবং সর্বোপরি একজন সংবেদনশীল মানুষ। তার কথা বলায় ছিল নিজস্ব ছন্দ, তার চোখে ছিল চরিত্রের আগুন, তার মুখাবয়বে ছিল এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব।
হুমায়ুন ফরীদি জন্মেছিলেন ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায়। শৈশবেই তাকে অন্য শিশুদের থেকে আলাদা করে চেনা যেত। সরকারি চাকরিজীবী বাবার বদলির কারণে ফরীদির শৈশব কেটেছে দেশের নানা প্রান্তে—যশোর, কুষ্টিয়া, ঢাকাসহ বহু শহর ও জনপদে। সেই চলমান জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শ তার মনে গেঁথে দিয়েছিল এক গভীর অনুভূতির বীজ। আকাশ, নদী, গাছ, পাখি, মানুষের মুখ—সবকিছু তাকে ভাবায়, আলোড়িত করে।
শিক্ষাজীবনের শুরুতে ফরীদি ছিলেন এক মেধাবী ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৭০ সালে। কিন্তু তখনই শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বইয়ের পাতা ছেড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেন তিনি—দেশমাতৃকার টানে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। স্বাধীনতার পর ফিরে এলেন এক নতুন বাংলাদেশে, তবু তার ভেতরের তাড়না যেন অন্য পথে টানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর তাকে টানল না; চলে গেলেন শান্ত-সুনিবিড় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়ে। এখানেই তার জীবন বদলে যায়। পরিচয় হয় নাট্যজন সেলিম আল দীনের সঙ্গে—শুরু হয় এক ঐতিহাসিক যুগলবন্দি। সেলিম আল দীনের কলম আর ফরীদির অভিনয় জ্বেলে তোলে মঞ্চের আলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচর্চা তখন যেন এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন এই দুই প্রতিভা।
নাট্যচর্চার পাশাপাশি ফরীদি পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শ্রেণিকক্ষে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় ও প্রাণবন্ত। কিন্তু মহড়াকক্ষের ডাক তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না। অভিনয়ই ছিল তার শ্বাস-প্রশ্বাস। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্থিরতা ছেড়ে তিনি পুরোপুরি অভিনয়ে নিজেকে নিবেদন করলেন।
মঞ্চনাটকের পর্দা সরিয়ে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় আবির্ভূত হলেন হুমায়ুন ফরীদি। এ যেন এক নতুন যুগের সূচনা। তার প্রতিটি চরিত্র প্রতিটি সংলাপ যেন দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও বরকতউল্লাহর প্রযোজনায় নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ তাকে কিংবদন্তির আসনে বসায়। টেলিভিশনের পর্দা থেকে দেশের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে তার সংলাপ, তার দৃষ্টি আর তার মায়াবী রাগ।
শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক অবলম্বনে ইমদাদুল হক মিলনের নাট্যরূপে প্রখ্যাত প্রযোজক আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মাণ করেছিলেন নাটকটি। ‘কানকাটা রমজান’-এর ভূমিকায় হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় যেন এক ক্লাসিক উদাহরণ, যেখানে চরিত্র ও অভিনেতা একাকার হয়ে যায়।
ছোটপর্দার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তিনি পা রাখেন চলচ্চিত্র জগতে। একের পর এক চরিত্রে নিজের অভিনয়গুণে জয় করে নেন দর্শকের মন। ফরীদির প্রথম চলচ্চিত্র তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’। প্রথম বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘সন্ত্রাস’। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হচ্ছে ‘ভণ্ড’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘পালাবি কোথায়’ ও ‘মেহেরজান’। বাংলাদেশি সিনেমার খল চরিত্রে তিনি যোগ করেছিলেন এক নতুন মাত্রা। ‘সন্ত্রাস’ ছবির মাধ্যমে খলনায়ক হিসেবে অভিষেক হয় তার। তিনি ‘মাতৃত্ব’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৪ সালে। হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘এক জবানের জমিদার, হেরে গেলেন এবার’। ২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট মুক্তি পায় ছবিটি। প্রতিটি ছবিতে তিনি নিজেকে নতুন করে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ছিলেন সেই অভিনেতা, যার মুখের সংলাপ নয়, চোখই কথা বলত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি ইমদাদুল হক মিলনের লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘ভূমিকা’তে। নাটকটি আমার প্রযোজনায় নির্মিত হয়। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমার অনুরোধ রাখলেন। রামপুরা টেলিভিশন ভবনে প্রবেশ করে তিনি প্রায়ই দরজা খুলে বলতেন, ‘দিদি, কেমন আছেন?’ সেই সমীহ, সেই মমতা আজও আমার মনে অমলিন।
এক রমজানের সন্ধ্যায় চিত্রগ্রহণ চলছিল ঢাকার বাইরে। আজানের সময় ইফতার আনতে তিনি নিজেই দৌড়ে দোকানে গেলেন। আমার জন্য বোতল পানি ও হালকা খাবার এনে বললেন, ‘দিদি, আগে ইফতার করুন, তারপর কাজ।’ একজন তারকা নন, একজন মানুষ হিসেবে ফরীদির এই উষ্ণতা ছিল অসীম।
হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন অত্যন্ত রসিক ও প্রাণবন্ত মানুষ। হাসিঠাট্টায় আসর মাতিয়ে রাখতেন। কিন্তু মনের গভীরে ছিলেন অতি কোমল। তার একমাত্র মেয়ে দেবযানীর প্রতি ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। বেলী ফুলের মালা দিয়ে দেবযানীর মা ফরিদপুরের মেয়ে মিনুকে বিয়ে করেন হুমায়ুন ফরীদি। এ বিয়ে তখন সারা দেশে আলোড়ন তোলে। সেই সংসারেই তাদের সন্তান দেবযানী। একবার টেলিভিশনের কাজ শেষে গভীর রাতে হঠাৎ মনে পড়ল মেয়ের জন্য কিছু আনতে হবে। সব দোকান বন্ধ। অবশেষে এক দোকানদারকে ঘুম থেকে ডেকে উপহার কিনে বাসায় গেলেন। এমন স্নেহ, এমন ভালোবাসা খুব কম বাবা দেখাতে পারেন।
বিটিভি থেকে অবসর নেওয়ার পর আমি যখন ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কাজ করছিলাম, দেবযানীও তখন কমিউনিকেশনে কর্মরত। একদিন সে আমার রুমে এলো। কথা প্রসঙ্গে তার বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে করতে দুজনেই আবেগে ভেসে গেলাম। দেবযানী বলল, ‘বাবার নামে একটা আর্কাইভ করার ইচ্ছা আছে… দেখা যাক।’
ফরীদি একসময় ঘর বাঁধেন প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে। ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদও হয়ে যায়। তবে ব্যক্তিজীবন ছাপিয়ে হুমায়ুন ফরীদি সবার প্রিয় অভিনেতা হিসেবে এখনো আবিষ্ট করে রেখেছেন অগুনতি দর্শক-সমালোচককে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই দুর্বার অভিনেতার জীবনেও নেমে আসে নিঃসঙ্গতা। একসময় আর্থিক টানাপোড়েন, একাকিত্ব ও শারীরিক অসুস্থতা তাকে কাবু করে ফেলে। কিন্তু মনের দীপ্তি কখনো নিভে যায়নি। তিনি ছিলেন স্বপ্নে, সাহসে ও সৃষ্টিতে চিরতরুণ।
২০০৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ২০১৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান এই কিংবদন্তি অভিনেতা। কিন্তু তারও আগে তিনি দেশের কোটি দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন, যা কোনো পুরস্কারের চেয়ে অনেক বড়।
২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চিরনিদ্রায় চলে যান আমাদের হুমায়ুন ফরীদি; রেখে যান অনন্ত শূন্যতা, রেখে যান অভিনয়ের মাপকাঠি।
আমরা কি আর কোনোদিন পাব আরেকজন হুমায়ুন ফরীদি?
তিনি শুধু চরিত্রে অভিনয় করতেন না, চরিত্রে প্রাণ দিতেন। তার কণ্ঠে ছিল আগুন, তার চোখে ছিল কবিতা। একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন শিক্ষক, একজন শিল্পী, একজন মানবিক মানুষ—সব মিলিয়ে হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন এক অনন্য সংমিশ্রণ।
ফরীদি ভাই, আপনি আমাদের অহংকার। যুগ যুগ ধরে এই দেশের মানুষ আপনাকে স্মরণ করবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায়। আপনি মৃত্যুর গণ্ডি পেরিয়ে বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে, আমাদের মঞ্চে, আমাদের টেলিভিশনের পর্দায়।
‘আল্লাহ যেন ওপারে আপনাকে শান্তিতে রাখেন’—এ দিদির আন্তরিক প্রার্থনা রইল।
লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন
একজন মানুষ এত বহুমাত্রিক প্রতিভা নিয়ে জন্ম নিতে পারেন, তা হুমায়ুন ফরীদির জীবন না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। তাকে কোনো বিশেষণে বাঁধা যায় না; তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেতা, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা এবং সর্বোপরি একজন সংবেদনশীল মানুষ। তার কথা বলায় ছিল নিজস্ব ছন্দ, তার চোখে ছিল চরিত্রের আগুন, তার মুখাবয়বে ছিল এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব।
হুমায়ুন ফরীদি জন্মেছিলেন ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায়। শৈশবেই তাকে অন্য শিশুদের থেকে আলাদা করে চেনা যেত। সরকারি চাকরিজীবী বাবার বদলির কারণে ফরীদির শৈশব কেটেছে দেশের নানা প্রান্তে—যশোর, কুষ্টিয়া, ঢাকাসহ বহু শহর ও জনপদে। সেই চলমান জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শ তার মনে গেঁথে দিয়েছিল এক গভীর অনুভূতির বীজ। আকাশ, নদী, গাছ, পাখি, মানুষের মুখ—সবকিছু তাকে ভাবায়, আলোড়িত করে।
শিক্ষাজীবনের শুরুতে ফরীদি ছিলেন এক মেধাবী ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৭০ সালে। কিন্তু তখনই শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বইয়ের পাতা ছেড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেন তিনি—দেশমাতৃকার টানে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। স্বাধীনতার পর ফিরে এলেন এক নতুন বাংলাদেশে, তবু তার ভেতরের তাড়না যেন অন্য পথে টানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর তাকে টানল না; চলে গেলেন শান্ত-সুনিবিড় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়ে। এখানেই তার জীবন বদলে যায়। পরিচয় হয় নাট্যজন সেলিম আল দীনের সঙ্গে—শুরু হয় এক ঐতিহাসিক যুগলবন্দি। সেলিম আল দীনের কলম আর ফরীদির অভিনয় জ্বেলে তোলে মঞ্চের আলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচর্চা তখন যেন এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন এই দুই প্রতিভা।
নাট্যচর্চার পাশাপাশি ফরীদি পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শ্রেণিকক্ষে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় ও প্রাণবন্ত। কিন্তু মহড়াকক্ষের ডাক তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না। অভিনয়ই ছিল তার শ্বাস-প্রশ্বাস। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্থিরতা ছেড়ে তিনি পুরোপুরি অভিনয়ে নিজেকে নিবেদন করলেন।
মঞ্চনাটকের পর্দা সরিয়ে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় আবির্ভূত হলেন হুমায়ুন ফরীদি। এ যেন এক নতুন যুগের সূচনা। তার প্রতিটি চরিত্র প্রতিটি সংলাপ যেন দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও বরকতউল্লাহর প্রযোজনায় নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ তাকে কিংবদন্তির আসনে বসায়। টেলিভিশনের পর্দা থেকে দেশের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে তার সংলাপ, তার দৃষ্টি আর তার মায়াবী রাগ।
শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক অবলম্বনে ইমদাদুল হক মিলনের নাট্যরূপে প্রখ্যাত প্রযোজক আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মাণ করেছিলেন নাটকটি। ‘কানকাটা রমজান’-এর ভূমিকায় হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় যেন এক ক্লাসিক উদাহরণ, যেখানে চরিত্র ও অভিনেতা একাকার হয়ে যায়।
ছোটপর্দার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তিনি পা রাখেন চলচ্চিত্র জগতে। একের পর এক চরিত্রে নিজের অভিনয়গুণে জয় করে নেন দর্শকের মন। ফরীদির প্রথম চলচ্চিত্র তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’। প্রথম বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘সন্ত্রাস’। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হচ্ছে ‘ভণ্ড’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘পালাবি কোথায়’ ও ‘মেহেরজান’। বাংলাদেশি সিনেমার খল চরিত্রে তিনি যোগ করেছিলেন এক নতুন মাত্রা। ‘সন্ত্রাস’ ছবির মাধ্যমে খলনায়ক হিসেবে অভিষেক হয় তার। তিনি ‘মাতৃত্ব’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৪ সালে। হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘এক জবানের জমিদার, হেরে গেলেন এবার’। ২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট মুক্তি পায় ছবিটি। প্রতিটি ছবিতে তিনি নিজেকে নতুন করে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ছিলেন সেই অভিনেতা, যার মুখের সংলাপ নয়, চোখই কথা বলত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি ইমদাদুল হক মিলনের লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘ভূমিকা’তে। নাটকটি আমার প্রযোজনায় নির্মিত হয়। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমার অনুরোধ রাখলেন। রামপুরা টেলিভিশন ভবনে প্রবেশ করে তিনি প্রায়ই দরজা খুলে বলতেন, ‘দিদি, কেমন আছেন?’ সেই সমীহ, সেই মমতা আজও আমার মনে অমলিন।
এক রমজানের সন্ধ্যায় চিত্রগ্রহণ চলছিল ঢাকার বাইরে। আজানের সময় ইফতার আনতে তিনি নিজেই দৌড়ে দোকানে গেলেন। আমার জন্য বোতল পানি ও হালকা খাবার এনে বললেন, ‘দিদি, আগে ইফতার করুন, তারপর কাজ।’ একজন তারকা নন, একজন মানুষ হিসেবে ফরীদির এই উষ্ণতা ছিল অসীম।
হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন অত্যন্ত রসিক ও প্রাণবন্ত মানুষ। হাসিঠাট্টায় আসর মাতিয়ে রাখতেন। কিন্তু মনের গভীরে ছিলেন অতি কোমল। তার একমাত্র মেয়ে দেবযানীর প্রতি ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। বেলী ফুলের মালা দিয়ে দেবযানীর মা ফরিদপুরের মেয়ে মিনুকে বিয়ে করেন হুমায়ুন ফরীদি। এ বিয়ে তখন সারা দেশে আলোড়ন তোলে। সেই সংসারেই তাদের সন্তান দেবযানী। একবার টেলিভিশনের কাজ শেষে গভীর রাতে হঠাৎ মনে পড়ল মেয়ের জন্য কিছু আনতে হবে। সব দোকান বন্ধ। অবশেষে এক দোকানদারকে ঘুম থেকে ডেকে উপহার কিনে বাসায় গেলেন। এমন স্নেহ, এমন ভালোবাসা খুব কম বাবা দেখাতে পারেন।
বিটিভি থেকে অবসর নেওয়ার পর আমি যখন ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কাজ করছিলাম, দেবযানীও তখন কমিউনিকেশনে কর্মরত। একদিন সে আমার রুমে এলো। কথা প্রসঙ্গে তার বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে করতে দুজনেই আবেগে ভেসে গেলাম। দেবযানী বলল, ‘বাবার নামে একটা আর্কাইভ করার ইচ্ছা আছে… দেখা যাক।’
ফরীদি একসময় ঘর বাঁধেন প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে। ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদও হয়ে যায়। তবে ব্যক্তিজীবন ছাপিয়ে হুমায়ুন ফরীদি সবার প্রিয় অভিনেতা হিসেবে এখনো আবিষ্ট করে রেখেছেন অগুনতি দর্শক-সমালোচককে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই দুর্বার অভিনেতার জীবনেও নেমে আসে নিঃসঙ্গতা। একসময় আর্থিক টানাপোড়েন, একাকিত্ব ও শারীরিক অসুস্থতা তাকে কাবু করে ফেলে। কিন্তু মনের দীপ্তি কখনো নিভে যায়নি। তিনি ছিলেন স্বপ্নে, সাহসে ও সৃষ্টিতে চিরতরুণ।
২০০৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ২০১৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান এই কিংবদন্তি অভিনেতা। কিন্তু তারও আগে তিনি দেশের কোটি দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন, যা কোনো পুরস্কারের চেয়ে অনেক বড়।
২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চিরনিদ্রায় চলে যান আমাদের হুমায়ুন ফরীদি; রেখে যান অনন্ত শূন্যতা, রেখে যান অভিনয়ের মাপকাঠি।
আমরা কি আর কোনোদিন পাব আরেকজন হুমায়ুন ফরীদি?
তিনি শুধু চরিত্রে অভিনয় করতেন না, চরিত্রে প্রাণ দিতেন। তার কণ্ঠে ছিল আগুন, তার চোখে ছিল কবিতা। একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন শিক্ষক, একজন শিল্পী, একজন মানবিক মানুষ—সব মিলিয়ে হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন এক অনন্য সংমিশ্রণ।
ফরীদি ভাই, আপনি আমাদের অহংকার। যুগ যুগ ধরে এই দেশের মানুষ আপনাকে স্মরণ করবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায়। আপনি মৃত্যুর গণ্ডি পেরিয়ে বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে, আমাদের মঞ্চে, আমাদের টেলিভিশনের পর্দায়।
‘আল্লাহ যেন ওপারে আপনাকে শান্তিতে রাখেন’—এ দিদির আন্তরিক প্রার্থনা রইল।
লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন
গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১৯ ঘণ্টা আগেযখন অনুন্নত দেশের যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী ব্যক্তিরা উন্নত দেশে স্থানান্তরিত হন, তখন এ ঘটনাকে ‘মেধা পাচার’ বা ‘ব্রেইন ড্রেন’ বলা হয়। নানা কারণে দেশ ত্যাগ করার বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের ক্ষেত্রে। অথচ জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের ‘বিশ্ব জনসংখ্যার অবস্থা প্রতিবেদন-২০২৫’-এ বাংলাদেশকে বর্তমান
১৯ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের অনেক গুণ থাকলেও, যে গুণটির বড্ড অভাব, তা হলো আত্মপর্যালোচনার অভ্যাস। কিন্তু এর জন্য পুরোপুরি তাদের দায়ী করা চলে না। কারণ, তাদের কর্মকাণ্ডের যারা দর্শক-শ্রোতা তথা (সু)ফলভোগী, অর্থাৎ আমাদের মতো আমজনতা, আমরা তাদের কাজকে সেটা ভুল হোক, ভালো হোক হাততালি দিয়ে আর প্রশংসায় ভ
১৯ ঘণ্টা আগেভারতও এই নিয়মের বাইরে নয়। তাই আমি আবার সেই প্রশ্নে ফিরে যাই : আমরা কি মুসলিম, নাকি মুজরিম (অপরাধী)? কেন আমাদের প্রতিদিন আসামির মতো বাঁচতে হবে, যখন খুনিরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়? কেন আমাদের শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা মিডিয়া থেকে গায়েব করে ফেলা হয়, অথচ রাষ্ট্র স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ উদযাপন করে?
১৯ ঘণ্টা আগে