বাম ও ডান : মতাদর্শ নাকি রাজনৈতিক লেবেল

ড. হাসান মাহমুদ
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৫১
ড. হাসান মাহমুদ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাম ও ডানপন্থি রাজনীতি এবং দল নিয়ে অনেক সময়ই আলাপ-আলোচনা চলে। রাজনীতির আলোচনা বা বিতর্কে ‘বাম’ ও ‘ডান’—এই দুটি শব্দ আজ সারা বিশ্বেই প্রচলিত, তবু সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর। কখনো এগুলো মতাদর্শের প্রতীক, কখনো আবার শুধুই রাজনৈতিক দলের পরিচিতি। ইতিহাসে এই বিভাজন দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে; কিন্তু আসলে এই বিভাজন কতটা মতাদর্শিক এবং কতটা রাজনৈতিক?

বিজ্ঞাপন

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য ১৯৮৩ সালে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসের আরিয়ান (Asher Arian) ও মিখাল শামির (Michal Shamir) তাদের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘The Primarily Political Functions of the Left-Right Continuum’-এ দেখিয়েছিলেন, বাম ও ডান আসলে মতাদর্শিক বিভাজন নয়। এগুলো মূলত ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের চিহ্ন বা লেবেল। এই প্রবন্ধে তাদের বিশ্লেষণ অনুসরণ করে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাম ও ডান ধারণাগুলো কীভাবে কাজ করে, তা বিশ্লেষণ করব।

বাম ও ডানের সংজ্ঞা ও ঐতিহাসিক উৎস

বাম ও ডান শব্দ দুটি প্রথম ব্যবহার হয় ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) সময়। ফরাসি রাজা ষোড়শ লুইয়ের সংসদীয় অধিবেশনে যারা সামন্তব্যবস্থার বিরোধী ও পরিবর্তনকামী ছিলেন, তারা রাজাসনের বাম পাশে বসতেন আর যারা রাজতন্ত্র ও প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তারা বসতেন ডান পাশে। সেখান থেকেই ‘বামপন্থি’ মানে পরিবর্তন ও সমতার পক্ষে এবং ‘ডানপন্থি’ মানে স্থিতাবস্থা ও ঐতিহ্যের পক্ষেÑএই অর্থটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাজনৈতিকভাবে, ‘বামপন্থা (Left)’ বোঝায় সমতা, সমাজকল্যাণ, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও পরিবর্তনের প্রতি সহনশীলতা; অন্যদিকে ‘ডানপন্থা (Right)’ বোঝায় ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাজার অর্থনীতি, ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ এবং ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য।

কিন্তু আরিয়ান ও শামিরের মতে, এই তাত্ত্বিক অর্থ বাস্তব রাজনীতিতে প্রায়ই অস্পষ্ট হয়ে যায়। অধিকাংশ নাগরিকের জন্য বাম ও ডান মানে কোনো সুগঠিত মতাদর্শ নয়; বরং এটি তাদের দলীয় পরিচয় অথবা রাজনৈতিক অবস্থান বোঝানোর একটি শর্টকাট। তাদের ভাষায়, ‘The left-right continuum denotes a party space, not an ideological space.’Ñঅর্থাৎ বাম বা ডান আদতে দলীয় পরিচয়কে প্রকাশ করে, কোনো মতাদর্শিক অবস্থানকে না। মানুষ যেই দলকে ভোট দেয়, সেই দলের পরিচয় থেকেই নিজেদের বাম বা ডান হিসেবে চিহ্নিত করে। অর্থাৎ, কমিউনিস্ট পার্টিকে ভোট দেয় বলেই কোনো ব্যক্তি নিজেকে ‘বামপন্থি’ হিসেবে পরিচয় দেয়, বামপন্থি আদর্শের সঙ্গে তার কোনো ধরনের সম্পর্ক বা বোঝাপড়া না থাকলেও।

মতাদর্শিক বনাম রাজনৈতিক কার্যকারিতা

আরিয়ান ও শামির ‘বাম-ডান বিভাজন’-এর দুটি প্রধান কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করেছেন—

বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নমূলক কার্য (Object Appraisal Function) এবং সামাজিক-পরিচয়মূলক কার্যÑ

(Social Adjustment Function)

প্রথমটি মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক ও মতাদর্শিক—মানুষ এই স্কেলের মাধ্যমে রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করে। কিন্তু দ্বিতীয়টি সামাজিক ও সম্পর্কভিত্তিক—মানুষ এই লেবেলের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক দল, পরিবার, বা সমাজগোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় স্থাপন করে। আরিয়ান ও শামিরের মতে, বাস্তব রাজনীতিতে এই দ্বিতীয় অর্থটাই বেশি কার্যকর। অধিকাংশ মানুষ ‘বাম’ বা ‘ডান’ হয়ে ওঠে তাদের দলীয় পরিচয়, সামাজিক বন্ধন ও মিডিয়ার সংকেত অনুসারে, মতাদর্শিক বিশ্লেষণ অনুসারে নয়।

ইসরাইলের রাজনীতি নিয়ে তাদের গবেষণায় দেখা যায়—দেশটি যত বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক (competitive) হয়েছে, ততই বাম-ডান শব্দ দুটি বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এই বর্ধিত ব্যবহার মতাদর্শিক নয়, রাজনৈতিক। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিস্থিতিতে দলগুলো তাদের সমর্থকদের একত্র করতে ‘বাম’ বা ‘ডান’ লেবেল ব্যবহার করে, যাতে ভোটাররা দ্রুত বুঝতে পারে ‘আমাদের’ দল কোনটি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাম ও ডান

বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষণেও এই তত্ত্বটি যথাযথভাবে প্রযোজ্য। এখানকার ‘বাম’ ও ‘ডান’ বিভাজন মূলত মতাদর্শ নয়, বরং ইতিহাস, দলীয় আনুগত্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিফলন। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি প্রধান শক্তি—আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল— (নিজ নিজ ইতিহাস ও বর্ণনার ভিত্তিতে বাম ও ডান পরিচয় গড়ে তুলেছে, যদিও বাস্তবে তাদের অর্থনৈতিক নীতি বা রাষ্ট্রচিন্তায় খুব বেশি পার্থক্য নেই।

ক. বাংলাদেশের বাম : সমাজতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপুঁজিবাদে

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে বাম রাজনীতি ছিল রাষ্ট্রনির্মাণের কেন্দ্রবিন্দুতে। সংবিধানের চার মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই বাম ভাবধারার প্রতীক ছিল। আওয়ামী লীগ নিজেকে সেই ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে তুলে ধরে এবং সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দেয়। ছোট বাম দলগুলো যেমন কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বিএসডি) ইত্যাদি মার্ক্সবাদী মতাদর্শে বিশ্বাস করলেও ক্ষমতার রাজনীতিতে তারা প্রান্তিক থেকে গেছে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘বামপন্থা’ অনেকটাই প্রতীকী বা আচারগত হয়ে গেছে। একদিকে দলটি এখন নিজেকে ‘সেক্যুলার ও প্রগতিশীল’ হিসেবে উপস্থাপন করে, অন্যদিকে এর অর্থনৈতিক নীতি স্পষ্টভাবে নব্যউদারবাদী (neoliberal)—ব্যক্তি খাত, রপ্তানিনির্ভর শিল্প এবং বৈদেশিক বিনিয়োগে জোর দেয়। রাজনৈতিক পরিভাষায় এটি এক ধরনের রাষ্ট্রপুঁজিবাদ, যেখানে সরকারি ক্ষমতা ও করপোরেট স্বার্থ পরস্পর নির্ভরশীল। ফলে ‘বাম’ শব্দটি এখন মতাদর্শ নয়, বরং রাষ্ট্রক্ষমতার বৈধতা ও নৈতিক আধিপত্যের লেবেল। ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’, ‘প্রগতিশীল শক্তি’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ জনগণের কাছে একটি আবেগীয় সংকেত হিসেবে কাজ করে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের নৈতিকভাবে উচ্চতর প্রমাণ করতে চায়।

খ. বাংলাদেশের ডান : ধর্ম, জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা

অন্যদিকে ‘ডানপন্থা’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূলত ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের মাধ্যমে চিহ্নিত। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণা তুলে ধরে, যা আওয়ামী লীগের ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর বিকল্প বর্ণনা। এই ধারণায় ইসলামি ঐতিহ্য, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সামরিক শৃঙ্খলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে গ্রামীণ ও ধর্মনির্ভর সমাজের এক বৃহৎ অংশের আবেগ প্রতিফলিত হয়।

বিএনপির সঙ্গে ইসলামি দলগুলোর যেমন জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক মিত্রতা, ‘ডানপন্থা’ শব্দটিকে বাংলাদেশে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও নৈতিক জাতীয়তাবাদের প্রতীক বানিয়েছে। তবে অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে তফাত প্রায় নেই—উভয়েই মুক্তবাজার, বেসরকারীকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং বাংলাদেশের ‘ডানপন্থা’ পশ্চিমা অর্থে অর্থনৈতিক রক্ষণশীলতা নয়, বরং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান।

৪. রাজনৈতিক লেবেল হিসেবে বাম-ডান বিভাজন

আরিয়ান ও শামির যেমন ইসরাইলের ক্ষেত্রে দেখিয়েছিলেন, বাংলাদেশেও ‘বাম’ ও ‘ডান’ বিভাজন মূলত দলীয় রাজনীতির প্রতীকী ক্ষেত্র তৈরি করে। নিচের টেবিলটিতে এর কার্যকারিতা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—

কার্যকারিতা বাংলাদেশের উদাহরণ

লেবেলিং আওয়ামী লীগ ‘বাম’, ‘প্রগতিশীল’ বা ‘মুক্তিযুদ্ধপন্থি’; বিএনপি ‘ডান’, ‘ইসলামি’ বা ‘জাতীয়তাবাদী’ বলে পরিচিত।

সামাজিক পরিচয় : নাগরিকরা এই লেবেলগুলো ব্যবহার করে নিজেদের সামাজিক ও নৈতিক অবস্থান প্রকাশ করে—যেমন : ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে’, ‘আমরা ধর্মীয় ঐতিহ্যের পক্ষে’ ইত্যাদি।

রাজনৈতিক সংকেত : নির্বাচনের আগে দলগুলো ‘সেক্যুলার বনাম ইসলামপন্থি’, ‘দেশপ্রেমিক বনাম দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি ভাষায় সমর্থকদের একত্র করে।

মতাদর্শিক সামঞ্জস্য : খুবই সীমিত—উভয় প্রধান দল একই নব্যউদার অর্থনীতি ও আমলাতান্ত্রিক রাজনীতি অনুসরণ করে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘বাম-ডান- শব্দ দুটি তাই মূলত নৈতিক ও ঐতিহাসিক অবস্থান বোঝায়, মতাদর্শিক নীতি বা অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়।

Politics

সমকালীন রাজনীতিতে বাম-ডান বিভাজনের ব্যবহার

ক. ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা

আওয়ামী লীগ নিজেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘বাম’ দল হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ইসলামি প্রতীক ও ভাষা ব্যবহার করে। অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক মূল্যবোধ হিসেবে প্রচার করে, কিন্তু তারা ক্ষমতায় থাকলেও সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ধারা পুরোপুরি বিলোপ করেনি। তাই ধর্ম-ধর্মনিরপেক্ষতার এই সংঘাত মূলত প্রতীকী ও রাজনৈতিক, মতাদর্শিক নয়।

খ. অর্থনীতি ও উন্নয়ননীতি

উভয় দলই একই অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করে—বৈদেশিক বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স, রপ্তানিমুখী শিল্প এবং বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পে জোর দেয়। কারোই প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক বা কল্যাণমূলক অর্থনীতি নেই। ফলে ‘বাম’ ও ‘ডান’-এর বিভাজন এখানে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতীক।

গ. গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবিতা চর্চা

আওয়ামীপন্থি মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের ‘বাম’, ‘প্রগতিশীল’, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ বলে পরিচয় দেন এবং ভিন্নমতকে ‘ডান’, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বা ‘আত্মঘাতী ইসলামপন্থি’ হিসেবে আখ্যা দেন। বিপরীতে বিরোধী পক্ষ আওয়ামী লীগকে ‘ভণ্ড বাম’, ‘স্বৈরাচারী’ ও ‘অধার্মিক’ বলে চিহ্নিত করে। ফলে এখানে ‘বাম’ ও ‘ডান’ নৈতিক বিচারবোধের ভাষা হয়ে দাঁড়ায়, রাজনৈতিক মতাদর্শের নয়।

ঘ. ছাত্ররাজনীতি

ছাত্রলীগ (আওয়ামী লীগ) ও ছাত্রদল (বিএনপি)—উভয়ই দলীয় স্বার্থে পরিচালিত, কিন্তু নামমাত্র বাম-ডান পরিচয় বহন করে। তাদের রাজনীতি প্রায়ই পৃষ্ঠপোষকতা, দখল ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হিংসাকেন্দ্রিক, মতাদর্শিক নয়।

মতাদর্শ নয়, সামাজিক অবস্থান

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘বাম-ডান’ তাই মূলত একটি সামাজিক অবস্থান বা পরিচয়ের বিষয়। এখানে ভোটাররা নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে তারা কার পক্ষে বা কার বিরুদ্ধে—এই ভিত্তিতে, এইটা না যে তারা কোনো আদর্শে বিশ্বাস করে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন মানুষ নিজেকে ‘বাম’ বলবেন কারণ তিনি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন অথবা ‘ডান’ বলবেন কারণ তিনি ইসলামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক বা সামাজিক নীতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শিক অবস্থান প্রায়ই থাকে না।

এই পরিস্থিতি একদিকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে তীব্র করে তোলে, অন্যদিকে মতাদর্শিক বিতর্ক ও বৌদ্ধিক চর্চাকে দুর্বল করে। বাংলাদেশে তাই ‘বাম-ডান’ মানে প্রায়ই ‘আমরা বনাম তারা’, একটি নৈতিক বিভাজন—যেখানে রাষ্ট্র, দল ও জাতীয় ইতিহাস মিলেমিশে এক ধরনের রাজনৈতিক নৈতিকতা তৈরি করে।

আরিয়ান ও শামিরের তত্ত্ব আজও বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝার জন্য আশ্চর্যভাবে প্রাসঙ্গিক। তাদের যুক্তি অনুযায়ী, বাম-ডান বিভাজন আসলে একটি রাজনৈতিক কার্যকর উপকরণ, যার মাধ্যমে দলগুলো জনগণের সমর্থন সংগঠিত করে, ভোটাররা নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে এবং সমাজে ‘নৈতিক বৈধতা’ গঠন করে। কিন্তু এর ভেতরে প্রকৃত মতাদর্শিক গভীরতা খুবই সীমিত।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় ‘বাম’ মানে মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয় রাজনীতিতে নৈতিক কর্তৃত্বের পক্ষে থাকা; ‘ডান’ মানে ইসলামি মূল্যবোধ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের পক্ষে থাকা। তবে উভয় ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক নীতি, প্রশাসনিক কাঠামো ও রাজনৈতিক চর্চা প্রায় অভিন্ন।

ফলে ‘বাম’ ও ‘ডান’ এখানে কোনো বিপরীত মতাদর্শের প্রতীক নয়, বরং দলীয় আনুগত্য ও সামাজিক পরিচয়ের সূচক। নাগরিকরা নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করেন ইতিহাস, স্মৃতি ও সামাজিক আনুগত্যের ভিত্তিতে, নীতিগত বিতর্কের মাধ্যমে নয়।

যেমন আরিয়ান ও শামির ইসরাইলের ক্ষেত্রে দেখিয়েছিলেন, ‘left and right represent a political space, not an ideological space’, বাংলাদেশেও একই বাস্তবতা দৃশ্যমান। বাম ও ডান শব্দ দুটি আমাদের রাজনীতিকে দিকনির্দেশনা দেয়, কিন্তু সেই দিকটি মূলত দলীয় আনুগত্য ও নৈতিক পরিচয়ের, মতাদর্শিক নয়। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাম ও ডান একে অন্যের প্রতিপক্ষ হলেও তাদের মধ্যকার পার্থক্য মূলত ভাষার, ক্ষমতার ও বৈধতার, মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির নয়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কাতার

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত