দেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর মধ্যে তিস্তা অন্যতম। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি আন্তঃসীমান্ত নদী, যার উৎপত্তি ভারতের সিকিম রাজ্যে। ভারত থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে নদীটি।
তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি একেবারে কমে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে খরা, পানির সংকট, চাষাবাদে বিঘ্ন সৃষ্টি ও পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে ভারতের গজলডোবা বাঁধ খুলে দিলে তিস্তার অববাহিকায় ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়।
তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তির চেষ্টা করা হলেও তা আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতা ও কূটনৈতিক টানাপড়েনের কারণে তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। এই সমস্যা এখন আর শুধু একটি কূটনৈতিক ইস্যু নয়, বরং এটি বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন, পরিবেশ ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ অনেক বিষয়ই তিস্তা সমস্যার সমাধানের ওপর নির্ভর করছে।
তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েক দফা চুক্তি ও সমঝোতার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে আলোচনা হলেও বিষয়টির ফায়সালা হয়নি। ১৯৮৩ সালে দুই দেশ তিস্তার পানিবণ্টনে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে, কিন্তু এই চুক্তিও কার্যকর হয়নি।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এসে তিস্তার পানির ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাংলাদেশকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে কোনো চুক্তি হয়নি। ২০১৭ সালে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের আশ্বাস দেন। তবে তার সেই আশ্বাস বাস্তবে পরিণত হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানে ভারতের দিক থেকে বহুবার আশ্বাস দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত তারা এই সমস্যার কোনো সমাধান করেনি।
পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান না করে জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের পানি কনভেনশনের ৫ ও ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করছে। ১৯৭৫ সালে ভারত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে তিস্তার পানির প্রবাহ নিজেদের কব্জায় নিয়ে আন্তর্জাতিক এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত করার পথ বেছে নিয়েছে।
ভারতের এমন অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের ফলে বাংলাদেশ বাধ্য হয়েছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অংশের তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটার এবং এর আশপাশের প্রাণপ্রকৃতি রক্ষা করা যাবে। বাংলাদেশের এ পদক্ষেপের ফলে ভারত অসন্তুষ্ট হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিস্তার বাংলাদেশ অংশে একটি বহুমুখী ব্যারাজ নির্মাণের জন্য চীন যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি ভারতের আপত্তির কারণে আটকে আছে।
তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা, নদীর পাড় রক্ষা, সেচ সুবিধা, নৌ-চলাচল ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য নেওয়া একটি বিশাল পরিকল্পনা। এটি মূলত তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা এবং নদী ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করার জন্য বাংলাদেশের একটি কৌশলগত উদ্যোগ। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলে খরা, বন্যা, নদীভাঙন ও মরূকরণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, চূড়ান্তভাবে প্রণীত তিস্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন প্রস্তুত। তবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশকে। দ্রুত ব্যবস্থা নিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে রাষ্ট্রদূত ওয়েন উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া আগামী অক্টোবর-ডিসেম্বরের মধ্যে ‘পাওয়ার চায়না’ একটি প্রতিবেদন জমা দেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। বাংলাদেশকে তার নিজের দায়িত্বে একটি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাষ্ট্রদূত ওয়েন বলেছেন, ‘তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রস্তুত চীন।’ তারা এ ব্যাপারে দুই বছর অপেক্ষা করেছেন বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ দেশ। তিস্তা প্রকল্প চীনের হাতে যাক, এটি ভারত কোনোমতেই চাইবে না। এই প্রকল্প ঘিরে নতুন একটি ভূরাজনৈতিক ইস্যু শুরু হতে পারে ভারত ও চীনের মধ্যে। ভারত কখনো চাইবে না তার স্পর্শকাতর এলাকায় চীনের উপস্থিতি থাকুক। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহী হয়ে ওঠার বড় কারণ হচ্ছে, তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। এই প্রকল্পের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশকে চীন একই সুতোয় গাঁথতে চায়।
আন্তর্জাতিক সব আইন লঙ্ঘন করে ভারত তিস্তার উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আর সময়ক্ষেপণ না করে ১৯৯২ সালের ওয়াটার কনভেনশন ও ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষর করা বাংলাদেশের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলকে মরূকরণের হাত থেকে বাঁচাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ সরকারের এখন উচিত দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। চীনকে প্রকল্পটি দিলে বাংলাদেশেরই লাভ। এতে একদিকে চীনের সঙ্গে ঢাকার সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং অন্যদিকে ভারতকে পাল্টা চাপে রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতেও নতুনত্ব আসবে। তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উত্তরবঙ্গের উন্নয়নে নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি এই অঞ্চলে ফসলের উৎপাদনও কয়েকগুণ বাড়বে বলে মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

