আলী ওসমান শেফায়েত
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। এই দিনটি নিয়ে তাদের মধ্যে আছে বিপুল উচ্ছ্বাস। কতসব বিচিত্র আয়োজন হবে আজকের এই দিনকে ঘিরে। কিন্তু বিশ্বায়নের সূত্রে পাওয়া এই পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের জন্য কতটা মানানসই, তা কি একবারও ভেবে দেখেছি আমরা? অথচ আমাদেরই আছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। কিন্তু আমরা আমাদের সংস্কৃতির খোঁজখবর তেমন একটা রাখি না। বাঙালিদের জীবনে ৩৬৫ দিনই ভালোবাসার। অথচ একটি বিশেষ দিনকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে বাকি দিনগুলো আমরা ভালোবাসাহীন করে চালাতে চাইছি।
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে যে ভালোবাসা চিরন্তনভাবে চলে আসছে, মাঝপথে এসে সে ভালোবাসায় বাধার সৃষ্টি করে ভালোবাসাকেও করে ফেলছি সংকীর্ণ। ভালোবাসা দিবসের সময় এলে আমরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকি উন্মাদের মতো। অথচ একবারও জানতে চাই না ভালোবাসা দিবস উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস। মনে প্রশ্ন জাগে না কোন কারণে আমরা বিশেষ একটি দিনের খাঁচায় বন্দি করে ফেলছি মুক্ত ভালোবাসাকে? ভালোবাসা দিবস বলতেই তরুণ-তরুণীরা হুঁশ হারিয়ে উন্মাদনায় মেতে উঠছে। যেসব দেশ থেকে ভালোবাসা একেবারেই পরবাসী হয়েছে, সেসব দেশের মানুষ ভালোবাসা দিবস পালন করে কিছুটা লাভবান হলেও বাংলাদেশের মতো একটি ইসলামি সংস্কৃতির দেশে ভালোবাসা দিবস পালনের নামে যা হয়, তা আদৌ কাম্য নয়, নয় গ্রহণযোগ্যও। যে দেশের মানুষের জীবনের সব পরতে পরতে ভালোবাসায় ভরপুর, তারা নির্দিষ্ট একটি দিনকেন্দ্রিক ভালোবাসাকে পুঞ্জীভূত করে ফেলবে-এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। আমরা যে ইতিহাসকে স্মরণ করার মানসে ভালোবাসা দিবসকে পালন করি, সেসব ঘটনায় প্রকৃত ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও ছিল কি না, তা নিয়ে আছে গুরুতর প্রশ্ন।
পশ্চিমা দেশগুলোয় ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বলা হয়। বছরের ৩৬৫ থেকে মাত্র একটি দিন ও রাত প্রেম সরোবরে ডুব দেওয়া, সাঁতার কাটা, চরিত্রের নৈতিক ভূষণ খুলে প্রেম সরোবরে হারিয়ে যাওয়ার দিবস হচ্ছে, ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বা ‘ভালোবাসা দিবস’। এ দিনটিকে ‘লাভ ডে’ অথবা ‘লাভার্স ফেস্টিভ্যাল’ বলা হয় না। অথচ আমাদের দেশে ‘সেন্ট ভালেন্টাইন্স ডে’র অনুবাদ করে বলা হচ্ছে ‘ভালোবাসা দিবস’। এরূপ অনুবাদের কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে।
ভালোবাসা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শব্দ। মূল শব্দের অনুবাদ বিকৃত করে ‘ভালোবাসা দিবস’ বলায় এটা যে ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছে, সেটা সহজে বোঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মতো অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ তার নিজ নামের পরিবর্তে অনুবাদের ছদ্মাবরণে প্রবেশ করছে। ফলে এ দিবসের প্রকৃত অর্থ, উৎপত্তির কারণ ও ইতিহাস অনেকের কাছেই অজানা থেকে যাচ্ছে। অনেকটা হুজুগের বশবর্তী হয়ে বিজাতীয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতিতে লালিত ও পরিপুষ্ট একটি ধর্মীয় উৎসবের দিনকে এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা নিজেদের অন্যতম উৎসবের দিন হিসেবে গ্রহণ করছে।
‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-এর প্রথম শব্দটিই এ দিনটির আসল পরিচয় বলে দিচ্ছে। ‘Advanced Oxford Learner's Dictionary’-তে ‘Saint’ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে : ‘A person declared to be holy by the Christian Church because of her/his qualities or good works’ অর্থাৎ– ‘এমন ব্যক্তি, খ্রিষ্টান গির্জা, যাকে তার গুণাবলি বা ভালো কাজের জন্য পবিত্র সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছে’।
আর ‘Valentine’ শব্দের অর্থ ‘ভালোবাসা’ নয়। ‘Valentine’ মূলত একজন ‘ব্যক্তির নাম’। খ্রিষ্ট ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করার কারণে যাকে গির্জার তরফ থেকে যাকে Saint (পবিত্র সত্তা) ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, ‘গির্জা কর্তৃক পবিত্র সত্তা হিসেবে ঘোষিত একজন ধর্ম যাজকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এ দিনটি উদযাপনের মূল কারণ’। বিভিন্ন ‘Encyclopedia’ অধ্যয়ন করলে সহজেই ‘Saint Valentine’-এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যাবে। আরো জানা যাবে, ‘Saint Valentine Day’-এর উৎপত্তির কারণ।
২৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট ‘দ্বিতীয় ক্লডিয়াস’ নারী-পুরুষের বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। তার ধারণা ছিল, বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হলে যুদ্ধের প্রতি পুরুষদের অনীহা সৃষ্টি হয়। সে সময় রোমের খ্রিষ্টান গির্জার পুরোহিত ‘ভ্যালেন্টাইন’ রাজার নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গোপনে নারী-পুরুষের বিয়েবন্ধনের কাজ সম্পন্ন করতেন। এ ঘটনা প্রকাশের পর তাকে রাজার কাছে ধরে নিয়ে গেলে ‘ভ্যালেন্টাইন’ রাজাকে জানালেন, খ্রিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসের কারণে তিনি কাউকে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হতে বারণ করতে পারেন না। রাজা তখন তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং খ্রিষ্টান ধর্ম ত্যাগ করে প্রাচীন রোমান পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে এলে তাকে ক্ষমা করার কথা বলেন।
ভ্যালেন্টাইন রাজার প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানান। তখন রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন। এরপর ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি অনুগত থেকে ধর্মকে বিসর্জন না দিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণা করা হয়। পরে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রাধান্য সৃষ্টি হলে খ্রিষ্টান গির্জা ‘ভ্যালেন্টাইন’কে Saint (পবিত্র সত্তা) হিসেবে ঘোষণা করে। কেননা খ্রিষ্ট ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করলে গির্জার পক্ষ থেকে তাকে Saint (পবিত্র সত্তা) বলা হয়। ৩৫০ সালে রোমের যে স্থানে ‘ভ্যালেন্টাইন’কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তার স্মরণে একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়।
অবশেষে ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু ‘পোপ গেলাসিয়াস’ ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এ দিনে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে গির্জায় খ্রিষ্টান ধর্মমতে পবিত্র সত্তা (Saint) নিবার্চনের জন্য একটি লটারির আয়োজন করা হতো। লটারিতে যার নাম আসত তিনি ওই বছর থেকে গির্জা ও খ্রিষ্টান ধর্মের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতেন।
কথিত আছে, ‘ভ্যালেন্টাইন’ কারাগারে থাকাকালে কারারক্ষীর মেয়ের প্রেমে পড়েন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীর মেয়েকে একটি চিরকুট লিখে যান, যার শেষে লেখা ছিল, ÔFrom Your Valentine’ অর্থাৎ ‘তোমার ভ্যালেন্টাইনের পক্ষ থেকে’। যদিও ভ্যালেন্টাইনের প্রেম সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণার কয়েকটি ইতিহাস বা কারণের এটিও একটি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কারারক্ষীর মেয়ের প্রেমে ‘ভ্যালেন্টাইন’-এর কথিত ভালোবাসার কারণে কি পোপ গেলাসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণা করেছিলেন? নিশ্চয়ই না। কারণ, খ্রিষ্ট ধর্মে পুরোহিতদের জন্য বিয়ে করা বৈধ নয়। পুরোহিত হয়ে কারো মেয়ের প্রেমে আসক্তি খ্রিষ্ট ধর্ম মতেও অনৈতিক কাজ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, ভালোবাসার কারণে ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে যেতে হয়নি। কারণ, তিনি কারারক্ষীর মেয়ের প্রেমে আসক্ত হয়েছিলেন কারাগারে যাওয়ার পর।
সুতরাং, ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে নিক্ষেপ ও মৃত্যুদণ্ড প্রদানের সঙ্গে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাই ভ্যালেন্টাইনের কথিত ভালোবাসা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে-এর মূল বিষয় ছিল না। বরং খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতি গভীর ভালোবাসাই ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ডের কারণ ছিল। কারণ রাজার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি গোপনে নারী-পুরুষের বিয়েবন্ধনের কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে তার ধর্মীয় বিধান পালন করেছিলেন। এ জন্যই তাকে জীবন দিতে হয়েছিল। আর খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতি তার এহেন ভালোবাসার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই তার মৃত্যুদণ্ডের দিনটিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
শেষ কথা হচ্ছে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে সম্পর্কিত এসব তথ্য জানার পরও ইসলাম ধর্মের অনুসারী বাংলাদেশি ঐতিহ্যে লালিত কোনো নারী কিংবা পুরুষ কি এই দিনে তার প্রিয়জন থেকে কোনো চিরকুট, প্রেমপত্র, লাল গোলাপ, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কার্ড বা কোনো উপহার পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবেন? জেনে-শুনে এই দিনটিতে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ ও নিজ দেশের মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে অন্য বিজাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে মাতামাতি আত্মবিস্মৃতির চরম দেউলিয়াপনা ছাড়া আর কী হতে পারে? তাই সব বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের ওপর খেয়াল রাখা। তাদের সঠিকভাবে বোঝানো। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। এই দিনটি নিয়ে তাদের মধ্যে আছে বিপুল উচ্ছ্বাস। কতসব বিচিত্র আয়োজন হবে আজকের এই দিনকে ঘিরে। কিন্তু বিশ্বায়নের সূত্রে পাওয়া এই পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের জন্য কতটা মানানসই, তা কি একবারও ভেবে দেখেছি আমরা? অথচ আমাদেরই আছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। কিন্তু আমরা আমাদের সংস্কৃতির খোঁজখবর তেমন একটা রাখি না। বাঙালিদের জীবনে ৩৬৫ দিনই ভালোবাসার। অথচ একটি বিশেষ দিনকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে বাকি দিনগুলো আমরা ভালোবাসাহীন করে চালাতে চাইছি।
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে যে ভালোবাসা চিরন্তনভাবে চলে আসছে, মাঝপথে এসে সে ভালোবাসায় বাধার সৃষ্টি করে ভালোবাসাকেও করে ফেলছি সংকীর্ণ। ভালোবাসা দিবসের সময় এলে আমরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকি উন্মাদের মতো। অথচ একবারও জানতে চাই না ভালোবাসা দিবস উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস। মনে প্রশ্ন জাগে না কোন কারণে আমরা বিশেষ একটি দিনের খাঁচায় বন্দি করে ফেলছি মুক্ত ভালোবাসাকে? ভালোবাসা দিবস বলতেই তরুণ-তরুণীরা হুঁশ হারিয়ে উন্মাদনায় মেতে উঠছে। যেসব দেশ থেকে ভালোবাসা একেবারেই পরবাসী হয়েছে, সেসব দেশের মানুষ ভালোবাসা দিবস পালন করে কিছুটা লাভবান হলেও বাংলাদেশের মতো একটি ইসলামি সংস্কৃতির দেশে ভালোবাসা দিবস পালনের নামে যা হয়, তা আদৌ কাম্য নয়, নয় গ্রহণযোগ্যও। যে দেশের মানুষের জীবনের সব পরতে পরতে ভালোবাসায় ভরপুর, তারা নির্দিষ্ট একটি দিনকেন্দ্রিক ভালোবাসাকে পুঞ্জীভূত করে ফেলবে-এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। আমরা যে ইতিহাসকে স্মরণ করার মানসে ভালোবাসা দিবসকে পালন করি, সেসব ঘটনায় প্রকৃত ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও ছিল কি না, তা নিয়ে আছে গুরুতর প্রশ্ন।
পশ্চিমা দেশগুলোয় ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বলা হয়। বছরের ৩৬৫ থেকে মাত্র একটি দিন ও রাত প্রেম সরোবরে ডুব দেওয়া, সাঁতার কাটা, চরিত্রের নৈতিক ভূষণ খুলে প্রেম সরোবরে হারিয়ে যাওয়ার দিবস হচ্ছে, ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বা ‘ভালোবাসা দিবস’। এ দিনটিকে ‘লাভ ডে’ অথবা ‘লাভার্স ফেস্টিভ্যাল’ বলা হয় না। অথচ আমাদের দেশে ‘সেন্ট ভালেন্টাইন্স ডে’র অনুবাদ করে বলা হচ্ছে ‘ভালোবাসা দিবস’। এরূপ অনুবাদের কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে।
ভালোবাসা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শব্দ। মূল শব্দের অনুবাদ বিকৃত করে ‘ভালোবাসা দিবস’ বলায় এটা যে ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছে, সেটা সহজে বোঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মতো অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ তার নিজ নামের পরিবর্তে অনুবাদের ছদ্মাবরণে প্রবেশ করছে। ফলে এ দিবসের প্রকৃত অর্থ, উৎপত্তির কারণ ও ইতিহাস অনেকের কাছেই অজানা থেকে যাচ্ছে। অনেকটা হুজুগের বশবর্তী হয়ে বিজাতীয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতিতে লালিত ও পরিপুষ্ট একটি ধর্মীয় উৎসবের দিনকে এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা নিজেদের অন্যতম উৎসবের দিন হিসেবে গ্রহণ করছে।
‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-এর প্রথম শব্দটিই এ দিনটির আসল পরিচয় বলে দিচ্ছে। ‘Advanced Oxford Learner's Dictionary’-তে ‘Saint’ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে : ‘A person declared to be holy by the Christian Church because of her/his qualities or good works’ অর্থাৎ– ‘এমন ব্যক্তি, খ্রিষ্টান গির্জা, যাকে তার গুণাবলি বা ভালো কাজের জন্য পবিত্র সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছে’।
আর ‘Valentine’ শব্দের অর্থ ‘ভালোবাসা’ নয়। ‘Valentine’ মূলত একজন ‘ব্যক্তির নাম’। খ্রিষ্ট ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করার কারণে যাকে গির্জার তরফ থেকে যাকে Saint (পবিত্র সত্তা) ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, ‘গির্জা কর্তৃক পবিত্র সত্তা হিসেবে ঘোষিত একজন ধর্ম যাজকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এ দিনটি উদযাপনের মূল কারণ’। বিভিন্ন ‘Encyclopedia’ অধ্যয়ন করলে সহজেই ‘Saint Valentine’-এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যাবে। আরো জানা যাবে, ‘Saint Valentine Day’-এর উৎপত্তির কারণ।
২৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট ‘দ্বিতীয় ক্লডিয়াস’ নারী-পুরুষের বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। তার ধারণা ছিল, বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হলে যুদ্ধের প্রতি পুরুষদের অনীহা সৃষ্টি হয়। সে সময় রোমের খ্রিষ্টান গির্জার পুরোহিত ‘ভ্যালেন্টাইন’ রাজার নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গোপনে নারী-পুরুষের বিয়েবন্ধনের কাজ সম্পন্ন করতেন। এ ঘটনা প্রকাশের পর তাকে রাজার কাছে ধরে নিয়ে গেলে ‘ভ্যালেন্টাইন’ রাজাকে জানালেন, খ্রিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসের কারণে তিনি কাউকে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হতে বারণ করতে পারেন না। রাজা তখন তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং খ্রিষ্টান ধর্ম ত্যাগ করে প্রাচীন রোমান পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে এলে তাকে ক্ষমা করার কথা বলেন।
ভ্যালেন্টাইন রাজার প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানান। তখন রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন। এরপর ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি অনুগত থেকে ধর্মকে বিসর্জন না দিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণা করা হয়। পরে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রাধান্য সৃষ্টি হলে খ্রিষ্টান গির্জা ‘ভ্যালেন্টাইন’কে Saint (পবিত্র সত্তা) হিসেবে ঘোষণা করে। কেননা খ্রিষ্ট ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করলে গির্জার পক্ষ থেকে তাকে Saint (পবিত্র সত্তা) বলা হয়। ৩৫০ সালে রোমের যে স্থানে ‘ভ্যালেন্টাইন’কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তার স্মরণে একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়।
অবশেষে ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু ‘পোপ গেলাসিয়াস’ ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এ দিনে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে গির্জায় খ্রিষ্টান ধর্মমতে পবিত্র সত্তা (Saint) নিবার্চনের জন্য একটি লটারির আয়োজন করা হতো। লটারিতে যার নাম আসত তিনি ওই বছর থেকে গির্জা ও খ্রিষ্টান ধর্মের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতেন।
কথিত আছে, ‘ভ্যালেন্টাইন’ কারাগারে থাকাকালে কারারক্ষীর মেয়ের প্রেমে পড়েন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীর মেয়েকে একটি চিরকুট লিখে যান, যার শেষে লেখা ছিল, ÔFrom Your Valentine’ অর্থাৎ ‘তোমার ভ্যালেন্টাইনের পক্ষ থেকে’। যদিও ভ্যালেন্টাইনের প্রেম সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণার কয়েকটি ইতিহাস বা কারণের এটিও একটি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কারারক্ষীর মেয়ের প্রেমে ‘ভ্যালেন্টাইন’-এর কথিত ভালোবাসার কারণে কি পোপ গেলাসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণা করেছিলেন? নিশ্চয়ই না। কারণ, খ্রিষ্ট ধর্মে পুরোহিতদের জন্য বিয়ে করা বৈধ নয়। পুরোহিত হয়ে কারো মেয়ের প্রেমে আসক্তি খ্রিষ্ট ধর্ম মতেও অনৈতিক কাজ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, ভালোবাসার কারণে ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে যেতে হয়নি। কারণ, তিনি কারারক্ষীর মেয়ের প্রেমে আসক্ত হয়েছিলেন কারাগারে যাওয়ার পর।
সুতরাং, ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে নিক্ষেপ ও মৃত্যুদণ্ড প্রদানের সঙ্গে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাই ভ্যালেন্টাইনের কথিত ভালোবাসা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে-এর মূল বিষয় ছিল না। বরং খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতি গভীর ভালোবাসাই ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ডের কারণ ছিল। কারণ রাজার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি গোপনে নারী-পুরুষের বিয়েবন্ধনের কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে তার ধর্মীয় বিধান পালন করেছিলেন। এ জন্যই তাকে জীবন দিতে হয়েছিল। আর খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতি তার এহেন ভালোবাসার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই তার মৃত্যুদণ্ডের দিনটিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
শেষ কথা হচ্ছে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে সম্পর্কিত এসব তথ্য জানার পরও ইসলাম ধর্মের অনুসারী বাংলাদেশি ঐতিহ্যে লালিত কোনো নারী কিংবা পুরুষ কি এই দিনে তার প্রিয়জন থেকে কোনো চিরকুট, প্রেমপত্র, লাল গোলাপ, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কার্ড বা কোনো উপহার পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবেন? জেনে-শুনে এই দিনটিতে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ ও নিজ দেশের মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে অন্য বিজাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে মাতামাতি আত্মবিস্মৃতির চরম দেউলিয়াপনা ছাড়া আর কী হতে পারে? তাই সব বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের ওপর খেয়াল রাখা। তাদের সঠিকভাবে বোঝানো। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে