ওয়াক্‌ফ বিল পাস

মুসলমানদের জমি দখলে নিতে হিন্দুত্ববাদী পরিকল্পনা

হেনা শিকদার
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১: ২৪

ভারতে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের অধীনে থাকা মুসলমানদের লাখ লাখ একর জমি, ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা সরকারের দখলে নিতে ‘ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) ২০২৫’ বিলটি ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে (লোকসভা ও রাজ্যসভা) পাস হয়েছে। বিলটি পাস হওয়ার আগে পার্লামেন্টে তীব্র বিতর্ক ও ভোটাভুটি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই সংশোধনীগুলোর উদ্দেশ্য হলো ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা মোকাবিলা করা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা। নরেন্দ্র মোদির সরকার আরো দাবি করেছে, এই সম্পত্তি থেকে অর্জিত রাজস্ব দরিদ্র ও মহিলাদের কল্যাণে ব্যবহার করা হবে এবং এটি একটি ‘মুসলিম-বান্ধব সংস্কার’। কিন্তু বিভিন্ন দলের মুসলিম এমপিরা ও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এই বিল পাসের তীব্র সমালোচনা করে এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সংশোধিত বিলের মূল বিধানগুলোর মধ্যে রয়েছে—ওয়াক্‌ফ বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করা; দীর্ঘদিনের ব্যবহারের (ওয়াক্‌ফ বাই ইউজার) ভিত্তিতে কোনো সম্পত্তিকে ওয়াক্‌ফ হিসেবে গণ্য করার প্রথার বিলোপ, তবে বিতর্কিত নয় এবং সরকারি মালিকানাধীন নয়, এমন সম্পত্তির ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিতর্কিত সম্পত্তির বিষয়ে জেলা কালেক্টর সিদ্ধান্ত নেবেন; ওয়াক্‌ফ হিসেবে চিহ্নিত যেকোনো সরকারি সম্পত্তি সেই মর্যাদা হারাবে; ওয়াক্‌ফ বোর্ডগুলোর অ্যাকাউন্ট নিবন্ধন ও নিরীক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম তৈরির ক্ষমতা; যারা পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করছেন কেবল তারাই ওয়াক্‌ফ দান করতে পারবেন এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করার অধিকারের প্রবর্তন। এ ছাড়া বিলটিতে মহিলা এবং শিয়া, পশমান্দা ও বোহরা সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য ওয়াক্‌ফ বোর্ডে আসন সংরক্ষণের বিধান রয়েছে।

তবে বিরোধী দল ও মুসলিম সংগঠনগুলো এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করেছে। তারা এটিকে মুসলিমবিরোধী, অসাংবিধানিক ও মুসলিমদের জমি দখলের জন্য বিজেপির একটি কৌশল বলে অভিহিত করেছে। তাদের আশঙ্কা, ‘ওয়াক্‌ফ বাই ইউজার’-এর বিলোপ এবং সরকারি সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিধানের মাধ্যমে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত না হওয়া সম্পত্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। বিরোধী দলগুলো সম্পত্তি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে জেলা কালেক্টরের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

ওয়াক্‌ফ বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করা হয়েছে, কারণ এটি বৈষম্যমূলক এবং ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। মুসলিম সংগঠনগুলো মনে করে, এই সংশোধনের আসল উদ্দেশ্য হলো বিজেপি সমর্থকদের কমিটি ও বোর্ডগুলোয় অন্তর্ভুক্ত করে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনায় সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করা। ‘ইসলাম পালনকারী মুসলিম’-এর সংজ্ঞা এবং এর অপব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি তার হিন্দুত্ববাদী ভোটব্যাংককে তুষ্ট করার জন্য এই বিলটি এনেছে।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এই বিলটিকে বৈষম্যমূলক এবং মুসলিম নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রধান বিরাধী দল কংগ্রেস পার্টি ঘোষণা করেছে, তারা সুপ্রিম কোর্টে এই বিলের সাংবিধানিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। সরকারের ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির দাবির বিপরীতে ওয়াক্‌ফ সংশোধনী বিল চরম বিতর্কিত। বিরোধী দল ও মুসলিম সংগঠনগুলো এটিকে তাদের সম্পত্তির অধিকার ও ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের ওপর সরাসরি আক্রমণ হিসেবে দেখছে, যা বিদ্যমান উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের উজ্জয়িনী শহরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ প্রায় ২৫০টি বাড়িঘর, দোকান ও শতাব্দী প্রাচীন একটি মসজিদ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে ২ দশমিক ১ হেক্টর (৫ দশমিক ২৭ একর) বিস্তৃত জমি খালি করা হয়, যা মধ্যপ্রদেশ ওয়াক্‌ফ বোর্ডের মালিকানাধীন ছিল। এই গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিষয়কে শহরের বিখ্যাত মহাকালেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে এক বিলিয়ন ডলারের একটি সরকারি প্রকল্পের অংশ হিসেবে চালানো হয়েছিল।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুনে উজ্জয়িনীর এক রাজস্ব কর্মকর্তা এই ওয়াক্‌ফ জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তিনি ১৯৮৫ সালের গেজেট বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, এটি ওয়াক্‌ফ জমি এবং রাজ্য ওয়াক্‌ফ বোর্ডের কাছ থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ নেওয়া উচিত। তবে এক মাস পর উজ্জয়িনী জেলা প্রশাসন আদেশ জারি করে জানায়, ‘সামাজিক কারণে’ জমি অধিগ্রহণে অনুমতির প্রয়োজন নেই। এই অধিগ্রহণকে ওয়াক্‌ফ আইনের সরাসরি লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন আইনজীবী সোহেল খান, যিনি এ ঘটনাকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছেন। যদিও সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩৩০ মিলিয়ন রুপি (৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার) দিয়েছে, তবে শহরের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, কেন ওয়াক্‌ফ বোর্ড এই অর্থ দাবি করেনি। মধ্যপ্রদেশ ওয়াক্‌ফ বোর্ডের চেয়ারম্যান, যিনি উজ্জয়িনীর একজন বিজেপি নেতা, তিনি বলেছেন দলের আদেশ মেনে চলবেন।

ভারতে ২০ কোটিরও বেশি মুসলিমের আবাসস্থলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ওয়াক্‌ফ সম্পদ রয়েছে ৮ লাখ ৭২ হাজার একরের বেশি সম্পত্তি, প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার হেক্টর (১০ লাখ একর) জুড়ে বিস্তৃত, যার আনুমানিক মূল্য প্রয় ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ‘ওয়াক্‌ফ’ হলো মুসলমানদের ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে দান করা সম্পত্তি, যা বিক্রি বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। প্রতিটি রাজ্য ও ফেডারেল অঞ্চলে ওয়াক্‌ফ বোর্ড এসব সম্পত্তি পরিচালনা করে, যা দেশটির অন্যতম বৃহৎ ভূ-সম্পত্তির মালিক।

বছরের পর বছর ধরে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে ওয়াক্‌ফ জমির প্লট বিক্রি করেছে। জমি রেকর্ড ডিজিটাইজেশনের সময় মাঝে মাঝে ওয়াক্‌ফ জমি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু-বিষয়ক মন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৫৪ হাজার ৯২৯টি ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। উজ্জয়িনীর ঘটনা স্থানীয় উন্নয়নের অজুহাতে ঘটানো হলেও ভারতে মুসলিমদের মালিকানাধীন ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির ওপর দখলের বৃহত্তর চিত্রের অংশ। এই সম্পত্তিগুলোর বিশাল পরিমাণ ও মূল্য বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাছে লোভনীয় লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে।

লেখক : শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত