রাতের ভোটের অন্যতম কারিগর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোট ডাকাতির প্রস্তুতি তিনি এক বছর আগেই নেওয়া শুরু করেন। ওই বছরের জানুয়ারিতে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বিরোধীদের দমনের অঙ্গীকার করেন।
সে অনুযায়ী আঁটেন গণগ্রেপ্তারের কূটকৌশল। অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়ে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসাতে শুরু করেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সবচেয়ে সক্রিয়া নেতাদের, যাদের ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এভাবে তিনি নির্বাচনি মাঠ আওয়ামী লীগের অনূকূলে এনে দেন।
আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছিলেন, ‘এমন কাজ করব, যাতে বিএনপি ও জামায়াতের কোনো নেতাকর্মী বা অন্য বিরোধী দলের লোকজন নির্বাচনের মাঠে থাকতে না পারে।’ ওই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য শুরু হয় ‘মিথ্যা মামলার প্রকল্প’।
২০১৮ সালের জানুয়ারির শেষদিকে আছাদুজ্জামান দেশের সব পুলিশ ইউনিট প্রধানকে নিয়ে গোপন বৈঠক করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (আরঅ্যান্ডসিপি-১) বতর্মানে এআইজি (ওভারসিস অ্যাফেয়ার্স) মাহফুজুর রহমান আল মামুন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ফাঁসানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সব থানার ওসি, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি ও মহানগর এলাকায় ডিবির কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের মাধ্যমে সম্ভাব্য এজেন্টদের তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়।
আল মামুন ওই সভায় জানান, দেশের সব চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেট (সিএমএম) ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট (সিজিএম) তার পরিচিত। কারণ, তিনি বাংলাদেশ আইন সমিতির কয়েকবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি নিশ্চিত করেন, আদালত পর্যায়ে কোনো সমস্যা হবে না। তবে ওই বৈঠকে ভিন্নমত পোষণ করে কিছু ইউনিট প্রধান প্রশ্নও তোলেন। তারা জানতে চানÑযারা মাদক কারবারের সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিল না, এমন লোকদের কীভাবে সংশ্লিষ্ট মামলায় জড়ানো হবে? তারা মতামত দেন, বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তখন আছাদুজ্জামান জবাব দেন, ‘কিছুই হবে না, যদি এভাবে করা হয়। মামলার এজাহারে এমন ভাষা লেখা হবে, যাতে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে না পারে।’
ওই বৈঠকের পর বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের শত শত নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। অনেককে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং অনেকে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হন। এতে বিএনপি ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত এজেন্ট দিতে ব্যর্থ হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে (ভোট ডাকাতি) ব্যবহার করা হয়।
পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তে সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তা সম্প্রতি আমার দেশকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে গণমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি না থাকায় তারা নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।
মিথ্যা মামলার প্রকল্প
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে প্রস্তুতি ও প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল, তা নিছক ভোটের লড়াই ছিল না। সেটি ছিল সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার একটি অংশ। নির্বাচনের বহু আগে থেকেই শুরু হয় এক নিঃশব্দ অভিযান, যার নাম পরে আলোচনায় আসে ‘মিথ্যা মামলার প্রকল্প’ হিসেবে। ওই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্টÑবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আইনি জটিলতায় ফেলে মাঠচ্যুত করা, ভয় দেখানো এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ব্যাহত করা। প্রশাসনিক ক্ষমতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে এমন এক পরিবেশ তৈরি করা হয়, যেখানে ভোটের আগেই ফলাফল নিশ্চিত করা ছিল মূল লক্ষ্য।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কারণ, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা প্রায় শূনের কাছাকাছি চলে যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য বিরোধী দল বর্জন করেছিল। তাই ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ করার অভ্যন্তরীণ চাপ ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশও চাচ্ছিল নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্য দলগুলো অংশগ্রহণ করুক।
ওই পরিকল্পানা মাথায় রেখেই তৎকালীন সরকার নীলনকশা তৈরি করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটের মাঠের বাইরে রাখার জন্য প্রশাসনিকভাবে দমনমূলক কার্যক্রম শুরু হয়। ওই প্রক্রিয়ার সূচনা হয় একটি সুপরিকল্পিত ও কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত ‘মিথ্যা মামলার প্রকল্পের’ মাধ্যমে।
মিথ্যা মামলার পরামর্শ সভা
রাজনীতির আড়ালে অনেক সময় এমন সব বৈঠক হয়, যেগুলোর খবর জনমানুষের কাছে পৌঁছায় না। তবুও ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তই বদলে দেয় রাষ্ট্রের গতিপথ। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরে এমনই এক গোপন পরামর্শ সভার জন্ম হয়, যার মূল আলোচ্য বিষয় ছিলÑ‘কীভাবে বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করা যায়।’ ওই বৈঠকের টেবিলেই আঁকা হয় ভয়ংকর এক নকশা, যা আসলে মিথ্যা মামলার প্রকল্প ছিল।
আছাদুজ্জামানের ২০১৮ সালের জানুয়ারির ওই গোপন বৈঠকে আল মামুনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকাসহ দেশের সব নিম্ন আদালতের বিচারকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য, যাতে তারা পুলিশের মিথ্যা মামলার বিষয়ে অবগত থাকেন এবং এজাহার নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না করেন। দায়িত্ব পেয়ে আল মামুন বলেন, এটা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। প্রয়োজনে তিনি প্রধান বিচারপতির অফিস এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে রাখবেন।
বিচারকদের ম্যানেজ করার কাজটি আল মামুনের জন্য সহজ ছিল। কারণ, তিনি আওয়ামী সরকারের সময় ২০০৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আদালতসংশ্লিষ্ট পুলিশের অবৈধ আদেশ বাস্তবায়নের কাজে ন্যস্ত ছিলেন। এজন্য ওই গোপন বৈঠকে আছাদুজ্জামান এও বলেন, কোনো আদালতে বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে মামলা নিয়ে সমস্যা হলে সরাসরি আল মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
পরামর্শ সভায় ভিন্নমত ও সংশয়ের সুর
পরামর্শ সভার শুরুতে পরিবেশ ছিল আনুষ্ঠানিক কিন্তু আলোচনার গভীরে প্রবেশের পরই উঠে আসে ভিন্নমত। উপস্থিত কয়েকজন সদস্য প্রকাশ করেন তাদের সংশয়Ñরাষ্ট্রের নামে ‘মিথ্যা মামলার প্রকল্প’ চালু করা কেবল আইনের অপব্যবহার নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। কেউ কেউ সতর্ক করে দেনÑরাজনৈতিক সুবিধার জন্য এমন পরিকল্পনা পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করবে। কিন্তু সভার প্রভাবশালী অফিসাররা ওই সংশয়কে দেখেন ‘অবাধ্যতা’ হিসেবে। ফলস্বরূপ আপত্তিকারীদের মতামত পাত্তা না দিয়ে তাদের নিবৃত্ত করা হয় কঠোর দিকনির্দেশনার মাধ্যমে।
চাকরি হারানোর ভয়ে নাম প্রকাশ না করে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, কিছু ইউনিটপ্রধান প্রশ্ন তোলেন, সাধারণত মাদক মামলা হয় রিকভারি (উদ্ধার বা জব্দ) ভিত্তিক। কিন্তু কীভাবে মাদক কারবারের সঙ্গে আগে কখনো যুক্ত ছিল না, এমন মানুষদের নাম দেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। কিছু ইউনিট প্রধান প্রশ্ন তোলেন, এমন কাজ করতে গেলে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়াসহ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ভোটের আগে অনুগতদের পদোন্নতি
প্রক্রিয়াটি ছিল মূলত রাজনৈতিক কৌশল, যার উদ্দেশ্য নির্বাচনের আগে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে একটি ‘নিয়ন্ত্রিত আনুগত্য’ তৈরি করা। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের অনেকেই ভোট ডাকাতি ও বিরোধী মত দমনের কাজে অংশ নেন। এভাবে আগাম পুরস্কার হিসেবে দেওয়া পদোন্নতিগুলো পরিণত হয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে গোপন এক চুক্তিতে, যার প্রতিদান ছিল নীরব আনুগত্য ও নির্বাচনে ভোট ডাকাতি।
পরে মিথ্যা মামলা প্রকল্পের প্রধান আছাদুজ্জামানকে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এ-সংক্রান্ত একটি গেজেট নির্বাচনের পর ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়। এতে বলা হয়, নিয়োগ কার্যকর হবে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অথবা যোগদানের তারিখ থেকে। পরে তিনি এ পদে যোগদান করে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন চালান।
২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনের মাত্র সাত সপ্তাহ আগে পুলিশ বিভাগে ঘটে যায় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় একক পদোন্নতি কার্যক্রম। এর উদ্দেশ্য ছিল ভোট ডাকাতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়ার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের ‘অগ্রিম পুরস্কার’ বা ইনসেনটিভ দেওয়া। সে হিসেবে ২৩৫ পুলিশ কর্মকর্তাকে এসপি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ১৫০ জনকে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
পদোন্নতি দেওয়ার পর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর শত শত পুলিশ কর্মকর্তা তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেনÑ‘শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি, জামায়াত অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, তাই তাদের বয়কট করুন।’ ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর থেকে অনেক ওসি, এসপি ও ডিআইজি প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সভা-সমাবেশে উপস্থিত হয়ে দলীয় বক্তব্যও দেন। ওই পদোন্নতির বিষয়ে অবগত পুলিশের একটি সূত্র জানায়, পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হয়েছিল রাজনৈতিক আনুগত্য, বিশ্বস্ততা ও ভবিষ্যৎ অপারেশন বাস্তবায়নের সামর্থ্য (ভোট ডাকাতি) বিবেচনায়। এর অধিকাংশ কর্মকর্তাকে নির্বাচনি দায়িত্বে গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়, বিশেষ করে যেখানে বিরোধী দল শক্ত অবস্থানে ছিল।
২০১৯ সালের পুলিশের পদক তালিকার সাইটেশনের বই অন্যান্য বছরের চেয়ে দুই-তিনগুণ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্র হত্যাকারী ওই ভোট ডাকাতির কুশীলবদের ভূষিত করা হয় কোনো না কোনো পদকে।
পুরস্কার পেয়েছিলেন ২৯৯ আসনে ভোট ডাকাতি করার ডিসি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, অ্যাডিশনাল আইজিপি আতিক, ডিআইজি আনোয়ার, ডিআইজি হাবিব, এআইজি নাসিয়ান ওয়াজেদ, পুলিশ সুপার খোরশেদ আলম, আল মামুন, গোপন কক্ষের (কপোতাক্ষ) পুরো অ্যানালাইসিস টিম, ৬৪ জেলার এসপি, আট রেঞ্জ ডিআইজি এবং আট মেট্রোপলিটন কমিশনার। তারা বিপিএম, পিপিএম পদক বা আইজিপি ব্যাচ পান।
এছাড়া ভোট ডাকাতি করতে সফলভাবে অর্থ বিতরণ করার পুরস্কার হিসেবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থার (সিআইডি) অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন) আনজুমান কালাম ও তার অর্থ বিতরণ টিমের সদস্যদের বিপিএম ও পিপিএম পদক দেওয়া হয়। এরপর তাদের অধিকাংশ কর্মকর্তাকে ভালো জায়গায় পোস্টিংও দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির কুশীলবদের অনেককে আবার ২০২৬ সালের নির্বাচনের জন্য পুলিশের বিভিন্ন দায়িত্বে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা।