
মারুফ কামাল খান

হাসিনা যখন এই তল্লাটে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজ্যপাট চালাতেন, তখনকার কত সহস্র দুঃসহ স্মৃতি শাসিত, শোষিত, নিপীড়িত মানুষের মাথায়, মনে কিলবিল করে। হয়তো আরো অনেককালই করবে। মনে পড়ে কি সেই দিনগুলোর কথা? মানবসভ্যতার এক ভয়ংকর মহামারি করোনার ছোবলে পুরো জাতি যখন ক্ষতবিক্ষত, অনাহার, অর্ধাহারে যখন দুঃখী অগণিত মানুষের দিনলিপি, কাজের সংস্থান হারিয়ে এবং বাড়িভাড়া শোধে ব্যর্থ হয়ে হাজার হাজার পরিবার যখন রাজধানী ছেড়ে গাঁয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছিল, সেই ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে না-উঠতেই হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মচ্ছবের কথা মনে পড়ে কি? ঢাকাই নাটক-সিনেমার নট-নটিনীদের হাসিনা গণভবন নামক তার রানিনিবাসে প্রমোদ-সম্মিলনে একত্র করেছিলেন। ওরা সবাই ছিল তার তাঁবেদার। হাসিনার প্রহসনের ভোটরঙ্গে ওরা রঙঢঙ করত। খালেদা জিয়াকে তার অফিসে তিন মাস ধরে আটকে রাখার সময়ে ওরা সেখানে মাঝে-মাঝে যেত ঘেরাও করতে। যা-হোক, গণভবনে আয়োজিত এক আনন্দলীলার কথা বলছি। সেখানে হাসিনা ও তার বোন রেহানা সবার সঙ্গে প্রমোদে মন ঢেলে দিয়ে ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের তালে তালে হেলেদুলে করতালি বাজাচ্ছিলেন। আর অনেকে নিতম্ব দুলিয়ে নেচেছিলেন।
রাজকীয় উৎসবে গাওয়ার পর ওই গান আমিও পরম কৌতূহল নিয়ে শুনেছিলাম। ওই গানের স্থায়ী বা মুখড়া থেকে শুরু করে অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ পর্যন্ত পুরোটাই আমি গভীর অভিনিবেশ সহকারে শুনে মুখস্থ করে ফেলি।
‘তুমি বন্ধু কালা পাখি
আমি যেন কি?
বসন্ত কালে তোমায়
বলতে পারিনি।
সাদা সাদা কালা কালা
রং জমেছে সাদা কালা,
হইছি আমি মন পাগেলা
বসন্ত কালে...।’
এসব গভীর তত্ত্বকথার অর্থ, মোজেজা, শানে নজুলÑকিছুই আমার মাথায় ঢোকেনি। শুধু জেনেছি ‘হাওয়া’ নামের এক সিনেমার গান এটি। এই গান নিয়ে হলো আরেক অবাক কাণ্ড। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি তার বিদায়ি অনুষ্ঠানেও এই গান গেয়ে মাতিয়ে তোলেন দর্শক-শ্রোতাদের।
এরপর পড়ে গেলাম বিষম ধাঁধায়। হাসিনার আসরের এ গানের সঙ্গে বিদায়ি রাষ্ট্রদূতের যোগসূত্র কোথায়?
শুধু গান গেয়েই নয়, রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি আরেকটি নজিরবিহীন কাণ্ড করেছিলেন। জাপানের কোনো রাষ্ট্রদূত কখনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করেন না। সেই রীতি ভেঙে ফেলেন ইতো নাওকি। হাসিনার অধীনে ২০১৮ সালের তথাকথিত নির্বাচনকে দেশের লোকরা নাম দিয়েছিলেন নৈশভোট। আগের রাতে সিল মেরে বাক্স ভরার ওই মহড়া সম্পর্কে ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর খোলাখুলি মন্তব্য করেন জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি।’
সেই রাষ্ট্রদূত যখন হাসিনার প্রমোদ-আসরে গাওয়া গান নিজের গলায় গেয়ে তার বিদায়ের লগ্নকে চিহ্নিত করেন, তখন এর মধ্যে কূটনৈতিক কোনো গুপ্ত বার্তা আছে কি না, তার তত্ত্বতালাশে আমি অনেক দিন গলদঘর্ম ছিলাম। কিন্তু দুই মুঠোয় মাথার গোছা গোছা চুল ছিঁড়েও কোনো কিছুর হদিস করতে পারিনি। তাই আজ পর্যন্ত সাদা সাদা গান আমার মতো গাধার কাছে মস্ত এক ধাঁধাই হয়ে রয়েছে। আর দুর্বোধ্য কিছু দেখলেই আমার কানে ভেসে আসে সেই সুরে বাঁধা বাণী : ‘সাদা সাদা কালা কালা, হইছি আমি মন পাগেলা…।’
টাইম মেশিনে চড়ে পেছনে ফিরে আবার একটু হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম ঘুরে আসি। এত অপরাধ, এত হত্যাযজ্ঞ, এত জুলুম-নির্যাতন, লুঠতরাজ, দখল, দলীয়করণ, এতটা অবিচার-অনাচার, কুশাসন-দুঃশাসন বাংলাদেশ এর আগে আর কখনো দেখেনি। আবার মানুষের সম্মিলিত ক্রোধের এত উত্তাল ঘূর্ণিপাক কখনো এমন প্রবল আঘাত হানেনি ক্ষমতার মসনদে। মানুষ হলে এরপর ওরা অনুশোচনায় ভেঙে চৌচির হয়ে যেত। দুঃখে, লজ্জায়, গ্লানিতে লুটিয়ে পড়ত। মানুষ হলে ভুল স্বীকার, দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনাই হতো ওদের একমাত্র জবান। তার বদলে ওরা সব অপরাধ অস্বীকার করছে। সারাদেশের মানুষের যৌবন-জাগরী দুঃসাহসী অভ্যুত্থানকে ওরা ভয়ংকর স্পর্ধায় এখনো চ্যালেঞ্জ করছে। ষড়যন্ত্র বলে দুর্নাম রটাচ্ছে। ওরা রাষ্ট্রকে, জনতার শক্তিকে মোকাবিলার কথা বলছে, আঘাত করতে চাইছে।
ওরা তাদের দুর্বৃত্ত-শাসনকে ফিরিয়ে এনে কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছে। পালিয়ে গিয়ে বিদেশে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ দেশে হরতাল, অবরোধ, আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জাতির বিরুদ্ধে এটি একুশ শতকের সবচেয়ে বড় ধৃষ্টতা। এর মাধ্যমে ধ্বংসের খাতায় ওরা নাম লেখাল। বিনাশই ওদের অনিবার্য ও একমাত্র পরিণতি। কিন্তু এই দুঃসাহস দেখানোর সাহস তারা কোত্থেকে পেল? এই প্রশ্নের জবাব আমার মগজে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও আমি পাচ্ছি না। মস্তিষ্কের কোষে কোষে শুধুই বাজতে থাকে ‘সাদা সাদা কালা কালা।’
২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ও পালানোর পর থেকে এ পর্যন্ত শুধু ঢাকা মহানগরীতেই ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দেড় শ বিক্ষোভ হয়েছে। পাঁচ শ থেকে দশ হাজার পর্যন্ত লোক অংশ নিয়েছে প্রতিটি প্রতিবাদ-বিক্ষোভে। যৌক্তিক-অযৌক্তিক রঙবেরঙের নানা দাবি তাদের। সেসব দাবি আদায়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেছে নেওয়া হয়েছে নগরীর ব্যস্ততম জনপথ ও মোড়গুলো। গুরুত্বপূর্ণ নগরকেন্দ্র দখল ও অবরোধ করে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব কর্মসূচি যে ভয়ানক জনদুর্ভোগ ডেকে আনছে, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? এসব কর্মসূচি সব সময় নির্বিবাদী ও শান্তিপূর্ণও থাকছে না। অনেকে প্রতিপক্ষ ও পুলিশের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে সংঘর্ষ-সংঘাতে।
হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের প্রায় ষোলো বছরে এত দাবি-দাওয়া, এত আন্দোলন, এত আলটিমেটাম কোথায় ছিল? কখনো তো দেখিনি। ন্যায্য দাবি নিয়ে বা অন্যায়ের প্রতিবাদে এভাবে ফুঁসে উঠলে তো ফ্যাসিবাদ এত প্রকট ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারত না। আর সব দাবি এখনই, এই স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকেই আদায় করে ফেলতে হবে? আলাপ-আলোচনা ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির আগেই রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভে নামাটা কি অযৌক্তিক নয়? বর্তমান সরকার হাসিনার মতো পেটাচ্ছে না, গুলি করছে না, সহনশীলতা দেখাচ্ছে। দাবি-দাওয়া মোকাবিলায় সরকারের এই পরিবর্তিত কালচারকেই কি দুর্বলতা ভাবা হচ্ছে? নাকি পেছনে রয়েছে পতিতদের উসকানি ও বিনিয়োগ? দাবি-দাওয়া কি গৌণ? মুখ্য উদ্দেশ্য কি তবে জবাবদিহিহীন লুঠতরাজের জামানা ফিরে পাওয়া? কিন্তু সেটি তো আর হওয়ার নয়? মিছে কেন এ দুঃস্বপ্ন? আবারও আমার ভেতরের তন্ত্রীতে বেজে উঠছে সেই দুর্বোধ্য গান : সাদা সাদা কালা কালা…!
রেলের রানিং স্টাফদের বোনাস বন্ধ করেছেন হাসিনা চার বছর আগে। অন্যান্য সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়েছে তার হাতেই। কোনো প্রতিবাদ-আন্দোলনের নামগন্ধ দেখিনি তখন। এখন হুট করে দাবি দিয়েই জনগণকে জিম্মি করে সারা দেশে রেল ধর্মঘট শুরু করে দিল তারা। এই মহা-অযৌক্তিক ধর্মঘট এমনি এমনি? পেছনে কোনো কালো হাতের কারসাজি নেই? ঢাকার সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে সমস্যা-সংকট সৃষ্টি করে গেছেন হাসিনা। আর এখন তাৎক্ষণিক সমাধানের দাবিতে পথে নেমে মারামারি, সংঘর্ষ, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও ভাঙচুর করতে হবে? এগুলো কোনো নিরীহ-নির্দোষ কার্যকলাপ? দক্ষিণ ঢাকার সাবেক আওয়ামী মেয়র এবং আওয়ামী নেতা মোহাম্মদ হানিফপুত্র সাঈদ খোকনের মতো চিৎকার করে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, ‘কেন? কেন? কেন?’ নীল ধ্রুবতারার প্রশ্নের মতো আমার প্রশ্নেরও কোনো জবাব আসে না। আমি দিশাহারা হয়ে শুধু শুনতে পাই : সাদা সাদা কালা কালা…!
এই কদিন আগেই তো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা, ডান-বাম-মধ্যপন্থি নির্বিশেষ রাজনৈতিক দলগুলো, নানা শ্রেশি-পেশার মানুষ এক হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করল। ফ্যাসিবাদের পতনে সবাই যে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল সেই বিজয়োল্লাসের ভাষা ছিল অভিন্ন। সেই বিজয়ের পটভূমিতে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার এলো, তার প্রতি সবাই জানাল অকুণ্ঠ সমর্থন। কিন্তু ছয়টি মাস পেরোনোর আগেই সবার চলার পথ নানা দিকে এঁকেবেঁকে কেন আলাদা হয়ে গেল? আচ্ছা, পথ না হয় আলাদাই হলো, তাই বলে পতিত ফ্যাসিবাদের পরিত্যক্ত নষ্ট রাজনৈতিক পরিভাষায় পরস্পরকে আক্রমণ করতে হবে? হাসিনার অনুসৃত নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমদানি করতে হবে? বড় বড় সাফল্য ও অর্জনের পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের সরকারের অসাফল্য এবং ব্যর্থতা আছে বৈকি। ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে তারাও নন। তাই বলে সন্দেহ-অবিশ্বাসের বশে তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা ও বিরোধিতার রাজনৈতিক বৈরী বাতাস বইয়ে দিতে হবে? ড. ইউনূস এ বছর কিংবা বড়জোর আরো অতিরিক্ত ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে অঙ্গীকারবদ্ধ। নির্বাচনী কার্যক্রমের চাকা ইতোমধ্যে ঘুরতেও শুরু করেছে। একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে তিনি সেটুকু সংস্কারই করতে চান। সবার মত নিয়ে কতকগুলো সংস্কার কমিশন তিনি করেছেন। সেগুলোর সুপারিশ আসার পর সবার সঙ্গে বসে একটি ঐকমত্যে পৌঁছার কর্মসূচি আছে তার। এই লক্ষ্যে ড. ইউনূসকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন উদ্যোগ নেবে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেসব বিষয়ে সবাই মিলে একটি সমঝোতা সনদ বা অঙ্গীকারনামা সই করবেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরকারই সেই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে। তাহলে সেগুলো আর দলীয় হবে না, জাতীয় সমঝোতাভিত্তিক সংস্কার হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা কোনো রাজনৈতিক দল করলে সে দলকে সবাই আগাম স্বাগত জানিয়েছে। ছাত্ররাও বলেছেন, দল করলে তারা সরকার থেকে বেরিয়েই করবেন। তাহলে সমস্যা কোথায়? রাজনীতিতে ও নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থাকবেই। তবে আমি কোথাও কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উপাদান দেখছি না। তবু কেন উত্তাপ? পরস্পরের বিরুদ্ধে অহেতুক বাক্যবাণে কেন পরিবেশ কলুষিত করা হচ্ছে? তাহলে কি নন-ইস্যুকে ইস্যু করে, অনৈক্য সৃষ্টি ও ফাটল ধরিয়ে কেউ ফ্যাসিবাদী অপরাধীদের বিচারকে অপ্রধান করে তুলতে চাইছেন? কেউ কি চাইছেন সেই পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তই টিকিয়ে রাখতে? আবার কি সেই সাদা সাদা কালা কালাই?
প্রায় অর্ধশতবর্ষ ধরে আমি এ ভূখণ্ডের রাজনীতির এক নিবিষ্ট পর্যবেক্ষক। আমি পরিস্থিতি-পরিবেশ যেটুকু বুঝি এবং মানুষের হৃৎস্পন্দন যতটা পাঠ করতে পারি, তাতে নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়, আকস্মিক খুব বিরাট রকমের কোনো অঘটন না ঘটলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি নিশ্চিন্তে বিজয় স্পর্শ করবে। তবে এ বিজয়ের বিস্তার যতটা ব্যাপক হওয়ার কথা ছিল, তা কিছুটা সংকুচিত হয়ে আসছে দলের ধৈর্যহারা ও লোভাতুর কিছু নেতাকর্মীর অনৈতিক কার্যকলাপে। তারা অনেকেই ব্যক্তিস্বার্থের বিনিময়ে পতিত ফ্যাসিবাদের দোসর অপরাধীদের সুরক্ষায় বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই জনগণকে শোষণ ও তাদের ওপর অর্থনৈতিক খবরদারির মাধ্যমে বৈষয়িক লাভের কুকর্মগুলোয় পলাতক আওয়ামী নেতাকর্মীদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। রুমিন ফারহানাসহ দলের ভেতরে অনেকেই এসবের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন। বিএনপির কার্যকর শীর্ষনেতা তারেক রহমানও এ ব্যাপারে সচেতন। তার রোজকার বক্তৃতা-বিবৃতিতে তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক করছেন। অনেকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তারেক রহমান সাম্প্রতিককালে তার কথা ও কাজে সংযম, ঔদার্য, দূরদর্শিতা ও বাস্তববাদিতার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছেন। তিনি রাষ্ট্রসংস্কার কর্মসূচি নিয়েও যথেষ্ট সক্রিয়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে ওইসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন যে দলকে দিয়ে, সে দলের সংস্কার এখনকার এবং এই মুহূর্তের দাবি। নতুবা তার সব নসিহত ও কঠোরতা ব্যর্থ হবে। রাষ্ট্রসংস্কারও ব্যর্থ হবে অসংস্কৃত দলের হাতে পড়লে। তারেক রহমানের সংযম, ঔদার্য, দূরদর্শিতা, বাস্তববাদিতা ও গণমুখিনতাকে ছড়িয়ে দিতে হবে দলের সবখানে, সবার মধ্যে। সেটা শুধু সংস্কারের মাধ্যমেই করা সম্ভব। আমার আহ্বান, দল ও রাজনীতি সংস্কারের ব্যাপারটা যাতে কোনোক্রমেই সাদা সাদা কালা কালা না হয়ে যায়।
একি! সাদা সাদা কালা কালা… রং জমেছে সাদা কালা… অনবরত টেলিভিশনের স্ক্রলের মতো আমার মানসপটে ভেসে যাচ্ছে ‘হাওয়া’ সিনেমার সেই গান। আমি থামাতে পারছি না। আমি ‘মন পাগেলা’ হয়ে যাচ্ছি পুরোনো লিরিকে, পুরোনো সুরে, পুরোনো গানে, পুরোনো ছন্দে, পুরোনো নৃত্যে। আমরা কি সবাই মিলে প্রতিযোগিতা করে ফিরে যাচ্ছি সেই আগেকার হেজেমনির নিয়ন্ত্রণে? আমরা কি নিজেরাই গলা বাড়িয়ে আবার ফাঁস নিচ্ছি? সীমান্তপাড়ের সেই আধিপত্যের পলিটিকো-সোশিও-কালচারাল টুলস, সেই ব্যর্থ, পরাজিত রাজনীতি আবার কি আমরাই পুনরাধিষ্ঠিত করছি? সেই ফেলে দেওয়া থুতু কি আমরা আবার চেটে খাচ্ছি? আমরা কি আমাদের ক্লিষ্ট বর্তমানকে মসৃণ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে সুন্দর করার বদলে আবার ইতিহাসের আঁস্তাকুড় ঘাঁটতে বসে গেছি? বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যবাদী রাজনীতি ছেড়ে বিএনপিও কি বিভাজনের বিষাক্ত আওয়ামী রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছে? ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এ দেশে জামায়াতে ইসলামীর কিছু ভুল ও হঠকারী সিদ্ধান্ত রাজনীতির, দেশের এমনকি তাদের নিজেদেরও অনেক ক্ষতি করেছে। তার জন্য ন্যায্য সমালোচনা ওই দলের প্রাপ্য। কিন্তু বিএনপি তো মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আনুগত্য মেনে নেওয়া কারুর রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করার দল নয়। আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব ও ভারতীয় হেজেমনির বিরোধিতাকে বিএনপি তো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা বলে মনে করে না। ৫৫ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ এখনো রাজনীতির জীবন্ত বিষয়বস্তু হতে পারে না। এখন আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা ও বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো সম্ভব নয়। ওই ধুয়া তুলে অন্য আধিপত্যকে আশকারা দেওয়া ও আড়াল করা তো বিএনপির রাজনীতি নয়। তারেক রহমান, আপনার দলের নেতাকর্মীদের সাদা সাদা কালা কালা অর্থাৎ আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বাইনারি অপরাজনীতি থেকে বের করে আনুন। অনেকেই কিন্তু ইতোমধ্যে মারাত্মক ভুলের চোরাবালিতে পা দিয়ে ফেলেছে। সর্বনাশ হয়ে যাবে। আওয়ামী রাজনীতির বিরোধিতাকেই স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং সব বিরোধী মতকে রাজাকার চিহ্নিত করে দমিয়ে রাখার রাজনীতিকে অস্বীকার করে রাজাকার গালিকে অকার্যকর করে দিয়ে চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটে। সেই বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড বলে বিশ্বসভায় যার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকারের সেই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আপনি কী করে পতিত-পরাজিত রাজনীতির দরবারে ‘আমার কৈফিয়ত’ নিয়ে হাজির হন? পেছন ফিরে হাঁটবেন না কিংবা হাঁটু মুড়ে বসবেন না। দুরন্ত সাহস ও বিপ্লবী দৃঢ়তা নিয়ে পরাজিত ফ্যাসিবাদীদের ভাঙা অস্ত্র আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলুন। তাহলেই শুধু আবার কুর্নিশ করবে বিজয়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com

হাসিনা যখন এই তল্লাটে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজ্যপাট চালাতেন, তখনকার কত সহস্র দুঃসহ স্মৃতি শাসিত, শোষিত, নিপীড়িত মানুষের মাথায়, মনে কিলবিল করে। হয়তো আরো অনেককালই করবে। মনে পড়ে কি সেই দিনগুলোর কথা? মানবসভ্যতার এক ভয়ংকর মহামারি করোনার ছোবলে পুরো জাতি যখন ক্ষতবিক্ষত, অনাহার, অর্ধাহারে যখন দুঃখী অগণিত মানুষের দিনলিপি, কাজের সংস্থান হারিয়ে এবং বাড়িভাড়া শোধে ব্যর্থ হয়ে হাজার হাজার পরিবার যখন রাজধানী ছেড়ে গাঁয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছিল, সেই ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে না-উঠতেই হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মচ্ছবের কথা মনে পড়ে কি? ঢাকাই নাটক-সিনেমার নট-নটিনীদের হাসিনা গণভবন নামক তার রানিনিবাসে প্রমোদ-সম্মিলনে একত্র করেছিলেন। ওরা সবাই ছিল তার তাঁবেদার। হাসিনার প্রহসনের ভোটরঙ্গে ওরা রঙঢঙ করত। খালেদা জিয়াকে তার অফিসে তিন মাস ধরে আটকে রাখার সময়ে ওরা সেখানে মাঝে-মাঝে যেত ঘেরাও করতে। যা-হোক, গণভবনে আয়োজিত এক আনন্দলীলার কথা বলছি। সেখানে হাসিনা ও তার বোন রেহানা সবার সঙ্গে প্রমোদে মন ঢেলে দিয়ে ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের তালে তালে হেলেদুলে করতালি বাজাচ্ছিলেন। আর অনেকে নিতম্ব দুলিয়ে নেচেছিলেন।
রাজকীয় উৎসবে গাওয়ার পর ওই গান আমিও পরম কৌতূহল নিয়ে শুনেছিলাম। ওই গানের স্থায়ী বা মুখড়া থেকে শুরু করে অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ পর্যন্ত পুরোটাই আমি গভীর অভিনিবেশ সহকারে শুনে মুখস্থ করে ফেলি।
‘তুমি বন্ধু কালা পাখি
আমি যেন কি?
বসন্ত কালে তোমায়
বলতে পারিনি।
সাদা সাদা কালা কালা
রং জমেছে সাদা কালা,
হইছি আমি মন পাগেলা
বসন্ত কালে...।’
এসব গভীর তত্ত্বকথার অর্থ, মোজেজা, শানে নজুলÑকিছুই আমার মাথায় ঢোকেনি। শুধু জেনেছি ‘হাওয়া’ নামের এক সিনেমার গান এটি। এই গান নিয়ে হলো আরেক অবাক কাণ্ড। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি তার বিদায়ি অনুষ্ঠানেও এই গান গেয়ে মাতিয়ে তোলেন দর্শক-শ্রোতাদের।
এরপর পড়ে গেলাম বিষম ধাঁধায়। হাসিনার আসরের এ গানের সঙ্গে বিদায়ি রাষ্ট্রদূতের যোগসূত্র কোথায়?
শুধু গান গেয়েই নয়, রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি আরেকটি নজিরবিহীন কাণ্ড করেছিলেন। জাপানের কোনো রাষ্ট্রদূত কখনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করেন না। সেই রীতি ভেঙে ফেলেন ইতো নাওকি। হাসিনার অধীনে ২০১৮ সালের তথাকথিত নির্বাচনকে দেশের লোকরা নাম দিয়েছিলেন নৈশভোট। আগের রাতে সিল মেরে বাক্স ভরার ওই মহড়া সম্পর্কে ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর খোলাখুলি মন্তব্য করেন জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি।’
সেই রাষ্ট্রদূত যখন হাসিনার প্রমোদ-আসরে গাওয়া গান নিজের গলায় গেয়ে তার বিদায়ের লগ্নকে চিহ্নিত করেন, তখন এর মধ্যে কূটনৈতিক কোনো গুপ্ত বার্তা আছে কি না, তার তত্ত্বতালাশে আমি অনেক দিন গলদঘর্ম ছিলাম। কিন্তু দুই মুঠোয় মাথার গোছা গোছা চুল ছিঁড়েও কোনো কিছুর হদিস করতে পারিনি। তাই আজ পর্যন্ত সাদা সাদা গান আমার মতো গাধার কাছে মস্ত এক ধাঁধাই হয়ে রয়েছে। আর দুর্বোধ্য কিছু দেখলেই আমার কানে ভেসে আসে সেই সুরে বাঁধা বাণী : ‘সাদা সাদা কালা কালা, হইছি আমি মন পাগেলা…।’
টাইম মেশিনে চড়ে পেছনে ফিরে আবার একটু হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম ঘুরে আসি। এত অপরাধ, এত হত্যাযজ্ঞ, এত জুলুম-নির্যাতন, লুঠতরাজ, দখল, দলীয়করণ, এতটা অবিচার-অনাচার, কুশাসন-দুঃশাসন বাংলাদেশ এর আগে আর কখনো দেখেনি। আবার মানুষের সম্মিলিত ক্রোধের এত উত্তাল ঘূর্ণিপাক কখনো এমন প্রবল আঘাত হানেনি ক্ষমতার মসনদে। মানুষ হলে এরপর ওরা অনুশোচনায় ভেঙে চৌচির হয়ে যেত। দুঃখে, লজ্জায়, গ্লানিতে লুটিয়ে পড়ত। মানুষ হলে ভুল স্বীকার, দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনাই হতো ওদের একমাত্র জবান। তার বদলে ওরা সব অপরাধ অস্বীকার করছে। সারাদেশের মানুষের যৌবন-জাগরী দুঃসাহসী অভ্যুত্থানকে ওরা ভয়ংকর স্পর্ধায় এখনো চ্যালেঞ্জ করছে। ষড়যন্ত্র বলে দুর্নাম রটাচ্ছে। ওরা রাষ্ট্রকে, জনতার শক্তিকে মোকাবিলার কথা বলছে, আঘাত করতে চাইছে।
ওরা তাদের দুর্বৃত্ত-শাসনকে ফিরিয়ে এনে কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছে। পালিয়ে গিয়ে বিদেশে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ দেশে হরতাল, অবরোধ, আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জাতির বিরুদ্ধে এটি একুশ শতকের সবচেয়ে বড় ধৃষ্টতা। এর মাধ্যমে ধ্বংসের খাতায় ওরা নাম লেখাল। বিনাশই ওদের অনিবার্য ও একমাত্র পরিণতি। কিন্তু এই দুঃসাহস দেখানোর সাহস তারা কোত্থেকে পেল? এই প্রশ্নের জবাব আমার মগজে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও আমি পাচ্ছি না। মস্তিষ্কের কোষে কোষে শুধুই বাজতে থাকে ‘সাদা সাদা কালা কালা।’
২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ও পালানোর পর থেকে এ পর্যন্ত শুধু ঢাকা মহানগরীতেই ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দেড় শ বিক্ষোভ হয়েছে। পাঁচ শ থেকে দশ হাজার পর্যন্ত লোক অংশ নিয়েছে প্রতিটি প্রতিবাদ-বিক্ষোভে। যৌক্তিক-অযৌক্তিক রঙবেরঙের নানা দাবি তাদের। সেসব দাবি আদায়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেছে নেওয়া হয়েছে নগরীর ব্যস্ততম জনপথ ও মোড়গুলো। গুরুত্বপূর্ণ নগরকেন্দ্র দখল ও অবরোধ করে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব কর্মসূচি যে ভয়ানক জনদুর্ভোগ ডেকে আনছে, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? এসব কর্মসূচি সব সময় নির্বিবাদী ও শান্তিপূর্ণও থাকছে না। অনেকে প্রতিপক্ষ ও পুলিশের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে সংঘর্ষ-সংঘাতে।
হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের প্রায় ষোলো বছরে এত দাবি-দাওয়া, এত আন্দোলন, এত আলটিমেটাম কোথায় ছিল? কখনো তো দেখিনি। ন্যায্য দাবি নিয়ে বা অন্যায়ের প্রতিবাদে এভাবে ফুঁসে উঠলে তো ফ্যাসিবাদ এত প্রকট ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারত না। আর সব দাবি এখনই, এই স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকেই আদায় করে ফেলতে হবে? আলাপ-আলোচনা ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির আগেই রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভে নামাটা কি অযৌক্তিক নয়? বর্তমান সরকার হাসিনার মতো পেটাচ্ছে না, গুলি করছে না, সহনশীলতা দেখাচ্ছে। দাবি-দাওয়া মোকাবিলায় সরকারের এই পরিবর্তিত কালচারকেই কি দুর্বলতা ভাবা হচ্ছে? নাকি পেছনে রয়েছে পতিতদের উসকানি ও বিনিয়োগ? দাবি-দাওয়া কি গৌণ? মুখ্য উদ্দেশ্য কি তবে জবাবদিহিহীন লুঠতরাজের জামানা ফিরে পাওয়া? কিন্তু সেটি তো আর হওয়ার নয়? মিছে কেন এ দুঃস্বপ্ন? আবারও আমার ভেতরের তন্ত্রীতে বেজে উঠছে সেই দুর্বোধ্য গান : সাদা সাদা কালা কালা…!
রেলের রানিং স্টাফদের বোনাস বন্ধ করেছেন হাসিনা চার বছর আগে। অন্যান্য সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়েছে তার হাতেই। কোনো প্রতিবাদ-আন্দোলনের নামগন্ধ দেখিনি তখন। এখন হুট করে দাবি দিয়েই জনগণকে জিম্মি করে সারা দেশে রেল ধর্মঘট শুরু করে দিল তারা। এই মহা-অযৌক্তিক ধর্মঘট এমনি এমনি? পেছনে কোনো কালো হাতের কারসাজি নেই? ঢাকার সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে সমস্যা-সংকট সৃষ্টি করে গেছেন হাসিনা। আর এখন তাৎক্ষণিক সমাধানের দাবিতে পথে নেমে মারামারি, সংঘর্ষ, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও ভাঙচুর করতে হবে? এগুলো কোনো নিরীহ-নির্দোষ কার্যকলাপ? দক্ষিণ ঢাকার সাবেক আওয়ামী মেয়র এবং আওয়ামী নেতা মোহাম্মদ হানিফপুত্র সাঈদ খোকনের মতো চিৎকার করে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, ‘কেন? কেন? কেন?’ নীল ধ্রুবতারার প্রশ্নের মতো আমার প্রশ্নেরও কোনো জবাব আসে না। আমি দিশাহারা হয়ে শুধু শুনতে পাই : সাদা সাদা কালা কালা…!
এই কদিন আগেই তো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা, ডান-বাম-মধ্যপন্থি নির্বিশেষ রাজনৈতিক দলগুলো, নানা শ্রেশি-পেশার মানুষ এক হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করল। ফ্যাসিবাদের পতনে সবাই যে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল সেই বিজয়োল্লাসের ভাষা ছিল অভিন্ন। সেই বিজয়ের পটভূমিতে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার এলো, তার প্রতি সবাই জানাল অকুণ্ঠ সমর্থন। কিন্তু ছয়টি মাস পেরোনোর আগেই সবার চলার পথ নানা দিকে এঁকেবেঁকে কেন আলাদা হয়ে গেল? আচ্ছা, পথ না হয় আলাদাই হলো, তাই বলে পতিত ফ্যাসিবাদের পরিত্যক্ত নষ্ট রাজনৈতিক পরিভাষায় পরস্পরকে আক্রমণ করতে হবে? হাসিনার অনুসৃত নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমদানি করতে হবে? বড় বড় সাফল্য ও অর্জনের পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের সরকারের অসাফল্য এবং ব্যর্থতা আছে বৈকি। ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে তারাও নন। তাই বলে সন্দেহ-অবিশ্বাসের বশে তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা ও বিরোধিতার রাজনৈতিক বৈরী বাতাস বইয়ে দিতে হবে? ড. ইউনূস এ বছর কিংবা বড়জোর আরো অতিরিক্ত ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে অঙ্গীকারবদ্ধ। নির্বাচনী কার্যক্রমের চাকা ইতোমধ্যে ঘুরতেও শুরু করেছে। একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে তিনি সেটুকু সংস্কারই করতে চান। সবার মত নিয়ে কতকগুলো সংস্কার কমিশন তিনি করেছেন। সেগুলোর সুপারিশ আসার পর সবার সঙ্গে বসে একটি ঐকমত্যে পৌঁছার কর্মসূচি আছে তার। এই লক্ষ্যে ড. ইউনূসকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন উদ্যোগ নেবে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেসব বিষয়ে সবাই মিলে একটি সমঝোতা সনদ বা অঙ্গীকারনামা সই করবেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরকারই সেই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে। তাহলে সেগুলো আর দলীয় হবে না, জাতীয় সমঝোতাভিত্তিক সংস্কার হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা কোনো রাজনৈতিক দল করলে সে দলকে সবাই আগাম স্বাগত জানিয়েছে। ছাত্ররাও বলেছেন, দল করলে তারা সরকার থেকে বেরিয়েই করবেন। তাহলে সমস্যা কোথায়? রাজনীতিতে ও নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থাকবেই। তবে আমি কোথাও কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উপাদান দেখছি না। তবু কেন উত্তাপ? পরস্পরের বিরুদ্ধে অহেতুক বাক্যবাণে কেন পরিবেশ কলুষিত করা হচ্ছে? তাহলে কি নন-ইস্যুকে ইস্যু করে, অনৈক্য সৃষ্টি ও ফাটল ধরিয়ে কেউ ফ্যাসিবাদী অপরাধীদের বিচারকে অপ্রধান করে তুলতে চাইছেন? কেউ কি চাইছেন সেই পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তই টিকিয়ে রাখতে? আবার কি সেই সাদা সাদা কালা কালাই?
প্রায় অর্ধশতবর্ষ ধরে আমি এ ভূখণ্ডের রাজনীতির এক নিবিষ্ট পর্যবেক্ষক। আমি পরিস্থিতি-পরিবেশ যেটুকু বুঝি এবং মানুষের হৃৎস্পন্দন যতটা পাঠ করতে পারি, তাতে নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়, আকস্মিক খুব বিরাট রকমের কোনো অঘটন না ঘটলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি নিশ্চিন্তে বিজয় স্পর্শ করবে। তবে এ বিজয়ের বিস্তার যতটা ব্যাপক হওয়ার কথা ছিল, তা কিছুটা সংকুচিত হয়ে আসছে দলের ধৈর্যহারা ও লোভাতুর কিছু নেতাকর্মীর অনৈতিক কার্যকলাপে। তারা অনেকেই ব্যক্তিস্বার্থের বিনিময়ে পতিত ফ্যাসিবাদের দোসর অপরাধীদের সুরক্ষায় বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই জনগণকে শোষণ ও তাদের ওপর অর্থনৈতিক খবরদারির মাধ্যমে বৈষয়িক লাভের কুকর্মগুলোয় পলাতক আওয়ামী নেতাকর্মীদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। রুমিন ফারহানাসহ দলের ভেতরে অনেকেই এসবের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন। বিএনপির কার্যকর শীর্ষনেতা তারেক রহমানও এ ব্যাপারে সচেতন। তার রোজকার বক্তৃতা-বিবৃতিতে তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক করছেন। অনেকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তারেক রহমান সাম্প্রতিককালে তার কথা ও কাজে সংযম, ঔদার্য, দূরদর্শিতা ও বাস্তববাদিতার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছেন। তিনি রাষ্ট্রসংস্কার কর্মসূচি নিয়েও যথেষ্ট সক্রিয়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে ওইসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন যে দলকে দিয়ে, সে দলের সংস্কার এখনকার এবং এই মুহূর্তের দাবি। নতুবা তার সব নসিহত ও কঠোরতা ব্যর্থ হবে। রাষ্ট্রসংস্কারও ব্যর্থ হবে অসংস্কৃত দলের হাতে পড়লে। তারেক রহমানের সংযম, ঔদার্য, দূরদর্শিতা, বাস্তববাদিতা ও গণমুখিনতাকে ছড়িয়ে দিতে হবে দলের সবখানে, সবার মধ্যে। সেটা শুধু সংস্কারের মাধ্যমেই করা সম্ভব। আমার আহ্বান, দল ও রাজনীতি সংস্কারের ব্যাপারটা যাতে কোনোক্রমেই সাদা সাদা কালা কালা না হয়ে যায়।
একি! সাদা সাদা কালা কালা… রং জমেছে সাদা কালা… অনবরত টেলিভিশনের স্ক্রলের মতো আমার মানসপটে ভেসে যাচ্ছে ‘হাওয়া’ সিনেমার সেই গান। আমি থামাতে পারছি না। আমি ‘মন পাগেলা’ হয়ে যাচ্ছি পুরোনো লিরিকে, পুরোনো সুরে, পুরোনো গানে, পুরোনো ছন্দে, পুরোনো নৃত্যে। আমরা কি সবাই মিলে প্রতিযোগিতা করে ফিরে যাচ্ছি সেই আগেকার হেজেমনির নিয়ন্ত্রণে? আমরা কি নিজেরাই গলা বাড়িয়ে আবার ফাঁস নিচ্ছি? সীমান্তপাড়ের সেই আধিপত্যের পলিটিকো-সোশিও-কালচারাল টুলস, সেই ব্যর্থ, পরাজিত রাজনীতি আবার কি আমরাই পুনরাধিষ্ঠিত করছি? সেই ফেলে দেওয়া থুতু কি আমরা আবার চেটে খাচ্ছি? আমরা কি আমাদের ক্লিষ্ট বর্তমানকে মসৃণ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে সুন্দর করার বদলে আবার ইতিহাসের আঁস্তাকুড় ঘাঁটতে বসে গেছি? বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যবাদী রাজনীতি ছেড়ে বিএনপিও কি বিভাজনের বিষাক্ত আওয়ামী রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছে? ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এ দেশে জামায়াতে ইসলামীর কিছু ভুল ও হঠকারী সিদ্ধান্ত রাজনীতির, দেশের এমনকি তাদের নিজেদেরও অনেক ক্ষতি করেছে। তার জন্য ন্যায্য সমালোচনা ওই দলের প্রাপ্য। কিন্তু বিএনপি তো মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আনুগত্য মেনে নেওয়া কারুর রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করার দল নয়। আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব ও ভারতীয় হেজেমনির বিরোধিতাকে বিএনপি তো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা বলে মনে করে না। ৫৫ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ এখনো রাজনীতির জীবন্ত বিষয়বস্তু হতে পারে না। এখন আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা ও বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো সম্ভব নয়। ওই ধুয়া তুলে অন্য আধিপত্যকে আশকারা দেওয়া ও আড়াল করা তো বিএনপির রাজনীতি নয়। তারেক রহমান, আপনার দলের নেতাকর্মীদের সাদা সাদা কালা কালা অর্থাৎ আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বাইনারি অপরাজনীতি থেকে বের করে আনুন। অনেকেই কিন্তু ইতোমধ্যে মারাত্মক ভুলের চোরাবালিতে পা দিয়ে ফেলেছে। সর্বনাশ হয়ে যাবে। আওয়ামী রাজনীতির বিরোধিতাকেই স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং সব বিরোধী মতকে রাজাকার চিহ্নিত করে দমিয়ে রাখার রাজনীতিকে অস্বীকার করে রাজাকার গালিকে অকার্যকর করে দিয়ে চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটে। সেই বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড বলে বিশ্বসভায় যার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকারের সেই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আপনি কী করে পতিত-পরাজিত রাজনীতির দরবারে ‘আমার কৈফিয়ত’ নিয়ে হাজির হন? পেছন ফিরে হাঁটবেন না কিংবা হাঁটু মুড়ে বসবেন না। দুরন্ত সাহস ও বিপ্লবী দৃঢ়তা নিয়ে পরাজিত ফ্যাসিবাদীদের ভাঙা অস্ত্র আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলুন। তাহলেই শুধু আবার কুর্নিশ করবে বিজয়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com

গণমাধ্যমে ইসলামবিদ্বেষ হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে এমন নেতিবাচক, বিকৃত ও শত্রুতাপূর্ণ উপস্থাপন, যা ভয়, ঘৃণা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। গণমাধ্যমের এই বিদ্বেষ সরাসরি ‘ইসলাম খারাপ’ বলার মাধ্যমে নয়; বরং প্রশ্নের ভাষা ও প্রেক্ষাপটে মুসলিমসমাজকে সন্দেহের চোখে দেখানো হয়।
১ দিন আগে
নিউ ইয়র্কে একটি অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘ড. ইউনূসের মধ্যে জিয়াউর রহমানের প্রতিচ্ছবি দেখছি।’ দিনটি ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫। মাত্র এক মাসের মাথায় কী এমন ঘটল, সেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এখন তুলনা করা হচ্ছে জেনারেল আইয়ুব খান ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের
১ দিন আগে
ভারতে হিন্দু দক্ষিণপন্থিরা সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক যুদ্ধের অস্ত্রে পরিণত করেছে। যে উৎসবগুলো একসময় ছিল আলো, রঙ আর ভক্তির, সেগুলো তারা এখন ভয় প্রদর্শনের উপলক্ষ বানিয়ে ফেলেছে।
২ দিন আগে
হাসিনার দেড় দশকের শাসনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইসলামোফোবিয়া ভয়ংকর মাত্রায় রূপ নিয়েছিল। টুপি কিংবা হিজাব পরার কারণে বহু শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। দাড়ি রাখা, নামাজ পড়া কিংবা প্রাথমিকপর্যায়ে মাদরাসায় পড়েছেন এমন শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। বহু শিক্ষার্থীকে ধ
২ দিন আগে