আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

হাদির মৃত্যুমঞ্চ তৈরি করল কারা

ড. খান জহিরুল ইসলাম

হাদির মৃত্যুমঞ্চ তৈরি করল কারা

১. শরীফ ওসমান হাদি এখন আর শুধু একটি নাম নয়, কোনো একক নেতার নামও নয়। হাদি এখন একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানের নাম। তার সংগ্রাম কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ছিল না; তার লড়াই ছিল ৫৪ বছরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সমগ্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। হাদির প্রথম পরিচয় হলো তিনি একজন সম্মুখসারির জুলাইযোদ্ধা। দেশ বদলাতে হলে রাজনীতি বদলাতে হবে। রাজনীতি বদলাতে হলে রাজনীতিবিদ বদলাতে হবে। হাদি ছিল সেই রাজনীতিকে বদলে দেওয়া রাজনীতিবিদ।

গত ৫৪ বছরে এই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি—এর প্রধান কারণ পরিবারতন্ত্রের শেকল। আজও দেশ, রাজনীতি ও গণতন্ত্র কার্যত দুটি পরিবারের কাছে জিম্মি। এই পরিবারতন্ত্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে লুটপাটের এক সর্বগ্রাসী দুর্বৃত্তচক্র, যারা দশকের পর দশক ধরে রাষ্ট্রকে নিঃশেষ করেছে। এর অনিবার্য পরিণতি ছিল জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান—একদল বীর তরুণের নেতৃত্বে বিস্ফোরিত জনরোষ। তারা চেয়েছিল ৫৪ বছরের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের বলয় চূর্ণ করে নতুন করে দেশ গড়তে। হাদি ছিলেন সেই সাহসী তরুণ যোদ্ধাদেরই একজন।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন হলো—হাদিকে কারা এবং কেন হত্যার পরিকল্পনা করল? উত্তর খুবই সহজ : যারা হাদিকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের বলয় ভেঙে ফেলার হাতিয়ার মনে করেছে। হাদি হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মূলত চারটি পক্ষ জড়িত। প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হাসিনা ও তার দল এবং হাদির খুনিসহ সব খুনির আশ্রয়দাতা ভারত। বাকি দুটি পক্ষ হলো বিএনপি এবং বিভিন্ন পরিচয়ে টকশোকারী গোষ্ঠী—যারা দেশে হাদির মৃত্যুর জন্য অনুকূল পরিবেশ ও ‘মঞ্চ’ প্রস্তুত করেছে। এখন বলছি, এই চারটি গোষ্ঠী কীভাবে হাদি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

২. ফাঁসির আসামি শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগী খুনিরা প্রকাশ্যে, প্রতিনিয়ত জুলাইযোদ্ধাদের প্রাণনাশের হুমকি ও পরিকল্পনার কথা অনেক দিন ধরেই জানিয়ে আসছে। হাসিনা ও তার দলের খুনিরা যে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছে এবং নির্দেশ দিয়েছে তার বহু অডিও রেকর্ড ইতোমধ্যেই দেশবাসী শুনেছে। এমনকি তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ প্রকাশ্য ভিডিওতে বলেছে যে জুলাইযোদ্ধাদের হত্যার উদ্দেশ্যে তারা অর্থ সংগ্রহ করে অস্ত্র কিনে খুনিদের সরবরাহ করেছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই হাসিনা নিজে তার এক খুনিকে বলেছেন—‘কাজ করে দেখাও, শুধু মুখে বললে চলবে না।’ শেষ পর্যন্ত হাদিকে যে ব্যক্তি হত্যা করেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত করেছে, সে আওয়ামী লীগেরই সদস্য। অতএব, হাসিনা ও তার দল যে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

৩. হাদি প্রকাশ্যে ভারতসহ সব আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সিংহের মতো গর্জে উঠতেন প্রতিনিয়ত। তার এই আপসহীন অবস্থানই স্বাভাবিকভাবে তাকে ভারতের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। তথ্য ও প্রাসঙ্গিক আইনি নীতিমালার আলোকে যুক্তিসংগতভাবেই বলা যায় যে, হাদি হত্যাকাণ্ডে ভারত প্রত্যক্ষ সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমত, হাসিনাসহ হাদির হত্যাকারীরা ভারতে আশ্রয় পেয়েছে এবং হত্যার পরিকল্পনা ও ৩০ বারেরও বেশি হুমকি ভারতীয় ভূখণ্ড থেকেই দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে খুনিদের প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানালেও ভারত তা প্রত্যাখ্যান করেছে; বরং প্রকাশ্যে বাংলাদেশে হাদি হত্যার প্রতিবাদকারীদের ‘জঙ্গি’ ও ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েছে। তৃতীয়ত, জুলাই গণহত্যায় সরাসরি জড়িত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হাসিনা এবং সংশ্লিষ্ট একাধিক মন্ত্রীকে ভারত নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে, বিশেষত রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা-সংক্রান্ত নীতিমালা (Articles on Responsibility of States for Internationally Wrongful Acts), সন্ত্রাস ও গুরুতর অপরাধে সহযোগিতা নিষিদ্ধকরণ এবং অপরাধীদের আশ্রয় না দেওয়ার বাধ্যবাধকতা (aut dedere aut judicare)—এ ধরনের আশ্রয় ও সহযোগিতা স্পষ্টতই অবৈধ। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত Bosnia and Herzegovina v. Serbia and Montenegro (2007) মামলায় স্পষ্টভাবে বলেছেন, যদি কোনো রাষ্ট্র জানে যে কোনো গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হবে এবং তারপরও অপরাধীদের সহায়তা, আশ্রয় বা সুরক্ষা দেয়, তবে তা ‘aiding and abetting’ হিসেবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক দায় সৃষ্টি করে। একইভাবে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতি ‘aut dedere aut judicare’ অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আশ্রয় নেওয়া গুরুতর অপরাধীদের হয় প্রত্যর্পণ করতে হবে, নয়তো নিজ দেশে বিচার করতে হবে। অতএব, অপরাধীদের আশ্রয়, হত্যা পরিকল্পনার সুযোগ, প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান ও ভুক্তভোগী রাষ্ট্রের নাগরিকদের আন্দোলনকে সন্ত্রাসী তকমা দেওয়ার ধারাবাহিক আচরণ প্রমাণ করে, হাদি হত্যাকাণ্ডে ভারতের ভূমিকা পরোক্ষ নয়—বরং প্রত্যক্ষ সহায়ক।

৪. শেখ হাসিনা এবং তার দল রাজনীতিতে ফেরার জন্য যে সঠিক পথটি ছিল, সেই পথে না হেঁটে তারা আবার হত্যাকাণ্ড ও আগুন-সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু এই কাজটি দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করতে হলে দেশের মধ্যে বহু ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা অপরিহার্য। এই ক্ষেত্রে তারা কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়াকে ব্যবহার করেছে।

হাদি সবসময় বলতেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা। একই সঙ্গে তিনি খালেদা জিয়ার প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ পোষণ করতেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার দল বিএনপি এখন আর তাদের আদর্শে চলে না। ৫ আগস্টের পর থেকেই বিএনপির কোনো কোনো নেতা বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগের লুটেরাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে ও দিচ্ছে। এর একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হলো হাদির হত্যাকারীকে কারাগার থেকে জামিন করিয়েছিলেন বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক। এই তথ্য পত্রিকাসহ বিভিন্ন সূত্রে জামিন আদেশের কপি প্রকাশিত হয়েছে। শাহেদ আলমসহ বিএনপির একাধিক চাটুকার, তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ হাদিকে নিয়ে প্রকাশ্যে অশালীন ও আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন—যার প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। বিএনপির নেত্রী রুমিন ফারহানা জুলাই যুদ্ধে অংশ নেওয়া আরেক বীর সন্তান হাসনাত আবদুল্লাহকে প্রকাশ্যে ‘ফকিন্নির বাচ্চা’, ‘ডাকাতের মতো চেহারা’—এ ধরনের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছেন।

৫ আগস্টের পর একটিক জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তাতে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সারা দেয়নি। জাতীয় সরকার গঠিত হলে আজ দেশের এই অরাজক অবস্থা তৈরি হতো না, হাদিকেও জীবন দিতে হতো না।

সবশেষে, হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে দুদিন আগে একটি সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা হয়। সেখানে প্রায় সব রাজনৈতিক দল উপস্থিত থাকলেও বিএনপি অংশ নেয়নি। ফলে দিবালোকের মতো স্পষ্ট—হাদি হত্যাকাণ্ডে বিএনপি অনেকটা নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেছে।

৫. হাদি হত্যাকাণ্ডে আরেকটি বড় পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামী লীগনিয়ন্ত্রিত মিডিয়া। প্রতিদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ছয়-সাতজনের একটি দল—সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব—এসব পরিচয়ে বিভিন্ন টেলিভিশনে গিয়ে খুনিদের ও লুটেরাদের পক্ষে বয়ান তৈরি করছে। এই সংগঠিত কুচক্রটি প্রকাশ্যে জুলাইযোদ্ধাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, প্রমাণ ছাড়া তাদের দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রচারসহ নানাভাবে জুলাইযোদ্ধাদের হেয়প্রতিপন্ন করে চলেছে। গত প্রায় এক বছর ধরে তাদের কাজের মূল লক্ষ্য হলো জুলাইকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে প্রমাণ করা এবং জুলাইযোদ্ধাদের কীভাবে ছোট করা যায়, অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যায়, সেই চেষ্টা করা। আনিস আলমগীর জুলাইকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যার প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্যমান। তিনি বিচার হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগেকে নির্বাচন করতে দেওয়া এবং গ্রামীণ ব্যাংক, জুলাই জাদুঘর ইত্যাদি পূর্বাভাস দিয়ে মূলত হত্যাকারী ও আগুন-সন্ত্রাসীদের উৎসাহ দিচ্ছেন। মাসুদ কামাল কোনো প্রমাণ ছাড়াই জুলাইযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অন্যায় ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। জুলাইযোদ্ধাদের ‘ছোকরা’ বলে তাচ্ছিল্য করেন। আবদুন নূর তুশার হাদিকে প্রকাশ্যে টকশোতে অপমান করেছেন। এই ব্যক্তি প্রতিটি টকশোতে জুলাই শক্তিকে পাড়ার মাস্তানের মতো ধমকায়, এমনকি একাধিক সঞ্চালককেও ধমক দিয়েছেন। তার শারীরিক ভঙ্গি ও দম্ভ দেখে বোঝা যায় যে তিনি মহাক্ষমতাশালী দুর্বৃত্ত। তুষার মূলত বিএনপির কর্মী ছিলেন; পরে আওয়ামী লীগের সময় মধু খেয়েছেন। এখন আবার বিএনপির মধু আহরণের কাজে নিয়োজিত। এছাড়া সিনিয়র আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী সাংবাদিক আছেন, যারা প্রতিদিন জুলাইযোদ্ধাদের অপরাধী হিসেবে প্রমাণ করতে চান। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি—এই টকশোকারীদের গত এক বছরের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে যে, এরা সবাই অপরাধ করেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই কুচক্রটি খুনি ও লুটেরাদের পরিকল্পনার একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এই চক্রটিই দেশের মধ্যে এখন জুলাইযোদ্ধাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

সব মিলিয়ে, উপরোক্ত দুটি প্রত্যক্ষ শক্তি দেশের বাইরে থেকে হাদিসহ জুলাইযোদ্ধাদের হত্যার পরিকল্পনা করেছে আর দুটি শক্তি দেশের ভেতর থেকে হত্যার জন্য মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে।

হাদি এই দেশকে শুধু দিয়েছেন; নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য এ দেশের কাছে তিনি কিছুই চাননি। তিনি রেখে গেছেন মাত্র একটি দাবি—যারা তাকে হত্যা করবে, তাদের বিচারটা যেন হয়। দেশের ভেতর ও বাইরের শক্তি মিলেই যখন হাদিকে হত্যা করেছে, তখন সেই দেশ কি পারবে এই হত্যার ন্যায়বিচার করতে? যদি না পারে, তবে শুনে রাখো—বাংলাদেশ চিরতরে হাদিদের জন্মের বন্ধ্যত্ববরণ করবে।

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, কানাডা

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন