সীমান্তে কাস্তে হাতে কৃষকের বার্তা

মেজর (অব.) নাসিম হোসেন
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ০৯
আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪: ০২

একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীর পাশে হাতে কাস্তে ধরা, মুখে বিড়ি, মাথায় গামছা পেঁচানো লুঙ্গি-গেঞ্জিতে আবৃত চিরায়ত বাংলার কৃষকের অবস্থান।

সীমান্তরক্ষী আর কৃষকের দৃষ্টি নিবদ্ধ কাঁটাতারের দিকে। সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে আছে গ্রামের শত শত বাসিন্দা। তারা সীমান্তরক্ষীদের যেকোনো সহায়তাদানের আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করছেন।

বিজ্ঞাপন

টাইম মেশিনে চড়ে কেউ ১৯৭১ সালে চলে গেলে এমন ছবির দেখা পাবেন। একটা প্রকৃত জনযুদ্ধের ছবি।

আমি সীমান্তে কাঁটাতার দেওয়ার বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক আইনানুসারে মীমাংসা হোকÑএই দৃঢ় প্রত্যাশা রেখে নিচের আলোচনাটি করছি।

প্রথমত. ভারত আমাদের ঘনিষ্ঠ নিকটবর্তী প্রতিবেশী। তার সঙ্গে আমার দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কটি ঐতিহাসিক এবং বাস্তবসম্মত। এটাকে মর্যাদার সঙ্গে ধরে রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত. ভারত বা যেকোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কে আপনার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তি অন্যতম নির্ধারক। নিজের আপন ভাইও তার দুর্বল ভাইকে ঠকায়। আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো আবেগ কাজ করে না। এক শ ভাগ নিখাদ পারস্পরিক স্বার্থই শেষ কথা।

আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকব ‘মহাভারত-বাইবেলের এমন কথাও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চলে না। ৫৩ বছর ধরে শুনে আসছি ভারতের ১৯৭১ সালের ঋণ কোনোকালেই শোধ হওয়ার নয়’Ñএমন এক বাইবেলীয় বয়ান। গত ১৬ বছরে ৬০০-এর বেশি বাংলাদেশির রক্ত ঝরেছে, তবুও কি হয়নি ঋণের কোনো কিস্তির পরিশোধ?

৯ মাসের যুদ্ধ, যা একটি অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে উদ্ভূত, তাতে ভারতের অংশগ্রহণ আঞ্চলিক বা পড়শি রাজনীতির অংশ ছিল ভারতের জন্য। যেকোনো দেশ তার পড়শি দেশে আধিপত্য বিস্তার, নিজ ভাষা বা ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীকে বাঁচাতে হস্তক্ষেপ করে। এখন যেমন রাশিয়া করছে ইউক্রেনে। কিন্তু ঋণের তো একটা সীমা থাকা উচিত। আর কতকাল শুনতে হবেÑ ‘তোমাদের এই ঋণ শোধ হবে না, না না শোধ হবে না’!

ভিয়েতনামের যুদ্ধে চায়না ২০ বছর অবিরাম অস্ত্র-গোলাবারুদ-নিজ সৈনিক-কূটনীতিক-অর্থ সাহায্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল মার্কিন বাহিনীকে পরাজিত করেছে। সেই ভিয়েতনামই কি না চায়নার সঙ্গে ১৯৭৯ সালে কয়েক সপ্তাহের এক খণ্ডকালীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভিয়েতনাম তার সীমান্তে চায়নার আগ্রাসনকে রুখে দেয়। যদিও চায়না এটাকে যুদ্ধ বলে না। দীর্ঘদিনের কমিউনিস্ট বন্ধু ভিয়েতনামের সঙ্গে এই সংঘর্ষকে ‘কেউ বেঈমানি’ বলে না। আজ যিনি বন্ধু, কাল শত্রু হতেই পারেন।

আমি দেখেছি, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটাকে আমাদের দিক থেকেই বেশি অনানুষ্ঠানিক বা ব্যক্তিপর্যায়ে নিয়ে এসেছি। সে জন্য আওয়ামী লীগের দায় অনেক বেশি। কূটনৈতিক কাঠামোর মধ্যে একটা মর্যাদাবোধ আছে, থাকতে হয়। ভারতে শেখ হাসিনার সফরগুলো কূটনৈতিক সদাচারের বাইরে ব্যক্তি সম্পর্কের ফ্রেমটা বেশি প্রশস্ত করতে গত ১৫ বছরের নিরন্তর প্রচেষ্টা ছিল, যা আমাদের মর্যাদাকে খাটো করেছে।

এমনও ঘটেছে, শেখ হাসিনা প্রণব মুখার্জিকে কদমবুসি করেছেন বলে শোনা যায়, যা দুর্বলতা প্রমাণ করে। মোদিরও একই স্টাইল : চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে এক দোলনায় দুলতে দুলতে ডাবের পানি পান করিয়েছিলেন মোদি। তার কদিন বাদেই লাদাখের শীতল জলে ভেসে যায় ২০ ভারতীয় জোয়ানের দেহ। আসলে সামরিক শক্তি সমপর্যায়ে না থাকলে কেউ কাউকে সম্মান দেখায় না।

হাসিনা সফরের চিত্রের বিপরীতে ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালের জিয়ার দিল্লি সফরের ছবিগুলো দেখুন। স্বয়ং মোরাজি দেশাই, ইন্দিরা গান্ধী, প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডিসহ তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে এসেছিলেন, যিনি কি না তোফায়েল আহমেদের ভাষায় ‘৪০০ টাকার মেজর’।

একটা দেশ আরেকটি দেশ থেকে তার মর্যাদা সমতার ভিত্তিতে আদায় করে নেয়। রাষ্ট্র যত ক্ষুদ্র হোক, আপনার মর্যাদা আপনাকে আদায় করে নিতেই হবে।

ভারতের সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রপর্যায়ের সম্পর্ক খুবই প্রেসনোটভিত্তিক কাগুজে। যাই থাকুক তা সাউথ ব্লকের কর্মকর্তা এবং সীমান্তের কাঁটাতার পর্যন্ত পৌঁছায় না। সীমান্তরক্ষী বিএসএফের সঙ্গে যতই মিষ্টি বিতরণ করি না কেন, কাঁটাতারে ফেলানীদের ঝুলন্ত লাশের প্রদর্শনী চলতেই থাকবে।

গত ১৫ বছরে দেখেছি প্রত্যেকটা বিজিবি-বিএসএফের ডিজিপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ডিজিদের মিউমিউ করতে। তারা সীমান্তে গুলি খাওয়ার জন্য ইনিয়ে-বিনিয়ে আমাদের জনগণকেই দায়ী করেছেন। আমরাই নাকি গরু আনতে সেখানে যাই। আমাদেরই দোষ। গত পনেরো বছরে একটা মেরুদণ্ডওয়ালা ডিজিকে দেখিনি আজকের সেই কর্নেলের মতো ‘আঙুল উঁচিয়ে’ কথা বলতে। তারা আলোচনার টেবিলে বসার আগেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ওপেনারের মতো শুরুতেই ওয়াশ আউট বা হাঁসের ডিম মেরে প্যাভিলিয়নে ফেরত আসতেন।

কোনো দেশের নেতৃত্ব তার দেশকে যদি এত নিচে নামিয়ে আনে, তবে তার ৫০ বছরের ঋণ কীভাবে শোধ হবে। ৫০০ বছর ধরে শোধ করলেও তো তা শোধ হবে না। আসলে ভারত জানে এ দেশের নেতারা খুব সহজলভ্য।

১৯৭১ সালে ওরা আমাদের কী দিয়েছে, তা ওদের কোনো বক্তব্যে যত না শুনি, তার চেয়ে বেশি শুনি আমাদের আলগা মোমেনদের মুখে। আমাদের নেতারাই তাদের বক্তব্য শুরু করেন ১৯৭১ সাল থেকে। কিন্তু তিস্তার পানিসহ বাকি হিসাব নেওয়ার সাহস আর থাকে না।

ভারতের কাছে বাংলাদেশ বলতে পুঁচকে একটা দেশ। ওদের থেকে চাল কিনে খাইÑকিডনির চিকিৎসা-বিয়ের কেনাকাটা-লেখাপড়া করতে যাই। ওদের বিদ্যুৎ না হলে চলে না। আমরা হারিকেন জ্বালিয়ে চলব।

অমিত শাহর ভাষায় পোকামাকড় আমরা। আমাদের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে অমিত শাহর একটা ছবি সবাই দেখেছেন। এত নতজানু কাঁচুমাচু ভঙ্গি একমাত্র জমিদার আর তার রায়তের সঙ্গেই যায়।

ভারত তো বটেই, অনেক সুশীল বুদ্ধিজীবীও ভাবেন বাংলাদেশ একটা দুর্বল দেশ চারদিকে ভারতÑ

‘আমরা কি ওদের সঙ্গে পারব?’

ওদের মনে হলো আর ১৩ দিনে দখল করে নিল। আসলে আমাদের আমলা-বুদ্ধিজীবীদের বিরাট একটা অংশের মনোজগতে ভারত একটা ‘ভিম’ আমরা পুঁচকে ছোকরা। তাই ভারত হুংকার দিলেই আমরা ‘হেগে দিলুম আর কী’!!

এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের একটা সাক্ষাৎকার মনে করতে চাইÑ

কারগিল আক্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন ভারতীয় সাংবাদিক। কী মনে করে কেন কারগিলে আত্মঘাতী অভিযানে নিযুক্ত করেন তার সৈন্যদের।

তার বক্তব্য ছিল, ‘দেখুন একটা দেশ যখন যুদ্ধে লিপ্ত হয়, সে শুধু তার অস্ত্র কত আধুনিক, তার জেনারেল কত ভালো, তার রণকৌশল কত উন্নত, তার ওপরই নির্ভর করে না, নির্ভর করে তার উইল টু ফাইট তার উইল টু বাইট মানসিকতার ওপর। আমি মরব কিন্তু একটা মরণ কামড় আমি দেব। শত্রুকে এই মেসেজ দেওয়া। এই যে ডেটারেন্স বা ভীতিÑ এটাই শত্রুকে নিবৃত্ত করবে’।

কয়েক দিনে সীমান্তে কাস্তে হাতে কৃষক আর তার পাশে বিজিবির সৈনিককে দেখে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আমাদের দেশে আক্রমণকারীকে একটা প্রাণঘাতী জনযুদ্ধের মোকাবিলা করতে হবে। সে হিসাব কষে যেন শত্রুরা আসে, এই বার্তা সেই কাস্তে হাতের কৃষক দিচ্ছেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

এমবি

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত