হাসিনা-মোদির হাতে জলিলের ‘ট্রাম্প কার্ড’

এম এ নোমান
প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০: ৫৯

আবার আলোচনায় সেই ‘ট্রাম্প কার্ড’। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে ট্রাম্প কার্ড খেলে বিএনপি সরকারের পতন ঘটানোর ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিতে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। সেই ট্রাম্প কার্ডটি আবার আলোচনায় আনলেন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনা ও সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনার একের পর এক ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে। এসব ফোনালাপের একটিতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে হটাতে ‘ট্রাম্প কার্ড’ খেলার ফরমুলা দিতে শোনা যায় তাকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি-সংবলিত পোস্টার ও ফেস্টুন নিয়ে ঢাকায় মিছিল করার এবং ট্রাম্পের ছবি পোড়ানোর নির্দেশনা দেন দলটির পালিয়ে থাকা নেতাকর্মীদের।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শেখ হাসিনার পক্ষ হয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করতে গিয়ে ‘ওভার ট্রাম্পের’ শিকার হয়ে নাস্তানাবুদ হলেন নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চোখে-মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে ট্রাম্প মোদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘উনি তো কয়েক শ বছর ধরে বাংলাদেশকে নিয়ে কাজ করছেন। ওই দেশ নিয়ে (প্রশ্নের) জবাবও তিনিই দেবেন।’

জলিলের ট্রাম্প কার্ড

২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে হঠাৎ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সেখানে ঘোষণা দেন ‘আগামী ৩০ এপ্রিল বিএনপি সরকারের পতন হবে’। এ সময় বেঁধে দেওয়ার ভিত্তি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আবদুল জলিল জানিয়েছিলেন, ‘আমার হাতে একটি ট্রাম্প কার্ড রয়েছে। ওইদিন আমি এটি ছুড়ব। তাতেই বিএনপি সরকারের পতন হবে।’

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এমন ট্রাম্প কার্ডের ঘোষণায় তৎকালীন সরকারসহ পুরো জাতি নড়েচড়ে বসে। সাংবাদিকরা প্রতিদিনই এ বিষয় নিয়ে তার শরণাপন্ন হন। তিনিও অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই ৩০ এপ্রিল তার হাতে থাকা ‘ট্রাম্প কার্ড’ খেলবেন বলে সাংবাদিকদের নিশ্চয়তা দেন। তবে সাংবাদিকরা অনেক পীড়াপীড়ি করলে তিনি সেই ‘ট্রাম্প কার্ড’ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে বলতেন, ‘৩০ এপ্রিলই সেটি দেখতে পাবেন। আমরা সরকার পতন উদযাপন করব।’

আবদুল জলিলের সেই ট্রাম্প কার্ড নিয়ে আগের দিন ২৯ এপ্রিল চারদিকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অন্যদিকে তিনিও ট্রাম্প কার্ড নিয়ে অতি আত্মবিশ্বাসে নিজের অবস্থানে অটল। অবশেষে ৩০ এপ্রিল অন্য দিনগুলোর মতোই পূর্বদিগন্তে দেখা দেয় সূর্য। তা দুপুর গড়িয়ে বিকেলের নরম গোধূলি পেরিয়ে পশ্চিমাকাশে অস্ত যায়। কিন্তু জলিলের সেই ট্রাম্প কার্ডের কোনো লক্ষণ দেখা মেলে না কোথাও। জলিলের ট্রাম্প কার্ড চ্যালেঞ্জ সুপার ফ্লপ হওয়ার ঘটনা নিয়ে দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে পরদিন লিড স্টোরি করা হয়। অন্যদিকে, রাজনৈতিক মহলসহ সব মহলে হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হন আবদুল জলিল।

যেভাবে হাসিনার হাতে এলো সেই ট্রাম্প কার্ড

আবদুল জলিল এখন বেঁচে নেই। তবে তার সেই বহুল আলোচিত ট্রাম্প কার্ড ফের আলোচনায় দুই দশক পর। এবারের ট্রাম্প কার্ড খেলার দায়িত্ব নিয়েছেন শেখ হাসিনা নিজে।

শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া ফোনালাপে অপর প্রান্ত থেকে ‘আপা’ বলতে শোনা যায়। শেখ হাসিনা ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচিতে ব্যানার ও পোস্টারে ‘জাতির জনক’ ও ‘নেত্রী শেখ হাসিনা’র ছবির পরিবর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি দেওয়ার নির্দেশ দেন।

তিনি বলেন, তোমরা আমার ও জাতির জনকের ছবির পরিবর্তে ট্রাম্পের ছবি দিয়ে পোস্টার বানিয়ে রাস্তায় মিছিল করবে। সরকার মিছিলে হামলা করলে তোমরা ছবি তুলবে। আগেই ক্যামেরাপারসন ঠিক করে রাখবে। ওই ছবি আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। আমি সেগুলো ট্রাম্পের কাছে পাঠিয়ে দেব। ট্রাম্পের সঙ্গে আমার ভালো যোগাযোগ আছে। এরপর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে সেই ‘ট্রাম্প কার্ড’। শেখ হাসিনার এ নির্দেশনার পর সেই রাতেই রাজধানী থেকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ১০ কর্মীকে ট্রাম্পের ছবি-সংবলিত ফেস্টুনসহ আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ দফা ব্যর্থ হয় শেখ হাসিনার ট্রাম্প কার্ড খেলা।

ওভার ট্রাম্প কার্ডের শিকার হলেন মোদি

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ছিল বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সেদিন ভারতীয় সময় সকাল ৯টার দিকে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানো, এফ৩৫ যুদ্ধ বিমান বিক্রিসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে থাকা ভারতীয় নাগরিকদের ফেরত পাঠানো, শুল্ক আরোপ কিংবা মোদির বন্ধু আদানির ওপর আরোপিত ‘খড়্‌গ’ নামানোর বিষয়ে ট্রাম্প কোনো আশ্বাস দেননি বলেই ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে। হোয়াইট হাউসে ক্ষুদ্র পরিসরে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের একজন সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘আপনি বাংলাদেশ বিষয়ে কী বলতে চান? কেননা আমরা দেখেছি এবং এটা স্পষ্ট যে, বাইডেন প্রশাসনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেট ক্ষমতার পরিবর্তনে জড়িত ছিল; এরপর জুনিয়র সরোসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সুতরাং বাংলাদেশের বিষয়ে আপনার অভিমত কী?’

এর জবাবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা সরাসরি নাকচ করে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘সেখানে আমাদের ডিপ স্টেটের কোনো ভূমিকা ছিল না। এটা এমন একটা বিষয়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।’ এরপর নরেন্দ্র মোদির দিকে ইঙ্গিত করে ট্রাম্প বলেন, তিনি সেখানে শতশত বছর ধরে কাজ করেছেন। আমি বাংলাদেশের বিষয়টি (জবাব দেওয়ার জন্য) তার ওপর ছেড়ে দেব।’

এরপর নরেন্দ্র মোদি জবাব দিতে গিয়ে ট্রাম্পের বিরক্তি ভাব দেখে আর বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি আনলেনই না। তিনি ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ভারতের অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্য দেন।

লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক আমার দেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত