সৈয়দ আবদাল আহমদ
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশ সফরে আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার তিনি ঢাকায় পৌঁছাবেন। তার অফিস থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, মাহে রমজানের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম-অধ্যুষিত বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি রোজা রাখবেন এবং ওই দিন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইফতার করবেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে আন্তোনিও গুতেরেসের এটি দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ সফর। এর আগে ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা ইস্যুতেই তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। জুলাই বিপ্লবের পর এবার তার ঢাকা সফর বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। গুতেরেস ছাড়াও এর আগে জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছেন ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেম, জেভিয়ার পেরেজ দ্য কুয়েলার ও কফি আনান। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব হিসেবে বান কি মুন বাংলাদেশ সফর করেন ২০১৯ সালে। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশেষ দূত অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জুলি বিশপ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্তোনিও গুতেরেসের আসন্ন সফর নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি জানিয়েছেন, দুই নেতা ঢাকায় বৈঠককালে কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাসরত মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার মানবিক সহায়তার জন্য নতুন দাতাদের সম্পৃক্ত করার বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে জাতিসংঘ চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে কাতারের রাজধানী দোহায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে রোহিঙ্গা-বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া ও ফিনল্যান্ড এই সম্মেলনের সহযোগী হতে সম্মত হয়েছে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস ৩ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে আশা প্রকাশ করেছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের আসন্ন সফরে রোহিঙ্গা সংকটকে আবার বৈশ্বিক মনোযোগে আনা সম্ভব হবে, বিশেষ করে যখন এক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবরাহেই ব্যয় হচ্ছে দেড় কোটি ডলার।
বাংলাদেশ গত ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবস পালন করেছে। বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে সম্পর্কের এখন পাঁচ দশক চলছে। জাতিসংঘ স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশকে খাদ্য সহায়তা ও যুদ্ধোত্তর সংস্কারে সহায়তা করেছে। এরপর জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশ বিভিন্ন কারিগরিমূলক সহযোগিতা ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা পেয়েছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারে সহায়তায় যুক্ত হবে জাতিসংঘ।
গত জুলাই বিপ্লব চলাকালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী যাতে বলপ্রয়োগ না করে, সে ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। সম্প্রতি বিবিসি হার্ডটকে অংশ নিয়ে ফলকার টুর্ক বলেছেন, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যাতে সমস্যা না হয়, সে বিষয়টি বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
আমরা লক্ষ করেছি, ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লব নিয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল বাংলাদেশে সরেজমিনে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম চালিয়েছে। এর ভিত্তিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর জেনেভা থেকে ‘বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের গণআন্দোলন-সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন’ শীর্ষক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ তথ্যানুন্ধান দল।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ও দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে খুনি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। অধিকাংশই নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। যারা হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু।
এতে আরো বলা হয়, বিক্ষোভ দমনের কৌশলের অংশ হিসেবে তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে এবং সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন চালানো হয়। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হত্যাযজ্ঞ পরিচালনাকারী দল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে। গত ৫ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫৫তম অধিবেশনে সংস্থার মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদন সম্পর্কে সদস্য দেশগুলোকেও ব্রিফ করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানান। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসকে তিনি ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত সব নৃশংসতার সঠিক নথিভুক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এর মধ্যে রয়েছে শাপলা চত্বরে আন্দোলনকারী আলেম ও মাদরাসা ছাত্রদের ওপর দমনপীড়ন, গণহত্যা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যা এবং বছরের পর বছর ধরে ঘটে যাওয়া গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ড. ইউনূস বলেন, এই দেশে জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত সব নৃশংসতার যথাযথ নথিভুক্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এটা না করা হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থই বলেছেন। গত ১৫ বছর ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের এক চরম দুঃশাসনের কাল। এমন কোনো অপকর্ম নেই যা ওই সময়ে হয়নি। ২০০৯ সালে মইন-মাসুদের জরুরি সরকারের আশীর্বাদে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় এসেই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ৫৭ চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করে ক্ষমতার সর্বস্তরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এই গণহত্যার সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতও জড়িত বলে তথ্য-প্রমাণে উঠে এসেছে। আমরা মনে করি এই গণহত্যার বিষয়টিও জাতিসংঘ মহাসচিবের দৃষ্টিতে আনা প্রয়োজন।
শেখ হাসিনা ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অনুগত একটি নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে কারচুপি ও প্রহসনের নির্বাচনের পথ সুগম করেন। ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচন, ২০১৮ সালের নিশিরাতের ভোটের নির্বাচন এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
অকল্পনীয় কারচুপি, জালিয়াতি ও প্রহসনের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে আবির্ভূত হয় ভয়ংকর, নিপীড়ক ও দুর্নীতিবাজ শাসকগোষ্ঠী হিসেবে। যতই দিন যেতে থাকে, ততই মানুষের মত প্রকাশের অধিকার আরো বেশি সংকুচিত হতে থাকে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং যথেচ্ছ মামলায় মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিরই ৬০ লাখ লোক মামলার শিকার হন।
এমনও হয়েছে, গ্রেপ্তারের ভয়ে নেতাকর্মীদের ধান ক্ষেতে গিয়ে রাত কাটাতে হয়েছে। শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশে গণহত্যাগুলো সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পিলখানা গণহত্যা, শাপলা চত্বর গণহত্যা, মাওলানা সাঈদীর রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে গণহত্যা, মোদির বাংলাদেশ সফর কেন্দ্র করে প্রতিবাদকারীদের ওপর গণহত্যা এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে জুলাই গণহত্যায় দুই হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা হত্যা।
এককথায় বলতে গেলে শেখ হাসিনার শাসনামলটি ছিল রাজনীতির নামে বিরোধীদের নির্মূলকরণ, নির্বাচনের নামে প্রহসন, উন্নয়নের নামে প্রতারণা, বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে নির্লজ্জ ভারততোষণ, মানবাধিকারের নিষ্ঠুর লঙ্ঘন এবং নাগরিক সমাজকে বশীভূতকরণ। দুর্নীতিই ছিল তাদের নীতি। শ্বেতপত্রে এসেছে, ৬০ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একটি চোরতন্ত্র। একটি সরকার ও একজন শাসক যে কতটা নিকৃষ্ট হতে পারে এবং জনগণের বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে রাষ্ট্রগুলোর অভিভাবক হিসেবে, সে চিত্র জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সামনে তুলে ধরা যেতে পারে।
২০২১ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণকারী হিসেবে (প্রেস ফ্রিডম প্রিডেটরস) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনকালে তিনি যে একজন স্বাধীন গণমাধ্যমবিদ্বেষী ও মতপ্রকাশের কণ্ঠরোধকারী তাও চিহ্নিত হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সামনে বিশেষভাবে তুলে ধরতে হবে গুম হওয়া মানুষের কাহিনি। আয়নাঘরে নিয়ে তাদের কী বীভৎস কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে, তা বিশ্বের অভিভাবক হিসেবে জাতিসংঘ মহাসচিবের জানা উচিত। গুম কমিশন এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছে, তা থেকে জানা যায়, ১ হাজার ৭০০ মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। কমিশন বলেছে, এর মধ্যে ৩০০ গুম হওয়া ব্যক্তিকে আর কোনোদিন স্বজনরা হয়তো পাবেন না। গুম করার পর অনেকেই নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন। লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছে, বস্তায় ভরে লাশ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও যমুনায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
গোপন বন্দিশালা আয়নাঘর যারা গুম হয়েছে তাদের নির্যাতন করার এক বড় হাতিয়ার ছিল। জুলাই বিপ্লবের পর এই আয়নাঘরের সন্ধান পাওয়া যায়। শুধু ঢাকার টিএফআই সেলই নয়, দেশের প্রতিটি জেলায় এমন আয়নাঘর তৈরি করে মানুষকে নির্যাতন করা হয়েছে। সেই আয়নাঘর অর্থাৎ ঢাকার টিএফআই সেলে বন্দি ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী ব্যারিস্টার আরমান। তিনি বেঁচে ফিরে এসেছেন। তাকে সাড়ে আট বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল একটি কক্ষে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তাকে চোখ বন্ধ করে বেঁধে রাখা হতো ওই কক্ষে। দিনের বেলায় সামনে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হতো এবং রাতের বেলায় ঘুমানোর সময় পেছনে হাতকড়া পরানো হতো।
এভাবেই তিনি ছিলেন আলো-বাতাসহীন একটি কক্ষে, যেখানে ফ্যান নেই, লাইট নেই। রাতের বেলায় একটি লাইট জ্বালানো হতো তিনি কী করছেন তা দেখার জন্য। বাইরে থেকে একটি ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে তাকে দেখা হতো। তিনি কয়েকবারই অসুস্থ হয়েছেন। সার্জারির প্রয়োজন হলে ওই রুমেই তাকে সার্জারি করা হয়েছে। পাশের রুমগুলো ছিল টর্চার সেল।
গুম হওয়া বন্দিদের পৈশাচিকভাবে টর্চার করা হতো। সেই টর্চার করার সময় হাত-পা বেঁধে উলটো করে ঝোলানো হতো, যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো, দেয়ালে বীভৎস ছবি টানিয়ে রেখে দেখানো হতো—‘তোর অবস্থাও এমন হবে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম এসব কাহিনি বর্ণনা করে বলেছেন, আমরা একটি ছেলের কাহিনি শুনেছি, যাকে এত নির্যাতন করা হয়েছিল যে তার সারা শরীর পচে গিয়েছিল।
পাশের রুমের বন্দিরা বলতেন, ‘এখানে এত দুর্গন্ধ কেন?’ তখন এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে বারবার দুর্গন্ধমুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আয়নাঘর থেকে ফিরে এসে এক বিন্দ জানান, ছেলেটির সারা শরীরে এত নির্যাতন করা হয়েছিল যে শরীরে ঘা হয়ে গিয়েছিল। ফলে শরীর পচে যাওয়ায় দুর্গন্ধ বের হয়। আয়নাঘরে নির্যাতনে কেউ মারা গেলে ওই লাশের ওপর দিয়ে অন্য বন্দিদের হাঁটানো হতো। বলা হতো—‘তোরও দশা এমন হবে।’ এই ছিল আয়নাঘরের চিত্র। জাতিসংঘ মহাসচিবকে আয়নাঘরের এই বর্ণনা জানানো হোক এবং সম্ভব হলে তাকে আয়নাঘর পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
জুলাই আন্দোলন চলাকালে ঢাকার রাস্তায় জাতিসংঘের লোগো ব্যবহার করে সাঁজোয়া যান নামানো হয়েছিল। তেমনি বিগত শেখ হাসিনার সরকার ইসরাইল থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত পেগাসাস প্রযুক্তি এনেছিল নজরদারির জন্য। আন্তর্জাতিকভাবে এই প্রযুক্তি নিষিদ্ধ। শতকোটি টাকায় এই নিষিদ্ধ ঘোষিত প্রযুক্তি কিনে এনে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের নজরদারিতে ব্যবহার করা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সামনে এ বিষয়গুলোও উত্থাপন করা উচিত।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, আমরা আপনাকে ঢাকায় স্বাগত জানাই। আপনার কাছে আমরা আশা করি, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী হিসেবে চিহ্নিত শেখ হাসিনার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে আয়োজনের ব্যবস্থা আপনি করবেন। জাতিসংঘ বাংলাদেশের ঘটনা তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে মানুষ খুশি। এবার তারা ন্যায়বিচার দেখতে চায়।
বাংলাদেশের মানুষ জাতিসংঘ মহাসচিবের ওপর আশাবাদী, কারণ গাজায় ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে আপনি জোরালো প্রতিবাদ করেছেন, সে সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ অবহিত। আপনি বলেছিলেন, ‘আমি জাতিসংঘ মহাসচিব হওয়ার পর সবচেয়ে জঘন্য পর্যায়ের হত্যা ও ধ্বংস দেখেছি গাজায়। ইসরাইলি হামলায় সেখানে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য শিশু।’
বাংলাদেশে আপনার সফর আনন্দদায়ক হোক মি. আন্তোনিও গুতেরেস।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক
দৈনিক আমার দেশ
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশ সফরে আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার তিনি ঢাকায় পৌঁছাবেন। তার অফিস থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, মাহে রমজানের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম-অধ্যুষিত বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি রোজা রাখবেন এবং ওই দিন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইফতার করবেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে আন্তোনিও গুতেরেসের এটি দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ সফর। এর আগে ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা ইস্যুতেই তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। জুলাই বিপ্লবের পর এবার তার ঢাকা সফর বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। গুতেরেস ছাড়াও এর আগে জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছেন ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেম, জেভিয়ার পেরেজ দ্য কুয়েলার ও কফি আনান। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব হিসেবে বান কি মুন বাংলাদেশ সফর করেন ২০১৯ সালে। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশেষ দূত অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জুলি বিশপ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্তোনিও গুতেরেসের আসন্ন সফর নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি জানিয়েছেন, দুই নেতা ঢাকায় বৈঠককালে কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাসরত মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার মানবিক সহায়তার জন্য নতুন দাতাদের সম্পৃক্ত করার বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে জাতিসংঘ চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে কাতারের রাজধানী দোহায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে রোহিঙ্গা-বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া ও ফিনল্যান্ড এই সম্মেলনের সহযোগী হতে সম্মত হয়েছে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস ৩ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে আশা প্রকাশ করেছেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের আসন্ন সফরে রোহিঙ্গা সংকটকে আবার বৈশ্বিক মনোযোগে আনা সম্ভব হবে, বিশেষ করে যখন এক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবরাহেই ব্যয় হচ্ছে দেড় কোটি ডলার।
বাংলাদেশ গত ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবস পালন করেছে। বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে সম্পর্কের এখন পাঁচ দশক চলছে। জাতিসংঘ স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশকে খাদ্য সহায়তা ও যুদ্ধোত্তর সংস্কারে সহায়তা করেছে। এরপর জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশ বিভিন্ন কারিগরিমূলক সহযোগিতা ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা পেয়েছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারে সহায়তায় যুক্ত হবে জাতিসংঘ।
গত জুলাই বিপ্লব চলাকালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী যাতে বলপ্রয়োগ না করে, সে ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। সম্প্রতি বিবিসি হার্ডটকে অংশ নিয়ে ফলকার টুর্ক বলেছেন, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যাতে সমস্যা না হয়, সে বিষয়টি বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
আমরা লক্ষ করেছি, ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লব নিয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল বাংলাদেশে সরেজমিনে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম চালিয়েছে। এর ভিত্তিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর জেনেভা থেকে ‘বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের গণআন্দোলন-সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন’ শীর্ষক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ তথ্যানুন্ধান দল।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ও দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে খুনি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। অধিকাংশই নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। যারা হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু।
এতে আরো বলা হয়, বিক্ষোভ দমনের কৌশলের অংশ হিসেবে তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে এবং সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন চালানো হয়। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হত্যাযজ্ঞ পরিচালনাকারী দল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে। গত ৫ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫৫তম অধিবেশনে সংস্থার মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদন সম্পর্কে সদস্য দেশগুলোকেও ব্রিফ করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানান। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসকে তিনি ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত সব নৃশংসতার সঠিক নথিভুক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এর মধ্যে রয়েছে শাপলা চত্বরে আন্দোলনকারী আলেম ও মাদরাসা ছাত্রদের ওপর দমনপীড়ন, গণহত্যা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যা এবং বছরের পর বছর ধরে ঘটে যাওয়া গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ড. ইউনূস বলেন, এই দেশে জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত সব নৃশংসতার যথাযথ নথিভুক্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এটা না করা হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থই বলেছেন। গত ১৫ বছর ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের এক চরম দুঃশাসনের কাল। এমন কোনো অপকর্ম নেই যা ওই সময়ে হয়নি। ২০০৯ সালে মইন-মাসুদের জরুরি সরকারের আশীর্বাদে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় এসেই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ৫৭ চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করে ক্ষমতার সর্বস্তরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এই গণহত্যার সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতও জড়িত বলে তথ্য-প্রমাণে উঠে এসেছে। আমরা মনে করি এই গণহত্যার বিষয়টিও জাতিসংঘ মহাসচিবের দৃষ্টিতে আনা প্রয়োজন।
শেখ হাসিনা ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অনুগত একটি নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে কারচুপি ও প্রহসনের নির্বাচনের পথ সুগম করেন। ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচন, ২০১৮ সালের নিশিরাতের ভোটের নির্বাচন এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
অকল্পনীয় কারচুপি, জালিয়াতি ও প্রহসনের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে আবির্ভূত হয় ভয়ংকর, নিপীড়ক ও দুর্নীতিবাজ শাসকগোষ্ঠী হিসেবে। যতই দিন যেতে থাকে, ততই মানুষের মত প্রকাশের অধিকার আরো বেশি সংকুচিত হতে থাকে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং যথেচ্ছ মামলায় মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিরই ৬০ লাখ লোক মামলার শিকার হন।
এমনও হয়েছে, গ্রেপ্তারের ভয়ে নেতাকর্মীদের ধান ক্ষেতে গিয়ে রাত কাটাতে হয়েছে। শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশে গণহত্যাগুলো সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পিলখানা গণহত্যা, শাপলা চত্বর গণহত্যা, মাওলানা সাঈদীর রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে গণহত্যা, মোদির বাংলাদেশ সফর কেন্দ্র করে প্রতিবাদকারীদের ওপর গণহত্যা এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে জুলাই গণহত্যায় দুই হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা হত্যা।
এককথায় বলতে গেলে শেখ হাসিনার শাসনামলটি ছিল রাজনীতির নামে বিরোধীদের নির্মূলকরণ, নির্বাচনের নামে প্রহসন, উন্নয়নের নামে প্রতারণা, বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে নির্লজ্জ ভারততোষণ, মানবাধিকারের নিষ্ঠুর লঙ্ঘন এবং নাগরিক সমাজকে বশীভূতকরণ। দুর্নীতিই ছিল তাদের নীতি। শ্বেতপত্রে এসেছে, ৬০ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একটি চোরতন্ত্র। একটি সরকার ও একজন শাসক যে কতটা নিকৃষ্ট হতে পারে এবং জনগণের বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে রাষ্ট্রগুলোর অভিভাবক হিসেবে, সে চিত্র জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সামনে তুলে ধরা যেতে পারে।
২০২১ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণকারী হিসেবে (প্রেস ফ্রিডম প্রিডেটরস) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনকালে তিনি যে একজন স্বাধীন গণমাধ্যমবিদ্বেষী ও মতপ্রকাশের কণ্ঠরোধকারী তাও চিহ্নিত হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সামনে বিশেষভাবে তুলে ধরতে হবে গুম হওয়া মানুষের কাহিনি। আয়নাঘরে নিয়ে তাদের কী বীভৎস কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে, তা বিশ্বের অভিভাবক হিসেবে জাতিসংঘ মহাসচিবের জানা উচিত। গুম কমিশন এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছে, তা থেকে জানা যায়, ১ হাজার ৭০০ মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। কমিশন বলেছে, এর মধ্যে ৩০০ গুম হওয়া ব্যক্তিকে আর কোনোদিন স্বজনরা হয়তো পাবেন না। গুম করার পর অনেকেই নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন। লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছে, বস্তায় ভরে লাশ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও যমুনায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
গোপন বন্দিশালা আয়নাঘর যারা গুম হয়েছে তাদের নির্যাতন করার এক বড় হাতিয়ার ছিল। জুলাই বিপ্লবের পর এই আয়নাঘরের সন্ধান পাওয়া যায়। শুধু ঢাকার টিএফআই সেলই নয়, দেশের প্রতিটি জেলায় এমন আয়নাঘর তৈরি করে মানুষকে নির্যাতন করা হয়েছে। সেই আয়নাঘর অর্থাৎ ঢাকার টিএফআই সেলে বন্দি ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী ব্যারিস্টার আরমান। তিনি বেঁচে ফিরে এসেছেন। তাকে সাড়ে আট বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল একটি কক্ষে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তাকে চোখ বন্ধ করে বেঁধে রাখা হতো ওই কক্ষে। দিনের বেলায় সামনে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হতো এবং রাতের বেলায় ঘুমানোর সময় পেছনে হাতকড়া পরানো হতো।
এভাবেই তিনি ছিলেন আলো-বাতাসহীন একটি কক্ষে, যেখানে ফ্যান নেই, লাইট নেই। রাতের বেলায় একটি লাইট জ্বালানো হতো তিনি কী করছেন তা দেখার জন্য। বাইরে থেকে একটি ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে তাকে দেখা হতো। তিনি কয়েকবারই অসুস্থ হয়েছেন। সার্জারির প্রয়োজন হলে ওই রুমেই তাকে সার্জারি করা হয়েছে। পাশের রুমগুলো ছিল টর্চার সেল।
গুম হওয়া বন্দিদের পৈশাচিকভাবে টর্চার করা হতো। সেই টর্চার করার সময় হাত-পা বেঁধে উলটো করে ঝোলানো হতো, যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো, দেয়ালে বীভৎস ছবি টানিয়ে রেখে দেখানো হতো—‘তোর অবস্থাও এমন হবে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম এসব কাহিনি বর্ণনা করে বলেছেন, আমরা একটি ছেলের কাহিনি শুনেছি, যাকে এত নির্যাতন করা হয়েছিল যে তার সারা শরীর পচে গিয়েছিল।
পাশের রুমের বন্দিরা বলতেন, ‘এখানে এত দুর্গন্ধ কেন?’ তখন এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে বারবার দুর্গন্ধমুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আয়নাঘর থেকে ফিরে এসে এক বিন্দ জানান, ছেলেটির সারা শরীরে এত নির্যাতন করা হয়েছিল যে শরীরে ঘা হয়ে গিয়েছিল। ফলে শরীর পচে যাওয়ায় দুর্গন্ধ বের হয়। আয়নাঘরে নির্যাতনে কেউ মারা গেলে ওই লাশের ওপর দিয়ে অন্য বন্দিদের হাঁটানো হতো। বলা হতো—‘তোরও দশা এমন হবে।’ এই ছিল আয়নাঘরের চিত্র। জাতিসংঘ মহাসচিবকে আয়নাঘরের এই বর্ণনা জানানো হোক এবং সম্ভব হলে তাকে আয়নাঘর পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
জুলাই আন্দোলন চলাকালে ঢাকার রাস্তায় জাতিসংঘের লোগো ব্যবহার করে সাঁজোয়া যান নামানো হয়েছিল। তেমনি বিগত শেখ হাসিনার সরকার ইসরাইল থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত পেগাসাস প্রযুক্তি এনেছিল নজরদারির জন্য। আন্তর্জাতিকভাবে এই প্রযুক্তি নিষিদ্ধ। শতকোটি টাকায় এই নিষিদ্ধ ঘোষিত প্রযুক্তি কিনে এনে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের নজরদারিতে ব্যবহার করা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সামনে এ বিষয়গুলোও উত্থাপন করা উচিত।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, আমরা আপনাকে ঢাকায় স্বাগত জানাই। আপনার কাছে আমরা আশা করি, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী হিসেবে চিহ্নিত শেখ হাসিনার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে আয়োজনের ব্যবস্থা আপনি করবেন। জাতিসংঘ বাংলাদেশের ঘটনা তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে মানুষ খুশি। এবার তারা ন্যায়বিচার দেখতে চায়।
বাংলাদেশের মানুষ জাতিসংঘ মহাসচিবের ওপর আশাবাদী, কারণ গাজায় ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে আপনি জোরালো প্রতিবাদ করেছেন, সে সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ অবহিত। আপনি বলেছিলেন, ‘আমি জাতিসংঘ মহাসচিব হওয়ার পর সবচেয়ে জঘন্য পর্যায়ের হত্যা ও ধ্বংস দেখেছি গাজায়। ইসরাইলি হামলায় সেখানে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য শিশু।’
বাংলাদেশে আপনার সফর আনন্দদায়ক হোক মি. আন্তোনিও গুতেরেস।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক
দৈনিক আমার দেশ
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৩ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৩ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৪ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে