লোকসংগীতের সুর সম্রাট আব্দুল আলিম

কামরুননেসা হাসান
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৯: ৩৭

আমাদের দেশে একজন লোকসংগীতের সম্রাট ছিলেন, যার কণ্ঠে পল্লিসংগীত-ভাটিয়ালি-মুর্শিদি গান পল্লিবালাদের উদাস করে দিত।

১৯৩১ সালে ২৭ জুলাই মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লোকসংগীতের বরপুত্র আব্দুল আলিম। ছোটবেলায় পাঠশালায় পড়ার সময় মনের মধ্যে সংগীতের প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করে। দেশভাগের পর নিঃস্ব হয়ে এ দেশে চলে আসেন। গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুনে চর্চা করতেন এবং গ্রামে ঘুরে ঘুরে পালা গান করতেন।

বিজ্ঞাপন

আবদুল আলিমের কণ্ঠ শুনে ঢাকা রেডিও তালিকাভুক্ত শিল্পী নির্বাচিত করে নেয়। এরপর তিনি বেদনার উদ্দীন আহমেদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, মমতাজ আলী খান, আবদুল লতিফ, কানাইলাল শীল, আব্দুল হালিম চৌধুরী এসব দেশবরেণ্য সংগীত বিশেষজ্ঞদের কাছে তালিম নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন।

* এই যে দুনিয়া, কিসেরও লাগিয়া, এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই

* নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা কোন দেশেতে যাও চইলা

* এই সুন্দর ফল সুন্দর ফুল মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানি

* হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে

এবং অন্য আর একটি গান

* ও পদ্মা..... সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই

বল আমারে তোর কি আর কোন কূলকিনারা নাই।

এ রকম অসংখ্য কালজয়ী লোকসংগীত আজও আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়।

ষাট দশকের শেষের দিকে আমি রেডিওতে অনুষ্ঠান ঘোষণা করতাম। তখন আব্দুল আলিমকে কাছে দেখার সুযোগ হয়েছে। সকালে প্রথম অধিবেশনে তিনি গান পরিবেশন করতে আসতেন। আমি গানগুলো মিলিয়ে ঘোষণা করতাম। সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবি পরতেন। চোখ দুটো সব সময় লাল থাকত। আমার খুব কৌতূহল হতো। একদিন সেতারবাদক ওস্তাদ মীর কাশেম ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম

আচ্ছা আলিম ভাইয়ের চোখ সব সময় লাল হয়ে থাকে কেন?

ধুর বোকা মেয়ে, এসব জিজ্ঞাসা করতে হয় না।

আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। অনেক পরে বুঝতে পেরে খুব হাসি পেয়েছিল।

জাদুকরী দরাজ কণ্ঠের অধিকারী আব্দুল আলিমের প্রতিটি গান মানুষের মনকে কোথায় যেন হারিয়ে নিয়ে যায়।

এই সুন্দর ফুল আর সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি

খোদা তোমার মেহেরবানি

কোনো রকম বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার না করে ইসলামি গানটি করেছিলেন। অনেক পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে গানটি চিত্রায়ণ করে প্রচার করি। কারণ তিনি মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-এ মৃত্যুবরণ করেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত এক বলিষ্ঠ সুরের কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন ক্ষণজন্মা এই মহান শিল্পী আব্দুল আলিম।

মনে পড়ে আর একটি গানের কথা। চলচ্চিত্র জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এক গান, যা আজও বাংলার প্রেমিক-প্রেমিকার রোমান্টিক দৃশ্যের এক অনবদ্য প্রকাশ।

* সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা

তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা।

প্রয়াত কিংবদন্তি খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘সুজন সখী’ ছবির গান। রতনে রতন চেনে। আতা ভাই আব্দুল আলিমকে দিয়ে গানটি করালেন। বক্স অফিস হিট। অভিনয় করলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের শ্রেষ্ঠ সফল রোমান্টিক জুটি কবরী-ফারুক। অনবদ্য এক চিত্রায়ণ।

আজও চলচ্চিত্রের সেরা গান। আমার বিশ্বাস আব্দুল আলিম ছাড়া অন্য কেউ এভাবে গাইতেন কি না সন্দেহ। কণ্ঠে সুরের এক মায়াজাল ছড়িয়ে দিল আকাশে বাতাসে এবং আব্দুল আলিম পেলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ কণ্ঠ শিল্পী হিসেবে।

১৯৭৭-এ পেলেন মরণোত্তর একুশে পদক।

ক্ষণজন্মা এই লোকসংগীত শিল্পী আরো অনেক কিছু দিতে পারতেন, ইসলামি এবং মরমি গানের ভান্ডার আরো সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার অকালমৃত্যুতে তা আর হলো না।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ এতগুলো রেডিও চ্যানেল আব্দুল আলিমের গান কি প্রচার করে? টেলিভিশনে একটা গান ধারণ করা আছে। কিন্তু বেতারে গান প্রচারে এত অনীহা কেন? ওনার ছেলেমেয়ে সবাই মোটামুটি গান চর্চা করে থাকেন।

পল্লিসংগীত সম্রাট আব্দুল আলিম জীবদ্দশায় কিছুদিন সংগীত মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

আব্দুল আলিমের লেখা ও সুর করা মারফত-মুর্শিদি এবং দেহতত্ত্ব গান নিয়ে গবেষণা করলে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে বাংলাদেশে একজন কত বড় মাপের একজন শিল্পী ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন এ দায়িত্ব কার?

লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন

বিষয়:

লোক সংগীত
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত