ব্রি. জে. (অব.) রোকন উদ্দিন
প্রতিটি জাতির ইতিহাস শুধু বিজয়ের কাহিনি দিয়ে নয়, বিশ্বাসঘাতকতার কালো অধ্যায় দিয়েও রচিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা সত্য। ত্যাগ, শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আমাদের প্রিয় সশস্ত্র বাহিনী ছিল যুদ্ধের ঢাল, শান্তির প্রতীক ও জাতির গৌরব। অথচ কিছু কুলাঙ্গার কর্মকর্তা ক্ষমতার নেশায় অন্ধ হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে নিজেদের শপথ ভেঙেছে, পোশাকের সম্মান কলুষিত করেছে এবং যাদের রক্ষার শপথ নিয়েছিল, সেই জনগণের বিরুদ্ধেই অপরাধ করেছে।
ফ্যাসিবাদের সেই দীর্ঘ অন্ধকার যুগে সংঘটিত এসব কর্মকাণ্ড কোনো সাধারণ অপরাধ ছিল না; এগুলো ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপরাধ এবং জাতির সামনে সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করার মতো অপরাধ। অনেক দিন ধরে এসব অপরাধী অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে; কেউ কেউ এমন ভান করছে যেন সময়ই তাদের অপরাধ ধুয়ে-মুছে ফেলেছে। দীর্ঘদিন ধরে আমরা অজুহাত, অর্ধেক-অপূর্ণ বিচার আর আপসের নামে তাদের রক্ষা করে এসেছি; কিন্তু আর নয়। Enough is enough! অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই হবে, আর তা হতে হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC)।
অনেকে বলবেন, ‘আমরা চাইলে সাধারণ বা সামরিক আদালতে বিচার করতে পারি।’ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। দেশে ন্যায়বিচার বহুবার রাজনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতাশালী মহলের চাপ এবং নানা আইনি ফাঁকফোকরে জড়িয়ে গেছে। আর আমাদের দেশের সামরিক আইনে এ ধরনের অপরাধগুলো বিচারের কোনো ধারা নেই বা এখতিয়ারভুক্ত নয়। যেখানে ন্যায়বিচার হয় নির্বাচিতভাবে, দেরিতে বা প্রভাবিত হয়ে—সেটা আর ন্যায়বিচার থাকে না।
ফ্যাসিবাদের সময় সংঘটিত অপরাধগুলো ছিল আন্তর্জাতিক মাত্রার অপরাধ। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, সুসংগঠিত ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জাতীয় সম্মান ধ্বংস করার মতো অপরাধ। এগুলোই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। তাই এসব বিচার কেবল দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক আদালতে হওয়া উচিত, যেখানে সবার সামনে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট হবে। আইসিসিতে বিচার হলে আর কেউ বলতে পারবে না যে এসব বিচার পক্ষপাতদুষ্ট বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তখন স্পষ্ট হবে, বাংলাদেশ প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার চায়; প্রতিহিংসা নয়, সত্য প্রতিষ্ঠা চায়। এতে বিশ্বমঞ্চে আমাদের নৈতিক অবস্থান দৃঢ় হবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনী ঘরে-বাইরে সম্মান অর্জন করেছে পেশাদারত্ব, ত্যাগ আর সেবার মাধ্যমে। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষেত্র থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা প্রান্তে শান্তিরক্ষা মিশনে তারা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে গৌরবের সঙ্গে। কিন্তু কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক যখন নিজের ব্যক্তিস্বার্থে ইউনিফর্মের মর্যাদা কলুষিত করেছেন, তখন তারা শুধু দেশকেই নয়, সেই সব সৈনিকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। আমি একজন পেশাদার দেশপ্রেমিক সৈনিক হিসেবে নিজের জীবনের মুখ্য সময়টা দিয়েছি দেশের জন্য আর এই সেনাবাহিনীর সম্মানের জন্য। কাজেই আজ যখন দেখি, আমার সেই প্রিয় সেনাবাহিনী কিছু কুলাঙ্গারের অপকর্মের কারণে দেশব্যাপী বিতর্ক ও সমালোচনার শিকার, তখন আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। যেমনটি হয় আরো অনেক সেনাসদস্যের।
আমরা কীভাবে শহীদদের পরিবারের চোখের দিকে তাকাব, যদি অপরাধীরা এখনো মুক্ত থাকে? কীভাবে আগামী দিনের তরুণ অফিসারদের অনুপ্রাণিত করব, যদি অতীতের অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যায়? প্রকৃত সম্মান পুনরুদ্ধার হয় না নীরবতা বা অস্বীকারে, প্রকৃত সম্মান পুনরুদ্ধার হয় সাহসে—নিজেদের ব্যর্থতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহসে, নিজেদের ঘর পরিষ্কার করার সাহসে এবং বিশ্বকে দেখানোর সাহসে যে, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ন্যায়বিচারের প্রতীক, অপরাধ ঢাকার হাতিয়ার নয়। অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে আমরা স্পষ্ট বার্তা দেব—ইউনিফর্ম পবিত্র; এটি অপরাধের লাইসেন্স নয়, এটি বিশ্বাসঘাতকতার ঢাল নয়, এটি ফ্যাসিবাদের মুখোশ নয়।
প্রতিটি অশাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধ ভবিষ্যতের নতুন অপরাধকে আমন্ত্রণ জানায়। প্রতিটি অবহেলিত বিশ্বাসঘাতকতা পরবর্তী বিশ্বাসঘাতকতাকে উৎসাহিত করে। ফ্যাসিবাদের সেই দীর্ঘ বছরগুলো আমাদের শিখিয়েছে, যখন অপরাধ উপেক্ষা করা হয় ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ বা ‘প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার’ নামে, তখন সেগুলো মুছে যায় না; বরং ফিরে আসে আরো শক্তিশালী হয়ে, আরো ভয়ংকর হয়ে।
যারা এখনো মুক্ত, যারা এখনো মনে করে তারা প্রভাব, অর্থ কিংবা সম্পর্ক দিয়ে বিচার এড়িয়ে যাবে, তাদের জানিয়ে দিতে হবে—‘কোনো নিরাপদ আশ্রয় নেই। কোনো ফাঁকফোকর নেই। কোনো ঢাল নেই। দেরি হোক বা তাড়াতাড়ি, তোমাদের আইন ও ন্যায়বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। আর যেদিন সেই রায় আসবে, তাতে শুধু তোমাদের শাস্তিই হবে না; বরং ভবিষ্যতের সব বিশ্বাসঘাতকের জন্য তা হবে এক অমোঘ সতর্কবাণী।’
ন্যায়বিচার শুধু অপরাধীর শাস্তি নয়, ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা। আমাদের তরুণ অফিসাররা, প্রশিক্ষণরত ক্যাডেটরা, মাঠের সৈনিকরা—তাদের শেখাতে হবে, জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কোনোদিন সহ্য করা হবে না। তাদের জানতে হবে, সশস্ত্র বাহিনীর সম্মান কোনো ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে অনেক বড়।
যদি আজ আমরা ন্যায়বিচার না করি, তাহলে ভবিষ্যতে কীভাবে নিশ্চিত করব যে আর কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মকর্তা ব্যক্তিগত স্বার্থে একই পথে হাঁটবে না? কীভাবে নিশ্চিত করব যে আর কোনো চক্র সশস্ত্র বাহিনীকে আবার কলঙ্কের অন্ধকারে টেনে নেবে না? তাই আজকের বিচার শুধু অতীতের জন্য নয়, আগামীকালের সুরক্ষার জন্যও অপরিহার্য।
অজুহাতের সময় শেষ। দ্বিধার সময়ও শেষ। এখন প্রয়োজন শুধু একটাই—দৃঢ় পদক্ষেপ। জাতি যতদিন বিলম্ব করবে, ততদিন অপরাধীরা সময় পাবে নিজেদের রক্ষা করার, নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করার এবং আগামী প্রজন্মকে ভুল বার্তা দেওয়ার। তাই আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যারা সশস্ত্র বাহিনীর নামে অপরাধ করেছে, জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা আর কোনোভাবেই রক্ষা পাবে না। অপরাধীদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হতে হবে। কারণ এই অপরাধ শুধু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ। যখন একটি সেনাবাহিনী, জনগণের রক্ষক হিসেবে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান কিছু বিশ্বাসঘাতকের কারণে অপব্যবহৃত হয়, তখন সেই অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেই হওয়া উচিত। স্থানীয় আদালত বারবার প্রভাবিত হয়েছে, প্রমাণ নষ্ট হয়েছে, বিচার দীর্ঘসূত্রতায় বিলীন হয়েছে। আইসিসি হলো সেই একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে অপরাধীরা ফাঁকফোকর দিয়ে পালাতে পারবে না।
এটি শুধু কয়েকজন ব্যক্তির বিচারের প্রশ্ন নয়; এটি একটি নেটওয়ার্ক ধ্বংসের প্রশ্ন। যারা অপরাধ করেছে, তারা একা করেনি। তাদের পেছনে ছিল সুবিধাভোগী, সুযোগসন্ধানী, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, এমনকি কিছু বিদেশি মদতও। এই নেটওয়ার্ক উদ্ঘাটিত করতে হবে, কারণ শিকড় উপড়ে না ফেললে নতুন অপরাধীরা আবার মাথা তুলবে। তাই শুধু ব্যক্তির শাস্তি নয়, পুরো ষড়যন্ত্রের চক্র ভেঙে দিতে হবে। অনেকে বলবে, এটি প্রতিশোধ! না, এটি প্রতিশোধ নয়, এটি শুদ্ধি; জাতির শরীর থেকে পচা অংশ কেটে ফেলার মতোই অপরিহার্য এই প্রক্রিয়া। এটি প্রতিহিংসা নয়, বরং একটি প্রতিষ্ঠানের পুনর্জন্ম। যদি আমরা আজ এই শুদ্ধি না করি, তাহলে সশস্ত্র বাহিনীকে ভবিষ্যতে আরেকটি বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠীর হাতে সমর্পণ করার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারব না।
বাংলাদেশ আরেকটি বিশ্বাসঘাতকতার অধ্যায় বহন করতে পারবে না। স্বাধীনতার জন্য যারা রক্ত দিলেন, যারা দেশের সীমান্তে জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের আত্মত্যাগকে আরেকবার উপহাসে পরিণত হতে দেওয়া জাতির প্রতি সবচেয়ে বড় অন্যায় হবে। আমাদের সৈনিকরা নীরবে সব সহ্য করে। তারা শৃঙ্খলা মেনে চলে, ঊর্ধ্বতনদের প্রতি আনুগত্য দেখায়। কিন্তু তারা মানুষ, তাদেরও হৃদয় আছে। যখন তারা দেখে কিছু কুলাঙ্গার অপরাধ করে বেঁচে যায়, আর তারা নিজের জীবন দিয়ে দায়িত্ব পালন করে—তখন তাদের অন্তরে ক্ষোভ জমে ওঠে। সেই ক্ষোভ যদি ন্যায়বিচারের মাধ্যমে মুক্তি না পায়, তবে সেটি প্রতিষ্ঠানটির ভেতরেই বিষাক্ত প্রভাব ফেলবে।
এই বিচার একটি প্রতীক হবে। এটি জানিয়ে দেবে, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী কোনো ব্যক্তির হাতিয়ার নয়। এটি জাতির প্রতিষ্ঠান, জনগণের প্রতিষ্ঠান। যে কেউ এটিকে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য ব্যবহার করতে চাইবে, তাকে একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। অতএব অজুহাতের সময় শেষ, দ্বিধার সময় শেষ। এখন সময় দৃঢ় পদক্ষেপের। অপরাধীদের আইসিসিতে দাঁড় করাতে হবে, তাদের অপরাধ উন্মোচন করতে হবে, তাদের চক্র ধ্বংস করতে হবে এবং যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সশস্ত্র বাহিনী তার হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারবে, জনগণ আবার আস্থা ফিরে পাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝবে, ‘এই বাহিনী পবিত্র, এ বাহিনী অপরাধের ঢাল নয়।’ বিশ্বকে আমাদের বার্তা স্পষ্ট শোনাতে হবে—আর নয় আপস, আর নয় দেরি, আর নয় সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে খেলা। ন্যায়বিচার হবে। সৈনিকদের সম্মান পুনরুদ্ধার হবে। আর শিক্ষা হয়ে থাকবে চিরকাল—বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতির সম্পদ, কোনো বিশ্বাসঘাতকের উচ্চাকাঙ্ক্ষার হাতিয়ার নয়।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক
প্রতিটি জাতির ইতিহাস শুধু বিজয়ের কাহিনি দিয়ে নয়, বিশ্বাসঘাতকতার কালো অধ্যায় দিয়েও রচিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা সত্য। ত্যাগ, শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আমাদের প্রিয় সশস্ত্র বাহিনী ছিল যুদ্ধের ঢাল, শান্তির প্রতীক ও জাতির গৌরব। অথচ কিছু কুলাঙ্গার কর্মকর্তা ক্ষমতার নেশায় অন্ধ হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে নিজেদের শপথ ভেঙেছে, পোশাকের সম্মান কলুষিত করেছে এবং যাদের রক্ষার শপথ নিয়েছিল, সেই জনগণের বিরুদ্ধেই অপরাধ করেছে।
ফ্যাসিবাদের সেই দীর্ঘ অন্ধকার যুগে সংঘটিত এসব কর্মকাণ্ড কোনো সাধারণ অপরাধ ছিল না; এগুলো ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপরাধ এবং জাতির সামনে সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করার মতো অপরাধ। অনেক দিন ধরে এসব অপরাধী অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে; কেউ কেউ এমন ভান করছে যেন সময়ই তাদের অপরাধ ধুয়ে-মুছে ফেলেছে। দীর্ঘদিন ধরে আমরা অজুহাত, অর্ধেক-অপূর্ণ বিচার আর আপসের নামে তাদের রক্ষা করে এসেছি; কিন্তু আর নয়। Enough is enough! অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই হবে, আর তা হতে হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC)।
অনেকে বলবেন, ‘আমরা চাইলে সাধারণ বা সামরিক আদালতে বিচার করতে পারি।’ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। দেশে ন্যায়বিচার বহুবার রাজনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতাশালী মহলের চাপ এবং নানা আইনি ফাঁকফোকরে জড়িয়ে গেছে। আর আমাদের দেশের সামরিক আইনে এ ধরনের অপরাধগুলো বিচারের কোনো ধারা নেই বা এখতিয়ারভুক্ত নয়। যেখানে ন্যায়বিচার হয় নির্বাচিতভাবে, দেরিতে বা প্রভাবিত হয়ে—সেটা আর ন্যায়বিচার থাকে না।
ফ্যাসিবাদের সময় সংঘটিত অপরাধগুলো ছিল আন্তর্জাতিক মাত্রার অপরাধ। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, সুসংগঠিত ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জাতীয় সম্মান ধ্বংস করার মতো অপরাধ। এগুলোই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। তাই এসব বিচার কেবল দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক আদালতে হওয়া উচিত, যেখানে সবার সামনে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট হবে। আইসিসিতে বিচার হলে আর কেউ বলতে পারবে না যে এসব বিচার পক্ষপাতদুষ্ট বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তখন স্পষ্ট হবে, বাংলাদেশ প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার চায়; প্রতিহিংসা নয়, সত্য প্রতিষ্ঠা চায়। এতে বিশ্বমঞ্চে আমাদের নৈতিক অবস্থান দৃঢ় হবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনী ঘরে-বাইরে সম্মান অর্জন করেছে পেশাদারত্ব, ত্যাগ আর সেবার মাধ্যমে। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষেত্র থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা প্রান্তে শান্তিরক্ষা মিশনে তারা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে গৌরবের সঙ্গে। কিন্তু কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক যখন নিজের ব্যক্তিস্বার্থে ইউনিফর্মের মর্যাদা কলুষিত করেছেন, তখন তারা শুধু দেশকেই নয়, সেই সব সৈনিকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। আমি একজন পেশাদার দেশপ্রেমিক সৈনিক হিসেবে নিজের জীবনের মুখ্য সময়টা দিয়েছি দেশের জন্য আর এই সেনাবাহিনীর সম্মানের জন্য। কাজেই আজ যখন দেখি, আমার সেই প্রিয় সেনাবাহিনী কিছু কুলাঙ্গারের অপকর্মের কারণে দেশব্যাপী বিতর্ক ও সমালোচনার শিকার, তখন আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। যেমনটি হয় আরো অনেক সেনাসদস্যের।
আমরা কীভাবে শহীদদের পরিবারের চোখের দিকে তাকাব, যদি অপরাধীরা এখনো মুক্ত থাকে? কীভাবে আগামী দিনের তরুণ অফিসারদের অনুপ্রাণিত করব, যদি অতীতের অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যায়? প্রকৃত সম্মান পুনরুদ্ধার হয় না নীরবতা বা অস্বীকারে, প্রকৃত সম্মান পুনরুদ্ধার হয় সাহসে—নিজেদের ব্যর্থতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহসে, নিজেদের ঘর পরিষ্কার করার সাহসে এবং বিশ্বকে দেখানোর সাহসে যে, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ন্যায়বিচারের প্রতীক, অপরাধ ঢাকার হাতিয়ার নয়। অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে আমরা স্পষ্ট বার্তা দেব—ইউনিফর্ম পবিত্র; এটি অপরাধের লাইসেন্স নয়, এটি বিশ্বাসঘাতকতার ঢাল নয়, এটি ফ্যাসিবাদের মুখোশ নয়।
প্রতিটি অশাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধ ভবিষ্যতের নতুন অপরাধকে আমন্ত্রণ জানায়। প্রতিটি অবহেলিত বিশ্বাসঘাতকতা পরবর্তী বিশ্বাসঘাতকতাকে উৎসাহিত করে। ফ্যাসিবাদের সেই দীর্ঘ বছরগুলো আমাদের শিখিয়েছে, যখন অপরাধ উপেক্ষা করা হয় ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ বা ‘প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার’ নামে, তখন সেগুলো মুছে যায় না; বরং ফিরে আসে আরো শক্তিশালী হয়ে, আরো ভয়ংকর হয়ে।
যারা এখনো মুক্ত, যারা এখনো মনে করে তারা প্রভাব, অর্থ কিংবা সম্পর্ক দিয়ে বিচার এড়িয়ে যাবে, তাদের জানিয়ে দিতে হবে—‘কোনো নিরাপদ আশ্রয় নেই। কোনো ফাঁকফোকর নেই। কোনো ঢাল নেই। দেরি হোক বা তাড়াতাড়ি, তোমাদের আইন ও ন্যায়বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। আর যেদিন সেই রায় আসবে, তাতে শুধু তোমাদের শাস্তিই হবে না; বরং ভবিষ্যতের সব বিশ্বাসঘাতকের জন্য তা হবে এক অমোঘ সতর্কবাণী।’
ন্যায়বিচার শুধু অপরাধীর শাস্তি নয়, ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা। আমাদের তরুণ অফিসাররা, প্রশিক্ষণরত ক্যাডেটরা, মাঠের সৈনিকরা—তাদের শেখাতে হবে, জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কোনোদিন সহ্য করা হবে না। তাদের জানতে হবে, সশস্ত্র বাহিনীর সম্মান কোনো ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে অনেক বড়।
যদি আজ আমরা ন্যায়বিচার না করি, তাহলে ভবিষ্যতে কীভাবে নিশ্চিত করব যে আর কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মকর্তা ব্যক্তিগত স্বার্থে একই পথে হাঁটবে না? কীভাবে নিশ্চিত করব যে আর কোনো চক্র সশস্ত্র বাহিনীকে আবার কলঙ্কের অন্ধকারে টেনে নেবে না? তাই আজকের বিচার শুধু অতীতের জন্য নয়, আগামীকালের সুরক্ষার জন্যও অপরিহার্য।
অজুহাতের সময় শেষ। দ্বিধার সময়ও শেষ। এখন প্রয়োজন শুধু একটাই—দৃঢ় পদক্ষেপ। জাতি যতদিন বিলম্ব করবে, ততদিন অপরাধীরা সময় পাবে নিজেদের রক্ষা করার, নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করার এবং আগামী প্রজন্মকে ভুল বার্তা দেওয়ার। তাই আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যারা সশস্ত্র বাহিনীর নামে অপরাধ করেছে, জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা আর কোনোভাবেই রক্ষা পাবে না। অপরাধীদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হতে হবে। কারণ এই অপরাধ শুধু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ। যখন একটি সেনাবাহিনী, জনগণের রক্ষক হিসেবে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান কিছু বিশ্বাসঘাতকের কারণে অপব্যবহৃত হয়, তখন সেই অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেই হওয়া উচিত। স্থানীয় আদালত বারবার প্রভাবিত হয়েছে, প্রমাণ নষ্ট হয়েছে, বিচার দীর্ঘসূত্রতায় বিলীন হয়েছে। আইসিসি হলো সেই একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে অপরাধীরা ফাঁকফোকর দিয়ে পালাতে পারবে না।
এটি শুধু কয়েকজন ব্যক্তির বিচারের প্রশ্ন নয়; এটি একটি নেটওয়ার্ক ধ্বংসের প্রশ্ন। যারা অপরাধ করেছে, তারা একা করেনি। তাদের পেছনে ছিল সুবিধাভোগী, সুযোগসন্ধানী, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, এমনকি কিছু বিদেশি মদতও। এই নেটওয়ার্ক উদ্ঘাটিত করতে হবে, কারণ শিকড় উপড়ে না ফেললে নতুন অপরাধীরা আবার মাথা তুলবে। তাই শুধু ব্যক্তির শাস্তি নয়, পুরো ষড়যন্ত্রের চক্র ভেঙে দিতে হবে। অনেকে বলবে, এটি প্রতিশোধ! না, এটি প্রতিশোধ নয়, এটি শুদ্ধি; জাতির শরীর থেকে পচা অংশ কেটে ফেলার মতোই অপরিহার্য এই প্রক্রিয়া। এটি প্রতিহিংসা নয়, বরং একটি প্রতিষ্ঠানের পুনর্জন্ম। যদি আমরা আজ এই শুদ্ধি না করি, তাহলে সশস্ত্র বাহিনীকে ভবিষ্যতে আরেকটি বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠীর হাতে সমর্পণ করার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারব না।
বাংলাদেশ আরেকটি বিশ্বাসঘাতকতার অধ্যায় বহন করতে পারবে না। স্বাধীনতার জন্য যারা রক্ত দিলেন, যারা দেশের সীমান্তে জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের আত্মত্যাগকে আরেকবার উপহাসে পরিণত হতে দেওয়া জাতির প্রতি সবচেয়ে বড় অন্যায় হবে। আমাদের সৈনিকরা নীরবে সব সহ্য করে। তারা শৃঙ্খলা মেনে চলে, ঊর্ধ্বতনদের প্রতি আনুগত্য দেখায়। কিন্তু তারা মানুষ, তাদেরও হৃদয় আছে। যখন তারা দেখে কিছু কুলাঙ্গার অপরাধ করে বেঁচে যায়, আর তারা নিজের জীবন দিয়ে দায়িত্ব পালন করে—তখন তাদের অন্তরে ক্ষোভ জমে ওঠে। সেই ক্ষোভ যদি ন্যায়বিচারের মাধ্যমে মুক্তি না পায়, তবে সেটি প্রতিষ্ঠানটির ভেতরেই বিষাক্ত প্রভাব ফেলবে।
এই বিচার একটি প্রতীক হবে। এটি জানিয়ে দেবে, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী কোনো ব্যক্তির হাতিয়ার নয়। এটি জাতির প্রতিষ্ঠান, জনগণের প্রতিষ্ঠান। যে কেউ এটিকে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য ব্যবহার করতে চাইবে, তাকে একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। অতএব অজুহাতের সময় শেষ, দ্বিধার সময় শেষ। এখন সময় দৃঢ় পদক্ষেপের। অপরাধীদের আইসিসিতে দাঁড় করাতে হবে, তাদের অপরাধ উন্মোচন করতে হবে, তাদের চক্র ধ্বংস করতে হবে এবং যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সশস্ত্র বাহিনী তার হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারবে, জনগণ আবার আস্থা ফিরে পাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝবে, ‘এই বাহিনী পবিত্র, এ বাহিনী অপরাধের ঢাল নয়।’ বিশ্বকে আমাদের বার্তা স্পষ্ট শোনাতে হবে—আর নয় আপস, আর নয় দেরি, আর নয় সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে খেলা। ন্যায়বিচার হবে। সৈনিকদের সম্মান পুনরুদ্ধার হবে। আর শিক্ষা হয়ে থাকবে চিরকাল—বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতির সম্পদ, কোনো বিশ্বাসঘাতকের উচ্চাকাঙ্ক্ষার হাতিয়ার নয়।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৭ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৭ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৭ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে