সংস্কারের সাতসতেরো

মারুফ কামাল খান
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ৩৩

দুনিয়াজোড়া মান্য গ্রেগরীয় পঞ্জিকা মোতাবেক নতুন খ্রিষ্টীয় বছর ২০২৫-এর গণনা শুরু হয়েছে। সবাইকে এ উপলক্ষে শুভেচ্ছা, শুভ নববর্ষ। বিদায় নিয়ে যাওয়া বছরটি অনেক হতাশা নিয়ে শুরু হলেও তৃতীয় প্রান্তিকে এসে অলৌকিক এক বিজয় উপহার দেয়। বাংলাদেশ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের কবলমুক্ত হয়। অবশ্য কুঞ্ঝটিকার রহস্যপর্দা এখনো পুরোপুরি ভেদ করা যায়নি। তবুও বিতাড়িত হাসিনাহীন নতুন বছরটি জাতীয় জীবনে অনেক সম্ভাবনার পর্ব হবে বলে আশালতা বিকশিত হতে পারছে দেশপ্রেমিকদের অন্তরজুড়ে। নতুন বছরের জন্য বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা সকাশে মোনাজাত করি: ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিমÑ আমাদের সরলপথ দেখাও।’ এত কুহেলিকা ও বিভ্রান্তির মধ্যে বাংলাদেশি জাতি এবং নেতৃত্ব যেন বিপথগামী না হয়। যেন সঠিক পথ চিনে নিতে পারে।

বিজ্ঞাপন

ভাব ও ক্রিয়াকর্মে আমি একজন মধ্যপন্থি লোক। সে হিসেবে আমি বিপ্লবী নই, সংস্কারবাদী। সংস্কার কথাটা হালে বেশ লোকপ্রিয়। অথচ একসময় সংস্কার শব্দটি অনেকের মধ্যেই দারুণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত। ২০০৭ সালে অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা কবজা করার পর ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দিনদের কিম্ভূতকিমাকার এক শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর তাদের পছন্দসই কিছু বন্দোবস্ত চাপানোর চেষ্টা করেছিল সেই জবরদস্তির সরকার। বেঁধে দেওয়া সেই ‘প্রেসক্রাইবড’ বন্দোবস্তের নাম দেওয়া হয়েছিল সংস্কার কর্মসূচি। এক-এগারোর সরকার ডাক নামে আখ্যায়িত ওই শাসনব্যবস্থার অনুগত রাজনীতিকরা তখন ‘সংস্কারবাদী’ অভিধা পেয়েছিলেন, যা খুব একটা প্রীতিপ্রদ ছিল না।

সরাসরি দলীয় রাজনীতি না করলেও আমি নিজে তখন অবস্থার ফেরে পড়ে রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িয়ে গিয়েছিলাম। এ বিষয়ে বিবরণ দেওয়ার আগে আত্মপক্ষ সমর্থনে আমার একটা বয়ান থাকা দরকার। সবাই জানেন, আমি সাংবাদিকতা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দল নেত্রী ও জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়ার বক্তৃতা-বিবৃতির খসড়া রচনা ও মিডিয়া কভারেজ তদারকির কাজ অনেক দিন ধরে করেছি। শিক্ষাজীবন শেষে সিদ্ধান্ত নিই, রাজনীতি আর নয়, পলিটিকস ইজ নট মাই কাপ অব টি। আমি জীবিকা অর্জনের জন্য সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিই। পাশাপাশি চেষ্টা ছিল কিছু সৃজনশীল লেখালেখি করার।

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী তার অভিজ্ঞতার আলোকে ইংরেজিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক একটি বই লিখছিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আমি সেটির বাংলা তরজমা করার চেষ্টা করছিলাম। পরে সংবাদমাধ্যমে তার বক্তব্য-বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করার দায়িত্বও আমাকে কিছুদিন পালন করতে হয়। একসময় প্রবীণ রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানের লেখা দুটি বই অনুলিখনের দায়িত্বও আমি পালন করি। তিনি তার স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থগুলোর নামকরণ করতেন সময়সীমার উল্লেখে। যেমন: ‘ওজারতির দুই বছর’ কিংবা ‘স্বৈরাচারের এক দশক’। আমি ওনার যে দুটি গ্রন্থ সম্পাদনা করি, সে দুটির শিরোনাম ছিল: ‘অবরুদ্ধ নয় মাস’ ও ‘প্রধানমন্ত্রিত্বের নয় মাস’। এ ছাড়া জনাব খানের মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত অনেক লেখা ও বিবৃতিও আমাকে দেখে দিতে হয়। শেষে তিনি ‘ওকালতির পঞ্চাশ বছর’ নামে আরেকটি বই লিখতে শুরু করেছিলেন, তবে শেষ করে যেতে পারেননি।

জেনারেল এইচএম এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং সরকার-পরিচালনারীতি ও অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ আমাকে ভেতর থেকেই ক্রমান্বয়ে বিরূপ করে তোলে। একই সঙ্গে নিজে থেকেই আমি ধীরে ধীরে বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকি। ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদার আমাকে ব্যক্তিগতভাবে স্নেহ করতেন। তিনি মহাসচিব হওয়ার পর বিএনপির প্রচার-প্রচারণা ও মিডিয়াসংক্রান্ত নানা ব্যাপারে কখনও কখনও আমার মতামত জানতে চাইতেন। এভাবে নিজের অজান্তেই দলীয় প্রচারণার কাজে একটু একটু করে যুক্ত হয়ে যাই। ১৯৯১ সালে নির্বাচনী প্রচারণায় সালাম ভাই আমাকে প্রায় পুরো পরিকল্পনার দায়ভার দিয়ে দেন। আমি সাংবাদিক সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আমার জন্য প্রায় অসাধ্য সেই গুরুদায়িত্ব পালন করি। বিএনপি সরকার গঠনের পর তালুকদার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ধাপে ধাপে উঠে এসে তার স্থলাভিষিক্ত হন।

মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গেও আমার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল। মিডিয়াসংক্রান্ত বিষয়ে তিনিও আমার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন এবং নানামুখী কাজে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতেন। আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া মহাসচিব হওয়র পর খ্যাতনামা প্রবীণ সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ আনোয়ার জাহিদকে বিএনপি চেয়ারপারসনের তথ্য উপদেষ্টার পদ থেকে সরানোর ব্যবস্থা করেন। সাংবাদিক নেতা রিয়াজউদ্দিন আহমেদ তার স্থলাভিষিক্ত হন। তত দিনে তারেক রহমান বিএনপির নীতিনির্ধারণী স্তরে উঠে এসেছেন। তথ্য উপদেষ্টা হিসেবে রিয়াজউদ্দিনের পারফরম্যান্স-এ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে নরসিংদীর নিজ আসন থেকে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলা হয় রিয়াজউদ্দিন আহমেদকে। তিনি তাতে অসম্মতি জানিয়ে তথ্য উপদেষ্টার দায়িত্বই পালন করে যেতে চান। রিয়াজ ভাইয়ের ওই সিদ্ধান্তে ভোগান্তি বাড়ে আমার।

নির্বাচন উপলক্ষে বিএনপির মুখপত্র দৈনিক দিনকাল পত্রিকা চালানোর দায়িত্ব আমার ওপর চাপানো হয়। আমাদের সিনিয়র বন্ধু কাজী সিরাজ তখন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তাকে বহাল রেখে আমি কোনো পদ-পদবি ও মাইনে ছাড়াই নির্বাচনকালীন সময়ে পত্রিকাটির দায়িত্ব নিই। নির্বাচন উপলক্ষে একটি প্রচার-পুস্তিকা সিরিজ প্রকাশের দায়িত্ব পালন করছিল শফিক রেহমানের নেতৃত্বাধীন একটি টিম। আমাকে ওই টিমেও কাজ করতে হচ্ছিল। এরপর আমার ওপর চেপে যায় চেয়ারপারসনের তথ্য উপদেষ্টা রিয়াজউদ্দিনের প্রায় পুরো কাজ। একদিকে ম্যাডাম জিয়া ও তারেক রহমানের ফরমায়েশ, অন্যদিকে অন্তর্গত কর্তব্যের তাগিদ। উপেক্ষা করার উপায় ছিল না। গ্রামের বাড়িতে আমার ছোট বোনের বিয়ে। যেতে পারলাম না। ঘাড় গুঁজে রোজ লিখতে হয় ম্যাডামের ভাষণের টকিং পয়েন্টস, প্রয়োজনীয় বিবৃতি, মিডিয়া সেল থেকে রোজ বিকালে যে প্রেস ব্রিফিং হয় তার স্ক্রিপ্ট ইত্যাদি। এর মধ্যে বলা হলো, ম্যাডাম জাতির উদ্দেশে বেতার-টিভিতে যে নির্বাচনী ভাষণ দেবেন, সেটাও লিখতে হবে আমাকেই। লিখলাম। বেগম জিয়া যাচ্ছিলেন রকেট ইস্টিমারে করে দক্ষিণানঞ্চলে নির্বাচনী প্রচার অভিযানে। আমার ড্রাফট নিয়ে নজরুল ইসলাম খান সেই ইস্টিমারে গেলেন ম্যাডামের সফরসঙ্গী হয়ে। নৌপথে তিনি ভাষণের খসড়া পড়ে শোনান ম্যাডামকে। আর তার পর্যবেক্ষণ ও সংযোজন-বিয়োজনের নির্দেশনা নোট করে নেন। ফিরতি ইস্টিমারে ঢাকায় ফিরে নজরুল ভাই আমাকে বুঝিয়ে দেন ম্যাডামের নির্দেশনা। সে অনুযায়ী আমি খসড়াটি চূড়ান্ত করে আমার কণ্ঠেই অডিও টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে বারবার বাজিয়ে প্রয়োজনীয় রদবদল করতে থাকি। এরপর শফিক ভাই একটা নোট দিয়ে সেটি নূরুল ইসলাম ছোটনকে দিয়ে পাঠান ম্যাডামের কাছে। তিনি দেখে সবুজসংকেত দেওয়ার পরও আরও কিছুটা ফাইন টিউনিং করেন শফিক রেহমান। সবশেষ নির্দেশ আসে, নির্বাচন উপলক্ষে পত্রিকায় বিএনপির যে ক্রোড়পত্র যাবে, ওটাও তৈরি করে দিতে হবে। মিডিয়া সেল থেকে রিয়াজ ভাইয়েরা যে ক্রোড়পত্র দাঁড় করিয়েছিলেন, ওটা ম্যাডাম কিংবা তারেক রহমান কারও পছন্দ হয়নি। হাতে সময় মাত্র তিন দিন। বুঝেন ঠ্যালা! করলাম। বাধ্য হয়ে ঢেঁকি গেলা যাকে বলে!

নির্বাচনের রাতে দিনকাল পত্রিকার ব্যানার হেড লিড শিরোনাম লিখলাম: ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌, বিএনপি বিজয়ী’। তারপর শফিক ভাইদের সঙ্গে দল বেঁধে হাওয়া ভবন, বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিসে গিয়ে তারেক রহমানকে অভিনন্দন জানিয়ে বাসায় গিয়ে লম্বা ঘুম ও বিশ্রাম। ফোন বন্ধ করে টানা কয়েক দিন এভাবেই চলল। তারপর বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম জাতীয় প্রেস ক্লাবে। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে গেলাম যায়যায়দিন অফিসে। সেখানে গিয়ে দেখি তারেক রহমান এসেছেন। আর শফিক ভাইয়ের সঙ্গে উপস্থিত আছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন। ছোটন তখন চেয়ারপারসনের অফিসের সঙ্গে মূল লিয়াজোঁ রাখেন। ওখানকার নির্দেশনা ও চাহিদা জেনে আসেন আর আমরা সবাই মিলে যে কাজ করি, সেই আউটপুট ওখানে পৌঁছান। শফিক ভাই মাঝে মাঝে যান গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে। আর আমি যাই একেবারেই কালেভদ্রে।

তারেক সাহেব আমাকে দেখেই বললেন, ভোটের পর থেকেই আপনার খোঁজ নেই। কোথায় লুকিয়েছিলেন? নাকি আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিলেন? ফোন বন্ধ, বাসার ঠিকানাও কেউ বলতে পারে না। যাই হোক, আপনাকে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যোগ দিতে হবে। আম্মু আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য পুলিশ লাগাতে বলেছেন। আমি এখন উঠব। তবে আপনারা বসে একটা তালিকা বানান, যাদের দিয়ে একটা বেস্ট কেবিনেট হতে পারে। আমাদের পরামর্শ দল কতটুকু নেবে জানি না। তবে একটা এক্সারসাইজ হোক না। এখান থেকেও তো পার্টি একটা আইডিয়া পেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকরি করব? চুক্তিভিত্তিক হোক আর যাই হোক। বাসা আর প্রেস ক্লাবের আড্ডার বাইরে আর তেমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ছেড়ে দিলাম। ১০ অক্টোবর বঙ্গভবনে নয়া মন্ত্রিসভার শপথ হয়, তাতেও যাইনি। ধানমণ্ডিতে বন্ধু জিয়াউদ্দিন মাহমুদের বাসায় রোজ বসত জমজমাট সান্ধ্য আড্ডা। সেখানে মাঝেমধ্যে যেতাম। ব্যস, এটুকুই। এর মধ্যে জানলাম, আমার সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আমার নিয়োগ হয়ে গেছে এবং এ নিয়োগে আমলাচক্র এন্তার কারসাজি করেছে। যা-হোক, তারপরও মাস দেড়েক আমি এড়িয়ে চলতে পেরেছি। পরে আর পারা গেল না। যোগ দেওয়ার অল্পদিনেই আমার মধ্যে একটা বিদ্রোহী ভাব জেগে উঠল। ক্ষমতার করিডরে নানা রকম ধান্দাবাজি, ধাপ্পাবাজি, স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা ও প্রতারণায় মন বিষিয়ে উঠত। ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ ব্যক্তিদের দেখতাম একদিকে ক্ষমতাবানদের পায়রবি করছে, অন্যদিকে প্রবল প্রতাপে ছড়ি ঘোরাচ্ছে দুর্বলের ওপর। হরেক রকম তদবির ও অনিয়মে তাদের ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেখতাম চোখের সামনে। দিনকে দিন বাড়ছিল তাদের চেকনাই। অসহায় হয়ে তাকিয়ে দেখতাম প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আস্থা ও সারল্যকে তারা কীভাবে ‘এক্সপ্লইট’ করছে!

সরকারি চাকরিতে বেতন-ভাতা ও আইনানুগ সুযোগ-সুবিধা খুব কম। ওই সীমিত আয়ে কায়ক্লেশে চলতে হতো। প্রতিদিন মনে হতো আমি এখানে ‘আনফিট’। তাই নিজেকে গুটিয়ে রেখে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতি মুসাবিদার কাজটাই নিষ্ঠার সঙ্গে করতাম। রিয়াজ ভাইয়ের জন্য খারাপ লাগত। ভদ্রলোক আশা করেছিলেন, নির্বাচনের পর তাকে কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রাখা হবে। মন্ত্রিসভায় নাম না দেখে তিনি খুব আশাহত হয়েছিলেন। আমি তার জন্য তদবির করতে গিয়ে খুব ইতিবাচক জবাব পাইনি। নির্বাচন করতে রাজি না হওয়ায় তাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। তাকে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় একটি পদে নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি রাজি হননি এবং কিছুদিন পর বিএনপি চেয়ারপারসনের তথ্য উপদেষ্টার পদে ইস্তফা দেন। আমার নিরাসক্ততা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর অফিসে চাকরির মেয়াদ যত বাড়ছিল, আমার ওপর কাজের চাপ ও পরিধি তত প্রসারিত হচ্ছিল। শেষে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলাম, চোখ-কান বন্ধ করে চাকরিটা কোনোমতে শেষ করি। এরপর ক্ষমতা ও রাজনীতির অলিন্দ থেকে নিজেকে শতহাত তফাতে সরিয়ে নেব। কিন্তু তা আর হলো কই?

শেষের দিকে চারদিকের আলামত দেখে আমার মন বিষাদে ছেয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে ঘনীভূত হয়েছে গভীর চক্রান্তের কালোমেঘ। বড় ধরনের একটা অঘটন ঘটবে বলে আমার যষ্ঠেন্দ্রিয় বা ‘সিক্সথ সেন্স’ প্রতিনিয়ত সিগন্যাল দিচ্ছিল। বেশি খারাপ লাগছিল, ম্যাডাম জিয়া এর কোনো আভাসই পাচ্ছেন না বলে। তিনি যাদের ওপর অটল বিশ্বাস পোষণ করছিলেন, তাদের আমার ন্যূনতম বিশ্বস্ত বলে মনে হচ্ছিল না। আমি একবার এ নিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে ম্যাডামকে কিছু বলতে গেলে তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, দেখুন, এবার আমাদের বেশ কিছু ভুলত্রুটি হয়ে গেছে। এখন তো আর সেগুলো শোধরানোর সময় নেই। নির্বাচনটা হয়ে যাক। পরেরবার আর এসব ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না। আমি বিপন্ন বিস্ময়ে ম্যাডামের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আমাকে একটি উঁচু পদে নিয়োগ ও একটি বাড়ি বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়ে বললেন, ‘কখনো তো কিছু বলেন না। আমি আপনার অবস্থা জেনেছি। চলবেন কীভাবে? আপাতত এই ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। নির্বাচনের পর আল্লাহ সুযোগ দিলে সব ঠিক করে দেব।’ আমি বললাম, ম্যাডাম এখন কিচ্ছু করতে হবে না। আমি আছি আপনার সঙ্গে। ইলেকশনের পর দেখা যাবে।

তারপর দেশে নামল সেই এক-এগারো। সপরিবারে বিপন্ন হলেন ম্যাডাম। চারদিকে বিশ্বাস-হন্তাদের চেহারা রোজ উন্মোচিত হচ্ছে। শীর্ষনেতাদের বেশিরভাগই অচেনা আচরণ করছেন। সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা দিগভ্রান্ত। ম্যাডামের সঙ্গে পরামর্শ করে তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি পাঠালাম আমি। তাতে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মস্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হলেও পরিস্থিতি ঘুরে গেল। এ ঘটনা আমার মতো একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে অলিখিতভাবে দেশের পয়লা নম্বর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপদেষ্টা পর্যায়ে তুলে দিল। এরপর ম্যাডামের কারাবরণ ও মুক্তির ঘটনাবহুল সময়ে আমাকে প্রায়ই কাটাতে হয়েছে উত্তেজনায় টানটান বিনিদ্র রজনি। থাক সেসব ইতিবৃত্ত। ম্যাডামের কারামুক্তির পর তার বাসার ড্রইংরুমে বসে আমি বললাম, আমার দায়িত্ব পালনের আরেকটি পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। আমি ছা-পোষা দরিদ্র মানুষ। এবার আমি ছুটি চাই। ম্যাডাম তো রাজনৈতিক নেত্রী। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, লড়াই কি শেষ হয়েছে? আমি ধীরে মাথা নাড়লাম। তিনি বললেন, ‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই মাঝপথে কারা চলে যায়?’ কী জবাব দেব এ প্রশ্নের? ম্যাডাম গেলেন পল্টনে পার্টির সদর দপ্তরে সভা করতে। আমি গেলাম ফরহাদ মজহার সাহেবের ইফতারের দাওয়াতে প্রবর্তনায়। সেখানে ছিলেন শফিক রেহমান, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেহমান। ওখানেই শুনলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী প্রস্তাব দিয়েছেন, কুচক্রীরা বেগম জিয়াকে বিএনপি চেয়ারপারসনের পদ থেকে অপসারণের অপচেষ্টা করেছিল। তাই তাকে আজীবন বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে ঘোষণা করা হোক। তার এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়েছে। ইফতারের পর আবার গেলাম ম্যাডামের বাসায়। একটু পরই তিনি ফিরলেন। বললাম, একটা গণতান্ত্রিক দল এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এতে আপনার ভাবমর্যাদাই ক্ষুণ্ণ হবে ম্যাডাম। তিনি একমত হলেন। বললেন, সিদ্ধান্ত তো প্রচার হয়ে গেছে। এখন কী করা যায়? বললাম, তাদের আবেগের প্রতি সম্মান জানিয়ে আপনি বিনীতভাবে এ প্রস্তাব তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে পাবলিক স্টেটমেন্ট দেবেন। ম্যাডামকে তক্ষুনি বিবৃতি দিয়ে দিতে বললাম। আমি বিবৃতির খসড়া তৈরি করে পড়ে শোনালাম। ম্যাডাম সম্মতি দিলে জিজ্ঞেস করলাম, আমার কী পদবি ম্যাডাম? বিবৃতি প্রেরকের পদবি কী উল্লেখ করব? তিনি বললেন, আপনার যা খুশি। আমি একটু ভেবে বললাম, রাষ্ট্রপতি জিয়ার মিডিয়া কনসালট্যান্ট ও প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন। আপনার ছিলেন মিডিয়া অ্যাডভাইজার ও প্রেসসচিব। আমি ক্ষুদ্র মানুষ। গালভরা পদ-পদবি আমাকে বড় করতে পারবে না। তাই প্রেসসচিবই লিখে দিচ্ছি। ম্যাডাম বললেন, আমি ভেবেছিলাম অ্যাডভাইজারের কথা। আমি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে এলাম।

বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত গুলশানে চেয়ারপারসন অফিসে আমাকে প্রেসসচিবের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কিছুটা রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করতে হয়েছে। ম্যাডাম নানা বিষয়ে আমার মতামত জানতে চাইতেন। তিনি বলতেন, আমি তো জেলে ছিলাম। তখনকার অনেক ঘটনা জানা নেই। আপনারা তো সব দেখেছেন। সম্মেলনের পর দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি ঘোষণা হলে আমি ম্যাডামকে বলি, এখন আপনার দলের নীতিনির্ধারণী সংস্থা গঠিত হয়ে গিয়েছে। তারাই রাজনীতি ও দল সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও সাংগঠনিক জ্ঞান খুব কম এবং যেটুকু আছে তাও তত্ত্বগত। তারপরও ক্রান্তিকালে অনেক বিষয়েই মতামত দিয়েছি। এখন আমি আমার নির্ধারিত পরিধির মধ্যেই কর্তব্য পালন করতে চাই। তিনি বললেন, ‘সে দেখা যাবে। চলে তো আর যাচ্ছেন না।’ এই সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ে আমি খুব নিবিড়ভাবে বিএনপির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া অবলোকনের সুযোগ পেয়েছি। আমার মধ্যে দৃঢ় প্রতীতি জন্মেছে যে, দেশ ও দলের স্বার্থেই বিএনপির মতো বড় দলগুলোর রাজনীতি ও কাঠামোর সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেটা হতে হবে মৌলিক ও অর্থবহ সংস্কার। কোনো প্রসাধনী সংস্কারে ফায়দা হবে না।

এক-এগারো জামানায় জবরদস্তিমূলক সংস্কার উদ্যোগকে মোকাবিলা করতে আমরা বলেছিলাম, মুক্ত পরিবেশে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে রাজনীতি ও দলের সংস্কার করা হবে। গুলশান অফিসে ম্যাডাম সেই অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে রাজনীতি ও দল সংস্কারের উদ্যোগ নিতে বারবার বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে উদ্যোগ নিতে গিয়ে দেখা গেছে, দলের উপরিকাঠামো এই সংস্কারের ঘোরবিরোধী। সব দেখে-শুনে আমার মনে হয়েছে, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব চাইলেও পারবেন না। সংস্কার উদ্যোগের সরাসরি বিরোধিতা করা সম্ভব না হলে সনাতনী নেতৃত্ব তাদের কায়েমি স্বার্থরক্ষায় নানা কৌশল ও অপকৌশলে তা ব্যর্থ করে দেবেন। এখন রাষ্ট্রীয় নানা সংস্কারের উদ্যোগ আয়োজন চলছে। দিন শেষে রাষ্ট্র চালাবেন রাজনীতিবিদরাই। কাজেই রাজনীতি ও দলের সংস্কার ছাড়া রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্কারই অর্থবহ এবং টেকসই হবে না। হতে পারে না। তাই একজন সংস্কারবাদী হয়েও আমি মনে করি, দল-রাজনীতির প্রত্যাশিত সংস্কার অপরিহার্য হলে এর জন্য ভেতর থেকেই একটি ‘বিগ পুশ’ বা বৈপ্লবিক ধাক্কা মনে হয় প্রয়োজন হবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

ই-মেইল : mrfshl@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত