মাঠে, অনুশীলনে, প্রেস বক্সে, সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নটি অনেকবার হলো। অনেকেই শুনলেন একই প্রশ্ন। কী আশ্চর্য, সবার উত্তরই এক ও অভিন্ন!
-মুশফিক ঠিক কোথায় বাকিদের চেয়ে আলাদা?
কোচ থেকে কাছের মানুষ, সাংবাদিক থেকে সতীর্থ- সবার কাছ থেকেই একই উত্তর মিলল। পাওয়া গেল পাঁচটি শব্দ-পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ডেডিকেশন, ডিসিপ্লিন আর জেতার জেদ।
এই পাঁচের যোগফলের অন্য নাম মুশফিকুর রহিম।
২০০৫ সালের ২৬ মে যেদিন লর্ডস টেস্টে মুশফিকের অভিষেক হয়েছিল, সেদিন তার কিশোরসুলভ চেহারা দেখে ধারাভাষ্যকাররা বলেছিলেন ‘বেবিফেইস ক্রিকেটার’। আজ ক্যারিয়ারের ২০ বছর পেরিয়ে মুশফিক যখন তার ১০০তম টেস্ট ম্যাচ খেলছেন, তখন তার ধীর-স্থিরতার সঙ্গে গেঁথে থাকা দৃঢ়তা বলছে-‘এই যুদ্ধে আমি জিতেছি।’
মুশফিকের পুরো ক্রিকেট জীবনই এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটের আইকনিক ক্যারেক্টার। ২০০৫ সালে লর্ডসের পেস ঝাঁঝালো উইকেটে তার ১৯ রানের ইনিংস দেখে সেদিন কে ভেবেছিল এই কিশোরই একদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা সম্পদ হয়ে উঠবেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিজেকে মহামূল্যবান করার সেই পথপরিক্রমা, পরিস্থিতি- সবকিছুই নিজের হাতে তৈরি করেছেন মুশফিক। যে পথ রচনার প্রতিটি ক্ষুদ্র কণায় রয়েছে একটি ছোট্ট শব্দ ‘পরিশ্রম’।
লর্ডসের সেই কিশোর মুশফিকের আজকের সেঞ্চুরি টেস্টের আইকনিক মুশফিক হয়ে ওঠার নিয়ামক ওটাই- ‘পরিশ্রম’!
ক্রিকেট অনেকেই খেলেন; কিন্তু সত্যিকার অর্থে নিজেকে চেনানো, সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জনে নিজেকে নিজের ভঙ্গিতে তৈরি করা, হৃদয়-স্বত্বতায় ছাপ রেখে যাওয়া, পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ানো, জেতার জেদে নতুন তাগিদে লড়াই জেতা- এ সবকিছুরই প্রতিভূ হলেন মুশফিকুর রহিম।
মুশফিকের সেঞ্চুরি টেস্ট এবং টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের জন্য আজকের দিনটি কেবল একটি তারিখ বা সংখ্যা নয়; এটা স্বীকৃতি, প্রতিজ্ঞা, পরিশ্রম ও সাফল্যের প্রমাণ। এটা নেহাৎ ক্রিকেটার মুশফিকের ব্যক্তিগত মাইলফলক নয়, এটা গোটা দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা।
পেছনের ২০ বছরে মুশফিক যে শুধু সাফল্য পেয়েছেন, তা নয়। বরং সমস্যাই বেশি দেখেছেন। খেলোয়াড় হিসেবে, অধিনায়ক হিসেবে প্রতিনিয়তই অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। অধিনায়কত্বও পেয়েছিলেন; আবার হারিয়েছেনও। ক্রিকেট জীবনের এই পর্বে মুশফিক এসব সমস্যা যে সাবলীল কায়দায় সমাধান করেছিলেন, সেটাও অনেকের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। সব পথ ফুলে সাজানো থাকবে না। সমস্যাসংকুল হবেই। তবে সেই সমস্যাকে কীভাবে ডাউন দ্য উইকেটে এসে গ্যালারিতে ছক্কা মারার ভঙ্গিতে সমাধানে পরিণত করতে হয়- সেটা মুশফিকের চেয়ে ভালো সম্ভবত আর কেউ জানত না।
আর তাই মুশফিক এখনো ২২ গজে খেলে চলেছেন, আর তার সঙ্গে ক্রিকেট শুরু করা বিশাল তালিকার সবাই এখন গ্যালারিতে, চলে গেছেন স্বেচ্ছা অবসরে, বিশ্রামে।
২০০৫ থেকে ২০২৫। লর্ডস থেকে মিরপুর। এক থেকে ১০০। এই সংখ্যা, এই স্থানভেদের প্রতিটি দিনের পেছনে আছে অনেক অভিমান, অনুশীলন, কষ্ট-কাঠিন্যের গল্প। মুশফিক তার ক্রিকেট জীবনে অনেক ম্যাচ হেরেছেন। যে ম্যাচে জেতা প্রায় নিশ্চিত ছিল- এমন ম্যাচে হারও তাকে দেখতে হয়েছে। তবে সেই ব্যর্থতা, সেই বেদনার চিহ্ন দূর করে কীভাবে সামনে বাড়তে হয়- সেই সততা, সেই অধ্যবসায় তার ক্রিকেট অনুশীলনের প্রতিটি পদক্ষেপে অনুকরণীয়-অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।
১০০ টেস্টে খেলা বিশ্বের অনেক ক্রিকেটারের মুশফিকের চেয়ে বেশি রান ও সেঞ্চুরি রয়েছে। তবে আমরা শুধু রান বা সেঞ্চুরির সংখ্যায় তাকে মনে রাখব না। আমরা তাকে মনে রাখব তার অম্লান দৃঢ়তার জন্য। দলের কঠিন মুহূর্তে ব্যাট হাতে তার লড়াকু মেজাজের জন্য।
মিরপুর টেস্টে ব্যাট করতে নামার আগে মুশফিক যে হাততালির গর্জন পাবেন, সেটা খেলা শুরুর অনেক আগে থেকেই অনুভব করতে পারছি। এই টেস্টে তার প্রতিটি রানই হবে গ্যালারির দর্শকদের জন্য উৎসবের উপলক্ষ। ব্যাট হাতে বাংলাদেশের হয়ে অনেক ম্যাচ রাঙিয়েছেন মুশফিক। মিরপুর টেস্ট সে তালিকায় হোক সবচেয়ে রঙিন।

