প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
আমন ‘হার্ভেস্টিং’ বা কাটামারি মৌসুমে গৃহস্থরা এ ধান নিয়ে সারা বছরের অপূরিত স্বপ্নসাধ পূরণের জন্য পরিকল্পনা করে থাকেন। এ সময় একসঙ্গে অনেকে বাজারে ধান বিক্রি করতে যাওয়ার ফলে দাম কমে যায়। সেজন্য লাভ হয় দরিদ্র মানুষের। কিন্তু এ বছর খেটে খাওয়া দিনমজুর ও স্বল্প আয়ের মানুষ বাজারে মোটা চালের অগ্নিমূল্যের কাছে অসহায় হয়ে কেনা কমিয়ে দিয়ে কম করে খেতে হচ্ছে।
ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। তাই চাল একটি নিত্যপণ্য। এ নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলা ঠিক নয়। কিন্তু সেটাই চলছে আড়ালে-আবডালে। গণমাধ্যমে চাল, তেল, ডিম, পেঁয়াজ প্রভৃতি সিন্ডিকেটের কথা শুনতে শুনতে নিম্নআয়ের মানুষ বড় বিরক্ত; তারা অসহায়ত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন। সরকারি চাকরিহীন এসব মানুষের কাছে ২০২৫ সালের মহার্ঘভাতা বাড়ার সংবাদও বড় বেদনাদায়ক।
চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ যে কষ্ট পাচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তবে এ সমস্যা সাময়িক বলে দাবি করে তিনি বলেছেন, ‘আমার হাতে কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই যে, তাতে সুইচ দিলেই আগামীকাল বাজার ঠিক হয়ে যাবে।’
আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম কেন বাড়ে, এ নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের শেষ নেই। প্রতিদিন আলোচনা শেষে অভিযোগের পাল্লা চলে যাচ্ছে চালকল মালিক ও বড় চাল মজুতদার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তারা খেয়ালখুশিমতো চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের অতি মুনাফা ও লোভের কাছে ভোক্তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ যাবেন কোথায়?
বিষয়টা একটু খোলাসা করে বললে বলা যায়, প্রান্তিক কৃষকরা ধান ঘরে তোলার শুরুতেই বিক্রি করে ঋণ শোধ ও প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সে সময় সবাই একসঙ্গে ধান বিক্রি শুরু করলে স্থানীয় বাজারে নতুন ধানের দাম হঠাৎ কমে যায়। ফড়িয়ারা কম দামে ধান কিনে জমা করেন। কিন্তু সেই ধান কিছুদিনের মধ্যে বেশি লাভের হিসাব কষে মিলমালিক ও সরকারি শস্য সংগ্রহকারী বা ক্রয়কারীদের কাছে বিক্রি করে দেন। এতে মাঠপর্যায়ের উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র কৃষক ও খুচরা ব্যবসায়ীরা লাভের নাগাল না পেলেও মুনাফার অঙ্ক বেড়ে চলে যায় মিলমালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের হাতে। তারা চাল বানিয়ে বাজারে বিক্রি করেন অধিক মুনাফায়।
সেই অগ্নিমূল্যের চাল এখন বাজারে সয়লাব। কিন্তু দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষ সেই নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল কিনতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। চালের বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে মুনাফালোভী মিলমালিক ও মজুতদার ব্যবসায়ীদের হাতে। এটাকে তারা বলছেন ‘সুপার নরমাল প্রফিট’। কিন্তু সাধারণ ভোক্তারা এই ‘সুপার নরমাল প্রফিট’-এর ফাঁদে অসহায় হয়ে পড়েছেন।
তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য মেলাতে না পেরে গোলমেলে অবস্থার মধ্যে জীবন-যাপন চলছে। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষেরা আগে চালের দাম বৃদ্ধি পেলে আটা কিনে রুটি খেতেন। ব্যবসায়ীরা আমদানি করা গম বা আটার মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই এখনকার বাজারে আটার অগ্নিমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে। সেখানেও দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষদের বিকল্প খোঁজার কোনো উপায় নেই। এছাড়া এই মুহূর্তে বাজারে কিছু শীতের সবজি ছাড়া সব ধরনের খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিকল্প উপায় হারিয়ে সাধারণ মানুষ হাবাডুবু খাচ্ছেন।
এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কার্যত বলা যায়, আমাদের চিরায়ত সামাজিক নিরাপত্তা বলয় ভেঙে গেছে। অবশিষ্ট আছে সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিম্ন আয়ধারী, ভাসমান দরিদ্র ও প্রকৃত ভিক্ষুকদের জন্য স্থায়ী খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু হঠাৎ করে সেটা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ আমাদের এই লজ্জাকর চিত্র দেশের সব জায়গায় অবলোকন করা গেলেও অদ্যাবধি ভিক্ষুকদের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ সামাজিক ব্যাধি বা ভয়ানক আনস্মার্ট বিষয়টি প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগও নেই।
অপরদিকে, প্রান্তিক কৃষকদের অবস্থা বেগতিক হওয়ার কারণ তারা নিজের সামান্য জমি ছাড়াও চুক্তিতে অন্যের জমি বর্গাচাষ করেন। কিন্তু সেচের জ্বালানি, বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধির জন্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ফসল ফলিয়ে তাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাদের লাভের অঙ্ক পিঁপড়া ও বড় ব্যবসায়ীরা খেয়ে নিচ্ছে। এতে গ্রামীণ সমাজে দরিদ্র কৃষকরা আরও বেশি দরিদ্র হয়ে পড়ছে। এভাবে বাপ-দাদার কৃষি পেশা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ায় কৃষি শ্রমিকের অভাবে খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সেজন্য কোনোভাবেই চালের দাম বা খাদ্যপণ্যের মূল্য কমানোর সরকারি নীতি-নির্দেশনা কাজে আসছে না। মৌসুমের শুরুতে ধানের দাম কম, কিন্তু চালের দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম। তাই দাম বেশি হওয়ার কথা। অর্থনীতির এই তত্ত্ব যদি সঠিক হয়, তাহলে চালের চাহিদার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সংকটের সময় সরবরাহের তথ্য প্রকাশ করা হয়। পর্যবেক্ষকরা বলেন, তাহলে নিশ্চয়ই পথে যেতে যেতে সরবরাহের চাল হারিয়ে যায়। তা না হলে চালের বাজার এত গরম কেন?
আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, সব সরকারের সময় সরকারি ভাষ্যে প্রায়ই বলা হয়, ‘চালের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে।’ সরকারি গুদামে মজুত বা ব্যবসায়ীদের সাইলোতে মজুত থাকলে বণ্টনে গরমিল কেন? যথার্থ মনিটরিং কি নেই? পত্রিকায় (আমার দেশ; জানুয়ারি ১১, ২০২৫) জানা গেল ‘রংপুরে ক্রয় প্রক্রিয়ার ভুলে গত দুই মৌসুমে সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্যে ধান কেনা যায়নি। ধান বিক্রি করতে গেলে লটারিতে নাম উঠতে হয়। কৃষক জানেন না, সেখানে কে লটারিতে জিতেছিল। শতভাগ শুকনো ধান কেনে সরকার, কিন্তু কৃষকরা মাড়াইয়ের পর কাঁচা ধান বিক্রি করে। এই অভিযোগে ফাঁকিবাজি শুরু করায় ফড়িয়ারা লাভবান হয়।’ বিভিন্ন জায়গায় গুদাম খালি পড়ে আছে, ‘যশোরে খাদ্যমজুত তলানিতে’ প্রভৃতি।
এছাড়া বাজারে মুদি দোকানে আজকাল চালসহ মাছ, মাংস, তেল, আটা, চিনি ইত্যাদির মূল্যতালিকা ঝুলে থেকে অসহায় ক্রেতাকে প্রহসন করে। মজুত আছে সে হিসাব শুনে অসহায় ভোক্তাদের কী লাভ? ক্রেতারা চায় নিজেদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে খাদ্যপণ্য কিনতে। সাধারণ মানুষ টিভি বা অনলাইনে দেওয়া পর্যাপ্ত খাদ্য মজুতের কথা শোনার সুযোগও পায় না।
দেশের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ নিম্নআয়ের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এদেশে শতকরা ২০ ভাগ মানুষের হাতে ৮০ ভাগ সম্পদ ও সুযোগ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। কোনো কিছুর মুনাফা অর্জিত হলে সেটার মূলভাগ তারাই ভোগ করেন। ফলে ক্রয়ক্ষমতা ও মৌলিক চাহিদা ভোগের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের সামাজিক ভ্যাকুয়্যাম তৈরি হয়ে গেছে। সামাজিক নীতি-নির্ধারকরা একথা জেনেও কিছুই করতে পারছেন না।
তার ওপর সম্প্রতি ট্রাকসেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরিবার কার্ড বাতিল করা হয়েছে ৪৩ লাখ। কারণ সেখানে কার্ড বিতরণে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের অনিয়ম খুঁজে পাওয়া গেছে। অতীতে সারাদেশে ট্রাকসেল চালু ছিল। সেটা ২০২২ সালে পরিবার কার্ড কর্মসূচির আওতায় আসে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য। মাথাপিছু নির্দিষ্টহারে স্বল্পমূল্যে পাঁচ কেজি চাল, চিনি, তেল, আলু, পিঁয়াজ, ডাল ইত্যাদি সরবরাহ করা হবে। বলা হয়েছিল, টিসিবি মোট এক কোটি মানুষকে কার্ড দিয়েছে, কিন্তু কার্যত কার্ড দেওয়া হয় ৫৭ লাখ মানুষকে। বাকি ৩৩ লাখের গরমিল রয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতি এখানেই হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকার এখন এখানে কাগুজে কার্ড বাতিল করে স্মার্টকার্ড প্রদানের কথা ভাবছেন।
তবে এরই মধ্যে ১০ জানুয়ারি খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। পাইকারদের চালবাজিতে কোনো কোনো চালের মূল্য কেজিতে ১৬ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে! নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য ও সার্বিকভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার এই কঠিন সময়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমার হাতে কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই যে, তাতে সুইচ দিলেই আগামীকাল বাজার ঠিক হয়ে যাবে।’দরিদ্র ভোক্তারা এই বক্তব্য শুনে আরও বিরক্ত হচ্ছেন। তারা বলছেন, ‘দায়িত্বে থেকে এমন কথা বলা ঠিক নয়।’ তারা বলছেন, এসব কথা আমাদের ব্যথা বাড়ায়।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আমনের ভরা মৌসুমেও কিনতে অপারগ মোটা চালের ভোক্তারা। নিয়ন্ত্রণহীন খাদ্যপণ্যের বাজারে অভুক্ত মানুষের বোবা কান্না কে শোনে? সৎভাবে বাঁচার জন্য চেষ্টা করে যাওয়া স্বল্পআয়ের লোকদের আকুতি শোনার কেউ কি নেই?
এ নিয়ে নেতিবাচক ভাবনা ও আশঙ্কার শেষ নেই। কিন্তু এসব ভাবনা ও আশঙ্কাকে বিনাশ করার জন্য নতুন কর্মপরিকল্পনা কোথায়? সাধারণ জনগণ চায় মৌলিক নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতা নাগালের মধ্যে স্বাভাবিক থাক। সহজে খাদ্য ও পুষ্টি মিলুক। জীবন বাঁচার পথ খোলা থাকুক সবার জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার যদি বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারে, তাহলে একটি শক্তিশালী নির্বাচিত সরকার আসতে আর দেরি কেন? হাতে ‘আলাদিনের চেরাগ’ থাকুক বা না থাকুক এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশার ফিরিস্তি অনেক বেশি।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন, fakrul@ru.ac.bd
আমন ‘হার্ভেস্টিং’ বা কাটামারি মৌসুমে গৃহস্থরা এ ধান নিয়ে সারা বছরের অপূরিত স্বপ্নসাধ পূরণের জন্য পরিকল্পনা করে থাকেন। এ সময় একসঙ্গে অনেকে বাজারে ধান বিক্রি করতে যাওয়ার ফলে দাম কমে যায়। সেজন্য লাভ হয় দরিদ্র মানুষের। কিন্তু এ বছর খেটে খাওয়া দিনমজুর ও স্বল্প আয়ের মানুষ বাজারে মোটা চালের অগ্নিমূল্যের কাছে অসহায় হয়ে কেনা কমিয়ে দিয়ে কম করে খেতে হচ্ছে।
ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। তাই চাল একটি নিত্যপণ্য। এ নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলা ঠিক নয়। কিন্তু সেটাই চলছে আড়ালে-আবডালে। গণমাধ্যমে চাল, তেল, ডিম, পেঁয়াজ প্রভৃতি সিন্ডিকেটের কথা শুনতে শুনতে নিম্নআয়ের মানুষ বড় বিরক্ত; তারা অসহায়ত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন। সরকারি চাকরিহীন এসব মানুষের কাছে ২০২৫ সালের মহার্ঘভাতা বাড়ার সংবাদও বড় বেদনাদায়ক।
চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ যে কষ্ট পাচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তবে এ সমস্যা সাময়িক বলে দাবি করে তিনি বলেছেন, ‘আমার হাতে কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই যে, তাতে সুইচ দিলেই আগামীকাল বাজার ঠিক হয়ে যাবে।’
আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম কেন বাড়ে, এ নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের শেষ নেই। প্রতিদিন আলোচনা শেষে অভিযোগের পাল্লা চলে যাচ্ছে চালকল মালিক ও বড় চাল মজুতদার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তারা খেয়ালখুশিমতো চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের অতি মুনাফা ও লোভের কাছে ভোক্তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ যাবেন কোথায়?
বিষয়টা একটু খোলাসা করে বললে বলা যায়, প্রান্তিক কৃষকরা ধান ঘরে তোলার শুরুতেই বিক্রি করে ঋণ শোধ ও প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সে সময় সবাই একসঙ্গে ধান বিক্রি শুরু করলে স্থানীয় বাজারে নতুন ধানের দাম হঠাৎ কমে যায়। ফড়িয়ারা কম দামে ধান কিনে জমা করেন। কিন্তু সেই ধান কিছুদিনের মধ্যে বেশি লাভের হিসাব কষে মিলমালিক ও সরকারি শস্য সংগ্রহকারী বা ক্রয়কারীদের কাছে বিক্রি করে দেন। এতে মাঠপর্যায়ের উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র কৃষক ও খুচরা ব্যবসায়ীরা লাভের নাগাল না পেলেও মুনাফার অঙ্ক বেড়ে চলে যায় মিলমালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের হাতে। তারা চাল বানিয়ে বাজারে বিক্রি করেন অধিক মুনাফায়।
সেই অগ্নিমূল্যের চাল এখন বাজারে সয়লাব। কিন্তু দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষ সেই নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল কিনতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। চালের বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে মুনাফালোভী মিলমালিক ও মজুতদার ব্যবসায়ীদের হাতে। এটাকে তারা বলছেন ‘সুপার নরমাল প্রফিট’। কিন্তু সাধারণ ভোক্তারা এই ‘সুপার নরমাল প্রফিট’-এর ফাঁদে অসহায় হয়ে পড়েছেন।
তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য মেলাতে না পেরে গোলমেলে অবস্থার মধ্যে জীবন-যাপন চলছে। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষেরা আগে চালের দাম বৃদ্ধি পেলে আটা কিনে রুটি খেতেন। ব্যবসায়ীরা আমদানি করা গম বা আটার মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই এখনকার বাজারে আটার অগ্নিমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে। সেখানেও দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষদের বিকল্প খোঁজার কোনো উপায় নেই। এছাড়া এই মুহূর্তে বাজারে কিছু শীতের সবজি ছাড়া সব ধরনের খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিকল্প উপায় হারিয়ে সাধারণ মানুষ হাবাডুবু খাচ্ছেন।
এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কার্যত বলা যায়, আমাদের চিরায়ত সামাজিক নিরাপত্তা বলয় ভেঙে গেছে। অবশিষ্ট আছে সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিম্ন আয়ধারী, ভাসমান দরিদ্র ও প্রকৃত ভিক্ষুকদের জন্য স্থায়ী খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু হঠাৎ করে সেটা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ আমাদের এই লজ্জাকর চিত্র দেশের সব জায়গায় অবলোকন করা গেলেও অদ্যাবধি ভিক্ষুকদের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ সামাজিক ব্যাধি বা ভয়ানক আনস্মার্ট বিষয়টি প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগও নেই।
অপরদিকে, প্রান্তিক কৃষকদের অবস্থা বেগতিক হওয়ার কারণ তারা নিজের সামান্য জমি ছাড়াও চুক্তিতে অন্যের জমি বর্গাচাষ করেন। কিন্তু সেচের জ্বালানি, বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধির জন্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ফসল ফলিয়ে তাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাদের লাভের অঙ্ক পিঁপড়া ও বড় ব্যবসায়ীরা খেয়ে নিচ্ছে। এতে গ্রামীণ সমাজে দরিদ্র কৃষকরা আরও বেশি দরিদ্র হয়ে পড়ছে। এভাবে বাপ-দাদার কৃষি পেশা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ায় কৃষি শ্রমিকের অভাবে খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সেজন্য কোনোভাবেই চালের দাম বা খাদ্যপণ্যের মূল্য কমানোর সরকারি নীতি-নির্দেশনা কাজে আসছে না। মৌসুমের শুরুতে ধানের দাম কম, কিন্তু চালের দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম। তাই দাম বেশি হওয়ার কথা। অর্থনীতির এই তত্ত্ব যদি সঠিক হয়, তাহলে চালের চাহিদার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সংকটের সময় সরবরাহের তথ্য প্রকাশ করা হয়। পর্যবেক্ষকরা বলেন, তাহলে নিশ্চয়ই পথে যেতে যেতে সরবরাহের চাল হারিয়ে যায়। তা না হলে চালের বাজার এত গরম কেন?
আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, সব সরকারের সময় সরকারি ভাষ্যে প্রায়ই বলা হয়, ‘চালের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে।’ সরকারি গুদামে মজুত বা ব্যবসায়ীদের সাইলোতে মজুত থাকলে বণ্টনে গরমিল কেন? যথার্থ মনিটরিং কি নেই? পত্রিকায় (আমার দেশ; জানুয়ারি ১১, ২০২৫) জানা গেল ‘রংপুরে ক্রয় প্রক্রিয়ার ভুলে গত দুই মৌসুমে সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্যে ধান কেনা যায়নি। ধান বিক্রি করতে গেলে লটারিতে নাম উঠতে হয়। কৃষক জানেন না, সেখানে কে লটারিতে জিতেছিল। শতভাগ শুকনো ধান কেনে সরকার, কিন্তু কৃষকরা মাড়াইয়ের পর কাঁচা ধান বিক্রি করে। এই অভিযোগে ফাঁকিবাজি শুরু করায় ফড়িয়ারা লাভবান হয়।’ বিভিন্ন জায়গায় গুদাম খালি পড়ে আছে, ‘যশোরে খাদ্যমজুত তলানিতে’ প্রভৃতি।
এছাড়া বাজারে মুদি দোকানে আজকাল চালসহ মাছ, মাংস, তেল, আটা, চিনি ইত্যাদির মূল্যতালিকা ঝুলে থেকে অসহায় ক্রেতাকে প্রহসন করে। মজুত আছে সে হিসাব শুনে অসহায় ভোক্তাদের কী লাভ? ক্রেতারা চায় নিজেদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে খাদ্যপণ্য কিনতে। সাধারণ মানুষ টিভি বা অনলাইনে দেওয়া পর্যাপ্ত খাদ্য মজুতের কথা শোনার সুযোগও পায় না।
দেশের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ নিম্নআয়ের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এদেশে শতকরা ২০ ভাগ মানুষের হাতে ৮০ ভাগ সম্পদ ও সুযোগ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। কোনো কিছুর মুনাফা অর্জিত হলে সেটার মূলভাগ তারাই ভোগ করেন। ফলে ক্রয়ক্ষমতা ও মৌলিক চাহিদা ভোগের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের সামাজিক ভ্যাকুয়্যাম তৈরি হয়ে গেছে। সামাজিক নীতি-নির্ধারকরা একথা জেনেও কিছুই করতে পারছেন না।
তার ওপর সম্প্রতি ট্রাকসেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরিবার কার্ড বাতিল করা হয়েছে ৪৩ লাখ। কারণ সেখানে কার্ড বিতরণে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের অনিয়ম খুঁজে পাওয়া গেছে। অতীতে সারাদেশে ট্রাকসেল চালু ছিল। সেটা ২০২২ সালে পরিবার কার্ড কর্মসূচির আওতায় আসে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য। মাথাপিছু নির্দিষ্টহারে স্বল্পমূল্যে পাঁচ কেজি চাল, চিনি, তেল, আলু, পিঁয়াজ, ডাল ইত্যাদি সরবরাহ করা হবে। বলা হয়েছিল, টিসিবি মোট এক কোটি মানুষকে কার্ড দিয়েছে, কিন্তু কার্যত কার্ড দেওয়া হয় ৫৭ লাখ মানুষকে। বাকি ৩৩ লাখের গরমিল রয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতি এখানেই হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকার এখন এখানে কাগুজে কার্ড বাতিল করে স্মার্টকার্ড প্রদানের কথা ভাবছেন।
তবে এরই মধ্যে ১০ জানুয়ারি খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। পাইকারদের চালবাজিতে কোনো কোনো চালের মূল্য কেজিতে ১৬ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে! নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য ও সার্বিকভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার এই কঠিন সময়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমার হাতে কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই যে, তাতে সুইচ দিলেই আগামীকাল বাজার ঠিক হয়ে যাবে।’দরিদ্র ভোক্তারা এই বক্তব্য শুনে আরও বিরক্ত হচ্ছেন। তারা বলছেন, ‘দায়িত্বে থেকে এমন কথা বলা ঠিক নয়।’ তারা বলছেন, এসব কথা আমাদের ব্যথা বাড়ায়।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আমনের ভরা মৌসুমেও কিনতে অপারগ মোটা চালের ভোক্তারা। নিয়ন্ত্রণহীন খাদ্যপণ্যের বাজারে অভুক্ত মানুষের বোবা কান্না কে শোনে? সৎভাবে বাঁচার জন্য চেষ্টা করে যাওয়া স্বল্পআয়ের লোকদের আকুতি শোনার কেউ কি নেই?
এ নিয়ে নেতিবাচক ভাবনা ও আশঙ্কার শেষ নেই। কিন্তু এসব ভাবনা ও আশঙ্কাকে বিনাশ করার জন্য নতুন কর্মপরিকল্পনা কোথায়? সাধারণ জনগণ চায় মৌলিক নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতা নাগালের মধ্যে স্বাভাবিক থাক। সহজে খাদ্য ও পুষ্টি মিলুক। জীবন বাঁচার পথ খোলা থাকুক সবার জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার যদি বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারে, তাহলে একটি শক্তিশালী নির্বাচিত সরকার আসতে আর দেরি কেন? হাতে ‘আলাদিনের চেরাগ’ থাকুক বা না থাকুক এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশার ফিরিস্তি অনেক বেশি।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন, fakrul@ru.ac.bd
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে