হোম > আমার দেশ স্পেশাল

কাদের আনিসুল জিয়াউল আজমের ব্যবসা বহাল

সাইদুর রহমান রুমী

দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব উৎস সড়ক ও সেতুর টোল এক সময় আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও নেতাদের অবৈধ আয়ের লোভনীয় খাত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আধুনিক টোল ব্যবস্থাপনার নামে তারা সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব লুটে নেন দীর্ঘ সময় ধরে। এখনো অনেক ক্ষেত্রে তাদের সেই লুটপাট অব্যাহত আছে।

জানা গেছে, আওয়ামী শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছর সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এবং গুম-খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা লুটপাটের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। জুলাই বিপ্লবের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে আওয়ামী লীগ নেতারা অবৈধভাবে নিজেদের কোম্পানির মাধ্যমে টোল আদায়ের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

সাবেক মন্ত্রীদের কোম্পানি ইউডিসি, সিএনএস, শামীম এন্টারপ্রাইজ, সেল ভান, রেগনাম, এটিটি এবং পেন্টা গ্লোবালের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ রয়েছে। গত সরকারের আমলে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের সংশ্লিষ্ট এসব কোম্পানির এত ক্ষমতা ছিল যে, তাদের বিষয়গুলো সঠিকভাবে অডিটও করা হতো না। তারা টোল কালেকশন করে ৫০ শতাংশ জমা দিত আর ৫০ শতাংশ লুটপাট করত। কোম্পানিগুলোর ভারতীয় পার্টনার ভ্যান ইনফ্রার সহযোগিতায় এসব অপকর্ম চালানো হতো। এভাবে বিভিন্ন কৌশলে টোলের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হতো।

সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কোম্পানি কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) দলীয় প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডার ছাড়াই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে ২৪ শতাংশ রেশিওতে যমুনা সেতুর টোল আদায় করে। গত এক যুগে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অন্তত পাঁচ ধরনের কাজ বাগিয়ে নেয় সিএনএস। ওই সময়ে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোম্পানিটি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও ভৈরব, ঘোড়াশাল ও লেবুখালী সেতুর টোল নিয়ন্ত্রণ করছে।

একই ভাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী জামালপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য মির্জা আজমের নিয়ন্ত্রণাধীন ইউডিসি কনস্ট্রাকশন বর্তমানে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল নিয়ন্ত্রণ করছে। কোম্পানিটি দলীয় ক্ষমতার জোরে একটানা ১৭ বছর রূপসা সেতু, লালন শাহ সেতু, হাটিকুমরুল ইন্টারচেঞ্জ এবং কর্ণফুলী সেতুর টোল নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এখনো কোম্পানিটি দেশের বেশ কয়েকটি সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্বে আছে।

দৃশ্যপটে রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক শামীমের শামীম এন্টারপ্রাইজও। শামীম এন্টারপ্রাইজ ও মির্জা আজমের ইউডিসি কনস্ট্রাকশন বড় বড় টোল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মগবাজার উড়াল সড়ক, ঢাকা বাইপাস সড়ক নির্মাণ, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাসের বিশেষ লেন (বিআরটি) নির্মাণসহ অসংখ্য প্রকল্প করায়ত্ত করে।

জানা যায়, সাবেক যোগাযোগ সচিব নজরুল ইসলাম বড় ধরনের অনিয়ম দেখে টেন্ডার বাতিল করে দিয়েছিলেন। তবে তিনি অবসরে যাওয়ার পর নতুন সচিব নুরিকে ম্যানেজ করে বাতিল টেন্ডার পুনরায় রিভিউ ও পাস করিয়ে টোলপ্লাজার দায়িত্ব নেয় এ দুই কোম্পানি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, মন্ত্রণালয় ও বিআরটির সার্ভার অডিট করলে সব দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে।

আরেক কোম্পানি এশিয়ান ট্রাফিক টেকনোলজি (এটিটি) বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেরপুর সেতু ও ফেঞ্চুগঞ্জ সেতুর টোল নিয়ন্ত্রণ করত। কোম্পানিটির মালিক ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ওবাদুল কাদেরের আশীর্বাদপুষ্ট। দীর্ঘ সময় ধরে সড়ক ও জনপথ দপ্তরের আওতাধীন এ দুই টোলপ্লাজায় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করে এ কোম্পানি। সাম্প্রতিক এক অডিটে তাদের বড় ধরনের দুর্নীতি ধরা পড়ে। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

গুম-খুনে জড়িত কুখ্যাত জিয়াউল আহসানের কোম্পানি পেন্টা গ্লোবাল বিগত সময়ে বিভিন্ন টোলের সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কিছুদিন চুপচাপ থেকে আবারও তারা বিভিন্ন সেতুর দরপত্রে অংশ নিচ্ছে।

এছাড়া সাবেক সেতুমন্ত্রী ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আশীর্বাদপুষ্ট রেগনাম রিসোর্স এখনো চরসিন্ধুর সেতুর টোল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।

সম্প্রতি মেঘনা-গোমতী সেতুতে টোল আদায়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সিএনএসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৬ সালে সিএনএসকে একক উৎসভিত্তিক দরপত্রের মাধ্যমে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোম্পানিটি ৪৮৯ কোটি টাকার বেশি বিল গ্রহণ করে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। একক উৎসভিত্তিক চুক্তির মাধ্যমে দায়িত্ব দেওয়ায় সরকারের ৩০৯ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক ছয় মন্ত্রী ও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, জুলাই বিপ্লবের পরও আওয়ামী নেতাদের মালিকাধীন কোম্পানিগুলো অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এসব টোলপ্লাজায় এখনো বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমান প্রশাসনকে নানা ধরনের অবৈধ সুবিধা দিয়ে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দরপত্রগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করা হচ্ছে, যেন নতুন কোনো কোম্পানি এতে অংশ নিতে না পারে।

এসব বিষয়ে জানতে ইউডিসি কনস্ট্রাকশনের পরিচালক কামাল আহমেদকে ফোন দিলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি মেসেজ পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

রেগনাম রিসোর্সের পরিচালক মোহাম্মদ জনি তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে আমার দেশকে বলেন, আমরা রাজনৈতিক কোনো ছত্রছায়ায় বিগত সময়ে ব্যবসা করিনি। তিনি সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা থাকার কথাও অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা চরসিন্ধুর সেতুর টোলের দায়িত্ব পালন করছি। মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তবে নতুন কেউ দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত আমরাই কাজ করছি। টোল আদায়ে দুর্নীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুদক আমাদের ডেকেছিল। আমরা সেখানে উত্তর দিয়েছি।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে সাবেক মন্ত্রী বা রাজনীতিকদের প্রভাবে এ ধরনের দুর্নীতি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছিল। আমলাদের জোরালো যোগসাজশ না থাকলে হয়তো এতটা সম্ভব হতো না। তাই রাজনীতিকদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আমলাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান আমার দেশকে বলেন, বিগত সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় টোল আদায়ে কোম্পানিগুলো নিয়োগ দেওয়ায় এতে ব্যাপক দুর্নীতি করার সুযোগ হয়। এসব কোম্পানি মেয়াদ শেষের পরও অনেক বছর বিভিন্ন ছুতোয় বছরের পর বছর অবৈধভাবে টোল আদায় করেছে। এর ফলে সরকার ব্যাপক রাজস্ব হারিয়েছে। তিনি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দরপত্র এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পরিহারের আহ্বান জানান।

অবশেষে কাঠগড়ায় ১৫ আর্মি অফিসার

পলাতক আওয়ামীদের গাড়ি যাচ্ছে আমলাদের সেবায়

এমপি নেই, তবু ৪০ ভাগ ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব

ঐক্য চায় তৃণমূল, ভিন্ন হিসাব নেতাদের

খুনের রাজ্য তৈরি করেন আসাদুজ্জামান নূর

রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ডিসিদেরই রাখছে ইসি

বছরের শুরুতে মাধ্যমিকের বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা

গণহারে জামিন পাচ্ছে ফ্যাসিবাদের দোসররা

শাপলার বিরোধে শঙ্কায় গণতান্ত্রিক উত্তরণ

মেট্রোরেলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নাশকতার শঙ্কা