ক্ষুধায় মৃত্যুপুরী গাজা

মুসলিম হিসেবে করণীয়

মুফতি আ. জ. ম. ওবায়দুল্লাহ
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ২৮

গাজা একটি নাম, একটি জনপদ, একটি প্রতিরোধের প্রতীক। যেখানে প্রতিদিন সূর্য ওঠে আগুন আর ধোঁয়ার আলোছায়ায়, যেখানে শিশুর কান্না বোমার শব্দকে হার মানায় আর নারীদের বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ কেঁপে ওঠে। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই ভূমিতে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা। প্রতিনিয়ত বোমাবর্ষণ, বিমান হামলা ও ট্যাংকের গর্জনে প্রকম্পিত হচ্ছে গাজার আকাশ-বাতাস। তবে আজকের গাজা শুধু বোমা আর গুলির আঘাতেই সীমাবদ্ধ নয়; ক্ষুধা নামক এক নীরব ঘাতকের আক্রমণে সেখানে শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাই ধুঁকে ধুঁকে মরছে।

বিজ্ঞাপন

আগে আঘাত করত গুলি, বোমা ও বিমান হামলা করে, কিন্তু এখন তারা বুঝে গেছে, বোমা নয়, ক্ষুধাই হলো সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্র। এখন তারা বোমা ছোড়ে না শুধু, বরং রুটি-রুজির পথ বন্ধ করে দেয়, পানির উৎস শুকিয়ে দেয়, শিশুর মুখের দুধ কেড়ে নেয়। এ যেন এক নতুন রণনীতি—যেখানে শত্রু মারা পড়ে ধ্বংসের শব্দ ছাড়াই। তারা জেনে গেছে, ক্ষুধা হচ্ছে এক নীরব ঘাতক, যা আগুনের চেয়েও নির্মম, গুলির চেয়েও নিঃশব্দে শেষ করে দেয় তাজা প্রাণ।

যে বিশ্বনেতারা মানবাধিকারের বড় বড় বুলি আওড়ায়, তারাই আজ চুপ। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি—সবাই জানে কী চলছে গাজায়। কিন্তু প্রতিবাদ আসে শুধু ভাষণে, বিবৃতিতে, সমাবেশে; কিন্তু উদ্যোগ নেই বাস্তবে। এমনকি মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ রাষ্ট্রগুলো সবাই যেন নীরব দর্শক।

ইসলামের দৃষ্টিতে মজলুমের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ঈমানি ও নৈতিক দায়িত্ব। পবিত্র কোরআন, হাদিসেও মজলুমের সাহায্যে এগিয়ে আসতে মুসলমানদের প্রতি কঠিন নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা একে অন্যকে সাহায্য করো ন্যায়পরায়ণতা ও আল্লাহভীতির কাজে।’ (সুরা মায়িদা : ২)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি যদি একটি মজলুমকে সাহায্য না করো, তবে আল্লাহ তোমার সাহায্য ত্যাগ করবেন।’ এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের হৃদয় কি গাজার কান্নায় কাঁপে? আমাদের ঘরে যখন খাবার থাকে, পাখার বাতাসে ঘুম আসতে থাকে, তখন কি মনে পড়ে, গাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকে, অনাহারে দিন কাটায়?

প্রতিটি ক্ষুধার্ত শিশু, প্রতিটি রক্তাক্ত মা আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘তোমরা কি আমাদের ভাই নও? তোমাদের হৃদয়ে কি ইসলামের ভালোবাসা নেই? কোরআনের আহ্বান কি তোমরা শুনো না? গাজার নির্যাতিত মুসলমানরা আজ আমাদের সাহায্যপ্রার্থী।’

এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের উচিত অবিলম্বে একজোট হয়ে ইসরাইলের ওপর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। সাধারণ মুসলমানদের উচিত দোয়া, দান ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গাজাবাসীর পাশে দাঁড়ানো। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজা নিয়ে সরব হওয়া এবং ইসরাইলের বর্বরতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। সর্বোপরি, নিজের জীবনে ইখলাস ও তাকওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করা।

গাজাবাসীর জন্য আমাদের করণীয় কী—এ প্রশ্ন আজ শুধু একটি ভাবনার বিষয় নয়, বরং এটি একটি ঈমানি দায়িত্ব, আখিরাতের জবাবদিহির ব্যাপার। গাজার মজলুম মুসলমানদের জন্য মুসলিম উম্মাহর কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো—

১. আন্তরিকভাবে অশ্রুসিক্ত হয়ে দোয়া করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দোয়া ইবাদতের মূল।’ (তিরমিজি) তাদের জন্য দোয়া করা আমাদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব।

২. অর্থনৈতিক সাহায্য পাঠানো। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বিশ্বস্ত সংস্থা ও চ্যানেলের মাধ্যমে গাজার মানুষদের জন্য অর্থ, খাদ্য, ওষুধ বা অন্যান্য সামগ্রী পাঠাতে পারেন।

৩. কলম ও কণ্ঠের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বক্তৃতা, খুতবা, সংবাদ ও লেখালেখির মাধ্যমে গাজা বিষয়ে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া এবং অন্যদের গাজার পাশে সজাগ করা জরুরি।

৪. তাদের জন্য রোজা, নামাজ ও কোরআন খতম করা। গাজার ভাই-বোনদের জন্য নফল রোজা রাখা, কোরআন খতম করা, ইস্তিগফার করা এবং ওই সওয়াব তাদের জন্য হাদিয়া হিসেবে দোয়ার মাধ্যমে পৌঁছানো আমাদের আধ্যাত্মিক দায়িত্ব।

৫. ঐক্য গঠন ও উম্মাহকে জাগ্রত করা। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের উচিত ইসলামি ঐক্য গঠন করে গাজার বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। আর সাধারণ মুসলমানদের উচিত ঈমানি দায়িত্ব মনে করে এই ঐক্যের দাবিতে সোচ্চার হওয়া।

গাজা আজ এক যন্ত্রণার নাম, এক রক্তাক্ত ইতিহাস, একটি মজলুম জাতির কান্না। গাজার প্রতিটি গলিতে আজ আর্তনাদের প্রতিধ্বনি, প্রতিটি ঘরে ক্ষুধার চিৎকার। শিশুরা ক্ষুধায় কাঁদছে, নারীরা এক টুকরো রুটির জন্য চতুর্দিকে হন্যে হয়ে ঘুরছে, মায়েরা খালি পেটে সন্তানকে কোলে চেপে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, আর বৃদ্ধরা বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলছে। বাতাসে ভেসে আসে পোড়া মানুষের গন্ধ, আকাশ কাঁপে বোমার শব্দে আর মাটি ভেজে বোমার আঘাতে ও অনাহারে মরা মানুষের রক্তে। এটি কোনো গল্প নয়, একটি জ্বলন্ত বাস্তবতা। এই কঠিন বাস্তবতায় আমরা নিশ্চুপ থেকে কি দায় এড়াতে পারি? আমাদের মানবিক বিবেকের কাছে এই প্রশ্ন রেখে দিলাম।

লেখক : গ্রন্থকার, মুহাদ্দিস, ছারছীনা দারুস্সুন্নাত জামেয়ায়ে নেছারিয়া দীনিয়া, নেছারাবাদ, পিরোজপুর

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত