আবু নাসের সিফাত
কোরবানির ঈদে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষকে গরুর মাংসের তেহারি, জর্দা ও ৫০০ মিলিলিটার মিনারেল ওয়াটার দিয়েছেন পাঠকমেলার সদস্যরা।
এপ্রিলের ১২ তারিখ। পাঠকমেলার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পর্ষদের সদস্যরা বৈঠকে বসেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পর্ষদের সদস্যরা একে একে তুলে ধরছেন পাঠকমেলাকেন্দ্রিক তাদের যত পরিকল্পনা। আমার দেশ পাঠকমেলার স্লোগান হলো—‘ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ-বিরোধী পাঠ, চিন্তা-নির্মাণে; মানুষের পাশে, দেশের কল্যাণে।’ মোটাদাগে স্লোগানের মধ্যেই আমাদের কার্যক্রমের আভাস পাওয়া যায়। আমরা উপস্থাপন করছিলাম সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের ভয়াল থাবা, মিথ্যা ইতিহাস ও বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির ওপর ভারতীয় আধিপত্যবাদের কালো ছায়া থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে কীভাবে নতুন সংস্কৃতি বিনির্মাণ করা যায়। এসব আলোচনায় আমার দেশ সম্পাদক বেশ আগ্রহসহ অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং আমাদের দিকনির্দেশনা প্রদান করছিলেন।
এসবের মাঝে কার্যনির্বাহী পর্ষদের মাদরাসা-বিষয়ক সম্পাদক ইমাম হাসান প্রস্তাব করলেন আমরা এবারের কোরবানির ঈদে তাদেরও ‘ঈদ মোবারক’ বলতে চাই, যাদের কেউই ‘ঈদ মোবারক’ বলে না। তাদেরও ঈদ মোবারক বলা আমাদের দায়িত্ব। পুরো সভাকক্ষের নজর তখন ইমাম হাসানের দিকে। তিনি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলেন এভাবে—‘আমাদের সবার পরিবার আছে, আত্মীয়-স্বজন আছে, ঘরবাড়ি আছে। আমরা আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকলেও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা একে অপরকে যেকোনো উপায়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারি। কিন্তু আমরা এই নগরীতে বসবাস করি, এখানে আমাদেরও কিছু প্রতিবেশী আছেন। তাদের ঘরবাড়ি নেই, আত্মীয়-স্বজন নেই। আত্মীয়-স্বজন থাকলেও ভাগাভাগি করার মতো কোনো আনন্দ তাদের থাকে না; কারণ এখানে একবেলার খাবার জোগাড় করতেই তাদের অনেকটা কাঠখড় পোড়াতে হয়। ঈদের দিনটাও তাদের কাছে নিছক অন্যান্য দিনের মতোই। আমাদের মতো নতুন পোশাক, টেবিলভর্তি সাজানো হরেক রকমের খাবার আর বসবাসের মতো সুন্দর সমাজ তাদের নেই। তাই পাঠকমেলার পক্ষ থেকে তাদের একবেলার খাবারসহ ঈদ মোবারক বলতে চাই।’ কার্যনির্বাহী পর্ষদের বাকি সদস্যরাও এক বাক্যে ইমাম হাসান ভাইয়ের প্রস্তাবে একমত হলাম—‘হ্যাঁ, তাদেরও ঈদ মোবারক বলা আমাদের দায়িত্ব।’
ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য পথশিশু ও ছিন্নমূল মানুষগুলোই যেন আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠল। আমরা সবাই মিলে সমবেত হয়ে ছক কষতে লাগলাম—কীভাবে আমাদের এই উদ্যোগকে সফল করা যায়। ডাকা হলো কার্যনির্বাহী পর্ষদের জরুরি সভা। প্রধান ও অন্যতম এজেন্ডা হলো কীভাবে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই যাত্রাকে সফল করা যায়। আমরা সবাই আলোচনা-পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা করতে লাগলাম। আলোচনার সারমর্ম হিসেবে আমাদের কাছে মোটাদাগে দুটি চ্যালেঞ্জ মুখ্য হিসেবে ধরা দিল—প্রথমটি আর্থিক সংস্থান, দ্বিতীয়টি জনবল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত ২০১৯ সালের এক গবেষণাপত্রের পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা শহরে ছিন্নমূল ও ভাসমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারেরও অধিক। এত বড় জনগোষ্ঠীর মাঝে একবেলার খাদ্য বিতরণের অভিযান চালানোর মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাঝে একবেলার খাবার উঠিয়ে দিতে যে পরিমাণ আর্থিক সংস্থান ও জনবলের প্রয়োজন, তার কোনোটাই আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের মনে অনেক বড় আকাঙ্ক্ষা—আমরা ৫০ হাজার না পারি, অন্তত ৫০০ জনের হাতে খাবার উঠিয়ে দিয়ে তাদের ‘ঈদ মোবারক’ বলতে চাই।
ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে প্রায় এক যুগ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল আমার দেশ। শত চ্যালেঞ্জ মোকবিলা করে ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে নিয়মিতভাবে নির্বিঘ্নে পাঠকের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে পত্রিকাটি। এক যুগের স্থবিরতা থেকে মুক্ত হয়ে সবেমাত্র ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে আমার দেশ। এমন পত্রিকার জন্য ৫০০ মানুষের একবেলার আর্থিক সংস্থান করা সত্যিকারার্থেই অসম্ভব মনে হলো আমাদের কাছে। আমরা যখন প্রস্তাব উত্থাপন করেছি আমার দেশ সম্পাদক মহোদয়ের কাছে, তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন এবং আর্থিক সংস্থানের ব্যাপারে আমাদের অভয় দিলেন। সম্পাদক মহোদয় সেই বৈঠকে শুধু বললেন, ‘তোমরা কত লোকের আয়োজন করতে চাও আমাকে জানাও।’ আমরা বললাম, ‘পাঁচশ।’ তিনি বললেন, ‘পাঁচশ নয়, তোমরা আল্লাহর নামে ১ হাজার মানুষের খাবারের পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোও। আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তোমরা একটা ড্রাফট হিসাব করে দেখো এই আয়োজনে খরচ কী পরিমাণ হতে পারে। ড্রাফট করে আমাকে জানাও। তোমাদের এই মহৎ পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে আমি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব আর্থিক সংস্থান করার।’
আলহামদুলিল্লাহ আমরা এই কার্যক্রমের আর্থিক সংস্থানের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলাম। আমাদের মাঝে কাজ করার আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি ছিল না। তবে কিছুটা শঙ্কা তো ছিল অবশ্যই। আমাদের শঙ্কার মূলে ছিল আর্থিক সংস্থান ও জনবল। সম্পাদক মহোদয়ের এমন দৃঢ় আশ্বাস আমাদের কান অবধি পৌঁছানোর পর আমার দেশ পাঠকমেলা কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পর্ষদের সদস্যদের কর্মোদ্যম ও কর্মস্পৃহা বহুগুণে বেড়ে গেল। আমাদের প্রত্যেকটি সদস্যকে অনেকটা উল্লসিত অবস্থাতেই আবিষ্কার করলাম। তখন আর্থিক সংস্থানের বিষয়টা একপাশে রেখে আমরা দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ‘জনবল’ নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। কারণ ১ হাজার মানুষের কাছে ঈদের নামাজের আগেই একবেলার খাবার পৌঁছানো চারটিখানি কথা নয়। এখানে যথাযথ জনবল না পাওয়া গেলে পুরো আয়োজন ভেস্তে যাবে। জনবলের ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনায় এলো—এই ঈদটা তো কোরবানির ঈদ। নাড়ির টানে অধিকাংশ মানুষই তিলোত্তমা এই নগরী ছেড়ে পাড়ি জমায় নিজ নিজ গ্রামে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। আয়োজনটা ঠিক ঈদের দিন সকালে হওয়ায় আমাদের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেল। কারণ পাঠকমেলার সদস্যরাও ঢাকা ছেড়ে নাড়ির টানে নিজ বাড়িতে পাড়ি জমানো মানুষদের থেকে কোনো অংশেই ব্যতিক্রম নয়। এই প্রজেক্ট নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠায় সময় পার করছিলাম।
আমাদের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়ে সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার দুঃসাহস দেখালেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পর্ষদের দুজন। তারা হলেন পাঠকমেলার অর্থ সম্পাদক সাইদুল হাসান ও মাদরাসা-বিষয়ক সম্পাদক ইমাম হাসান। আমরা অনেক হাফ ছেড়ে বেঁচে তাদের প্রতি তৎক্ষণাৎ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। সাইদুল ভাই ও ইমাম ভাই দুজনই ঢাকার বাসিন্দা। এই কোরবানির ঈদকে উপলক্ষ করে আমরা ঢাকা শহরকে সাময়িক বিদায় জানালেও সাইদুল ভাই ও ইমাম ভাই ঢাকাতেই থাকবেন। তাই তারা অনেকটা সাহস করে এই কার্যক্রমের গুরুভার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলেন। তার পরেও আমরা বাস্তবতা চিন্তা করে তাদের বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, ‘আপনারা সত্যিই কি সামলাতে পারবেন এত এত কাজ!’ তারা হাসিমুখে আমাদের অভয় দিলেন।
আমাদের আয়োজনে থাকবে গরুর মাংসের তেহারি, জর্দা ও ৫০০ মিলিলিটার মিনারেল ওয়াটার। অনুষ্ঠানের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য আগের দিনই রান্নার সব জিনিসপত্রের জোগাড়-যন্ত্র করে রাখা জরুরি। তাই আমাদের গরু কেনা হয়েছিল ৫ জুন রাতে। সেইসঙ্গে রান্নার আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসপত্রও সন্ধ্যার আগেই আমরা পৌঁছে দিয়েছি মিরপুর-১১ নম্বরে আপ্যায়ন কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানকার রাঁধুনিদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছিল, তারা আমাদের ১ হাজার প্যাকেট খাবার তৈরি করে দেবেন। আমরা ৪ তারিখেই বাবুর্চিদের কাছ থেকে বাজারের তালিকা প্রস্তুত করে নিয়েছি। সেই তালিকা অনুযায়ী ৫ তারিখ রাতের মধ্যেই গরুসহ বাকি সব জিনিসপত্র কিনে বাবুর্চিদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। রান্নার জন্য বাজার তৈরির এ কাজে সাইদুল ভাই ও ইমাম হাসান ভাইকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন ঢাকায় অবস্থানকারী আমার দেশ পাঠকমেলার বিভিন্ন উপশাখার সদস্যরা। আমার দেশ পাঠকমেলা পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি নাহিদ, শাওন, কাশিফ, তানভীর মেহেদী, ইমরান, মোহাম্মদ, রেদোয়ান ও আখতার ভাইয়ের প্রতি। তারা সর্বাত্মকভাবে আমাদের সহযোগিতা করে বাধিত করেছেন।
৬ তারিখ সকাল ১১টা নাগাদ আমাদের গরু জবাই করে রান্নার উপযোগী করার প্রস্তুতি চলতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই মিরপুরের আপ্যায়ন কমিউনিটি সেন্টারে কাজের উৎসব লেগে গেল। কাজের তুলনায় জনবল খুবই কম ছিল। তাই কম লোকের ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে গেল। সবার চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা গেলেও কেউ এতটুকুও বিশ্রাম নিচ্ছিলেন না। সবাই যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব খুবই ভালোভাবে পালন করতে লাগলেন। আগামীকাল ঈদ, সারা বছরে এই ঈদ একবারই আসে, সেইসঙ্গে সবাই যার যার কর্মজীবন থেকে সাময়িক অবকাশ পেয়েছেন। এই সময়টায় ঘোরাঘুরি নয়, একটু বিশ্রাম নেওয়ার কথা। কিন্তু সেই ছিন্নমূল মানুষগুলোর মুখে একবেলার খাবার উঠিয়ে দেওয়ার যে অপরিমেয় প্রশান্তি, তা লাভের জন্যই আমাদের সদস্যরা সবকিছু ত্যাগ করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই বিষয়টা ভাবলেই যে কারো ভালোলাগা কাজ করবে। আমাদের ঈদ আনন্দ থেকে কিঞ্চিৎ আনন্দ উৎসর্গ করেছি আমাদের ছিন্নমূল ও ভাসমান ভাইবোনদের জন্য। এর চেয়ে ভালোলাগার বিষয় আর কী হতে পারে? গরু কাটাকাটির পর্ব শেষ হতে হতে প্রায় বেলা দেড়টা বেজে গেল। পরবর্তী কাজগুলো ছিল মূলত আমাদের বাবুর্চি ভাইদের। রান্নার সবকিছু জোগাড়-যন্ত্র করে মোটামুটি ২টা ৩০ মিনিটের মধ্যেই রান্না আরম্ভ হলো। সাইদুল ভাইসহ অন্য সদস্যরা সাহায্য করেছেন বাবুর্চি ভাইদের। বাবুর্চি ভাইয়েরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেদের মনে করে আমাদের কাজটা করে দিয়েছেন।
রান্নার কাজটা দুধাপে শেষ হয়েছে। প্রথম ধাপের রান্না শেষ হয়েছে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ। প্রথম ধাপের রান্না শেষ হওয়ার পর শুরু হয় প্রথম ধাপের প্যাকেজিং কার্যক্রম। প্যাকেজিং শেষ হতে সময় লেগেছে প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো। রাত সাড়ে ৯টার মধ্যে প্রথম ধাপের রান্নার প্যাকেজিং কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় ধাপের রান্না চুলা থেকে নেমেছে রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ। সাড়ে ১২টায় দ্বিতীয় ধাপের রান্না শেষ হওয়ার পর সেটিরও প্যাকেজিংয়ের কাজ শেষ করা হয় রাত আড়াইটার মধ্যেই। আমাদের সদস্যরা সেই সকাল ১১টায় গরু জবাই থেকে নিয়ে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত বিনিদ্র, ক্লান্তিহীন। রাত আড়াইটায় দ্বিতীয় ধাপের প্যাকেজিং শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় খাবারগুলো ট্রাকে ওঠানোর কাজ। ট্রাকে ওঠানোর পর সাইদুল ভাই ও ইমাম ভাইয়ের নেতৃত্বে রাত ৩টা নাগাদ আমাদের আগে থেকে ভাড়া করা ট্রাক মিরপুর ১১-এর আপ্যায়ন কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে পড়ে।
আমরা যে যে এলাকাগুলোর ছিন্নমূল মানুষগুলোকে একবেলার খাবার উঠিয়ে দিয়েছি, সেগুলো হলো—মিরপুর-১২, সাড়ে এগারো, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, মিরপুর-২, মিরপুর-১, টেকনিক্যাল, শ্যামলী, কল্যাণপুর, কলেজগেট, আড়ংমোড়, মানিক মিয়া এভিনিউ, খামারবাড়ী ফার্মগেট, বিজয় সরণি, আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া হয়ে আবারও মিরপুর-১০, ১১, কালশী ও সাগুফতা। এখানে এসে শেষ হয় আমাদের খাবার বিতরণ কার্যক্রম।
এই যাত্রাপথের প্রতিটি পদক্ষেপজুড়েই তৈরি হয়েছে আমাদের অসংখ্য ভালোলাগার গল্প। এই ভালোলাগার অনুভূতিগুলো বিচরণ করেছে আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণজুড়ে। রাতের শেষাংশ থেকে সকাল পর্যন্ত আমরা যতবারই ছিন্নমূল ভাসমান মানুষগুলোর দোরগোড়ায় পৌঁছে তাদের একবেলার খাবার পৌঁছে দিতে পেরেছি, ততবারই আমরা অজানা উৎস থেকে আনন্দানুভূতির সাক্ষাৎ পেয়েছি। একটি ঘটনা আমাদের সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করেছে। মিরপুর-১ টোলারবাগ মসজিদের সামনে আমরা একজোড়া মানুষকে দেখতে পেলাম। মধ্যরাতে যখন আমাদের ট্রাকটি তাদের কাছাকাছি পৌঁছলো, ট্রাকের হেডলাইটের আলোয় একটি শিশু শোয়া অবস্থায় মাথা উঁচু করল। শিশুটির বয়স হবে হয়তো তিন-চার। তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল চোখজুড়ে আতঙ্ক। এই ঈদের রাতে কোনো অজানা বিপদ যেন তাদের কাবু করে—এই শঙ্কায় হয়তো শিশুটির চোখেমুখে আতঙ্ক আর ভয়ের ছাপ। ভয়ে আর আতঙ্কে কাবু হয়ে শিশুটি তার পাশে শুয়ে থাকা এক মধ্যবয়স্ক মহিলাকে গায়ে হাত দিয়ে ডাকছে। ইমাম হাসান ভাই ট্রাকের পেছন থেকে দুহাতে দুটি প্যাকেট নিয়ে তাদের দিকে দুটি প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। তখন বয়স্ক মহিলাটি প্রশ্ন করলেন, ‘কী আছে এইডার মইধ্যে?’ প্রশ্নের উত্তরে ইমাম হাসান বললেন, ‘এতে খাবার আছে, গরুর মাংসের তেহারি। ঈদ উপলক্ষে আমার দেশ পাঠকমেলা থেকে আমরা আপনাদের জন্য এই ছোট্ট উপহার নিয়ে এসেছি। ‘ঈদ মোবারক’, আপনাদের কোরবানির ঈদের শুভেচ্ছা।’ তখন সেই মধ্যবয়স্ক মহিলার চোখজুড়ে কৃতজ্ঞতার অশ্রুধারা। আবেগে আপ্লুত হয়ে মহিলাটি ইমাম হাসান ভাইয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন আর বললেন, ‘আল্লাহ তোমাগো অনেক ভালো করুক, বাবা। মেলাদিন হয়া গেছে গরুর মাংস খাই না। বাজারে যে দাম! আমরা গরিবরা তো এসব কিনতেও পারি না, খাইতেও পারি না। থাকনেরই জায়গার ঠিক নেই, আজ এদিকে তো কাল ওদিকে। পোলাডারে লইয়া পুরো ঢাহা শহর ঘুরতাছি।’ তার চোখের সেই ভাষা বর্ণনা করার মতো শব্দ আমাদের জানা নেই।
ভোরের আলো তখন সবে ফুটতে শুরু করেছে। আমাদের ট্রাকে খাবারের প্যাকেটের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে। আমাদের ট্রাকটি খামারবাড়ী গোল চত্বরে এসে দাঁড়াল। সেখানে আমরা দেখতে পেলাম কয়েকজন বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অপ্রয়োজনীয় ব্যানার আর পোস্টার মাটিতে পেতে আঁটোসাঁটো হয়ে শুয়ে আছেন। তারা হয়তো ঘুমের শেষ ইনিংসে রয়েছেন। সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তীব্রতায় হয়তো তাদের ঘুম ভাঙে। ট্রাক থেকে নেমে পাঠকমেলার সদস্য নাহিদ হোসেন কয়েকটি প্যাকেট হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন সেসব বৃদ্ধের দিকে। তাদের একজনকে চাচা বলে কয়েকবার ডাকার পরেই মোটামুটি সবাই জাগ্রত হয়ে গেলেন। তারা চোখ কচলাতে কচলাতে তাকাচ্ছিলেন নাহিদ হোসেনের দিকে। নাহিদ তাদের দিকে খাবারের প্যাকেট বাড়িয়ে যখন ‘ঈদ মোবারক’ বললেন, তখন তাদেরও একই প্রশ্ন—‘কী আছে এতে?’ প্যাকেটে থাকা খাবারের বিবরণ দেওয়ার পর একজন বৃদ্ধ নাহিদ হোসেনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ঘুমভাঙা আধো আধো চোখে নাহিদ হোসেনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে কী যেন বললেন, তা বোঝা গেল না। কিন্তু তার চোখের ভাষা জানান দিচ্ছে তার ভেতরস্থ খুশি আর আনন্দের। আমাদের খাদ্য বিতরণের প্রতিটি পদক্ষেপে এমন হাজারো অনির্বচনীয় গল্পের জন্ম হয়েছে, যা আমাদের সারা দিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে উপহার দিয়েছে এক অভিন্ন সুখকর আনন্দানুভূতি, যে আনন্দকে শব্দ দিয়ে মোড়ানো সম্ভব নয়।
রাতজুড়ে ঢাকা শহর পাহারা দেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আমাদের এই কার্যক্রমকে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদান করেছেন। আমরা তাদের খাবারের প্যাকেট দিতে চাইলেও তারা নিতে রাজি হননি। তারা বলেছিলেন, ‘আমাদের তো আল্লাহ মাঝেমধ্যেই ভালো-মন্দ খাওয়ান; কিন্তু যারা এই খাবার পান না, এটা তাদের জন্য। আপনারা তাদেরই এই খাবার পৌঁছে দিন।’
৬ জুন সকাল ১১টার গরু জবাই থেকে নিয়ে পরদিন সকাল ৭টায় ঈদের নামাজের আগ পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে গোসল সেরে কোনোরকমে নামাজে শামিল হয়েছেন আমাদের স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়েরা। তাদের এই ঋণ আমরা কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। কোরবানির ত্যাগকে এভাবেই ধারণ করে প্রত্যেক মুসলমান।
কোরবানির ঈদে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষকে গরুর মাংসের তেহারি, জর্দা ও ৫০০ মিলিলিটার মিনারেল ওয়াটার দিয়েছেন পাঠকমেলার সদস্যরা।
এপ্রিলের ১২ তারিখ। পাঠকমেলার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পর্ষদের সদস্যরা বৈঠকে বসেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পর্ষদের সদস্যরা একে একে তুলে ধরছেন পাঠকমেলাকেন্দ্রিক তাদের যত পরিকল্পনা। আমার দেশ পাঠকমেলার স্লোগান হলো—‘ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ-বিরোধী পাঠ, চিন্তা-নির্মাণে; মানুষের পাশে, দেশের কল্যাণে।’ মোটাদাগে স্লোগানের মধ্যেই আমাদের কার্যক্রমের আভাস পাওয়া যায়। আমরা উপস্থাপন করছিলাম সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের ভয়াল থাবা, মিথ্যা ইতিহাস ও বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির ওপর ভারতীয় আধিপত্যবাদের কালো ছায়া থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে কীভাবে নতুন সংস্কৃতি বিনির্মাণ করা যায়। এসব আলোচনায় আমার দেশ সম্পাদক বেশ আগ্রহসহ অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং আমাদের দিকনির্দেশনা প্রদান করছিলেন।
এসবের মাঝে কার্যনির্বাহী পর্ষদের মাদরাসা-বিষয়ক সম্পাদক ইমাম হাসান প্রস্তাব করলেন আমরা এবারের কোরবানির ঈদে তাদেরও ‘ঈদ মোবারক’ বলতে চাই, যাদের কেউই ‘ঈদ মোবারক’ বলে না। তাদেরও ঈদ মোবারক বলা আমাদের দায়িত্ব। পুরো সভাকক্ষের নজর তখন ইমাম হাসানের দিকে। তিনি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলেন এভাবে—‘আমাদের সবার পরিবার আছে, আত্মীয়-স্বজন আছে, ঘরবাড়ি আছে। আমরা আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকলেও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা একে অপরকে যেকোনো উপায়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারি। কিন্তু আমরা এই নগরীতে বসবাস করি, এখানে আমাদেরও কিছু প্রতিবেশী আছেন। তাদের ঘরবাড়ি নেই, আত্মীয়-স্বজন নেই। আত্মীয়-স্বজন থাকলেও ভাগাভাগি করার মতো কোনো আনন্দ তাদের থাকে না; কারণ এখানে একবেলার খাবার জোগাড় করতেই তাদের অনেকটা কাঠখড় পোড়াতে হয়। ঈদের দিনটাও তাদের কাছে নিছক অন্যান্য দিনের মতোই। আমাদের মতো নতুন পোশাক, টেবিলভর্তি সাজানো হরেক রকমের খাবার আর বসবাসের মতো সুন্দর সমাজ তাদের নেই। তাই পাঠকমেলার পক্ষ থেকে তাদের একবেলার খাবারসহ ঈদ মোবারক বলতে চাই।’ কার্যনির্বাহী পর্ষদের বাকি সদস্যরাও এক বাক্যে ইমাম হাসান ভাইয়ের প্রস্তাবে একমত হলাম—‘হ্যাঁ, তাদেরও ঈদ মোবারক বলা আমাদের দায়িত্ব।’
ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য পথশিশু ও ছিন্নমূল মানুষগুলোই যেন আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠল। আমরা সবাই মিলে সমবেত হয়ে ছক কষতে লাগলাম—কীভাবে আমাদের এই উদ্যোগকে সফল করা যায়। ডাকা হলো কার্যনির্বাহী পর্ষদের জরুরি সভা। প্রধান ও অন্যতম এজেন্ডা হলো কীভাবে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই যাত্রাকে সফল করা যায়। আমরা সবাই আলোচনা-পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা করতে লাগলাম। আলোচনার সারমর্ম হিসেবে আমাদের কাছে মোটাদাগে দুটি চ্যালেঞ্জ মুখ্য হিসেবে ধরা দিল—প্রথমটি আর্থিক সংস্থান, দ্বিতীয়টি জনবল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত ২০১৯ সালের এক গবেষণাপত্রের পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা শহরে ছিন্নমূল ও ভাসমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারেরও অধিক। এত বড় জনগোষ্ঠীর মাঝে একবেলার খাদ্য বিতরণের অভিযান চালানোর মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাঝে একবেলার খাবার উঠিয়ে দিতে যে পরিমাণ আর্থিক সংস্থান ও জনবলের প্রয়োজন, তার কোনোটাই আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের মনে অনেক বড় আকাঙ্ক্ষা—আমরা ৫০ হাজার না পারি, অন্তত ৫০০ জনের হাতে খাবার উঠিয়ে দিয়ে তাদের ‘ঈদ মোবারক’ বলতে চাই।
ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে প্রায় এক যুগ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল আমার দেশ। শত চ্যালেঞ্জ মোকবিলা করে ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে নিয়মিতভাবে নির্বিঘ্নে পাঠকের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে পত্রিকাটি। এক যুগের স্থবিরতা থেকে মুক্ত হয়ে সবেমাত্র ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে আমার দেশ। এমন পত্রিকার জন্য ৫০০ মানুষের একবেলার আর্থিক সংস্থান করা সত্যিকারার্থেই অসম্ভব মনে হলো আমাদের কাছে। আমরা যখন প্রস্তাব উত্থাপন করেছি আমার দেশ সম্পাদক মহোদয়ের কাছে, তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন এবং আর্থিক সংস্থানের ব্যাপারে আমাদের অভয় দিলেন। সম্পাদক মহোদয় সেই বৈঠকে শুধু বললেন, ‘তোমরা কত লোকের আয়োজন করতে চাও আমাকে জানাও।’ আমরা বললাম, ‘পাঁচশ।’ তিনি বললেন, ‘পাঁচশ নয়, তোমরা আল্লাহর নামে ১ হাজার মানুষের খাবারের পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোও। আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তোমরা একটা ড্রাফট হিসাব করে দেখো এই আয়োজনে খরচ কী পরিমাণ হতে পারে। ড্রাফট করে আমাকে জানাও। তোমাদের এই মহৎ পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে আমি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব আর্থিক সংস্থান করার।’
আলহামদুলিল্লাহ আমরা এই কার্যক্রমের আর্থিক সংস্থানের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলাম। আমাদের মাঝে কাজ করার আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি ছিল না। তবে কিছুটা শঙ্কা তো ছিল অবশ্যই। আমাদের শঙ্কার মূলে ছিল আর্থিক সংস্থান ও জনবল। সম্পাদক মহোদয়ের এমন দৃঢ় আশ্বাস আমাদের কান অবধি পৌঁছানোর পর আমার দেশ পাঠকমেলা কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পর্ষদের সদস্যদের কর্মোদ্যম ও কর্মস্পৃহা বহুগুণে বেড়ে গেল। আমাদের প্রত্যেকটি সদস্যকে অনেকটা উল্লসিত অবস্থাতেই আবিষ্কার করলাম। তখন আর্থিক সংস্থানের বিষয়টা একপাশে রেখে আমরা দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ‘জনবল’ নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। কারণ ১ হাজার মানুষের কাছে ঈদের নামাজের আগেই একবেলার খাবার পৌঁছানো চারটিখানি কথা নয়। এখানে যথাযথ জনবল না পাওয়া গেলে পুরো আয়োজন ভেস্তে যাবে। জনবলের ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনায় এলো—এই ঈদটা তো কোরবানির ঈদ। নাড়ির টানে অধিকাংশ মানুষই তিলোত্তমা এই নগরী ছেড়ে পাড়ি জমায় নিজ নিজ গ্রামে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। আয়োজনটা ঠিক ঈদের দিন সকালে হওয়ায় আমাদের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেল। কারণ পাঠকমেলার সদস্যরাও ঢাকা ছেড়ে নাড়ির টানে নিজ বাড়িতে পাড়ি জমানো মানুষদের থেকে কোনো অংশেই ব্যতিক্রম নয়। এই প্রজেক্ট নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠায় সময় পার করছিলাম।
আমাদের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়ে সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার দুঃসাহস দেখালেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পর্ষদের দুজন। তারা হলেন পাঠকমেলার অর্থ সম্পাদক সাইদুল হাসান ও মাদরাসা-বিষয়ক সম্পাদক ইমাম হাসান। আমরা অনেক হাফ ছেড়ে বেঁচে তাদের প্রতি তৎক্ষণাৎ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। সাইদুল ভাই ও ইমাম ভাই দুজনই ঢাকার বাসিন্দা। এই কোরবানির ঈদকে উপলক্ষ করে আমরা ঢাকা শহরকে সাময়িক বিদায় জানালেও সাইদুল ভাই ও ইমাম ভাই ঢাকাতেই থাকবেন। তাই তারা অনেকটা সাহস করে এই কার্যক্রমের গুরুভার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলেন। তার পরেও আমরা বাস্তবতা চিন্তা করে তাদের বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, ‘আপনারা সত্যিই কি সামলাতে পারবেন এত এত কাজ!’ তারা হাসিমুখে আমাদের অভয় দিলেন।
আমাদের আয়োজনে থাকবে গরুর মাংসের তেহারি, জর্দা ও ৫০০ মিলিলিটার মিনারেল ওয়াটার। অনুষ্ঠানের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য আগের দিনই রান্নার সব জিনিসপত্রের জোগাড়-যন্ত্র করে রাখা জরুরি। তাই আমাদের গরু কেনা হয়েছিল ৫ জুন রাতে। সেইসঙ্গে রান্নার আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসপত্রও সন্ধ্যার আগেই আমরা পৌঁছে দিয়েছি মিরপুর-১১ নম্বরে আপ্যায়ন কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানকার রাঁধুনিদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছিল, তারা আমাদের ১ হাজার প্যাকেট খাবার তৈরি করে দেবেন। আমরা ৪ তারিখেই বাবুর্চিদের কাছ থেকে বাজারের তালিকা প্রস্তুত করে নিয়েছি। সেই তালিকা অনুযায়ী ৫ তারিখ রাতের মধ্যেই গরুসহ বাকি সব জিনিসপত্র কিনে বাবুর্চিদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। রান্নার জন্য বাজার তৈরির এ কাজে সাইদুল ভাই ও ইমাম হাসান ভাইকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন ঢাকায় অবস্থানকারী আমার দেশ পাঠকমেলার বিভিন্ন উপশাখার সদস্যরা। আমার দেশ পাঠকমেলা পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি নাহিদ, শাওন, কাশিফ, তানভীর মেহেদী, ইমরান, মোহাম্মদ, রেদোয়ান ও আখতার ভাইয়ের প্রতি। তারা সর্বাত্মকভাবে আমাদের সহযোগিতা করে বাধিত করেছেন।
৬ তারিখ সকাল ১১টা নাগাদ আমাদের গরু জবাই করে রান্নার উপযোগী করার প্রস্তুতি চলতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই মিরপুরের আপ্যায়ন কমিউনিটি সেন্টারে কাজের উৎসব লেগে গেল। কাজের তুলনায় জনবল খুবই কম ছিল। তাই কম লোকের ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে গেল। সবার চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা গেলেও কেউ এতটুকুও বিশ্রাম নিচ্ছিলেন না। সবাই যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব খুবই ভালোভাবে পালন করতে লাগলেন। আগামীকাল ঈদ, সারা বছরে এই ঈদ একবারই আসে, সেইসঙ্গে সবাই যার যার কর্মজীবন থেকে সাময়িক অবকাশ পেয়েছেন। এই সময়টায় ঘোরাঘুরি নয়, একটু বিশ্রাম নেওয়ার কথা। কিন্তু সেই ছিন্নমূল মানুষগুলোর মুখে একবেলার খাবার উঠিয়ে দেওয়ার যে অপরিমেয় প্রশান্তি, তা লাভের জন্যই আমাদের সদস্যরা সবকিছু ত্যাগ করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই বিষয়টা ভাবলেই যে কারো ভালোলাগা কাজ করবে। আমাদের ঈদ আনন্দ থেকে কিঞ্চিৎ আনন্দ উৎসর্গ করেছি আমাদের ছিন্নমূল ও ভাসমান ভাইবোনদের জন্য। এর চেয়ে ভালোলাগার বিষয় আর কী হতে পারে? গরু কাটাকাটির পর্ব শেষ হতে হতে প্রায় বেলা দেড়টা বেজে গেল। পরবর্তী কাজগুলো ছিল মূলত আমাদের বাবুর্চি ভাইদের। রান্নার সবকিছু জোগাড়-যন্ত্র করে মোটামুটি ২টা ৩০ মিনিটের মধ্যেই রান্না আরম্ভ হলো। সাইদুল ভাইসহ অন্য সদস্যরা সাহায্য করেছেন বাবুর্চি ভাইদের। বাবুর্চি ভাইয়েরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেদের মনে করে আমাদের কাজটা করে দিয়েছেন।
রান্নার কাজটা দুধাপে শেষ হয়েছে। প্রথম ধাপের রান্না শেষ হয়েছে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ। প্রথম ধাপের রান্না শেষ হওয়ার পর শুরু হয় প্রথম ধাপের প্যাকেজিং কার্যক্রম। প্যাকেজিং শেষ হতে সময় লেগেছে প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো। রাত সাড়ে ৯টার মধ্যে প্রথম ধাপের রান্নার প্যাকেজিং কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় ধাপের রান্না চুলা থেকে নেমেছে রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ। সাড়ে ১২টায় দ্বিতীয় ধাপের রান্না শেষ হওয়ার পর সেটিরও প্যাকেজিংয়ের কাজ শেষ করা হয় রাত আড়াইটার মধ্যেই। আমাদের সদস্যরা সেই সকাল ১১টায় গরু জবাই থেকে নিয়ে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত বিনিদ্র, ক্লান্তিহীন। রাত আড়াইটায় দ্বিতীয় ধাপের প্যাকেজিং শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় খাবারগুলো ট্রাকে ওঠানোর কাজ। ট্রাকে ওঠানোর পর সাইদুল ভাই ও ইমাম ভাইয়ের নেতৃত্বে রাত ৩টা নাগাদ আমাদের আগে থেকে ভাড়া করা ট্রাক মিরপুর ১১-এর আপ্যায়ন কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে পড়ে।
আমরা যে যে এলাকাগুলোর ছিন্নমূল মানুষগুলোকে একবেলার খাবার উঠিয়ে দিয়েছি, সেগুলো হলো—মিরপুর-১২, সাড়ে এগারো, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, মিরপুর-২, মিরপুর-১, টেকনিক্যাল, শ্যামলী, কল্যাণপুর, কলেজগেট, আড়ংমোড়, মানিক মিয়া এভিনিউ, খামারবাড়ী ফার্মগেট, বিজয় সরণি, আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া হয়ে আবারও মিরপুর-১০, ১১, কালশী ও সাগুফতা। এখানে এসে শেষ হয় আমাদের খাবার বিতরণ কার্যক্রম।
এই যাত্রাপথের প্রতিটি পদক্ষেপজুড়েই তৈরি হয়েছে আমাদের অসংখ্য ভালোলাগার গল্প। এই ভালোলাগার অনুভূতিগুলো বিচরণ করেছে আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণজুড়ে। রাতের শেষাংশ থেকে সকাল পর্যন্ত আমরা যতবারই ছিন্নমূল ভাসমান মানুষগুলোর দোরগোড়ায় পৌঁছে তাদের একবেলার খাবার পৌঁছে দিতে পেরেছি, ততবারই আমরা অজানা উৎস থেকে আনন্দানুভূতির সাক্ষাৎ পেয়েছি। একটি ঘটনা আমাদের সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করেছে। মিরপুর-১ টোলারবাগ মসজিদের সামনে আমরা একজোড়া মানুষকে দেখতে পেলাম। মধ্যরাতে যখন আমাদের ট্রাকটি তাদের কাছাকাছি পৌঁছলো, ট্রাকের হেডলাইটের আলোয় একটি শিশু শোয়া অবস্থায় মাথা উঁচু করল। শিশুটির বয়স হবে হয়তো তিন-চার। তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল চোখজুড়ে আতঙ্ক। এই ঈদের রাতে কোনো অজানা বিপদ যেন তাদের কাবু করে—এই শঙ্কায় হয়তো শিশুটির চোখেমুখে আতঙ্ক আর ভয়ের ছাপ। ভয়ে আর আতঙ্কে কাবু হয়ে শিশুটি তার পাশে শুয়ে থাকা এক মধ্যবয়স্ক মহিলাকে গায়ে হাত দিয়ে ডাকছে। ইমাম হাসান ভাই ট্রাকের পেছন থেকে দুহাতে দুটি প্যাকেট নিয়ে তাদের দিকে দুটি প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। তখন বয়স্ক মহিলাটি প্রশ্ন করলেন, ‘কী আছে এইডার মইধ্যে?’ প্রশ্নের উত্তরে ইমাম হাসান বললেন, ‘এতে খাবার আছে, গরুর মাংসের তেহারি। ঈদ উপলক্ষে আমার দেশ পাঠকমেলা থেকে আমরা আপনাদের জন্য এই ছোট্ট উপহার নিয়ে এসেছি। ‘ঈদ মোবারক’, আপনাদের কোরবানির ঈদের শুভেচ্ছা।’ তখন সেই মধ্যবয়স্ক মহিলার চোখজুড়ে কৃতজ্ঞতার অশ্রুধারা। আবেগে আপ্লুত হয়ে মহিলাটি ইমাম হাসান ভাইয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন আর বললেন, ‘আল্লাহ তোমাগো অনেক ভালো করুক, বাবা। মেলাদিন হয়া গেছে গরুর মাংস খাই না। বাজারে যে দাম! আমরা গরিবরা তো এসব কিনতেও পারি না, খাইতেও পারি না। থাকনেরই জায়গার ঠিক নেই, আজ এদিকে তো কাল ওদিকে। পোলাডারে লইয়া পুরো ঢাহা শহর ঘুরতাছি।’ তার চোখের সেই ভাষা বর্ণনা করার মতো শব্দ আমাদের জানা নেই।
ভোরের আলো তখন সবে ফুটতে শুরু করেছে। আমাদের ট্রাকে খাবারের প্যাকেটের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে। আমাদের ট্রাকটি খামারবাড়ী গোল চত্বরে এসে দাঁড়াল। সেখানে আমরা দেখতে পেলাম কয়েকজন বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অপ্রয়োজনীয় ব্যানার আর পোস্টার মাটিতে পেতে আঁটোসাঁটো হয়ে শুয়ে আছেন। তারা হয়তো ঘুমের শেষ ইনিংসে রয়েছেন। সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তীব্রতায় হয়তো তাদের ঘুম ভাঙে। ট্রাক থেকে নেমে পাঠকমেলার সদস্য নাহিদ হোসেন কয়েকটি প্যাকেট হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন সেসব বৃদ্ধের দিকে। তাদের একজনকে চাচা বলে কয়েকবার ডাকার পরেই মোটামুটি সবাই জাগ্রত হয়ে গেলেন। তারা চোখ কচলাতে কচলাতে তাকাচ্ছিলেন নাহিদ হোসেনের দিকে। নাহিদ তাদের দিকে খাবারের প্যাকেট বাড়িয়ে যখন ‘ঈদ মোবারক’ বললেন, তখন তাদেরও একই প্রশ্ন—‘কী আছে এতে?’ প্যাকেটে থাকা খাবারের বিবরণ দেওয়ার পর একজন বৃদ্ধ নাহিদ হোসেনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ঘুমভাঙা আধো আধো চোখে নাহিদ হোসেনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে কী যেন বললেন, তা বোঝা গেল না। কিন্তু তার চোখের ভাষা জানান দিচ্ছে তার ভেতরস্থ খুশি আর আনন্দের। আমাদের খাদ্য বিতরণের প্রতিটি পদক্ষেপে এমন হাজারো অনির্বচনীয় গল্পের জন্ম হয়েছে, যা আমাদের সারা দিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে উপহার দিয়েছে এক অভিন্ন সুখকর আনন্দানুভূতি, যে আনন্দকে শব্দ দিয়ে মোড়ানো সম্ভব নয়।
রাতজুড়ে ঢাকা শহর পাহারা দেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আমাদের এই কার্যক্রমকে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদান করেছেন। আমরা তাদের খাবারের প্যাকেট দিতে চাইলেও তারা নিতে রাজি হননি। তারা বলেছিলেন, ‘আমাদের তো আল্লাহ মাঝেমধ্যেই ভালো-মন্দ খাওয়ান; কিন্তু যারা এই খাবার পান না, এটা তাদের জন্য। আপনারা তাদেরই এই খাবার পৌঁছে দিন।’
৬ জুন সকাল ১১টার গরু জবাই থেকে নিয়ে পরদিন সকাল ৭টায় ঈদের নামাজের আগ পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে গোসল সেরে কোনোরকমে নামাজে শামিল হয়েছেন আমাদের স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়েরা। তাদের এই ঋণ আমরা কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। কোরবানির ত্যাগকে এভাবেই ধারণ করে প্রত্যেক মুসলমান।
‘সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানের চর্চায় তরুণরাই সমাজের আলোকবর্তিকা’ এই বিশ্বাসে আমার দেশ পাঠকমেলা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো কার্যনির্বাহী সদস্যদের আলোচনা ও রাকসু নির্বাচনকে ঘিরে এক মতবিনিময় সভা।
৫ দিন আগেঢাকার প্রাণকেন্দ্র জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে চলছে মাসব্যাপী আন্তর্জাতিক ইসলামি বইমেলা। বিভিন্ন দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং বইপ্রেমী মানুষের আগমনে মুখর বইমেলা পরিদর্শনে যান আমার দেশ পাঠকমেলা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা।
১২ দিন আগেবন্দর ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ বিভাগের শিক্ষার্থী রিফাদুল ইসলামের সঞ্চালনায় পাঠচক্রে আলোচ্য বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশে পাশ্চাত্য মূল্যবোধের প্রভাব’। এই পাঠচক্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ও বিভিন্ন সেশনের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত থেকে নির্ধারিত বিষয়ের ওপর তাদের সুচিন্তিত মন্তব্য তুলে ধরেন।
১২ দিন আগেআন্তর্জাতিক ইসলামী বইমেলা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হলো মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান।
১৯ দিন আগে