যমুনার পানি কখন লাঠি হয়ে যায়

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৫, ০৯: ২৬
আপডেট : ২৩ মে ২০২৫, ১৯: ২৫

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরাজিত হয়ে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা পালিয়ে যাওয়ার পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বরেণ্য ব্যক্তি বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ব্যক্তি ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১/১১-খ্যাত বিশেষ সরকারের দুই বছর এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের ১৬ বছর নানা বঞ্চনার শিকার মানুষ তাদের বহু বঞ্চনা ও দাবির কথা নিয়ে হাজির হতে লাগলেন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের দরবারে। তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মোক্ষম জায়গা হিসেবে সবাই বেছে নেওয়া শুরু করলেন তার বাসভবন যমুনাকে। কারণ বাংলাদেশে এটা মোটামুটি সবার মাথায় এত বছরে গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে, রাষ্ট্রের সবকিছু দেওয়ার মালিক একজন। ১৬ বছরে এই দেশে যেকোনো বিষয়ে রাষ্ট্রের নাগরিকদের কিছু চাইতে হলে মাফিয়ারানি শেখ হাসিনার কাছেই চাইতে হবে, এটা ছিল অলিখিত নিয়ম। এখনো মানুষ সেই মাইন্ডসেট থেকে বের হতে পারেনি। রাষ্ট্র পরিচালকরাও অবশ্য এই মাইন্ডসেট থেকে রাষ্ট্রের নাগরিকদের বের করে আনার কোনো চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়নি। তাই মানুষ দাবি আদায়ের জন্য প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনাকেই বেছে নিতে শুরু করল তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের বাড়বাড়ন্ত দেখে পুলিশ সিদ্ধান্ত নিল যমুনার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে গণজমায়েত নিষিদ্ধ করার। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কিছু মানুষ ১৪৪ ধারা ভেঙে অবস্থান নিলেন যমুনার সামনে। তখন পুলিশের দেওয়া ১৪৪ ধারা ভাঙার কারণে সরকার বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং আন্দোলনকারীদের গরমে কষ্ট পাওয়া নিয়ে বিচলিত হলো। সিটি করপোরেশন থেকে যমুনার সামনে শীতল জলের স্প্রে করে তাদের কিঞ্চিৎ আরাম দেওয়ার চেষ্টা করা হলো। এর মাধ্যমে সরকার দুটি মেসেজ দিল—

এক. এই সরকারের কাছেও নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো দাবি জানালেই তা আদায় হবে, এমন আশা করা যায় না। বিএনপি চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে গণহত্যার জন্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছিল, আর এনসিপিসহ অনেক দল মাঠে-ময়দানে থেকেও ফ্যাসিবাদী দলটিকে নিষিদ্ধের জোরালো দাবি জানিয়ে আসছিল। সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। পরে যমুনার সামনে গিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে সরকারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগের পর সরকার দাবি মেনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। তার ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধনও বাতিল করে। এর অর্থ দাঁড়ায়, ন্যায়সংগত দাবির ক্ষেত্রেও রাস্তায় নেমে চাপ প্রয়োগ করে সরকারকে বাধ্য না করা পর্যন্ত সরকার ওই দাবি মেনে নেয় না।

দুই. যমুনার সামনের ১৪৪ ধারাটি সম্ভবত গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের অংশীজনদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

এই দুটি কারণ মাথায় রেখেই হয়তো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের অত্যন্ত ন্যায়সংগত দাবি নিয়ে যমুনার সামনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচিতে সিটি করপোরেশনের ঠান্ডা পানির পরিবর্তে সপাং সপাং ছুটে আসে পুলিশের লাঠি ও টিয়ারশেল। এতে অনেকেই হতভম্ব হয়ে যান। কারণ এই কর্মসূচিতে স্বয়ং ভিসি, শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দসহ শিক্ষক ও ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, এনসিপি-সহ গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের প্রায় সব স্টেকহোল্ডার সম্পৃক্ত ছিলেন। সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল একটা জিনিস না বুঝতে পেরে যে, যমুনার পানি কখন কেন লাঠি ও টিয়ার গ্যাস হয়ে যায়! এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

পুলিশি হামলায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকসহ অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। তাদের মধ্যে অনেককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া এসব শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, কয়েক দিন আগেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনা ঘেরাও করা হয়েছিল, যেখানে পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি; বরং গরমে বিক্ষোভকারীদের স্বস্তি দিতে ঠান্ডা পানি স্প্রে করা হয়েছিল। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ করা হয়েছে, যা বৈষম্যমূলক আচরণ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র-সংক্রান্ত বিষয়েও সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নগরভবন কার্যত অচল। সেখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও অফিসে যেতে পারছেন না। কারণ আদালতের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরও বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ নিতে দেওয়া হয়নি। তিনি অভিযোগ করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু ব্যক্তি ক্ষমতার লোভে পক্ষপাতিত্ব করছেন। ঢাকায় বিএনপির মেয়রের শপথের বিরুদ্ধে সরকার সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করছে, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকারের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করে।

আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিএনপি নেতা ডা. সাহাদত হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার নজির বিদ্যমান। তিনি এরই মধ্যে তার দায়িত্ব পালন করে বেশ সুখ্যাতিও পেয়েছেন। তার ওপর সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নিয়োগ দেওয়া প্রশাসক নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে আবার একজন উপদেষ্টা, যিনি কার্যত এনসিপির প্রতিনিধি, তিনি দক্ষিণের মেয়র নিয়ে যে অবস্থান নিলেন তাতে তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।

সরকারের এসব পক্ষপাতমূলক আচরণ নিয়ে যখন সমালোচনা তুঙ্গে, তখন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের একটি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে ‘আমাদের সবকিছু করার ম্যানডেট আছে’ বলে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাম গণতান্ত্রিক জোট, বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতার সীমা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা মনে করে, এই সরকারের মূল ম্যানডেট হলো নির্বাচন আয়োজন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে রাষ্ট্র সংস্কার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা না করেই চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে দেওয়া, রাখাইনে মানবিক করিডোর স্থাপন, কাতারের সঙ্গে সামরিক কারখানা স্থাপনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

প্রেস সচিব শফিকুল আলম এই সমালোচনার জবাবে অবশ্য বলেছেন, বর্তমান সরকার একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের ম্যানডেট শুধু নির্বাচন নয়, বরং ব্যাপক রাষ্ট্র সংস্কার। তিনি বাম দলগুলোর সমালোচনার জবাবে আরেক দফা ঘি ঢেলে বলেছেন, ‘বামদের দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড হলে বাংলাদেশে জব হবে না। বাংলাদেশকে তারা ডুয়ার্ফ (বামন) বানিয়ে রাখতে চান, বনসাই বানিয়ে রাখতে চান।’ শফিকুল আলমের এই বক্তব্যকে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেছেন।

শফিকুল আলম যে এখতিয়ারের কথা বলছেন, তা গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলো প্রত্যাহার করে নিলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে তা হয়তো তিনি মাথায় রেখে কথা বলেননি। তাদের সবাই ম্যানডেটদাতা, কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডারও সব পক্ষই। তাদের কারো সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বা কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলা তার জন্য যে সংগত নয়, এটা নিশ্চয়ই তিনি বোঝেন।

সাম্প্রতিককালে সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ ও বক্তব্য স্পষ্ট করে, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কোনো পক্ষের অতি নৈকট্য, আবার কোনো কোনো পক্ষের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের ক্ষমতার সীমা এবং তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে মতবিরোধ বাড়ছে। সরকার একদিকে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সবকিছু করতে পারার ম্যানডেট আছে বলে দাবি করছে, অন্যদিকে অনেক রাজনৈতিক দল মনে করছে, এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেওয়া উচিত।

অন্তর্বর্তী সরকার ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে দূরত্ব যত বাড়বে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ অর্জনের স্বপ্ন ততটাই ফিকে হয়ে আসবে।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত