খানের আখ্যান

মারুফ কামাল খান

সেই বালকবেলায় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রত্যুষে ফুল হাতে নগ্নপায়ে ভাষাশহীদদের উদ্দেশে নিবেদিত কোরাস গানে গলা মিলিয়ে প্রভাতফেরিতে শামিল হওয়ার মধ্য দিয়ে কবে যে আমার মনোজগতে রাজনৈতিক চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিল, তার ঠিকুজি জানা নেই। কিশোর বয়সের সেই আবেগঘেরা আনুষ্ঠানিকতাই হয়তো এক ধরনের কর্তব্যের তাড়না ও আদর্শবাদের দিকে চালিত করেছিল। পাঠের বাইরের কার্যক্রম হিসেবে নাম লিখিয়েছিলাম ছাত্র রাজনীতির খাতায়। এরপর দ্রুতলয়ে আমাদের জীবনে এলো ১৯৬৯-এর সেই ঝড়ো দিনগুলো। সেই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান আমাকে ঝাঁজালো মিছিলে শরিক করল। আমিও উচ্চকিত স্লোগান, উত্তোলিত বজ্রমুঠি ও দীপ্ত পদচারণে নামোল্লেখহীন ইতিহাসের অংশীদার হলাম।
ছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের নিরীহ-নির্বিবাদী জ্যেষ্ঠ সন্তান। লেখাপড়ায় ভালো। স্বজনদের উচ্চাশা ঘিরে ছিল আমাকে। কিন্তু রাজনীতির দুর্নিবার আকর্ষণ আমার জীবনের লক্ষ্য বদলে দিল। হলাম প্রতিবাদী। পরীক্ষার ফলাফলের চেয়ে সাংগঠনিক কৃতিত্ব বেশি কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠল। এভাবেই মাঝারি ফলাফলের মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হলো। যোগ দিলাম সাংবাদিকতায়। এ পেশায় এসে মনে হলো রাজনীতি আমার জন্য নয়। ভাবামাত্র সিদ্ধান্ত। রাজনীতিতে পাততাড়ি গুটিয়ে জীবনখাতার পাতা উল্টে শুরু করলাম নতুন অধ্যায়। অনেক পরে বুঝতে পারি, রাজনীতিতে যোগ দেওয়াটা আমার যেমন ভুল হয়েছিল, তার চেয়ে বড় ভুল হয়েছে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া। কারণ একসময়ের তল্পিবাহক পর্যায়ের লোকদের এখন আমার মাথার ওপর ছড়ি ঘোরানো বরদাশত করতে হয়।
আমার এই আত্মকাহিনি শুধু আমার নয়, এদেশে মেধা ও মনীষা নিয়ে রাজনীতিতে এসে আদর্শবাদিতা লালন করতে গিয়ে ড্রপআউট হয়ে যাওয়া প্রতিটি এক্স পলিটিশিয়ানের। এই ধারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞাহীন এক ধান্ধাবাজতন্ত্রে অধঃপতিত করেছে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক মহামতি প্লেটোর একটা বিখ্যাত উক্তি আছে। তার কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ থেকে উৎকলিত সে উক্তিটি হলোÑ‘One of the penalties of refusing to participate in politics is that you end up being governed by your inferiors.’ মানে, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আপনার অনীহার অন্যতম শাস্তি হচ্ছে, আপনার তুলনায় নিকৃষ্ট লোকদের দ্বারা আপনি শাসিত হবেন। এখন সেটাই হচ্ছে এবং এটাই আমাদের বিধিলিপি।
দলীয় রাজনীতিতে সরাসরি তৎপরতা থেকে বিযুক্ত হলেও রাজনীতি কিন্তু আমাকে পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি। ব্যাপারটা অনেকটা কম্বল ও ভালুকের গল্পের মতো। নদীতে বান ডেকেছে। দুই বন্ধু নদীতীরে দাঁড়ানো। তাদের একজন ছিল পাকা সাঁতারু। দেখা গেল নদীতে কালোপানা কিছু একটা ভেসে যাচ্ছে। অনেক ঠাহর করে দুই বন্ধু ভাবল ওটা কম্বল। সেই কম্বল ধরতে সাঁতারু বন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। সাঁতরে সে দ্রুত পৌঁছে গেল ভাসমান সেই কম্বলসদৃশ বস্তুর কাছে। থাবা মেরে ধরল সেটি। সঙ্গে সঙ্গে সেই কম্বলের ভেতর থেকে কেউ তার ঠ্যাং কামড়ে ধরল। মহাবিপদ! সাঁতারু বন্ধু দ্রুত কম্বল ছেড়ে রত হলো আত্মরক্ষার চেষ্টায়। কিন্তু কিছুতেই ঠ্যাং ছাড়াতে পারছিল না। আসলে কম্বল নয়, ওটা ছিল একটা ভালুক। সাঁতারু আর ভালুকের টানাটানিতে তারা একবার ভাসে আর ডোবে। এ দৃশ্য দেখে ডাঙার বন্ধু চিৎকার করে বললÑ‘কম্বল ছেড়ে দিয়ে চলে আয় তুই।’ নদী থেকে বন্ধুটি অসহায় আর্তনাদ করে বললÑ‘আমি তো সেই কখন কম্বল ছেড়েছি, কিন্তু কম্বল তো আমাকে ছাড়ছে না।’
আমাকেও কিন্তু কম্বল ছাড়েনি। খুব রাজনীতি-ঘনিষ্ঠ পেশা সাংবাদিকতা। এই পেশায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজনীতির সংলগ্নতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা যায়নি। দলীয় রাজনীতি ছাড়লেও মাথায় আদর্শগত বিশ্বাস কিলবিল করত। এভাবেই চারপাশের বিরাজমান বাস্তবতার আলোকে নিজের অগোচরেই কোনো দলের প্রতি বিরাগ এবং কোনো দলের প্রতি নৈকট্য অনুভব করি। মন্দের ভালো বলে পক্ষপাত জন্মায় বিশেষ দলের প্রতি। এই বোধ এক ধরনের রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে আমাকে প্ররোচিত করে। দায়িত্ব পালনের সেই অধ্যায় আমি অতিক্রম করে এসেছি। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া একজন রুগ্ণ মানুষ হিসেবে তবুও এই ভাবনা আমাকে তাড়িত করে যে, রাজনীতি যদি সঠিক ও সুন্দর না হয়, তাহলে তো আমাদের দেশ-জাতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কারণ এই আধুনিককালে রাজনীতিই আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি দিক-দিগন্তকে প্রভাবিত করে।
শুধুই কি রাজনীতি? এই যে আমাদের মিডিয়া ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গনÑকী দশা সেখানকার? আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো চিত্র নেই। অনেক কিছু ছেড়েছুড়ে, অনেক লোভনীয় হাতছানি এড়িয়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। এই পেশাকে কত মহৎ কল্পনায় সাজিয়েছি। শুধু পেশা ভাবিনি, একটি ব্রত এবং একটি মিশন হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম সাংবাদিকতাকে। প্রবল উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠায় ভরা কত বিনিদ্র রাত জেগে আয়ু খরচ করে করে কাজ করেছি। মতভেদ হলে, মাথা নোয়াবার পরিস্থিতি এলে অবলীলায় চাকরি ছেড়ে অনিশ্চয়তা ও দুঃখ-কষ্টে ভরা বেকারত্বকে বেছে নিয়েছি। আদর্শ ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে কত অনাহার, পয়সার অভাবে হেঁটে চলা এবং আরো কত ক্লিষ্টতার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। কারো কাছে কখনো হাত পাতিনি, কৃপা ভিক্ষা করিনি কারুর। কিন্তু আমাদের মতো মুষ্টিমেয় সংবাদকর্মীর ত্যাগ তো এই পেশার মহিমা ধরে রাখতে পারেনি। বরং লোভ, লালসা, দুর্বৃত্তায়ন ও ভাড়া খেটে আখের গোছানোর নষ্ট প্রবৃত্তি আদর্শের সিংহদুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী রেজিমের পতনের পর যখন সাংবাদিক নামধারীদের বিত্ত-বেসাতের চিত্র উন্মোচিত হয়, তখন লজ্জায় ও ঘৃণায় অধোবদন হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। মুখোশ হিসেবে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে এরা সীমাহীন দুর্বৃত্তপনায় লিপ্ত ছিল। এখন আবার সেই পরিচয়কে ঢাল হিসেবে কাজে লাগিয়ে ওরা বিচার ও শাস্তি এড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে চাইছে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার পেছনে যতটা ত্যাগ স্বীকার করেছি, যতটা শ্রম ও মেধা বিনিয়োজিত করেছি, তার ‘সকলি গরল ভেল’ হয়েছে। জীবনটা বুঝি ষোলো আনাই বৃথা হয়েছে আমার।
এদেশ অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে, জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহে-বিপ্লবে ফুঁসে ওঠে। ‘উনসত্তরে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান বিজয়ী হয়। সেই অভ্যুত্থানের সফল নায়ক ছাত্রনেতারা খলিফা সেজে গড়ে তোলে দুর্বৃত্তপনার এক নষ্ট বলয়। এই গণঅভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অচিরেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ম্লান হয়ে যায়।’ নব্বইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের নেতারাও সম্পদ ও প্রতিপত্তি অর্জনের উদগ্র বাসনায় মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের স্পৃহাকে নষ্ট করে দেয়। এই নিস্পৃহতা এদেশে হাসিনার ফ্যাসিবাদী রেজিম প্রলম্বিত হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু অবশেষে সব ধারণা ও ছক ভেঙে চুরমার করে ছাত্র-জনতার এক মহাজাগৃতি ঘটে যায়। উড়ে যায় ফ্যাসিবাদের তখতে তাউস।
আশা ছিল, এই পরিবর্তন শুধু ব্যক্তি বা দলের পরিবর্তন হবে না। ব্যবস্থা, পদ্ধতি ও রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন হবে। রাজনীতি হবে শুদ্ধ ও মানবিক। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি? কেন এমন হলো? কার দোষে? কেউ দায় নেয় না। সবাই পারস্পরিক দোষারোপ করে পুরোনো ব্যবস্থাই টিকিয়ে রাখছে এবং সেই নষ্ট ব্যবস্থার আবর্তে প্রায় সবাই লুঠতরাজ, দখল, চাঁদাবাজি, অন্যায় ও দুর্বৃত্তপনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। অতএব, পরিবর্তনের ও ভালো কিছুর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। এই অতৃপ্তি থেকে মাঝেমধ্যেই নানা উপপ্লবের সৃষ্টি হবে কিন্তু সহসা আর কোনো পরিবর্তনের ঝঞ্ঝা বা বিপ্লব আসবে না। এই চক্রব্যূহের মধ্যেই আমাদের জীবন কেটে যাবে। এখন অতি সংকীর্ণ ও সীমিত প্রত্যাশা, ভালোয় ভালোয় একটা নির্বাচন হোক। একটি রাজনৈতিক সরকার আসুক এবং তাদের অনিবার্য ব্যর্থতা আসতে যেন একটু সময় লাগে। প্রার্থনা করি, আমাদের জীবনে তো কিছু হলো না, আমাদের পরের প্রজন্ম যেন সত্যিকারের অর্থবহ পরিবর্তন আনতে পারে। আমাদের হতাশা ও ব্যর্থতার অধ্যায় মুছে দিয়ে তারা যেন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, ইমেইল : mrfshl@gmail.com.

সেই বালকবেলায় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রত্যুষে ফুল হাতে নগ্নপায়ে ভাষাশহীদদের উদ্দেশে নিবেদিত কোরাস গানে গলা মিলিয়ে প্রভাতফেরিতে শামিল হওয়ার মধ্য দিয়ে কবে যে আমার মনোজগতে রাজনৈতিক চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিল, তার ঠিকুজি জানা নেই। কিশোর বয়সের সেই আবেগঘেরা আনুষ্ঠানিকতাই হয়তো এক ধরনের কর্তব্যের তাড়না ও আদর্শবাদের দিকে চালিত করেছিল। পাঠের বাইরের কার্যক্রম হিসেবে নাম লিখিয়েছিলাম ছাত্র রাজনীতির খাতায়। এরপর দ্রুতলয়ে আমাদের জীবনে এলো ১৯৬৯-এর সেই ঝড়ো দিনগুলো। সেই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান আমাকে ঝাঁজালো মিছিলে শরিক করল। আমিও উচ্চকিত স্লোগান, উত্তোলিত বজ্রমুঠি ও দীপ্ত পদচারণে নামোল্লেখহীন ইতিহাসের অংশীদার হলাম।
ছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের নিরীহ-নির্বিবাদী জ্যেষ্ঠ সন্তান। লেখাপড়ায় ভালো। স্বজনদের উচ্চাশা ঘিরে ছিল আমাকে। কিন্তু রাজনীতির দুর্নিবার আকর্ষণ আমার জীবনের লক্ষ্য বদলে দিল। হলাম প্রতিবাদী। পরীক্ষার ফলাফলের চেয়ে সাংগঠনিক কৃতিত্ব বেশি কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠল। এভাবেই মাঝারি ফলাফলের মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হলো। যোগ দিলাম সাংবাদিকতায়। এ পেশায় এসে মনে হলো রাজনীতি আমার জন্য নয়। ভাবামাত্র সিদ্ধান্ত। রাজনীতিতে পাততাড়ি গুটিয়ে জীবনখাতার পাতা উল্টে শুরু করলাম নতুন অধ্যায়। অনেক পরে বুঝতে পারি, রাজনীতিতে যোগ দেওয়াটা আমার যেমন ভুল হয়েছিল, তার চেয়ে বড় ভুল হয়েছে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া। কারণ একসময়ের তল্পিবাহক পর্যায়ের লোকদের এখন আমার মাথার ওপর ছড়ি ঘোরানো বরদাশত করতে হয়।
আমার এই আত্মকাহিনি শুধু আমার নয়, এদেশে মেধা ও মনীষা নিয়ে রাজনীতিতে এসে আদর্শবাদিতা লালন করতে গিয়ে ড্রপআউট হয়ে যাওয়া প্রতিটি এক্স পলিটিশিয়ানের। এই ধারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞাহীন এক ধান্ধাবাজতন্ত্রে অধঃপতিত করেছে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক মহামতি প্লেটোর একটা বিখ্যাত উক্তি আছে। তার কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ থেকে উৎকলিত সে উক্তিটি হলোÑ‘One of the penalties of refusing to participate in politics is that you end up being governed by your inferiors.’ মানে, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আপনার অনীহার অন্যতম শাস্তি হচ্ছে, আপনার তুলনায় নিকৃষ্ট লোকদের দ্বারা আপনি শাসিত হবেন। এখন সেটাই হচ্ছে এবং এটাই আমাদের বিধিলিপি।
দলীয় রাজনীতিতে সরাসরি তৎপরতা থেকে বিযুক্ত হলেও রাজনীতি কিন্তু আমাকে পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি। ব্যাপারটা অনেকটা কম্বল ও ভালুকের গল্পের মতো। নদীতে বান ডেকেছে। দুই বন্ধু নদীতীরে দাঁড়ানো। তাদের একজন ছিল পাকা সাঁতারু। দেখা গেল নদীতে কালোপানা কিছু একটা ভেসে যাচ্ছে। অনেক ঠাহর করে দুই বন্ধু ভাবল ওটা কম্বল। সেই কম্বল ধরতে সাঁতারু বন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। সাঁতরে সে দ্রুত পৌঁছে গেল ভাসমান সেই কম্বলসদৃশ বস্তুর কাছে। থাবা মেরে ধরল সেটি। সঙ্গে সঙ্গে সেই কম্বলের ভেতর থেকে কেউ তার ঠ্যাং কামড়ে ধরল। মহাবিপদ! সাঁতারু বন্ধু দ্রুত কম্বল ছেড়ে রত হলো আত্মরক্ষার চেষ্টায়। কিন্তু কিছুতেই ঠ্যাং ছাড়াতে পারছিল না। আসলে কম্বল নয়, ওটা ছিল একটা ভালুক। সাঁতারু আর ভালুকের টানাটানিতে তারা একবার ভাসে আর ডোবে। এ দৃশ্য দেখে ডাঙার বন্ধু চিৎকার করে বললÑ‘কম্বল ছেড়ে দিয়ে চলে আয় তুই।’ নদী থেকে বন্ধুটি অসহায় আর্তনাদ করে বললÑ‘আমি তো সেই কখন কম্বল ছেড়েছি, কিন্তু কম্বল তো আমাকে ছাড়ছে না।’
আমাকেও কিন্তু কম্বল ছাড়েনি। খুব রাজনীতি-ঘনিষ্ঠ পেশা সাংবাদিকতা। এই পেশায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজনীতির সংলগ্নতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা যায়নি। দলীয় রাজনীতি ছাড়লেও মাথায় আদর্শগত বিশ্বাস কিলবিল করত। এভাবেই চারপাশের বিরাজমান বাস্তবতার আলোকে নিজের অগোচরেই কোনো দলের প্রতি বিরাগ এবং কোনো দলের প্রতি নৈকট্য অনুভব করি। মন্দের ভালো বলে পক্ষপাত জন্মায় বিশেষ দলের প্রতি। এই বোধ এক ধরনের রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে আমাকে প্ররোচিত করে। দায়িত্ব পালনের সেই অধ্যায় আমি অতিক্রম করে এসেছি। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া একজন রুগ্ণ মানুষ হিসেবে তবুও এই ভাবনা আমাকে তাড়িত করে যে, রাজনীতি যদি সঠিক ও সুন্দর না হয়, তাহলে তো আমাদের দেশ-জাতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কারণ এই আধুনিককালে রাজনীতিই আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি দিক-দিগন্তকে প্রভাবিত করে।
শুধুই কি রাজনীতি? এই যে আমাদের মিডিয়া ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গনÑকী দশা সেখানকার? আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো চিত্র নেই। অনেক কিছু ছেড়েছুড়ে, অনেক লোভনীয় হাতছানি এড়িয়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। এই পেশাকে কত মহৎ কল্পনায় সাজিয়েছি। শুধু পেশা ভাবিনি, একটি ব্রত এবং একটি মিশন হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম সাংবাদিকতাকে। প্রবল উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠায় ভরা কত বিনিদ্র রাত জেগে আয়ু খরচ করে করে কাজ করেছি। মতভেদ হলে, মাথা নোয়াবার পরিস্থিতি এলে অবলীলায় চাকরি ছেড়ে অনিশ্চয়তা ও দুঃখ-কষ্টে ভরা বেকারত্বকে বেছে নিয়েছি। আদর্শ ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে কত অনাহার, পয়সার অভাবে হেঁটে চলা এবং আরো কত ক্লিষ্টতার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। কারো কাছে কখনো হাত পাতিনি, কৃপা ভিক্ষা করিনি কারুর। কিন্তু আমাদের মতো মুষ্টিমেয় সংবাদকর্মীর ত্যাগ তো এই পেশার মহিমা ধরে রাখতে পারেনি। বরং লোভ, লালসা, দুর্বৃত্তায়ন ও ভাড়া খেটে আখের গোছানোর নষ্ট প্রবৃত্তি আদর্শের সিংহদুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী রেজিমের পতনের পর যখন সাংবাদিক নামধারীদের বিত্ত-বেসাতের চিত্র উন্মোচিত হয়, তখন লজ্জায় ও ঘৃণায় অধোবদন হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। মুখোশ হিসেবে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে এরা সীমাহীন দুর্বৃত্তপনায় লিপ্ত ছিল। এখন আবার সেই পরিচয়কে ঢাল হিসেবে কাজে লাগিয়ে ওরা বিচার ও শাস্তি এড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে চাইছে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার পেছনে যতটা ত্যাগ স্বীকার করেছি, যতটা শ্রম ও মেধা বিনিয়োজিত করেছি, তার ‘সকলি গরল ভেল’ হয়েছে। জীবনটা বুঝি ষোলো আনাই বৃথা হয়েছে আমার।
এদেশ অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে, জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহে-বিপ্লবে ফুঁসে ওঠে। ‘উনসত্তরে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান বিজয়ী হয়। সেই অভ্যুত্থানের সফল নায়ক ছাত্রনেতারা খলিফা সেজে গড়ে তোলে দুর্বৃত্তপনার এক নষ্ট বলয়। এই গণঅভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অচিরেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ম্লান হয়ে যায়।’ নব্বইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের নেতারাও সম্পদ ও প্রতিপত্তি অর্জনের উদগ্র বাসনায় মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের স্পৃহাকে নষ্ট করে দেয়। এই নিস্পৃহতা এদেশে হাসিনার ফ্যাসিবাদী রেজিম প্রলম্বিত হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু অবশেষে সব ধারণা ও ছক ভেঙে চুরমার করে ছাত্র-জনতার এক মহাজাগৃতি ঘটে যায়। উড়ে যায় ফ্যাসিবাদের তখতে তাউস।
আশা ছিল, এই পরিবর্তন শুধু ব্যক্তি বা দলের পরিবর্তন হবে না। ব্যবস্থা, পদ্ধতি ও রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন হবে। রাজনীতি হবে শুদ্ধ ও মানবিক। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি? কেন এমন হলো? কার দোষে? কেউ দায় নেয় না। সবাই পারস্পরিক দোষারোপ করে পুরোনো ব্যবস্থাই টিকিয়ে রাখছে এবং সেই নষ্ট ব্যবস্থার আবর্তে প্রায় সবাই লুঠতরাজ, দখল, চাঁদাবাজি, অন্যায় ও দুর্বৃত্তপনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। অতএব, পরিবর্তনের ও ভালো কিছুর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। এই অতৃপ্তি থেকে মাঝেমধ্যেই নানা উপপ্লবের সৃষ্টি হবে কিন্তু সহসা আর কোনো পরিবর্তনের ঝঞ্ঝা বা বিপ্লব আসবে না। এই চক্রব্যূহের মধ্যেই আমাদের জীবন কেটে যাবে। এখন অতি সংকীর্ণ ও সীমিত প্রত্যাশা, ভালোয় ভালোয় একটা নির্বাচন হোক। একটি রাজনৈতিক সরকার আসুক এবং তাদের অনিবার্য ব্যর্থতা আসতে যেন একটু সময় লাগে। প্রার্থনা করি, আমাদের জীবনে তো কিছু হলো না, আমাদের পরের প্রজন্ম যেন সত্যিকারের অর্থবহ পরিবর্তন আনতে পারে। আমাদের হতাশা ও ব্যর্থতার অধ্যায় মুছে দিয়ে তারা যেন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, ইমেইল : mrfshl@gmail.com.

এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৪ ঘণ্টা আগে
‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৪ ঘণ্টা আগে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৫ ঘণ্টা আগে
গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে