নতুন বছরে, অর্থাৎ ২০২৬ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেবে, তার ওপর গভীর নজর রাখছেন বিশ্লেষকরা। ২০২৬ সাল শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে দুর্বল যুদ্ধবিরতি, গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার অভিযান পূর্ণগতিতে আবার শুরু হওয়ার আশঙ্কা, সিরিয়ার নতুন সরকারের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো এবং ইয়েমেনের সংঘাত আঞ্চলিক ভূরাজনীতির গতি-প্রকৃতি দ্রুত বদলে দিতে পারে।
নতুন বছরে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে আরো অপ্রতিরোধ্য আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে তার উত্থানকে জোরদারের চেষ্টা করবে। দেশটি কীভাবে ইরান ও তাদের সমর্থিত অবশিষ্ট ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ মুখোমুখি হবে, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একই সঙ্গে বাশার আল আসাদ-পরবর্তী সিরিয়াকে আয়ত্তের মধ্যে রাখতে ইসরাইল কতটুকু শক্তি প্রয়োগ করবে, তা এই অঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে।
ইরান-ইসরাইল ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি
২০২৫ সালের জুনে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে ১২ দিনের যুদ্ধের অবসান ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়। ছয় মাস ধরে এই যুদ্ধবিরতি বহাল থাকলেও নতুন বছরে তা যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। এতদিন ইরানে হামলার পক্ষে ইসরাইলি এবং আমেরিকান নব্য-রক্ষণশীলদের যুক্তিগুলোর মূলে ছিল দেশটির পারমাণবিক হুমকি। কিন্তু তাদের দৃষ্টি এখন নিবদ্ধ হয়েছে তেহরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার ওপর।
এর কারণ ইরানের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র মহড়া। ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির ২০ ডিসেম্বর মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল ব্র্যাড কুপারকে বলেছেন, ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র মহড়া নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। এই মহড়া ইসরাইলে ইরানের আকস্মিক হামলার প্রস্তুতিকে আড়াল করতে পারে বলে তার আশঙ্কা।
এই যুদ্ধবিরতিকে ‘অবিশ্বাস্যভাবে দুর্বল’ বর্ণনা করে আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রেসিডেন্ট ফেলো ড. হুসেইন ইবিশ বলেন, ‘ইরানে হামলা আবার শুরু করতে আগ্রহী ইসরাইল এবং তারা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে এটি করার চেষ্টা করতে পারে।’
অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক ড. থমাস জুনো মনে করেন, নতুন হামলার মাধ্যমে ইরানকে আরো দুর্বল করার সুযোগ কাজে লাগাতে নেতানিয়াহুর সরকার নতুন বছরে দেশের ভেতর থেকেই চাপের মুখে থাকবে।
ইরানের সঙ্গে সংঘাত পুনরুজ্জীবিত করার নেতানিয়াহুর চাপে হোয়াইট হাউস রাজি হবে কি নাÑসেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ সম্পর্কে ড. জুনোর পর্যবেক্ষণ হলোÑট্রাম্প একজন ‘আনপ্রেডিকটেবল’ মানুষ, তার মনোভাব আগে থেকে অনুমান করা কঠিন। তিনি ইরানে হামলার বিষয়ে নেতানিয়াহুকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, নাকি উৎসাহিত করবেন, তা আগাম বলা সম্ভব নয়।
আঙ্কারাভিত্তিক থিংক ট্যাংক ওসরামের গালফ স্টাডিজ কো-অর্ডিনেটর ড. গোখান এরেলি বলেছেন, ইসরাইল এবং ইরানকে একটি যুদ্ধবিরতিতে আনার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু দেশ দুটির মধ্যে নতুন বছরে সংঘাত আবার শুরুর জন্য যেসব উপাদান বা কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো এখনো আছে। মার্কিন রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ এগুলোর সমাধান করতে পারবে না।
গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে অনিশ্চয়তা
২০২৬ সালে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করবেÑএমনটি ভাবা অবাস্তব। তবে, নতুন বছরের জন্য মূল প্রশ্ন হলোÑট্রাম্পের ‘শান্তি উদ্যোগ’ ইসরাইলের অব্যাহতভাবে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের মধ্যে এগিয়ে যাবে, নাকি যুদ্ধবিরতিই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে গণহত্যার পথ আবার উন্মুক্ত করবে? ১০ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি বাহিনী এ পর্যন্ত ৭৩০ বারের বেশি তা লঙ্ঘন করেছে এবং এসব হামলায় ৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর মিয়ামিতে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতার এবং তুরস্কের প্রতিনিধিদের বৈঠক যৌথ বিবৃতি দিয়ে শেষ হয়েছে। এতে সব পক্ষকে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু ইসরাইলের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে তা বহাল থাকার আশা খুবই কম। ট্রাম্পের শান্তি উদ্যোগও তা বহাল রাখতে পারবে না।
চ্যালেঞ্জে সিরিয়ার নতুন সরকার
বাশার আল-আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ার নতুন সরকার দ্বিতীয় বছরে পা রেখেছে। ২০২৬ সালের প্রথমদিকের মাসগুলোতেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে, প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সরকার তার একক নিয়ন্ত্রণে দেশে কতটা স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেশটির অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে ইসরাইলি আগ্রাসন, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পুনরুত্থান এবং দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সরকারের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়গুলো।
ড. হুসেইন ইবিশ মনে করেন, ‘নতুন সিরিয়া’র সরকার দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল, কেন্দ্রীভূত এবং সফল রাষ্ট্রে পরিণত করার সক্ষমতা কতটুকু দেখাতে পারবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইসরাইল যদি তার পথে চলে এবং সিরিয়া বিশৃঙ্খল এবং খণ্ডিতই থাকে, তাহলে দেশটিতে অস্থিতিশীলতা কাটবে না। তবে, এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখা গেছে, তাতে বলা যায়, নতুন সরকার কিছুটা হলেও আস্থা তৈরি করছে সবার মনে।’
২০২৬ সালে এবং তার পরও সিরিয়ার স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা নির্ভর করবে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি), তুরস্ক এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থনের ওপর। এসব দেশ সিরিয়াকে স্থিতিশীল করতে নতুন সরকারকে সহায়তা দিয়েছে। ইসরাইলি বিরোধিতা সত্ত্বেও এসব দেশ সিরিয়ার ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে হোয়াইট হাউসে সফলভাবে লবিং করেছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আগামী দিনের পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে, তার ওপর নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বা তুরস্ক এবং আরব দেশগুলোর মধ্যে নতুন প্রতিযোগিতা পরিস্থিতিকে ভিন্নরূপ দিতে পারে।
ড. হুসেইন ইবিশ বলেন, ‘নতুন সিরিয়াকে মেনে নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানোর ক্ষেত্রে ইসরাইলের ওপর সৌদি আরবের জয় আরব কূটনীতির এক অসাধারণ বিজয় ছিল। ট্রাম্পের সিরিয়ানীতি তার পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়, যা একজন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করতেন না।’
তিনি আরো বলেন, ‘একটি স্থিতিশীল এবং কার্যকর কেন্দ্রীভূত সিরিয়া পুনর্গঠনের জন্য তুরস্ক-সৌদি জোটের প্রচেষ্টা ভালো ফল দিতে পারে।
সুদান ও ইয়েমেন নিয়ে আমিরাত-সৌদি দ্বন্দ্ব
২০২৬ সালে আঞ্চলিক নেতৃত্বের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং সৌদি আরবের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং এ ক্ষেত্রে সুদান এবং দক্ষিণ ইয়েমেন সংঘাত এই দ্বন্দ্বে মূল ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। গত অক্টোবরের শেষের দিকে সুদানের এল-ফাশারে ইউএই সমর্থিত র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) গণহত্যার পর সুদানে বিশ্ববাসীর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়। একই সঙ্গে আরএসএফকে সমর্থন করার জন্য ইউএই পশ্চিমা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে।
আরএসএফকে সশস্ত্র করার জন্য আমিরাতের কৌশলের মধ্যে আছে লোহিত সাগর এবং হর্ন অব আফ্রিকা হিসেবে পরিচিত অঞ্চলে নিজের একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। অন্যদিকে, সৌদি আরব সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) প্রতি সমর্থন দিয়েছে, যা উপসাগরীয় দুটি প্রভাবশালী দুটি রাজতন্ত্রকে বিরোধে জড়িয়েছে। অথচ দেশ দুটি ছিল একসময় ঘনিষ্ঠ মিত্র।
রিয়াদ আরএসএফের পরিবর্তে সুদান সশস্ত্র বাহিনীর মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করে। তারা সুদানে একটি সুসংহত শাসন কর্তৃপক্ষ চান, যা লোহিত সাগরের বন্দরগুলোকে সুরক্ষিত করতে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম হবে। সুদানে যুদ্ধ অব্যাহত থাকায় দেশটি নিয়ে সৌদি-আমিরাতের প্রতিযোগিতা বাড়বে, যা উপসাগরীয় এই দুটি শক্তিধর দেশের মধ্যে সম্পর্কে আরো ফাটল ধরাবে।
এদিকে, ইয়েমেন নিয়েও সৌদি-আমিরাত দ্বন্দ্ব বাড়ছে। সেখানে আরব আমিরাত-সমর্থিত দক্ষিণ ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এসটিসি) হুতিদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের প্রায় সব এলাকা দখল করেছে। এই সংঘাত এখন দেশটিতে আবুধাবি ও রিয়াদের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় মূল ইস্যু হয়ে উঠেছে। সৌদি আরব বহু বছর ধরে একীভূত ইয়েমেনের পক্ষে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসটিসির বিশাল এলাকা দখলকে ইয়েমেনের আবার উত্তর-দক্ষিণে ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করে রিয়াদ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সুদান এবং ইয়েমেনের সংঘাত নতুন বছরে সৌদি-আমিরাত সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। অস্ট্রিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির সিনিয়র উপদেষ্টা উলফগ্যাং পুসতাই বলেন, ‘ইয়েমেন এবং সুদানের সংঘাতময় পরিস্থিতি সৌদি-আমিরাত সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে।’ তবে ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই মিত্র দেশের মধ্যে বৈরিতার অবসান ঘটানোর চেষ্টা করবে।
এই পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় খেলোয়াড়রা, তুরস্কসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলো যদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করে, তবু তা কতটুকু ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
দ্য নিউ আরব থেকে ভাষান্তর, মোতালেব জামালী
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

