সীমাহীন সংকটে ধুঁকছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

মাসুদ রানা, ববি
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৫, ০৯: ৩৭

২০১১ সালে কীর্তনখোলার পাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি)। পথচলার এই ১৫ বছরে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, আবাসন কিংবা শিক্ষক।

নেই পর্যাপ্ত একাডেমিক ভবন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকটের কারণে অধিকাংশ বিভাগে সেশনজট এখন স্থায়ী রূপ নিচ্ছে, আর এসবের ভোগান্তি পোহাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

বিজ্ঞাপন

এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন পাঁচজন উপাচার্য (ভিসি), যার মধ্যে তিনজনই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে অনাকাঙ্ক্ষিত বিদায় নিতে বাধ্য হন। বারবার প্রশাসন বদলায় কিন্তু বদলায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্য ।

সরেজমিনে ও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র দুটি একাডেমিক ভবন। ছেলেদের ও মেয়েদের জন্য রয়েছে দুটি করে আবাসিক হল, যেখানে মাত্র ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন। ২৫টি বিভাগের জন্য মোট ৩৬টি শ্রেণিকক্ষ, ফলে এক ব্যাচ ক্লাসে থাকলে অন্য ব্যাচগুলোকে বাইরে অপেক্ষা করতে হয়।

বর্তমানে ১৬৭ জন শিক্ষক দিয়ে চলে বিভিন্ন বর্ষের প্রায় ১৫০টি ব্যাচের শিক্ষা কার্যক্রম। এর মধ্যে অনেকে আবার শিক্ষা ছুটিতে থাকায় পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অফিসকক্ষ সংকট, নেই অডিটোরিয়াম, মানসম্পন্ন গবেষণাগার কিংবা আধুনিক গ্রন্থাগার সুবিধা । সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে শিক্ষার্থীদের হতাশা দিন দিন বাড়ছে।

শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে দায়ী করে শিক্ষার্থীরা জানান, ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ হলো শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। বেশিরভাগ আন্দোলনের নেপথ্যে ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ ও দ্বন্দ্ব। শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে থাকেন। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে পরে পদ-পদবি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকে।’

এক শিক্ষার্থীর ভাষায়, ‘যতক্ষণ শিক্ষকরা সৎ ও শিক্ষার্থীবান্ধব না হবেন, ততক্ষণ এই সংকট কাটবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈছআ'র আহ্বায়ক ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব আহমেদ আমার দেশকে জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। কিছু শিক্ষক রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে নিয়োগ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করছেন, যা ক্যাম্পাসে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঠামোগত দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এখনো কাঠামোগত ও চিন্তাগত দিক থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে পারেনি। বিগত উপাচার্যরা সমস্যাগুলোর সমাধানে আন্তরিক না হয়ে গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব ও রাজনীতির জালে আটকে পড়েন। ফলে উন্নয়ন সংকট ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস থেকে দেখা যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা আর আন্দোলনের ছায়া যেন কোনো সময়ই থামেনি। সম্প্রতি ৫ম উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ভিসি অধ্যাপক শুচিতা শরমিনকে শিক্ষার্থীদের ২৯ দিনের আন্দোলনের জেরে অপসারণ করে সরকার।

৪র্থ উপাচার্য মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়াও ছয় মাসের মাথায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর আগে ৩য় উপাচার্য মো. ছাদেকুল আরেফিনের আমলে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হয় চার-পাঁচবার। তবে ছাদেকুল আরেফিন ও প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মো. হারুনর রশিদ খানই পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পেরেছিলেন।

সবচেয়ে বেশি আন্দোলনের মুখে পড়েন ২য় ভিসি এস এম ইমামুল হক। তার বিরুদ্ধে দুই দফায় আন্দোলন হয়Ñ একবার ১৫ দিন এবং পরের বার টানা ৪৪ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে।

মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ হোসেন বলেন, দক্ষিণবঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হওয়ার পরও পর্যাপ্ত উন্নয়ন বরাদ্দ পায় না বিশ্ববিদ্যালয়টি, প্রতি বাজেটই অবহেলার স্বীকার। প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘তাহলে কি প্রশ্ন থেকেই যায় দক্ষিণবঙ্গের সব বিষয়ের মতো দক্ষিণবঙ্গের এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠটি ও একই কারণেই অবহেলিত?’

ববির ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াছিন বরকন্দাজ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পার করলেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি । অনেক সময় গাদাগাদি করে ক্লাস করতে হয়। মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকা হওয়ার জন্য দাঁড়িয়েও থাকতে হয়। ল্যাবেও পাওয়া যায় না ভালো সুযোগ-সুবিধা।’

শিক্ষক সংকটের তীব্রতা ফুটে ওঠে পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান আহসানুল হকের কথায়। তিনি বলেন, ‘আমরা মাত্র দুজন শিক্ষক ৬-৭টি ব্যাচের ক্লাস চালাচ্ছি। প্রত্যেককে ১৮-২০টি কোর্স পড়াতে হয়। এই চাপ আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ও ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলছে। তবুও চেষ্টা করছি যেন সেশনজট না হয়।’

রাজনৈতিক অন্তকোন্দল নিয়ে জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, ‘শিক্ষকরা নিজেদের পদ-পদবির জন্য দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে। তাদের একটি অংশ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ বাগিয়ে নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করতে চায়।’

শিক্ষকদের দায়ী করে তিনি বলেন, ‘কোনো ভিসি যদি একটি পক্ষের ঘনিষ্ঠ হন, তখনই অন্য পক্ষ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ফলে বার বার সৃষ্টি হয় অস্থিরতা । এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয় । যতদিন এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ না হবে, ততদিন প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।’

নবনিযুক্ত (অন্তর্বর্তীকালীন) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরাই আমাদের মূল শক্তি। আমি সব সময় শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাব নিয়ে কাজ করি এবং আগামীতেও সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে চাই। আমার বিশ্বাস, আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে কোনো সমস্যাই সমস্যা থাকে না। একটু বুদ্ধি ও সদিচ্ছা থাকলেই সমাধান বেরিয়ে আসে।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত