ওয়ানডে ক্রিকেটে ক্রমেই অন্ধকারে বাংলাদেশ

এম. এম. কায়সার
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ০০
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ৩৭

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে কিছু সময়ের জন্য চারপাশ যেমন হয়, ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন ঠিক তেমনই নিকষ কালো অন্ধকার! কবে আলো ফিরবে তার কোনো দিশা নেই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই প্রথম ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হলো বাংলাদেশ। তিন ম্যাচেই যে কায়দার ক্রিকেট খেলেছে বাংলাদেশ, তাকে বলে নতজানু ক্রিকেট। এই নিষ্প্রভ ক্রিকেট পুরো দল, অধিনায়ক, টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক ও কোচিং স্টাফ—সবাইকে কঠিন সমালোচনার মুখে ফেলেছে। দেখে মনে হচ্ছে একসঙ্গে পুরো অফিসের সবাই ‘অযোগ্য’ হয়ে পড়েছেন!

ব্যাটিং ইউনিট প্রতিটি ম্যাচে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে, হাস্যকর সব শটস খেলে ব্যাটসম্যানরা আউট হচ্ছেন। নেতৃত্বে নেই দৃঢ়তা, ম্যাচ পরিকল্পনায় নেই কোনো স্পষ্ট রূপরেখা। ২০২৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের খেলার সরাসরি টিকিট পাবে কি না বাংলাদেশ সেই আতঙ্ক এখন ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে, গ্যালারি বিসিবির বারান্দা- সর্বত্র!

বিজ্ঞাপন

ব্যাটিং ভেঙে চুরমার, মিডল অর্ডার ডিসঅর্ডার!

বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, ধারাবাহিক ধস দেখতে চাইলে আপনি যেকোনো ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখতে শুরু করুন। কীভাবে এবং কেমন করে একটা দলের মিডলঅর্ডার ভেঙে পড়ে, সেই দৃশ্য দেখতে পাবেন আপনি! ওপেনিং জুটি টিকছে না, পাওয়ার প্লেতে রান তুলতেই হাঁসফাঁস। মিডল অর্ডারের ব্যাটাররা টিকতেই পারছেন না। স্পিন আক্রমণে রশিদ খানকে বল হাতে দেখলেই পুরো দল যেন অন্ধকারে সাপ দেখার আতঙ্কে থাকছে! সিঙ্গেল-ডাবল রোটেশন নেই, চাপ সামলানোর মানসিকতাও স্পষ্টভাবে অনুপস্থিত। যেমন ইচ্ছা তেমন করেই যেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নাচালেন এই সিরিজে আফগানিস্তানের চ্যাম্পিয়ন লেগস্পিনার রশিদ খান।

অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজ ব্যাট হাতে পুরো সিরিজে একটা হাফসেঞ্চুরি ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি। শেষের দুই ম্যাচে ডাবল ফিগারে পৌঁছানোর আগেই বিদায়। নেতৃত্বেও নিষ্প্রভ মেহেদি মিরাজ। নাজমুল হোসেন শান্ত অধিনায়কত্ব ছেড়েও পারফরম্যান্সে ফিরে আসতে পারছেন না। তিন ম্যাচে তার সাকুল্য রান ১২। সর্বোচ্চ ৭। তিনি দলে খেলছেন সেরা মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে! ইনজুরিতে লিটন দাস এই সিরিজে ছিলেন না—আর সেটিই টপ অর্ডারের ফাটল আরো বাড়িয়েছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে দলের অবস্থা এমনই শোচনীয় পরিস্থিতি এবং দুর্দশায় পড়েছে যে, অধিনায়ক মেহেদি মিরাজকে বলতে হচ্ছে-‘আমাদের এখন পুরো ৫০ ওভার পর্যন্ত খেলাকেই অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে।’

অধিনায়কের এই স্বীকারোক্তিতে এটা পরিষ্কার যে, জয় এখন অনেক দূরের চিন্তা, আগে পুরো ৫০ ওভার খেলে এসো! ১৯৮৬ সালে ওয়ানডে অভিষেক হওয়া একটা দল যখন ২০২৫-এ এসে এমন চিন্তায় পড়ে, তখন দেশের ক্রিকেট যে গভীর সংকটে পড়েছে- এটা জানার জন্য ক্রিকেট বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই!

বাংলাদেশ কি তাহলে এখন নেপাল, আরব আমিরাত ও কুয়েতের ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনীয় হবে?

শূন্যতা পূরণে ব্যর্থ নতুনরা

বাংলাদেশ ওয়ানডের উত্থান ঘটেছিল পাঁচতারকার স্বর্ণযুগে—তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ ও অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ছিলেন একসময় ওয়ানডে দলের আশা ও স্বপ্নপূরণের প্রতীক। কিন্তু এখন সেই অভিজ্ঞরা সময়ের পরিক্রমায় বিদায় নিয়েছেন। নতুন প্রজন্মের ব্যাটাররা এখনো আন্তর্জাতিক মানে নিজেদের প্রমাণ করতে পারেননি।

খেলায় হার-জিত থাকবেই। কেউ জিতবে কেউ হারবে। কিন্তু পুরো সিরিজে বাংলাদেশ যে কুৎসিত কায়দায় ব্যাটিং করেছে তা নিয়ে আলোচনা নয়, শুধু হাসি-ঠাট্টা হতে পারে! জাকের আলী, তাওহিদ হৃদয় বা নুরুল হাসান সোহানের আউট হওয়ার ভঙ্গি দেখলে মনে হচ্ছিল তারা অন্ধকারে দড়ির ওপর দিয়ে সাঁকো পার হচ্ছেন!

অদক্ষতার নেই জবাবদিহিতা

একদিকে ব্যাটিংয়ে ধস, অন্যদিকে টিম ম্যানেজমেন্টেও আছে পরিকল্পনার ঘাটতি। প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে কোচিং স্টাফদের পেছনে। কিন্তু পারফরম্যান্সে সেই বিনিয়োগের প্রতিফলন নেই।

বোর্ডের ভেতরেও দেখা যাচ্ছে সিদ্ধান্তহীনতা—কে দলে থাকবে, কে বাদ পড়বে, কাদের ওপর লং টার্ম বিনিয়োগ হবে—এসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর নেই। নির্বাচকরা কাকে কেন কী কারণে দলে রাখছেন সেই জবাবদিহিতা চাওয়ার সময়ও হয়ে এলো। সার্বিক সমন্বয়হীনতায় দল গোত্তা খাচ্ছে প্রায় প্রতি ম্যাচে। পেছনের ১২ ওয়ানডের মধ্যে একটি দল যখন ১১টিতে হারে তখন বুঝতে হবে এই দলের ক্রিকেটার-কোচ-কর্মকর্তা সবারই সমস্যা!

বিশ্বকাপের টিকিটও এখন ঝুঁকিতে

এই ধারাবাহিক ব্যর্থতায় বাংলাদেশ ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি এমন যে, আগামী বিশ্বকাপে খেলতে হলে বাছাই পর্বে খেলতে হতে পারে- ১৯৯৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে অভিষেকের পর কখনোই এমন আশঙ্কা বা জটিলতায় বাংলাদেশকে পড়তে হয়নি। আফগানদের কাছে ৩-০-এর এই হার কেবল সিরিজ হার নয়, এটি আসলে এক পুরো প্রজন্মের অনেক পরিশ্রমে অর্জিত অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ার অশনিসংকেত।

সমস্যার মূল যেখানে
* ব্যাটিং ইউনিটে কাঠামোগত দুর্বলতা ও অভিজ্ঞতার অভাব
* নেতৃত্বে অনুপ্রেরণা ও কৌশলগত সিদ্ধান্তের ঘাটতি
* টিম ম্যানেজমেন্টে সমন্বয়হীনতা ও স্বচ্ছ পরিকল্পনার অভাব
* সিনিয়রদের উত্তরসূরি তৈরি না হওয়ার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা
* পারফরম্যান্সভিত্তিক জবাবদিহিতা না থাকা

সমাধানের সম্ভাব্য পথ
* কোচিং স্টাফদের সঙ্গে পারফরম্যান্স চুক্তি ও কাজের মূল্যায়ন
* মিডল অর্ডারে অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান নিয়ে আসা
* স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্বের সঙ্গে দলীয় রূপরেখা তৈরি
* মানসিক প্রস্তুতি ও ফিনিশিং দক্ষতার বিশেষ প্রশিক্ষণ
* নির্বাচক, কোচ ও অধিনায়কের সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ

আফগানিস্তানের কাছে ধবলধোলাই কেবল এক সিরিজ হারের গল্প নয়—এটা বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটের ভঙ্গুর বাস্তবতা। সিনিয়রদের শূন্যস্থান পূরণে নতুনদের অপ্রস্তুতি ও নেতৃত্বের শূন্যতায় দল যেন দিকহারা।

বিসিবি বলছে এখনো র‌্যাংকিং উন্নত করতে ২৩টি ম্যাচ হাতে আছে বাংলাদেশের। তবে সামনের সেই ২৩ ম্যাচে বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলবে ৮ ম্যাচ। বাকি ১৫ ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। আরেকবার মনে করিয়ে দিই, শেষ ১২ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ হেরেছে ১১ ম্যাচে। আর তাই এখনই কাঠামোগত সংস্কার না আনলে, বিশ্বকাপ বাছাই থেকে শুরু করে বড় আসরে টিকে থাকাই হয়ে উঠবে ‘অসম্ভব মিশন’।

তখন যেকোনো বড় টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এলেই এই দলের পরিচয় হবে- এরা শুধু অংশগ্রহণকারী একটা দল, ব্যাস ওটুকুই!

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত