জাতীয় শিক্ষানীতি কেন সংশোধন প্রয়োজন

মো. মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০: ১৫

আমাদের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং শিক্ষা পদ্ধতি বহুবার পরিবর্তন করা হয়েছে। শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতিও পরিবর্তন করা হয়েছে অনেকবার। প্রতিটি পরিবর্তনের মাধ্যমেই নতুন কিছু সংযোজন ও বিয়োজন ঘটেছে।

সাধারণত প্রতি পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে একবার করে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়ন করতে হয়। জাতীয় শিক্ষানীতিও পরিমার্জনের প্রয়োজন পড়ে। তবে গত কয়েক বছরে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে, তার অনেক কিছুই ছিল অপ্রয়োজনীয়।

বিজ্ঞাপন

কখনো কখনো শুধু রাজনৈতিক কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় বারবার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও সংশোধন করতে গিয়ে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং শিক্ষার গতি-প্রকৃতিই বদলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত শিখন-অর্জনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে প্রবলভাবে। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি নিয়েও বিচিত্র কর্মকাণ্ড ঘটেছে। এসব নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে প্রায়ই অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হতে দেখা গেছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০’ অনুযায়ী একবার পঞ্চম শ্রেণি শেষে সব শিক্ষার্থীর জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সারা দেশে একটি সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণির পড়ালেখা শেষে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা নামে একটি পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের নিয়ম চালু করে। এরপর আবার দুটি পরীক্ষাই বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের যে কী পরিমাণ মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি করা হয়েছে, তা রাজনৈতিক সরকার কখনোই স্বীকার করতে চায় না।

গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ কয়েক বছর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষাবর্ষের মাঝখানে এসে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নতুন নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। কোনো শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই আকস্মিকভাবে পাঠ্যবিষয় ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত। এর কিছুদিন পর আবারো পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসবের পেছনে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অদক্ষতার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছে অনেকবার।

বিনা মূল্যের পাঠ্যবই রচনা, মুদ্রণ ও বিতরণ নিয়েও নানা ধরনের সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। এ নিয়ে প্রায়ই খবর প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ফলে পুরো শিক্ষাবর্ষেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়েছেন এবং এর ফলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দিকটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি কখনোই।

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ঘনঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন এবং শিক্ষাবর্ষের মাঝখানে এসে নানা রকমের নিয়ম চালু করার ফলে শিক্ষাকে একরকম ধ্বংসের মুখে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে বিদ্যমান জাতীয় শিক্ষানীতির উন্নয়ন ও পরিমার্জন এবং শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এখন একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থেই শিক্ষা নিয়ে জাতির ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা চালু ও পরিচালনা করা উচিত। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কী ধরনের হবে, শিক্ষার্থীরা কী শিখবে, কীভাবে শিখবে, কী ধরনের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, শিক্ষার্থীরা কোন স্তরে কত বছর ধরে পড়ালেখা করবে—এসবের একটি বিস্তারিত লিখিত রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।

প্রাজ্ঞ পাঠকরা জানেন, এ রূপরেখাই হলো শিক্ষানীতি। শিক্ষানীতি হতে হবে জাতির চাহিদা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী। যখন কোনো দেশের জনগণের চাহিদা ও ইচ্ছা অনুযায়ী আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার জন্য চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, তখন সেটাই জাতীয় শিক্ষানীতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক ও উন্নত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় শিক্ষা গ্রহণের পরিপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করা শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। একটি ভালো শিক্ষানীতির কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

এগুলো হলো—শিক্ষানীতিতে জাতির শিক্ষা-দর্শন, জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকতে হবে, শিক্ষানীতি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত ও গৃহীত হতে হবে। এসব বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করে কোনো শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলে সেটি ভালো শিক্ষানীতি হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না এবং তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যও হয় না।

এখন পর্যন্ত আমাদের সামনে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি রয়েছে। এ শিক্ষানীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের কাজে হাত দেয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ‘জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০’ প্রণয়ন করলেও তারা এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বা করেনি।

কেন আওয়ামী লীগ একটানা বহু বছর ক্ষমতায় থেকেও নিজের শাসনামলে প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করেনি, তার কারণও জানা যায়নি। ২০১০ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত অর্থাৎ দীর্ঘ ১৪ বছর পরও জাতির কাছে এই একটি শিক্ষানীতিই রয়েছে। অথচ একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে জাতীয় শিক্ষানীতিও পরিমার্জন ও উন্নয়ন করা জরুরি ছিল, কিন্তু সেটি এখন পর্যন্ত করা হয়নি। প্রশ্ন হলো, এটি করবে কে—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নাকি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার? বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতির স্বার্থেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০’ নিয়ে ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়। এরপর রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে। সরকারও এসব দাবি বিবেচনায় নিয়ে এবং রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য অনেকগুলো কমিশন গঠন করে। এরই মধ্যে বেশিরভাগ কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে দাখিল করেছে।

কিন্তু আমরা অত্যন্ত আশাহত হয়ে লক্ষ করছি, শিক্ষা দেশের অন্যতম বৃহৎ এবং শিক্ষিত জাতি গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান খাত হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কমিশন বা কোনো কমিটিও গঠিত হয়নি। এমনকি জাতীয় শিক্ষা দর্শনের প্রতিফলন থাকে যে শিক্ষানীতিতে, ১৪ বছর আগের সেই শিক্ষানীতির পরিমার্জন বা উন্নয়নের জন্যও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

অথচ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষানীতি জাতির সামনে থাকা অপরিহার্য। কারণ জাতীয় শিক্ষানীতি ছাড়া শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, পরিমার্জন বা উন্নয়ন কোনোটিই কার্যকরভাবে সফল হতে পারে না। এ অবস্থায় জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমের গুরুত্ব বিবেচনা করে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করি।

লেখক : সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত