নেতৃত্ব নির্বাচনে সচেতনতার ঘাটতি

ড. মো. মুনিরুল ইসলাম
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ৩৫
ছবি: সংগৃহীত

জাতি হিসেবে আমাদের অন্যতম দুর্বলতা হলো—সচেতনতার ঘাটতি। প্রতিভা, দক্ষতা, মেধা ও ধর্মীয় অনুশীলনে আমরা অনেক জাতির চেয়ে এগিয়ে। আমাদের ভেতরে রয়েছে বদান্যতা, সহনশীলতা, পরিশ্রম, ধার্মিকতার অনেক প্রতিফলন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব গুণাবলিকে সুসংহত করে ভবিষ্যতের জন্য কোনো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সঠিক পথ নির্ধারণের সক্ষমতা আমাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। আমরা অধিকাংশ সময় ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য কিংবা প্রকৃত মিত্র ও প্রতারকের মাঝে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হই। আমাদের ইতিহাসবোধ ও অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে বিচক্ষণতা থাকা উচিত, তা যেন আমাদের চিন্তাজগতে অনুপস্থিত।

বিজ্ঞাপন

আরো দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, আমরা আমাদের নেতৃত্বের জবাবদিহির আওতায় আনার সাহস রাখি না। নেতা হন রাজনৈতিক বা ধর্মীয়, তাদের অযাচিত ক্ষমতা ও বিভ্রান্তিকর ভাষণে আমরা বারবার বিভ্রান্ত হই। অপরাধী ও অবিচারকারীদের প্রতিরোধ করার যে মনোবল প্রয়োজন, তা আমরা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের আরেকটি গভীর জাতিগত দুর্বলতা হলো—সুগঠিত বক্তব্য, আবেগনির্ভর প্রতিশ্রুতি ও চাতুর্যপূর্ণ বাগ্মীতার ফাঁদে পড়ে বারবার প্রতারিত হওয়া। যখন আমরা বুঝি যে আমরা প্রতারিত হয়েছি, তখনো আমরা প্রতারকদের ‘নতুন মোড়কে পুরোনো প্রতারণা’ সহজেই মেনে নিই—ক্ষমা চাওয়ার অভিনয়কে গ্রহণ করি এবং আবার সেই একই চক্রে আবর্তিত হই। এই আত্মবিবেচনার ঘাটতিই আমাদের জাতি হিসেবে বারবার পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ।

তবে জুলাই-আগস্টের বিপ্লব জাতির ভাগ্যাকাশে যে নবজ্যোতি সংযোজন করেছে, তা যদি জাতিকে বোধসম্পন্ন ও বিবেকনিষ্ঠ নেতৃত্ব বাছাইয়ের দিশা দেখাতে পারে, তবেই এই দীর্ঘ বঞ্চনার অধ্যায়ের অবসান হবে।

আমাদের নেতৃত্বের একটি বৃহৎ অংশের চেতনা আজ নিঃশেষ প্রায়। যে সামান্য বোধের রেশ অবশিষ্ট আছে, তাও দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। তারা বুঝেও বুঝতে চান না, কে বন্ধু, কে শত্রু। ক্ষমতা আর ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার জন্য তারা দেশের কল্যাণ বিবেচনার বাইরে রাখেন।

বিচক্ষণ ও দৃঢ়চেতা মানুষ কখনোই এক গর্তে দ্বিতীয়বার পা দেন না। কিন্তু আমাদের জাতি যেন ইতিহাসের প্রতিটি দংশন ভুলে গিয়ে বারবার একই বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত হতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা ভুলে যায় ক্ষত, ভুলে যায় যন্ত্রণা, এমনকি ভুলে যায় সেই প্রতারকদের মুখ, যাদের হাতেই তারা বারবার প্রতারিত হয়েছে। এ জাতির স্মৃতি যেন মরুঝড়ে উড়ে যাওয়া ধূলিকণার মতো। এই দুর্বলতার সুযোগে জাতি আজ পরিণত হয়েছে বহিঃশত্রু ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকারীদের খেলার পুতুল।

পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও সুশাসনের প্রতি দায়বদ্ধতাই তাদের মহত্ত্বের ভিত্তি। তারা তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অযোগ্য ও স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্বের কবল থেকে রক্ষা করতে পেরেছে—আমরা পারিনি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমাদের এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে বাধ্য করে, সাধারণ জনতা, বিশেষত তরুণসমাজ ও ছাত্রশক্তিকে এখনই আত্মপ্রবঞ্চনার ঘোর থেকে জেগে উঠতে হবে।

দেশের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষরা যুগের পর যুগ রক্ত-ঘামে সিঞ্চিত করে গড়ে তুলেছে সভ্যতার ভীত অথচ তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল ভোগ করে এসেছে এক মুষ্টিমেয় স্বার্থান্ধ শাসকচক্র—যারা ভোগ-বিলাস, ক্ষমতার উন্মত্ততা ও উদাসীন ফুর্তির মধ্যে নিজেদের গড়েছে দুর্গম এক শ্রেণি। এই নিষ্ঠুর, বৈষম্যমূলক এবং অলিখিত সমাজদর্শনের অবসান এখন সময়ের দাবি। এই কায়েমি স্বার্থবাদী গুদাম-পচা দর্শনের পরিবর্তে আমাদের গ্রহণ করতে হবে এক নতুন, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সিদ্ধান্ত—যেখানে অবহেলিত হবে না বন্ধু, প্রশংসিত হবে না শত্রু; অপরাধীর থাকবে না রেহাই, আর সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ হবেন না বঞ্চিত বা উপেক্ষিত। প্রয়োজন এমন এক সমাজের, যেখানে নাগরিকরা—ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা ধর্মীয়—সব ধরনের জটিলতার মধ্যেও নিজের চিন্তা, প্রজ্ঞা, মেধা, মনন ও কর্মশক্তিকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করতে পারবেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা হবেন যথার্থভাবে সক্ষম আর রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের সেই সুযোগ করে দিতে হবেÑউন্মুক্ত, অবাধ ও ন্যায়ের আলোয় উদ্ভাসিত করে।

নির্বাচনের বাইরেও জাতি গঠনের ভাবনায় রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বোধের অন্বেষণ জরুরি। একটি জাতির গৌরবময় অগ্রযাত্রা শুধু নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের সামনে যে প্রশ্নগুলো এনে দাঁড় করিয়েছে, তা শুধু একটি নির্বাচনের রোডম্যাপে সমাধানযোগ্য নয়। বরং এই মুহূর্তে জরুরি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক সংস্কার, চিন্তার উৎকর্ষ এবং তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে একটি সেতুবন্ধ গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন একটি অংশ, সামগ্রিক বিষয় নয়। আজ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি একজোট হয়ে দ্রুত একটি নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। গণতন্ত্রে এটি একটি স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত দাবি হলেও, প্রশ্ন হলো—এই নির্বাচন আসলে কী জাতিকে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির পথে নিয়ে যেতে পারবে? অতএব, একটি নির্বাচনের আগে জরুরি হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর আত্মসমালোচনা ও নিজেদের আদর্শগত অবস্থান স্পষ্ট করা। দলীয় রাজনীতির সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

এ দেশের মানুষ বেশি কিছু চায় না—চায় শুধু একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে থাকবে সাম্য, ইনসাফ আর নাগরিক মর্যাদার নিশ্চয়তা। এ চাওয়া কোনো করুণা নয়, এ জাতির জন্মগত অধিকার। এই দাবি দলীয় নয়, এটি গোটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি। আপনি ও আপনার দল সেই প্রত্যাশার প্রতি কতটা নিষ্ঠাবান, এবার সেই বিচার মানুষ নিজের চোখেই দেখতে চায়, বিচার করতে চায়Ñমননে, বিবেকে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে।

লেখক : শিক্ষাবিদ

বিষয়:

আমার দেশ
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত