গণহত্যার দায়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরের যুদ্ধরাপরাধীদের বিচারের কথা বলে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ এ আদালত গঠন করেছিলেন তিনি নিজেই। তখন ‘ক্যাঙ্গারু’ কোর্টটির মাধ্যমে প্রহসন করে জামায়াতে ইসলামীর ছয় শীর্ষনেতা, বিএনপির এক বর্ষীয়ান নেতাসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। এর এক দশকের মাথায় সে ট্রাইব্যুনালেই ফাঁসির সাজা পেয়েছেন হাসিনা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন তৈরি করা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। কিন্তু এ আইনে তখন কোনো আদালত গঠন করা হয়নি। এ কারণে আইনটি অকার্যকর থেকে যায়। বিধানটিতে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ আন্তর্জাতিক আইনে অন্তর্ভুক্ত সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা এবং এর সহায়ক কোনো বাহিনীর সদস্যকে আটক ও ফৌজদারি আইনের অধীনে বিচারের কথা বলায়।
২০০৯ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩’ সংশোধন করে। এতে সিভিলিয়ানদের (অসামরিক) বিচারের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। গঠন করা হয় বিশেষ আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে ২৫ মার্চ শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাত্রা শুরু করে।
এরপর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত ও বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষনেতার বিরুদ্ধে করা ৫৭টি অভিযোগের মামলা নিষ্পত্তি করা হয় এ ট্রাইব্যুনালে। আইনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন হলেও জাজমেন্টে বলা হয় আন্তর্জাতিক আইন এখানে প্রযোজ্য হবে না। আওয়ামী লীগের সময় গড়া ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এছাড়া বিচারের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ঘটনার ৪৫ বছর পর তদন্ত শুরু হয়, নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা ও সাক্ষ্যপ্রমাণের সত্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর একই আইনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। তবে বেশকিছু সংশোধনী আনা হয়। আইনের সংশোধনীতে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে ওয়াইড স্প্রেড (ব্যাপকভাবে) ও সিস্টেমেটিক (পদ্ধতিগতভাবে) হত্যাকাণ্ড হতে হবে। একই সঙ্গে রোম স্ট্যাটিউটে যে সংজ্ঞা বলা আছে; মানবতাবিরোধী অপরাধের সে সংজ্ঞা এখানে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইন যথাযথভাবে মেনে বিচার করা হবে।
এছাড়া আগের আইনে শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল। নতুন সংশোধনীতে মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে কমপেনসেশন অর্থাৎ আসামির সম্পদ দিয়ে ভুক্তভোগীর ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়। রাখা হয় দল হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তির বিধানও।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১৪০০ ছাত্র-জনতা হত্যা ও হাজার হাজার মানুষকে গুরুতর আহতের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ভারতে পালিয়ে থাকা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিচার বর্তমান সংশোধিত সর্বশেষ আইনে করা হয়েছে।
২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন ক্ষমতাচ্যুত এ প্রধানমন্ত্রী। গণহত্যা তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আদালতের সমন জারির পরও হাজির না হওয়ায় তার অনুপস্থিতিতেই গতকাল সোমবার মামলার রায় পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনাল। রায়ে আদালত বলেছে, হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য চলাকালে বিএনপির প্রয়াত নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী একবার বলেছিলেন, ‘জজ সাহেব! এ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেন চালু থাকে, এখানে একদিন হাসিনারও বিচার হবে।’
এছাড়া বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী জীবনের পরন্ত বেলায় অবিচারের মুখোমুখি হয়ে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হচ্ছে, এ ট্রাইব্যুনাল যেন স্থায়ী থাকে। এটা যেন এ কয়েকটা অপরাধের বিচার করে শেষ না হয়। এ রকম স্থায়ী ট্রাইব্যুনাল থাকলে রাজনৈতিক ঋতু পরিবর্তন হলে এর কার্যক্রম যেন অব্যাহত থাকে।’
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঠিক ১০ বছর পর এ ট্রাইব্যুনালেই হাসিনার ফাঁসির রায় দেওয়া হলো। এখন পুরো জাতি রায় কার্যকরের অপেক্ষায় আছে।