হোম > আমার দেশ স্পেশাল

বাউলবাদ চর্চার নামে ইসলামবিদ্বেষ

মুহিম মাহফুজ

বাউল আবুল সরকার

মানিকগঞ্জের ঘিওরে গানের অনুষ্ঠানে মহান আল্লাহকে নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য এবং ধর্ম অবমাননা করেন নিজেকে ‘পীর’ ও ‘কোরআনের তাসফিরকারক’ দাবি করা বিতর্কিত বাউল আবুল সরকার। ওই মন্তব্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঘটনায় পর তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা হয় এবং গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে তার মুক্তির দাবিতে ২৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে কর্মসূচি ঘোষণা করেন তার সমর্থকরা। সেখানে আলেম-ওলামাদের আহ্বানে সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক জনগোষ্ঠীর পূর্বনির্ধারিত বিক্ষোভ মিছিলের সময় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের পাঁচজন আহত হন। ওই ঘটনায় এক বাউলশিল্পী মামলা করেন।

আবুল সরকারকে কেন্দ্র করে মানিকগঞ্জে ঘটা এসব ঘটনা পরে দেশজুড়ে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যা তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। তার বিচারের দাবিতে সরব হয়ে ওঠেন সারা দেশের মানুষ। এমনকি তার ধর্ম অবমাননার কঠোর সমালোচনা করেন বাউলশিল্পীরাও। অপরদিকে গ্রেপ্তার আবুল সরকারের মুক্তি দাবি করে বিচার প্রক্রিয়া প্রভাবিত করতে চাইছে একটি শ্রেণি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা খালা পাগলির মেলামঞ্চে গান পরিবেশনকালে মহান আল্লাহ ও ইসলাম সম্পর্কে চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করেন এই বাউল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হেড মুহাদ্দিস ড. ওয়ালীয়ুর রহমান খান বলেন, তার বক্তব্যের মধ্যে আল্লাহর বাণী হিসেবে যা দাবি করেছেন, এগুলো ভুল ও তাদের বানোয়াট গল্প। কোরআনুল কারিমের কোথায় এ কথাগুলো নেই।

ড. ওয়ালীয়ুর দাবি করেন, তার বক্তব্য অশ্লীল এবং অত্যন্ত আপত্তিজনক।

আবুল সরকারের স্বৈরাচার তোষণ

আবুল সরকার আওয়ামী আমলে বিভিন্ন সময় গানের আসরে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার নামে চাটুকারী গান পরিবেশন করে তাদের খুশি করার চেষ্টা করেন। অনুষ্ঠানগুলোয় শেখ মুজিব ও তার মেয়ে গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত স্বৈরশাসক হাসিনাকে নিয়েও গান গাইতেন। সম্প্রতি এরকম একটি গান সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে তাকে মুজিব, হাসিনা ও নৌকার গুণকীর্তন করতে দেখা যায়। এছাড়া আওয়ামী নেতাদের প্রভাব কাজে লাগিয়ে আপন ভাইয়ের জমি দখল ও নির্যাতনের অভিযোগও আছে এই বাউলের বিরুদ্ধে।

গানের ছদ্মাবরণে বাউলদের ইসলাম বিকৃতি

এর আগেও বিতর্কিত বাউল আবুল সরকার এ ধরনের মনগড়া ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এছাড়া বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মের অপব্যাখ্যা ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিকারী উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছেন বাউল সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শিল্পী। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে রিতা দেওয়ান নামে এক বাউলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। একই বছরের জানুয়ারিতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আরেক বাউল শরিয়ত সরকারকে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে বাউলদের ধর্ম অবমাননার ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অন্য কোনো ধর্ম সেভাবে টার্গেট নয়। তাদের টার্গেট ইসলাম। এতে বাউলদের ইসলাম-বিরাগের বিষয়টি সামনে আসে।

এ বিষয়ে ড. ওয়ালীয়ুর রহমান বলেন, কিছু বাউল আছে, যারা নাচ-গান করে এবং সমাজের নিম্নবিত্ত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনগণের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা প্রচার করে গানের ছলে। এগুলো করেই তারা জীবন-জীবিকা চালায়। এদের মধ্যে কিছু আছে ইসলামবিরোধী। তারা ধর্ম নিয়ে, মহান আল্লাহ, রাসুলুল্লাহ (সা.), ওলামায়ে কেরাম ও কোরআন-হাদিস নিয়ে বিভিন্ন আপত্তিকর কথা বলে জনপ্রিয় হতে চায়। এসব করে তারা ইসলামবিরোধী শক্তি থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে চায়। আমরা মনে করি, বিতর্কিত বাউল আবুল সরকারও একই উদ্দেশ্যে এসব আপত্তিকর কথা বলেছে।

বাউলবাদীদের অন্ধকার জগৎ

বাউল আবুল সরকারের ধর্ম অবমাননাকে কেন্দ্র করে সারা দেশ যখন উত্তাল, ঠিক তখনই বাউলদের অনৈতিকতার তথ্য ফাঁস করলেন আরেক নারী বাউল হাসিনা সরকার। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘বাউলদের বলতাম—আমার তো প্রোগ্রাম নাই, আমার দিকে একটু খেয়াল রাইখেন। তখন তারা বলেন, যদি খেয়াল রাখতে হয় তাহলে কথা শুনতে হবে। যখন ডাকি তখন আসতে হবে। আমি বলি, আসলে কী হবে? তখন তারা বলেন, এইটা কি ভেঙে বলতে হবে? আমাদের গুরুজনরাই তো আমাদের ভোগ করার জন্য বসে আছেন।’

বাউলদের ধর্ম বিকৃতি কেন?

বাউলরা কি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের অনুসারী হয়, নাকি স্বয়ং বাউলবাদই একটি স্বতন্ত্র ধর্ম? বাউলদের জীবনাচার, বিশ্লেষণ করলে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। লেখক ও গবেষক ফাহমিদ-উর-রহমান তার ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বইয়ে বাউলদের ধর্ম বিষয়ে লিখেছেন, বাউলদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক আছে। কিন্তু এরা কোনো জনপ্রিয় শাস্ত্রীয় ধর্ম মানে না। এদের জীবনযাত্রা সামাজিক মুসলমান বা হিন্দুর মতো নয়। এ কারণে হিন্দু-মুসলমান কোনো ধর্মই এদের গ্রহণ করেনি।

বাউলদের দেহবাদী ধারার সাধনার বিষয়ে তার বইয়ে আরো বলা হয়, দেহের সঙ্গে দেহের মিলন না হলে মাধুর্য ভজন হয় না। মাধুর্য ভজন না হলে মানুষ হয়ে জন্মানোর সার্থকতা কোথায়? এই হলো বাউলদের মৌল জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর তারা খোঁজেন বিকৃত রুচি কাম সাধনায়।

এ বিষয়ে আরো জানা যায় বিখ্যাত গবেষক ড. আহমদ শরীফের গবেষণা থেকে। তিনি তার ‘বাউলতত্ত্ব’ বইয়ে বাউলদের গোপন দেহবাদী ধারার পরকীয়া দেহসাধনা বিষয়ে লেখেন, বাউলদের জনশ্রুতিজাত ধারণা স্বয়ং চৈতন্যবাদের একটি গুহ্য সাধন প্রণালি ছিল। এই সাধনা ছিল পরকীয়া মৈথুনাত্মক। রূপ, সনাতন, নিত্যানন্দ, জীব প্রমুখ বৈষ্ণব সাধকের পরকীয়া সঙ্গিনী ছিল। চৈতন্যদেব স্বয়ং মুসলমান আউল চাঁদ রূপে পুনরাবির্ভূত হয়ে এই সাধন প্রণালি সাধারণের মধ্যে প্রচার করেন।

এ তথ্যের আলোকে বলা যায়, বাউলদের প্রকাশ্য সাধনা নাচ-গান ও তত্ত্বকথার প্রচার হলেও নারী-পুরুষের জোড়ায় জোড়ায় শারীরিক মিলন তাদের গোপন সাধনার অংশ। লালনের মাজারসহ দেশের বিভিন্ন আখড়ায় বাউলদের জোড়ায় জোড়ায় থাকতে দেখা যায়।

বাউল কারা?

আহমদ শরীফের মতে, বৈষ্ণব ধর্মগুরু চৈতন্যকে বাউলবাদের উদ্ভাবক হিসেবে দাবি করেন বাউলরা। আর বৈষ্ণব ধর্মে চৈতন্যকে বলা হয় রাধাকৃষ্ণের যুগল প্রেমের অবতার।

বাউলদের পরিচয় দিতে গিয়ে ড. আহমদ শরীফ উল্লেখ করেন, আসলে তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনাকে বজায় রেখে যারা বৈষ্ণব ধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল, তারাই বৈষ্ণব সহজিয়া রসিক বৈষ্ণব। প্রজ্ঞা-উপায়ের পরিবর্তে রাধা-কৃষ্ণ প্রতীকে সাধনা চৈতন্যপূর্ব যুগেই হয়তো শুরু হয়েছিল কিন্তু চৈতন্যোত্তর কালেই এ সম্প্রদায়ের প্রকাশ্য প্রসার ঘটে। তারই একটি শাখার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আউল চাঁদ। আর অপর শাখার প্রবর্তক ছিলেন মাধব বিবি। এই শাখার বিস্তৃতি ঘটে সম্ভবত বীরভদ্রের চেষ্টায়। এটিরই লোকপ্রচলিত নাম বাউল সম্প্রদায়।

বাউলরা সামাজিকভাবে নির্দিষ্ট কোনো মূলধারার ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের নিজ ধর্ম-বিধানের অনুসরণ করতে তেমন আগ্রহী দেখা যায় না। বরং ধর্মের সমালোচনা ও চটকদার নতুন নতুন ব্যাখ্যাই যেন তাদের প্রধান প্রবণতা। এ বাস্তবতার কারণ জানা যায় ড. আহমদ শরীফের আরেক মন্তব্যে। ‘বাউলতত্ত্বে’ তিনি লেখেন, যেসব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ ইসলাম কবুল করেছিল আর যেসব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ হিন্দু সমাজভুক্ত হয়ে নিজেদের পূর্বপুরুষের ধর্মাচরণে রত ছিল, তারাই কালে বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছে। বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাধারণ উত্তরাধিকার ছিল বলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বাউল মত গড়ে উঠতে পেরেছে।

বাউল নিয়ে বর্তমান বিতর্কে কার লাভ?

পুরো জাতি যখন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত, তখনই বাউল আবুল সরকারের কটূক্তিকাণ্ড নিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে একটি গোষ্ঠী। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—এই মুহূর্তে বাংলাদেশ অস্থির হলে লাভ কার? দেশকে অস্থিতিশীল করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে পারলে পতিত আওয়ামী লীগ এবং তার প্রভু ভারত যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আবুল সরকারের বিষয়টি ইতোমধ্যে আইনের অধীনে চলে গেছে। আইন অনুযায়ী তার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এই মুহূর্তে তার মুক্তির দাবি করা বিচারকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিকরা। এর মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টাও লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে উত্তরণ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এ বিষয়ে সব পক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।

চট্টগ্রামে চার ‘নিষিদ্ধ এলাকায়’ খুন আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

‘নিরপেক্ষ’ ৬৩৯ ওসির সন্ধানে পুলিশ সদর দপ্তর

বন পাহাড় জলাশয় সবই খায় আবুল খায়ের গ্রুপ

এনসিপির দ্বন্দ্বে শুরুতেই হোঁচট তৃতীয় শক্তির

ভূমিকম্পের পর ট্রমায় ভুগছে নারী-শিশুরা

স্বর্ণালংকার ছাড়াও মিলেছে হীরা-মুক্তাসহ দামি পাথর

পুলিশের সিসি ক্যামেরার ১০ কোটি টাকা হাওয়া

ফাইভ পাস আবুল বয়াতি এখন কোরআনের তাফসিরকারক!

গুমের দুঃসহ ক্ষত নিয়ে নির্বাচনি মাঠে

মহান আল্লাহকে নিয়ে আবুল সরকারের ধৃষ্টতায় বাড়ছে ক্ষোভ